গত সপ্তাহে গাজা উপত্যকার রাফা শহরের বাইরে বুলডোজার দিয়ে খননের পর একটি গর্তে ১৫ জন প্যারামেডিক ও উদ্ধারকর্মীর মৃতদেহ পাওয়া গেছে। এই প্যারামেডিক ও উদ্ধারকর্মীরা জানতেন যে তারা অন্যদের বাঁচানোর জন্য তাদের জীবন ঝুঁকির মধ্যে ফেলছেন। তবে ২৩ মার্চ ভোরে তাদের জন্য যা অপেক্ষা করছিল তার জন্য তারা প্রস্তুত ছিলেন না।
৪৫ বছর বয়সী রেড ক্রিসেন্ট অ্যাম্বুলেন্স অফিসার এবং প্যারামেডিক সালেহ মোয়ামার দুইবার মৃত্যুর কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিলেন।
সালেহ এর ভাই বিলাল জানান, যুদ্ধের শুরুতে সালেহকে হাসপাতালে রোগী পরিবহনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল যখন তার গাড়িটি ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর গুলিতে আক্রান্ত হয়েছিল। চালক তাৎক্ষণিকভাবে নিহত হন এবং সালেহর বুকে একটি গুলি হৃদপিণ্ডের কাছে বিদ্ধ হয়। নিজের প্রাথমিক চিকিৎসা ওই অবস্থাতেই নিজে করার পর তিনি তার আসনের নিচে নেমে যান এবং তার সহকর্মীদের রেডিওতে দেওয়া নির্দেশনা অনুসরণ করে গাড়িটিকে গোলাগুলির বাইরে সরিয়ে আনেন।
সালেহ তিন মাস হাসপাতালে কাটিয়ে তারপর কাজে ফিরে আসেন। কিছুদিন পরেই রাফার কাছে একটি উদ্ধার অভিযানে তার অ্যাম্বুলেন্সে আবার গুলি চালানো হয়। ওই সময় সালেহ ডান কাঁধে গুলিবিদ্ধ হন।
বিলাল বলেন সুস্থ হয়ে হয়ে কাজে ফেরার আগে সালেহ বলেছিল, “তার জন্য যা কিছু নির্ধারিত, তাই ঘটবে।”
২২ মার্চ রাতের শিফটে বের হওয়ার আগে, সালেহ তার স্ত্রী, তাদের ছয় সন্তান এবং তার ভাইয়ের দুই সন্তানের জন্য প্রচুর পরিমাণে গৃহস্থালি জিনিসপত্র কিনেছিলেন।
বিলাল বলেন, “সে বলেছিল যে এটি ভবিষ্যতে তাদের উপকার করবে। মনে হচ্ছিল যেন তার মনে হচ্ছে সে আর ফিরে আসবে না।”
২৩ মার্চ ভোরে যখন রাফাহর তেল আল-সুলতান এলাকায় বিমান হামলায় লোকজন আহত হওয়ার খবর আসে, তখন সালেহ একটি অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে ঘটনাস্থলে যান। হতাহতের সংখ্যা দেখে তিনি আরো অ্যাম্বুলেন্স ডেকেছিলেন, আহতদের উদ্ধার করেছিলেন এবং হাসপাতালে ফিরে এসেছিলেন। ফিরে এসে তিনি জানতে পারেন, ঘটনাস্থলে যাওয়া একটি অ্যাম্বুলেন্সের রেডিও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। সালেহের সহকর্মী মুস্তফা খাফাজা ওই অ্যাম্বুলেন্সটি চালাচ্ছিলেন। ইসরায়েলিদের তীব্র গুলিবর্ষণের শিকার হয়েছিল এবং ভোর ৪ টা ৩০ মিনিটে যখন তিনি শুনতে পান খাফাজা এবং তার সহকর্মী প্যারামেডিক এজ্জ আল-দিন শাত নিখোঁজ। খাফাজা ও এজ্জ আল-দিন শাত ইতিমধ্যেই মারা গেছেন সেই তথ্য তখনো জানতে পারেননি সালেহ।
ভোর হওয়ার আগে সালেহ রেড ক্রিসেন্ট অ্যাম্বুলেন্স, একটি উজ্জ্বল লাল সিভিল ডিফেন্স ফায়ার ট্রাক এবং জাতিসংঘের একটি গাড়িসহ উদ্ধারকারী কাফেলা তৈরি করেন। সব মিলিয়ে ১৩ জন প্যারামেডিক ও উদ্ধারকর্মী তাদের নিখোঁজ সহকর্মীদের খুঁজতে যান।
হানশিন এলাকায় যাওয়ার পরে সালেহসহ ১৩ জনকে ইসরায়েলি বাহিনী আটক করেছে। ইসরায়েলি বুলডোজার দিয়ে গর্ত খনন করা হয়। ওই ১৩ জনকে হত্যার পরে গাড়িসহ সেই গর্তে চাপা দেওয়া হয়। নিখোঁজ ব্যক্তিদের পরিবার এক সপ্তাহ পরে লাশের সন্ধান পায়।
দুজন প্রত্যক্ষদর্শী গার্ডিয়ানকে বলেছেন, “ইসরায়েলি সেনাবাহিনী সালেহকে বেঁধে রেখেছিল। অন্যান্যদেরও হাত বা পা বাঁধা ছিল।”
ভাইয়ের মৃত্যুতে শোকে স্তব্ধ বিলাল বলেন, “এই প্যারামেডিকরা মানবিক সেবা প্রদান করছিলেন। তারা কোনো হুমকি বা অস্ত্র বহন করতেন না। তাদের কী অপরাধ ছিল যে তাদের এভাবে হত্যা করা হল?”
ঢাকা/শাহেদ
.উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর সহকর ম র জন য ইসর য
এছাড়াও পড়ুন:
দুই বন্ধু ও দুটি স্বপ্নের বিদায়
উত্তরার ১৭ নম্বর সেক্টরের ৬ নম্বর অ্যাভিনিউতে বিজিএমইএ ভবন। রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাকশিল্প প্রতিষ্ঠান টিম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল্লাহ হিল রাকিবের জানাজায় শোকাবহ পরিবেশ। প্রিয় মানুষকে চিরবিদায় জানাতে এসেছেন দীর্ঘদিনের সহকর্মী, বন্ধু, পরিবারের সদস্য ও পরিচিতজন। শোক ও অশ্রুতে তারা রাকিবকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করছিলেন। রাকিবের অসমাপ্ত কাজ ও স্বপ্ন এগিয়ে নেওয়ার অঙ্গীকার করেন সহকর্মীরা।
৯ জুন কানাডায় একটি লেকে ভ্রমণের সময় নৌকাডুবে মারা যান আবদুল্লাহ হিল রাকিব ও তাঁর বন্ধু বাংলাদেশ বিমানের ক্যাপ্টেন মো. সাইফুজ্জামান। কানাডায় বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া মেয়ের সঙ্গে সাইফুজ্জামান ঈদের ছুটি কাটাতে স্ত্রী ও আরেক মেয়েকে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেখানে বন্ধু ব্যবসায়ী রাকিব ও তাঁর ছেলের সঙ্গে একটি লেকে ঘুরতে গিয়েছিলেন। অন্টারিও প্রদেশের স্টারজিয়ন লেকে ক্যানুতে (সরু লম্বা ছোট্ট নৌকা) চড়ে ভ্রমণে বের হন। নৌকাটি উল্টে গেলে পানিতে ডুবে প্রাণ হারান দু’জন। বিদেশের মাটিতে একসঙ্গে দুই বন্ধুর মৃত্যু, একই ফ্লাইটে ফেরা, দেশে ফিরে একই কবরস্থানে শেষ শয্যা!
অশ্রুসজল চোখে রাকিবের কানাডাপ্রবাসী মেয়ে লামিয়া তাবাসসুম বলেন, ‘বাবা স্বপ্ন দেখতেন, দেখাতেন। তিনি যেসব স্বপ্ন আমাদের দেখিয়েছেন, যেসব কাজ রেখে গেছেন, আমরা যেন সুন্দরভাবে তা বাস্তবায়ন করতে পারি। পরিবারের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে কানাডায় গিয়েছিলেন বাবা।’
রাকিব ও সাইফুজ্জামান ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। তাদের মরদেহ বিমানের একই ফ্লাইটে শুক্রবার রাতে ঢাকায় আনা হয়। জানাজা শেষে ঢাকায় বিমানবাহিনীর কবরস্থানে দু’জনকে সমাহিত করা হয়। তাদের সহকর্মী ও বন্ধুরা বলছেন, এর মধ্য দিয়ে অকালে দুটি স্বপ্ন বিদায় নিল।
রাকিবের সহকর্মীরা বলেন, বাংলাদেশের তৈরি পোশাক পণ্য রপ্তানিকে ১০০ বিলিয়ন বা ১০ হাজার কোটি ডলারে উন্নীত করার স্বপ্ন দেখতেন রাকিব। তারা সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে সর্বাত্মক সহায়তা করবেন বলে জানান।
উত্তরায় জানাজার আগে বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, ‘আবদুল্লাহ হিল রাকিবের সঙ্গে বেশ কয়েক বছর কাজ করেছি। সব সময়ই দেখেছি, তিনি নিজের পরিবার, বন্ধু, ব্যবসা ও বিজিএমইএকে সমান অগ্রাধিকার দিয়েছেন। তৈরি পোশাকশিল্প খাতের যে কোনো সমস্যা ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় তিনি সামনে চলে যেতেন। রাকিবের দর্শন ছিল– সফলতার মাত্রা নেই। তবে একজন ব্যক্তি কতটা সফল, সেটি তাঁর কর্মযজ্ঞ দেখলে বোঝা যায়।’
বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি এস এম ফজলুল হক বলেন, রাকিব উজ্জ্বল প্রদীপ। স্বপ্ন ছিল অনেক। ঝোড়ো হাওয়ায় সেই প্রদীপ নিভে গেছে। সবাই তাঁর জন্য দোয়া করবেন।
রাকিবের জন্য সবার কাছে দোয়া চান বিজিএমইএর সর্বশেষ নির্বাচনে বিজয়ী রাইজিং ফ্যাশনসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহমুদ হাসান খান। স্মৃতিচারণা করে বক্তব্য দেন রাকিবের বড় ভাই আবদুল্লাহ হিল নকীব।
ক্যাপ্টেন সাইফুজ্জামানের সহকর্মীরা জানান, শুক্রবার তাঁর মরদেহ কানাডা থেকে ঢাকায় আনার সময় তাঁর সঙ্গে স্ত্রী, দুই মেয়ে, বোন এবং ভগ্নিপতি ছিলেন। মরদেহ পৌঁছার পর উপস্থিত পাইলটরা সহকর্মীর মরদেহে স্যালুট দেন। এর পর বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স ও পাইলটস অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে কফিনে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়। পরে মরদেহ ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের (সিএমএইচ) মর্গে রাখা হয়। সেখান থেকে মরদেহ নেওয়া হয় তাঁর বনানীর ডিওএইচএসের বাসায়। বেলা ১১টার দিকে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর ঘাঁটি বাশারের কেন্দ্রীয় মসজিদে জানাজা হয়। সাবেক বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার মার্শাল মোহাম্মদ ইনামুল বারীসহ পাইলট, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা এতে অংশ নেন। পরে জোহরের নামাজ শেষে ডিওএইচএস মাঠে একসঙ্গে ক্যাপ্টেন সাইফুজ্জামান ও রাকিবের জানাজা হয়। সাইফুজ্জামানকে বাবা-মায়ের কবরের পাশে দাফন করা হয়। একই কবরস্থানে দাফন করা হয় রাকিবকে। তাঁর বাবা বিমানবাহিনীর সদস্য ছিলেন।