দেশের মানচিত্রের শুরুর জেলা পঞ্চগড়। হিমালয় পর্বতমালার কাছাকাছি এই জেলাকে হিমালয়ের কন্যাও বলে হয়। শীতকালে আকাশ মেঘমুক্ত হলে এখান থেকে দেখা যায় পৃথিবীর তৃতীয় সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ কাঞ্চনজঙ্ঘা। তিনদিকে ভারতীয় সীমানাবেষ্টিত জেলাটি স্বাভাবিকভাবেই ভ্রমণ পিপাসুদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে। শীতকালে প্রতিবছর পর্যটক সমাগম বাড়ে এখানে। এখানকার মূল আকর্ষণ কাঞ্চনজঙ্ঘা হলেও পুরো জেলা অপরুপ সৌন্দর্যমন্ডিত। কাঞ্চনজঙ্ঘার বাইরেও পর্যটকদের তৃষ্ণা মেটাতে রয়েছে বেশ কিছু ঐতিহাসিক নিদর্শন ও দর্শনীয় স্থান। ঈদের ছুটিতে ভ্রমণপিপাসুরা চাইলে ঘুরতে যাওয়ার তালিকায় রাখতে পারেন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পঞ্চগড়কে।

এ জেলার উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থানের মধ্যে রয়েছে, মির্জাপুর শাহী মসজিদ, সমতলের চা বাগান, বাংলাবান্ধা জিরো পয়েন্ট, মহারাজার দিঘী, পঞ্চগড় ইকো পার্ক, রকস মিউজিয়াম, তেঁতুলিয়া ডাক বাংলো, আনন্দধারা রিসোর্ট, বোদেশ্বরী মন্দির।

মির্জাপুর শাহী মসজিদ
মির্জাপুর শাহী মসজিদ পঞ্চগড়ের আটোয়ারী উপজেলায় বাংলাদেশের অন্যতম প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। এটি উপজেলার মির্জাপুর গ্রামে। জেলাশহর থেকে এর দূরত্ব ১৫ কিলোমিটার। মসজিদের শিলালিপি ঘেঁটে প্রত্নতত্ত্ববিদেরা ধারণা করেন, মির্জাপুর শাহী মসজিদটি ১৬৫৬ সালে নির্মাণ করা হয়েছে। তবে কে নির্মাণ করেছেন, এটি নিয়ে ঐতিহাসিকদের মতপার্থক্য রয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন, মালিক উদ্দিন নামে মির্জাপুর গ্রামের এক ব্যক্তি মসজিদটি নির্মাণ করেন। এই মালিক উদ্দিন মির্জাপুর গ্রামও প্রতিষ্ঠা করেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে। আবার কেউ কেউ মনে করেন, দোস্ত মোহাম্মদ নামে জনৈক ব্যক্তি মসজিদটির নির্মাণ কাজ শেষ করেন। তবে প্রত্নতত্ত্ববিদেরা ধারণা করেন, মুঘল শাসক শাহ সুজার শাসনামলে মসজিদটি নির্মাণ করা হয়েছিল। সেটি ১৬৫৬ সালে। 

মসজিদটির দৈর্ঘ্য ৪০ ফুট ও প্রস্থ ২৫ ফুট। মসজিদটির সামনের দেওয়ালে চিত্রাঙ্কন ও বিভিন্ন কারুকার্য রয়েছে, যেগুলো একটি অপরটি থেকে আলাদা। মসজিদে একই সারিতে তিনটি গম্বুজ রয়েছে। প্রতিটি গম্বুজের কোণায় একটি করে মিনার রয়েছে। মসজিদটিতে ফারসি ভাষার একটি শিলালিপি রয়েছে, যেটা থেকে ধারণা করা হয় এটি মুঘল আমলে নির্মিত হয়েছিল। 

সমতলের চা বাগান
পঞ্চগড় জেলায় সমতলে অসংখ্য ছোট-বড় চা বাগান সৌন্দর্য বর্ধন করেছে। সারি সারি চা গাছ ভ্রমণপিপাসুদের নজর কাড়ে। চা বোর্ডের তথ্যমতে, পঞ্চগড়ে চায়ের আবাদ রয়েছে ১০ হাজার ২৬৭ একর জমিতে। ২০০০ সালে এ জেলায় আনুষ্ঠানিকভাবে চা চাষ শুরু হয়। কাজী এন্ড কাজী, এমএমটি, স্যালিলনসহ বেশ কয়েকটি কোম্পানির টি স্টেট দর্শনার্থীদের আকর্ষণ করবে। 

বাংলাবান্ধা জিরো পয়েন্ট
পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলার বাংলাবান্ধা ইউনিয়নে বাংলাবান্ধা জিরো পয়েন্ট। বাংলাদেশ মানচিত্রের শুরু এখান থেকে। ভারত-বাংলাদেশ শূ্ণ্যরেখার পাশে এটির অবস্থান। তথ্যমতে, এখান থেকে নেপালের দূরত্ব মাত্র ৬১ কিলোমিটার, ভুটান মাত্র ৬৮ কিলোমিটার এবং চীন সীমান্ত মাত্র ২০০ কিলোমিটার দূরত্বে। ভারতের অন্যতম বড় শহর শিলিগুড়ির দূরত্ব মাত্র ৫ কিলোমিটার এবং শৈত্যশহর দার্জিলিং এই জিরো পয়েন্ট থেকে মাত্র ৫৮ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। দর্শনার্থীদের আগ্রহের অন্যতম জায়গা এটি। প্রতিনিয়তই এখানে পর্যটক সমাগম থাকে। 

বিজিবি-বিএসএফ যৌথ প্যারেড
জিরো পয়েন্ট সংলগ্ন ভারত-বাংলাদেশ শূণ্যরেখা। এদিকে বাংলাবান্ধা সীমান্ত, ওদিকে ভারতের ফুলবাড়ী। এই শূণ্যরেখায় সপ্তাহের দুইদিন যৌথ প্যারেড করে দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবি-বিএসএফ। সপ্তাহের শনিবার ও মঙ্গলবার বিকেলে এই প্যারেড দেখতে ভিড় করে দুই দেশের সব বয়সীরা। 

মহারাজার দিঘী
স্বচ্ছ জলরশির বিশালাকার পুকুরটির নাম মহারাজার দিঘী। পঞ্চগড় জেলা শহর থেকে প্রায় ১৬ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে সদর উপজেলার অমরখানা ইউনিয়নে ভারত সীমান্তঘেঁষা ভিতরগড় এলাকায় মহারাজার দিঘীর অবস্থান। মহারাজার দিঘী পর্যটকদের দারুণভাবে আকৃষ্ট করে। এটি প্রায় ৫৪ একর জায়গাজুড়ে অবস্থিত। দিঘির পাড়সহ আয়তন উত্তর-দক্ষিণে ৮০০ গজ ও পূর্ব-পশ্চিমে ৪০০ গজ। পাড়ের উচ্চতা প্রায় ২০ ফুট। এও দিঘীর ইটবাঁধানো ১০টি ঘাট ও ঘাটের উভয় পাশে ইট ও মাটি দিয়ে নির্মিত সুউচ্চ পাড়ে সবুজ গাছগাছালি। কোলাহলমুক্ত, গাছগাছালির নিবিড় ছায়ায়ঘেরা দিঘীর পাড়ে বসে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও বিস্তীর্ণ জলরাশির ঢেউ আর নানান পাখির কূজনে মোহিত হতে ভ্রমণপিপাসুরা এখানে আসে। 

পঞ্চগড় ইকো পার্ক
পঞ্চগড় সদরের ধাক্কামারা ইউনিয়নের মীরগড়ে গড়ে উঠেছে পঞ্চগড় ইকোপার্ক। এখনো আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন না হলেও পার্কটি দর্শকপ্রিয় হবে বলছেন সংশ্লিষ্টরা। পার্কের কাজও অসমাপ্ত রয়েছে। তবে প্রকৃতির একদম কাছাকাছি পার্কটি দর্শনার্থীদের তৃষ্ণা মেটাবে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ কর্মসূচির আওতায় ১১টি প্রকল্পের মোট ৫৪ লাখ টাকা ব্যয়ে পার্কটির কাজ শুরু করেছে জেলা প্রশাসন।

রকস মিউজিয়াম
দেশের একমাত্র পাথরের জাদুঘর রকস মিউজিয়াম। এটি পঞ্চগড় সরকারি মহিলা কলেজে অবস্থিত। ১৯৯৭ সালে কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ প্রফেসর ড.

মো. নামজুল হক ব্যক্তিগত উদ্যোগে গড়ে তোলেন এই রকস মিউজিয়াম। এই জাদুঘরে পঞ্চগড় জেলার প্রত্নতাত্ত্বিক ও লোকজ সংগ্রহ রয়েছে এক হাজারের বেশি। রকস মিউজিয়ামের অভ্যন্তরীণ ও উন্মুক্ত দুই রকমের গ্যালারি রয়েছে। অভ্যন্তরীণ গ্যালারিতে রয়েছে, বিভিন্ন আকৃতি, রং ও বৈশিষ্ট্যের আগ্নেয়শীলা, পাললিক শীলা ও নুড়ি পাথর, সিলিকা নুড়ি ও সিলিকা বালি, হলুদ ও গাঢ় হলুদ বালি, খনিজবালি, সাদা মাটি, তরঙ্গায়িত চ্যাপ্টা পাথর, লাইমস্টোন, পলি ও কুমোর মাটি এবং কঠিন শীলা। এখানে বহু বছরের পুরনো ইমারতের ইট, পোড়ামাটির মূর্তি দেখা যায়।

দেশ-বিদেশ থেকে সংগৃহীত পাথর, বালি বর্ণনাসহ সাজিয়ে রাখা হয়েছে কক্ষের মধ্যে। বাইরে সাজিয়ে রাখা পাথরগুলো নানাস্থান থেকে সংগৃহীত। পাথরের পাশাপাশি এখানে এ অঞ্চলের আদিবাসী ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর ব্যবহৃত জিনিসপত্র, হাজার বছরের পুরাতন ইমারতের ইট, পাথরের মূর্তি প্রভৃতি স্থান পেয়েছে। এছাড়াও আছে হাজার বছরের পুরনো দুটি নৌকা। প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে এগুলো ব্যবহার করা হতো বলে গবেষকরা মনে করেন।

হাজার বছরের পুরনো চুক্তিনামা, মোগল সাম্রাজ্য ও ব্রিটিশ শাসনামলের রোপ্য ও তামার মুদ্রা এখানে সংরক্ষিত আছে। ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর ব্যবহার্য গৃহস্থালির জিনিসপত্র, চাষাবাদের উপকরণ এবং ধর্মীয় উপাসনার নানাবিদ দ্রব্যাদি এখানে সাজিয়ে রাখা আছে। শুধু তাই নয়, পাথরের ওপরে লেখা চীন-নেপালি লিপির মুদ্রণ দেখা যায় এখানে। বার রকমের রঙিন বালু এই মিউজিয়ামকে করেছে সমৃদ্ধ। নানা নদীর তলদেশ থেকে কুড়িয়ে আনা হয়েছে বালু আর মাটি যা কৌতূহলী দর্শকের জ্ঞানের পিপাসা মেটাতে সহায়তা করে। 

তেঁতুলিয়া ডাক বাংলো
পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলা শহরেই ভারতের সীমান্তবর্তী মহানন্দা নদীর তীর ঘেঁষে ঐতিহাসিক তেঁতুলিয়া ডাক বাংলো অবস্থিত। ভিক্টোরিয়ান রীতিতে কুচবিহারের রাজা ভূমি থেকে প্রায় ১৫-২০ মিটার উঁচু গড়ের উপর এই ডাক বাংলোটি নির্মাণ করেছিলেন। বর্ষাকালে তেঁতুলিয়া ডাক বাংলো থেকে মহানন্দা নদীর অপূর্ব সৌন্দর্য পর্যটকদের মুগ্ধ করে। এছাড়া এই স্থান থেকে হেমন্ত ও শীতকালে পৃথিবীর তৃতীয় উচ্চতম পর্বতশৃঙ্গ কাঞ্চনজঙ্ঘার চুড়া দেখা যায়। বর্তমানে জেলা পরিষদের অধীনে থাকা তেঁতুলিয়া ডাক বাংলোটিতে একটি পিকনিক কর্ণার নির্মাণ করা হয়েছে। স্থানীয়দের কাছে এই ডাক বাংলোটি দর্শনীয় স্থান হিসেবে ব্যাপক জনপ্রিয়।

আনন্দধারা রিসোর্ট
আনন্দধারা রিসোর্ট বা কাজী এন্ড কাজী টি এস্টেট। পঞ্চগড় জেলার তেঁতুলিয়া উপজেলা সদর থেকে ৮-১০ কিলোমিটার দূরে শালবাহান ইউনিয়নের রওশনপুর এলাকায় অবস্থিত। সুনিবিড় মনোরম পরিবেশে গড়ে তোলা হয়েছে এই রিসোর্টটি। প্রাকৃতিক মনোরম পরিবেশ দেখতে পাবেন এই রিসোর্টে গেলে। এটি বাংলাদেশের একমাত্র অর্গানিক চা বাগান। 

দৃষ্টিনন্দন গেট দিয়ে রিসোর্টের মধ্যে প্রবেশ করলে দেখতে পাবেন লতাপাতার ছায়ায় অন্ধকারাচ্ছন্ন একটি পথ। যেদিকে তাকাবেন দেখতে পাবেন সবুজের সমারোহ, মাঝে দেখতে পাবেন আধুনিক দৃষ্টিনন্দন একটি কটেজ। মাঝে একটা লেকও রয়েছে, তার পাশে কয়েকটি কটেজ। লেকের উপর তৈরি করা হয়েছে ব্রিজ, ব্রিজ পেরিয়ে যাওয়া যায় রেস্টহাউজে। রিসোর্টের মধ্যে আরো দেখতে পাবেন সমতলের সবুজ চা বাগান।
এই রিসোর্টটি তৈরি করা হয় সৌখিনতায়। এখানে সাধারণ লোকেদের থাকার অনুমতি নেই। কাজী এন্ড কাজী টি এস্টেট এর মালিক পক্ষ এবং বাহিরের বায়ারগণ এই রিসোর্টে রাত্রিযাপন করতে পারবেন। এখানে প্রবেশ করার সময় গেটে থাকা দারওয়ানের নিকট থেকে অনুমতি নিয়ে প্রবেশ করতে হবে।

বোদেশ্বরী মন্দির
পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার বড়শশী ইউনিয়নের অন্তর্গত করতোয়া নদীর তীরে কারুকার্য মণ্ডিত প্রাচীন বোদেশ্বরী মহাপীঠ মন্দির অবস্থিত। ২ দশমিক ৭৮ একর জায়গা জুড়ে স্থাপিত মন্দিরের নামানুযায়ী বোদা উপজেলার নামকরণ করা হয়েছে বলে শ্রুতি রয়েছে।

পঞ্চগড়ে কীভাবে আসবেন
ঢাকার শ্যামলী, গাবতলী বাস টার্মিনাল ও মিরপুর থেকে নাবিল পরিবহন, হানিফ এন্টারপ্রাইজসহ অন্যান্য বাসে পঞ্চগড় আসতে পারবেন। ঢাকা থেকে পঞ্চগড় নন এসি বাস ভাড়া ১০০০-১১০০ টাকা এবং এসি বাস ভাড়া ১৩০০-১৯০০ টাকা পর্যন্ত।

ট্রেনে আসতে চাইলে ঢাকার কমলাপুর থেকে পঞ্চগড় এক্সপ্রেস, একতা ও দ্রুতযান এক্সপ্রেস ট্রেনে পঞ্চগড় আসতে পারেন। শ্রেণী অনুযায়ী ট্রেন টিকেটের ভাড়া জনপ্রতি ৬৯৫ থেকে ২৩৯৮ টাকা পর্যন্ত।

কোথায় থাকবেন
রাতযাপনের জন্য পঞ্চগড় জেলা শহরে বেশকিছু ভালো আবাসিক হোটেল ও রেস্ট হাউস রয়েছে। এসি, নন-এসি দু’ধরনেরই রুম পাওয়া যায়। ভাড়াও তুলনামূলক কম। পঞ্চগড়ের আবাসিক হোটেলগুলোর মধ্যে অন্যতম, সেন্ট্রাল গেস্ট হাউজ, হোটেল মৌচাক, হোটেল রাজনগর, হিলটন বোর্ডিং, এইচ কে প্যালেস, হোটেল প্রীতম ইত্যাদি। এছাড়া বিভিন্ন সরকারি রেস্ট হাউজ রয়েছে। তেঁতুলিয়া ডাকবাংলোতেও রাত্রিযাপন করতে পারেন। এজন্য আগে ভাগেই আপনাকে সিট বুক করতে হবে। এছাড়া জেলা পরিষদের একটি বাংলো রয়েছে। সেখানে থাকতেও আগাম বুকিং দিয়ে রাখতে হবে। তবে শীত মৌসুমে এগুলোতে সিট পাওয়া দুষ্কর।

ঢাকা/বকুল

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর এই র স র ট ন র ম ণ কর বছর র প র স ন দর য উপজ ল র অবস থ ত মন দ র মসজ দ

এছাড়াও পড়ুন:

সার্চ দুনিয়ার নতুন দিগন্ত জিইও: দেশের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো কী প্

ইন্টারনেট সার্চ দুনিয়ায় চলছে নীরব এক বিপ্লব। তথ্য খোঁজার ধরন বদলে যাচ্ছে আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে দ্রুত। আগে যেখানে গুগলে উচ্চ র‌্যাংকিং মানেই ছিল সাফল্য, এখন সেই জায়গা নিচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই)-নির্ভর সার্চ টুল।

সার্চ জগতের নতুন চ্যালেঞ্জ

চ্যাটজিপিটি, গুগল জেমিনি, মাইক্রোসফট কপিলট কিংবা পারপ্লেক্সিটি এআই-এগুলো আর শুধু সার্চ ইঞ্জিন নয়, বরং উত্তর তৈরিকারক ইঞ্জিন। ব্যবহারকারী এখন শুধু ‘লিংক’ নয়, বরং সরাসরি উত্তর পেতে চায়। আর এই পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার জন্যই এসেছে নতুন এক কৌশল- জিইও বা জেনারেটিভ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন।

জিইও কী?

জিইও (জেনারেটিভ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন) হলো এমন একটি প্রক্রিয়া, যেখানে আপনার ওয়েবসাইট ও কনটেন্ট এমনভাবে সাজানো হয় যাতে এআই-চালিত সার্চ ইঞ্জিন সহজেই আপনার তথ্য চিনতে, বুঝতে এবং ব্যবহারকারীর প্রশ্নের উত্তরে সেটি অন্তর্ভুক্ত করতে পারে।

আগে ব্র্যান্ডগুলোর ফোকাস ছিল গুগলের প্রথম পাতায় জায়গা করে নেওয়া। কিন্তু এখন গুরুত্ব পাচ্ছে- চ্যাটজিপিটি বা জেমিনি-এর উত্তরে আপনার ব্র্যান্ডের নাম আসছে কি না!

এসইও বনাম জিইও: সার্চ দুনিয়ার নতুন যুগের পালাবদল

অনেকেই এসইও (সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন) এবং জিইও (জেনারেটিভ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন) এক মনে করেন, কিন্তু এদের মধ্যে মূলত লক্ষ্য ও কৌশল ভিন্ন। এসইও হচ্ছে পুরোনো পদ্ধতি, অন্যদিকে জিইও হচ্ছে নতুন পদ্ধতি।

* মূল লক্ষ্য
এসইও: সার্চ ইঞ্জিনে র‌্যাংক বাড়ানো
জিইও: এআই সার্চের উত্তরে দৃশ্যমান হওয়া

* কাজের ধরন
এসইও: কিওয়ার্ড ও ব্যাকলিংক ভিত্তিক
জিইও: কনটেক্সট, প্রাসঙ্গিকতা ও ব্র্যান্ড অথরিটি নির্ভর

* ফলাফল
এসইও: ক্লিক ও ট্রাফিক বৃদ্ধি
জিইও: ব্র্যান্ড উল্লেখ ও আস্থা বৃদ্ধি

* প্ল্যাটফর্ম
এসইও: গুগল, বিং ইত্যাদি সার্চ ইঞ্জিন
জিইও: চ্যাটজিপিটি, জেমিনি, পারপ্লেক্সিটি, এসজিই ইত্যাদি এআই সার্চ

এসইও এখনও গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু ভবিষ্যতের সার্চ ইকোসিস্টেমে জিইও সমান অপরিহার্য হয়ে উঠছে।

বাংলাদেশি ব্যবসার জন্য জিইও-এর গুরুত্ব

বাংলাদেশে ডিজিটাল মার্কেটের ক্রমবর্ধমান প্রবৃদ্ধি স্পষ্টভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। শিক্ষা, ট্রাভেল, স্বাস্থ্যসেবা, ই-কমার্স, রিয়েল এস্টেট- প্রায় প্রতিটি খাতেই ব্যবসা অনলাইনে আরো দৃশ্যমান হতে চাচ্ছে। কিন্তু বদলেছে মানুষের সার্চ করার ধরন। এখন তারা শুধু গুগলে সার্চ করেই সন্তুষ্ট থাকছে না, তারা এআই-চালিত সার্চ টুলগুলো যেমন চ্যাটজিপিটি, জেমিনি বা পারপ্লেক্সিটি-এর মাধ্যমে সরাসরি উত্তর খুঁজছে। 

গার্টনারের এক গবেষণা অনুযায়ী, ২০২৬ সালের মধ্যে প্রচলিত সার্চ ইঞ্জিনে সার্চ ভলিউম প্রায় ২৫ শতাংশ কমে যাবে- কারণ ব্যবহারকারীরা দ্রুতই এআই-চালিত সার্চ ও চ্যাটবটের দিকে ঝুঁকছে। (তথ্যসূত্র: Gartner, “Search Engine Volume Will Drop 25% by 2026, Due to AI Chatbots and Other Virtual Agents)

তবে এই পরিবর্তনের প্রভাব ব্যবসার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ধরুন, কেউ চ্যাটজিপিটি-তে লিখল, ‘ঢাকায় সেরা অ্যাকাউন্টিং ফার্ম কোনটি?’ যদি আপনার কোম্পানির নাম বা কনটেন্ট এআই-এর তৈরি উত্তরে না আসে, তাহলে সম্ভাব্য ক্লায়েন্ট ও ব্যবসার সুযোগ হাতছাড়া হচ্ছে।

মূলত এখানেই জিইও-এর গুরুত্ব উঠে আসে। জিইও ব্যবহার করে কনটেন্ট এমনভাবে সাজানো যায় যাতে এআই সার্চ সিস্টেম আপনার ব্র্যান্ডকে সহজেই চিনতে পারে, বুঝতে পারে এবং ব্যবহারকারীর প্রশ্নের উত্তরে উল্লেখ করে। অর্থাৎ, বাংলাদেশের প্রতিটি ব্যবসা যদি এআই-এর দুনিয়ায় দৃশ্যমান থাকতে চায়, জিইও’র সঙ্গে খাপ খাওয়ানো এখন আর বিকল্প নয়- এটি একান্ত প্রয়োজন।

জিইও’র জন্য কীভাবে প্রস্তুতি নেবেন?

জেনারেটিভ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন (জিইও) কোনো একদিনে শেখার মতো বিষয় না- এটি একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া, যেখানে ব্যবসাগুলোকে নিজেদের কনটেন্ট, উপস্থিতি ও বিশ্বাসযোগ্যতা এআই-বান্ধব করে গড়ে তুলতে হয়। নিচে ধাপে ধাপে দেখা যাক, কীভাবে আপনি জিইও’র পথে প্রস্তুত হতে পারবেন।

১. অনলাইন উপস্থিতি যাচাই করুন

জিইও’র প্রথম ধাপ হলো আপনার ব্যবসা বা ব্র্যান্ডের বর্তমান অনলাইন উপস্থিতি যাচাই করা। চ্যাটজিপিটি বা পারপ্লেক্সিটি-এর মতো এআই-চালিত সার্চ টুলে সার্চ দিন ‘বাংলাদেশে সেরা (আপনার ইন্ডাস্ট্রি)-এর কোম্পানিগুলো কোনগুলো?’

যদি সার্চের উত্তরে আপনার নাম না আসে, বোঝা যাবে যে আপনার এআই-দৃশ্যমানতা এখনও সীমিত। এই ক্ষেত্রে আপনাকে জিইও অনুযায়ী কনটেন্ট ও অনলাইন উপস্থিতি বাড়াতে কাজ শুরু করতে হবে।

২. বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি করুন

জেনারেটিভ এআই সার্চ সিস্টেম সেই উৎসকেই অগ্রাধিকার দেয়, যা নির্ভরযোগ্য ও যাচাইযোগ্য। তাই আপনার ওয়েবসাইটে ব্র্যান্ড, টিম, যোগাযোগ ও রিভিউসহ সব তথ্য সম্পূর্ণ ও স্বচ্ছ রাখুন।

গুগল বিজনেস প্রোফাইল নিয়মিত আপডেট করুন-  ঠিকানা, সময়, পোস্ট ও রিভিউসহ।

বিশ্বস্ত সংবাদমাধ্যম ও ব্লগে ব্র্যান্ডের উল্লেখ বাড়ান।

E-E-A-T (Experience, Expertise, Authoritativeness, Trustworthiness) বজায় রাখুন।

এভাবেই এআই ও ব্যবহারকারীর কাছে আপনার ব্র্যান্ড একটি বিশ্বাসযোগ্য সোর্স হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে- যা জিইও সাফল্যের মূল চাবিকাঠি।

৩. কনভারসেশনাল কনটেন্ট লিখুন

এআই সার্চ এখন ব্যবহারকারীর প্রশ্নভিত্তিক অনুসন্ধানকে গুরুত্ব দেয়। তাই আপনার কনটেন্ট তৈরি করুন এমনভাবে যেন এটি প্রাকৃতিক প্রশ্ন ও কথোপকথনের মতো শোনায়। উদাহরণ: ‘Where can I find a trusted IELTS coaching center in Dhaka?’ ‘Where can I apply for a blue-collar job?’ এ ধরনের কনটেন্ট এআই-এর চোখে আরো সহজে বোঝার মতো হয় এবং ব্যবহারকারীর প্রশ্নের উত্তর হিসেবে উল্লেখযোগ্য।

৪. বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে সক্রিয় থাকুন

এআই শুধু ওয়েবসাইট থেকে তথ্য সংগ্রহ করে না। এটি ফেসবুক, ইউটিউব, লিংকডইন, কোরা এবং অন্যান্য সোশ্যাল প্ল্যাটফর্ম থেকেও তথ্য সংগ্রহ করে। তাই বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে আপনার উপস্থিতি নিশ্চিত করা জিইও-এর জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

৫. এসইও এবং জিইও একসাথে ব্যবহার করুন

ডিজিটাল দুনিয়ায় এখন শুধু সার্চ র‌্যাংকই যথেষ্ট নয়। এসইও যেমন গুগল সার্চে আপনার কনটেন্টকে শীর্ষে নিয়ে আসে, তেমনি নতুন যুগের জিইও (জেনারেটিভ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন) আপনার ব্র্যান্ডকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক সার্চে আরো দৃশ্যমান করে তোলে।

এসইও মূলত গুগল ও অন্যান্য সার্চ ইঞ্জিনে ওয়েবসাইটের অবস্থান উন্নত করে, আর জিইও শেখায়- কীভাবে এআই মডেলগুলো আপনার ব্র্যান্ডকে চিনবে, উল্লেখ করবে এবং বিশ্বাস করবে।

দুটি কৌশল একসাথে প্রয়োগ করলে অনলাইন উপস্থিতি অনেক বেশি শক্তিশালী হয়। একদিকে সার্চে দৃশ্যমানতা বাড়ে, অন্যদিকে এআই-নির্ভর প্ল্যাটফর্মগুলোতেও আপনার ব্র্যান্ডের নাম উঠে আসে স্বতঃস্ফূর্তভাবে।

ভবিষ্যতের সার্চ জগতে টিকে থাকতে হলে এখনই সময়- এসইও এবং জিইও-কে একসাথে কাজে লাগানোর।

বাংলাদেশের ব্যবসার জন্য জিইও’র নতুন সম্ভাবনা

জিইও বাংলাদেশের ব্যবসাগুলোর জন্য হতে পারে এক গেম চেঞ্জার। আগে যেখানে অনলাইন দৃশ্যমানতা মানেই ছিল গুগলে র‌্যাংক করা, এখন সেটি ধীরে ধীরে স্থান ছেড়ে দিচ্ছে এআই সার্চ ভিজিবিলিটি–কে।

আজ যদি কোনো ব্যবহারকারী চ্যাটজিপিটি বা জেমিনি-তে জিজ্ঞেস করে- 

‘বাংলাদেশে নির্ভরযোগ্য অনলাইন বই বিক্রির সাইট কোনটা?’

অথবা, ‘ঢাকায় সেরা ডিজিটাল মার্কেটিং এজেন্সি কারা?’

যদি আপনার ব্র্যান্ডের নাম সেই উত্তরে উঠে আসে, সেটিই হবে প্রকৃত দৃশ্যমানতা- শুধু ক্লিক নয়, বরং আস্থা, প্রভাব ও ব্র্যান্ড অথরিটি–এর প্রতিফলন।

বাংলাদেশে এখন প্রতিদিন শত শত নতুন অনলাইন ব্যবসা শুরু হচ্ছে- ই–কমার্স, এডুকেশন, হেলথটেক, রিয়েল এস্টেট, ফাইন্যান্স, এমনকি ছোট স্টার্টআপরাও দ্রুত ডিজিটাল হচ্ছে। কিন্তু একইসঙ্গে প্রতিযোগিতাও বেড়ে যাচ্ছে বহুগুণে।

এই প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে শুধু এসইও নয়, জিইও–কেন্দ্রিক কৌশলও অপরিহার্য।

জিইও’র ভবিষ্যৎ

খুব শিগগিরই এআই সার্চ টেক্সটের বাইরে গিয়ে ভয়েস, ভিডিও ও ইমেজ কনটেন্ট থেকেও উত্তর তৈরি করবে। তখন জিইও কেবল ওয়েবসাইট নয়, বরং ভিডিও, পডকাস্ট, সোশ্যাল প্রোফাইল, নিউজ রিপোর্ট- সবকিছুর মধ্যেই প্রভাব ফেলবে।

তাই এখন থেকেই যারা জিইও-কেন্দ্রিক কৌশল গ্রহণ করবে, ভবিষ্যতের সার্চ রেভোলিউশনে নেতৃত্ব দেবে তারাই।

উপসংহার

জেনারেটিভ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন (জিইও) শুধু নতুন ট্রেন্ড নয়- এটি ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের পরবর্তী অধ্যায়।

এসইও যেমন আপনাকে সার্চ রেজাল্টে নিয়ে যায়, জিইও তেমনি আপনাকে নিয়ে যাবে এআই–এর উত্তরে।

‘ভবিষ্যতের সার্চে র‌্যাংক নয়, ব্র্যান্ডের বিশ্বাসযোগ্যতাই হবে সাফল্যের আসল মাপকাঠি।’

লেখক: হেড অব ওয়েব অ্যানালাইসিস অ্যান্ড এসইও ডিরেক্টর, ইন্টেলেক আইটি এলএলসি (ইউএসএ অ্যান্ড বাংলাদেশ)

ঢাকা/ফিরোজ

সম্পর্কিত নিবন্ধ