গাইবান্ধা সদর হাসপাতালে দুর্নীতি বন্ধের দাবিতে বিক্ষোভ
Published: 3rd, April 2025 GMT
গাইবান্ধা জেলা সদর হাসপাতালে পর্যাপ্ত সংখ্যক চিকিৎসক, নার্স নিয়োগ; চিকিৎসাসেবার মান উন্নয়ন এবং অনিময়, দুর্নীতি বন্ধের দাবিতে নাগরিক মঞ্চের আয়োজনে বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। বৃহস্পতিবার (৩ এপ্রিল) দুপুরে গাইবান্ধা শহরের ডিবি রোডে অবস্থিত গাইবান্ধা নাট্য ও সাংস্কৃতিক সংস্থার (গানাসাস) সামনে কর্মসূচি পালন করা হয়।
গাইবান্ধা নাগরিক মঞ্চের আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট সিরাজুল ইসলাম বাবুর সভাপতিত্বে, অ্যাডভোকেট ফারুক কবীরের সঞ্চালনায় কর্মসূচির শুরুতে সূচনা বক্তব্য রাখেন বিশিষ্ট সাংবাদিক হেদায়েতুল ইসলাম বাবু এবং সামাজিক সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক জাহাঙ্গীর কবির তনু।
কর্মসূচিতে আরো বক্তব্য রাখেন, নাগরিক মঞ্চের সদস্য সচিব প্রবীর চক্রবর্তী, কুশলাশীষ চক্রবর্তী, মোহাম্মদ আলী প্রামাণিক, মানবাধিকার কর্মী শহিদুল ইসলাম, মনির সুইট, আদিবাসী নেতা বৃটিশ সরেন, জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আফজাল সিরাজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আজমাইন মাহতাব, রুয়েট শিক্ষার্থী পার্থ সারথি, মেডিকেল কলেজ শিক্ষার্থী সন্ধান বর্মন প্রমুখ।
আরো পড়ুন:
গোপালগঞ্জে জুলাই অভ্যুত্থানে আহত ১২ জনের হেলথ কার্ড প্রদান
ওসমানী মেডিকেল
সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়া নিয়ে ‘কিশোর গ্যাংয়ের’ হামলা, আহত ৩
বক্তারা বলেন, গাইবান্ধা জেলা সদর হাসপাতাল নানা অব্যবস্থাপনা ও অনিয়মের মধ্য দিয়ে চলছে। রোগীদের কাছ থেকে চিকিৎসা দেওয়ার নামে টাকা নেওয়া হচ্ছে। নোংরা ও অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে চিকিৎসা নিতে হচ্ছে। হাসপাতালের ভিতর ও বাইরে দুর্গন্ধ। বারবার অব্যবস্থাপনার অভিযোগ উঠলেও আজও প্রতিকার মেলেনি।
বক্তারা আরো বলেন, গাইবান্ধা জেনারেল হাসপাতাল ২৫০ শয্যার অনুমোদন পেয়েছে, কিন্তু ২৫০ শয্যার জনবল অনুমোদন দেওয়া হয়নি। বর্তমানে মাত্র ১০০ শয্যার জনবল দিয়ে হাসপাতালটি চলছে। এতে অনেক পদ শূন্য রয়েছে। ফলে সেবাপ্রত্যাশী জনগণ কাঙ্খিত চিকিৎসক না পেয়ে স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। হাসপাতালে বেড না পেয়ে রোগীদের মেঝেতে চিকিৎসাসেবা নিতে হয়। শয্যা সংকট নিরসনের জন্য নতুন বহুতল ভবন দ্রুত চালু করা প্রয়োজন। এছাড়া হৃদরোগে আক্রান্ত রোগীদের উন্নত চিকিৎসার জন্য আইসিইউ ইউনিট চালু করতে হবে।
বক্তারা আরো বলেন, বরাদ্দকৃত ঔষধ রোগীদের না দিয়ে বাইরে বিক্রি করে ওষুধ সংকট দেখানো হয়। রোগীদের প্রায়শই বাইরে থেকে ওষুধ কিনে এনে চিকিৎসা নিতে হয়। চিকিৎসক ও টেকনিশিয়ান কম; ইসিজি, এক্সরে মেশিন অকার্যকর। ভর্তিরত রোগীদের নিম্নমানের খাদ্য সরবরাহ এবং অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে দুর্ভোগের যেন শেষ নেই এই হাসপাতালে।
বক্তারা গাইবান্ধা জেনারেল হাসপাতালে সকল দুর্নীতি এবং অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে তদন্ত সাপেক্ষে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া; পর্যাপ্ত ঔষধ, যন্ত্রপাতি সরবরাহ এবং হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে সুষ্ঠু স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার দাবি জানান।
এক মাসের মাঝে দাবি পূরণ করা না হলে আগামী ৩ মে কঠোর কর্মসূচির ঘোষণা করা হবে বলে বিক্ষোভে অংশ নেওয়া নেতারা জানান।
ঢাকা/মাসুম/বকুল
.উৎস: Risingbd
এছাড়াও পড়ুন:
আউটসোর্সিং এবং শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন
আধুনিক শ্রমবাজারের একটি গুরুত্বপূর্ণ ও বিস্তৃত খাত হলো আউটসোর্সিং। এ খাতের মাধ্যমে হাজার হাজার শ্রমিক প্রতিদিন সরকারি-বেসরকারি নানা প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন। অথচ এই শ্রমিকদের অধিকাংশই শোভন কাজের মৌলিক মানদণ্ড থেকে বঞ্চিত। চাকরির স্থায়িত্ব নেই; সুরক্ষার নিশ্চয়তা নেই; নেই সংগঠনের অধিকার– এমন বাস্তবতায় শ্রমিকরা এক অনিশ্চিত ও অনুৎপাদনশীল পরিবেশে দিন কাটাচ্ছেন।
এ প্রেক্ষাপটে সম্প্রতি শ্রম সংস্কার কমিশন সরকারের কাছে ‘শ্রমজগতের রূপান্তর-রূপরেখা: শ্রমিক-অধিকার, সুসমন্বিত শিল্প-সম্পর্ক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন’ শীর্ষক একটি সুপরিকল্পিত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। প্রতিবেদনের বিভিন্ন অধ্যায়ে কাজের স্বীকৃতি, অধিকার, নিরাপত্তা ও স্থায়িত্ব নিয়ে যেসব সুপারিশ রাখা হয়েছে, তার মধ্যে আউটসোর্সিং খাতে নিযুক্ত শ্রমিকদের নিয়ে তৎপরতা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
বর্তমানে সরকারের রেজিস্ট্রেশনপ্রাপ্ত ১২৫০টি ঠিকাদারি সংস্থা জনবল সরবরাহ করছে। এর বাইরেও অগণিত অনিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যারা শ্রম আইনের তোয়াক্কা না করে কার্যক্রম চালাচ্ছে। সরকারি, আধা সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত শ্রমিকরা কর্মঘণ্টা, মজুরি, ছুটি, মাতৃত্বকালীন সুবিধা, নিরাপত্তা ইত্যাদি ক্ষেত্রে ভয়াবহ বৈষম্যের শিকার।
অধিকাংশ আউটসোর্সিং শ্রমিক ন্যূনতম মজুরি পান না। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো সরকার নির্ধারিত মজুরি না দিয়ে বেতন থেকে অবৈধভাবে টাকা কেটে রাখে; উৎসব ভাতা দেয় না; ওভারটাইমের ভাতা দেয় না। সাম্প্রতিক ২০২৫ সালের আউটসোর্সিং নীতিমালায় উৎসব ভাতা ও বৈশাখী ভাতা অন্তর্ভুক্তিকে ইতিবাচক পদক্ষেপ বলা যায়, তবে বাস্তবায়ন ও নজরদারি এখনও দুর্বল।
নীতিমালায় নারী শ্রমিকদের মাতৃত্বকালীন ছুটি সংক্রান্ত কোনো অর্থনৈতিক সুরক্ষা না থাকায় তারা এ সুবিধা থেকে বঞ্চিত। ফলে অন্তঃসত্ত্বা হলেই চাকরিচ্যুতির শঙ্কা থাকে। বেসরকারি খাতে এ অবস্থা আরও ভয়াবহ। নতুন নীতিমালায় ৪৫ দিনের প্রসূতিকালীন ছুটি সংযুক্ত করা হয়েছে, যা বিদ্যমান শ্রম আইনের ১১২ দিনের বিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
আউটসোর্সিং শ্রমিকদের সংগঠিত হওয়ার পথ রুদ্ধ। তারা ট্রেড ইউনিয়ন করতে পারেন না। করলে চাকরিচ্যুতির শিকার হন। ফলে শ্রমিকস্বার্থে কোনো সামাজিক সংলাপ বা দরকষাকষির সুযোগ থাকে না।
বিদ্যুৎ, পানি, স্বাস্থ্য, ওয়াসা, নিরাপত্তা খাতে কর্মরত হাজার হাজার আউটসোর্সিং শ্রমিক পেশাগত নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত। করোনা মহামারিতে তারা সম্মুখ সারিতে থেকেও কোনো রকম ক্ষতিপূরণ পাননি। শ্রম বিধিমালার ১৬(৩) অনুযায়ী মালিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার কথা থাকলেও তার বাস্তব প্রয়োগ দুর্বল।
সে জন্য শ্রম সংস্কার কমিশন তাদের প্রতিবেদনে আউটসোর্সিং শ্রমিকদের জন্য যেসব সুপারিশ করেছে, তা বাস্তবায়িত হলে এ খাতে শোভন কাজের নিশ্চয়তা আসবে। আউটসোর্সিং খাতের শ্রমিক-কর্মচারীদের শোভন কাজ, মৌলিক অধিকার এবং কর্মস্থলে সুরক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে।
আমি মনে করি, সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, করপোরেশন ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে স্থায়ী কাজের জন্য আউটসোর্সিং নিয়োগ বন্ধ করতে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার। এ জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর স্থায়ী জনবল কাঠামো হালনাগাদ করে আইনের ধারা ও বিধি অনুসরণপূর্বক প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনা দরকার। ঠিকাদারের মাধ্যমে সার্ভিস চার্জ বা কমিশনের ভিত্তিতে শ্রমিক নিয়োগ বন্ধ করে সরকারি, আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে সরাসরি নিয়োগ প্রদান নিশ্চিত করা দরকার। যারা ৫-১০ বছর বা তদূর্ধ্ব সময় ধরে কর্মরত থেকে দক্ষতা অর্জন করেছেন, তাদের শ্রম আইন অনুযায়ী অধিকার ও সুরক্ষা নিশ্চিত করতে মূল মালিককে দায়বদ্ধ করা দরকার।
শ্রমিকরা স্বেচ্ছায় অতিরিক্ত কাজ করতে রাজি না হলে তাদের চাকরিচ্যুত বা ভয়ভীতি প্রদর্শন করা যাবে না। এ বিষয়ে শ্রম পরিদর্শন দপ্তর কঠোর নজরদারি করবে। রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা, দপ্তর ও জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে আউটসোর্সিং বন্ধ করতে হবে। যেসব দপ্তর ও সেবা খাতে ইতোমধ্যে আউটসোর্সিং করা হয়েছে, বিশেষ করে তথ্যপ্রযুক্তি ও প্রশাসনিক গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে স্থায়ী নিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।
বাংলাদেশের শ্রমজীবী মানুষের প্রত্যাশা একটাই– শোভন কাজের বাস্তবায়ন। এ খাতের বৈষম্য কমাতে হলে সরকারের নীতিগত, আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক হস্তক্ষেপ দরকার। একই সঙ্গে সমাজকেও সচেতন হতে হবে, যাতে মানুষ সস্তা সেবার পেছনে শ্রমের শোষণকে গুরুত্ব দিতে শেখে।
মো. মাছুম বিল্লাহ: আইন কর্মকর্তা, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর