ট্রাম্পের পাল্টা শুল্কে গতকাল রীতিমতো রক্তাক্ত হয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শেয়ারবাজার। এশিয়ার দেশগুলো থেকে শুরু করেছে যুক্তরাষ্ট্র—সবখানেই এই রক্তপাত হয়েছে। তবে সেই ধাক্কা কাটিয়ে আজ সকালে এশিয়ার বিভিন্ন দেশের শেয়ারবাজার ঘুরে দাঁড়িয়েছে।

গতকাল ১০ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ পতন হয়েছিল ভারতের শেয়ার সূচক সেনসেক্স ও নিফটির। সেই দুই সূচক আজ বেশ ভালোভাবেই ঘুরে দাঁড়িয়েছে। আজ সকালে সেনসেক্স বেড়েছে ১ হাজার ২০৬ পয়েন্ট বা ১ দশমিক ৬৫ শতাংশ; নিফটি বেড়েছে ৩৬৫ পয়েন্ট বা ১ দশমিক ৬৫ শতাংশ। গতকাল সেনসেক্সের পতন হয়েছিল ৩ দশমিক ২ শতাংশ এবং নিফটির পতন হয়েছিল ৩ শতাংশ।

এদিকে আজ মঙ্গলবার সকালে এশিয়ার অন্যান্য দেশের শেয়ার সূচকও ঘুরে দাঁড়িয়েছে। সেই সঙ্গে ইউএস স্টক ফিউচার্সের অবস্থানও ঊর্ধ্বমুখী। এক দিন বড় ধরনের দরপতন হলে পরদিন শেয়ারবাজার সাধারণত ঘুরে দাঁড়ায়। সেই সঙ্গে ওয়াশিংটনও শুল্কের বিষয়ে আপস-রফা করতে চায়—এমন ধারণা বাজারে ছড়িয়ে পড়ার কারণে আজ বাজারে কিছুটা ইতিবাচক ধারা দেখা যাচ্ছে বলে রয়টার্সের সংবাদে বলা হয়েছে।

শেয়ারবাজারের পাশাপাশি অন্যান্য বাজারেও ঘুরে দাঁড়ানোর লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি বন্ডের সুদহার ছয় মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমেছিল; সেখান থেকে তার উত্থান অব্যাহত আছে। সোনার দামও বেড়েছে আজ। আউন্সপ্রতি সোনার দাম বেড়েছে ২৯ দশমিক ৪৫ ডলার বা শূন্য দশমিক ৯৯ শতাংশ। বন্ধ হয়েছে তেলের দর হ্রাস। আজ ব্রেন্ট ক্রুড তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ১ দশমিক ৩৭ শতাংশ বেড়ে ৬৫ দশমিক শূন্য ৯ ডলারে উঠেছে।

বিষয়টি হলো, অনিশ্চয়তার মধ্যে সাধারণত সোনার দাম বাড়ে; কিন্তু এবার দেখা গেল, বাজারের সেই চিরাচরিত নিয়মও ভেঙে পড়েছে। বুধবার ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্ক ঘোষণার পর সাময়িকভাবে সোনার দাম বাড়লেও তারপর দ্রুতগতিতে কমতে থাকে সোনার দাম। এরপর আজ আবার বাড়ল সোনার দাম।

আজ সকালে এশিয়ার শেয়ার সূচকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে জাপানের নিক্কিই এশিয়া সূচক। ৬ দশমিক ৫ শতাংশ বেড়েছে এই সূচক। জাপান যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সমঝোতার পথে আছে। যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যমন্ত্রী স্কট বেসেন্ট ও বাণিজ্য প্রতিনিধি জেমিসন গ্রির টোকিওর সঙ্গে এই আলোচনায় এই নেতৃত্ব দিচ্ছেন।

অন্যদিকে হংকংয়ের হ্যাং সেং সূচকের উত্থান হয়েছে ১ দশমিক ৭ শতাংশ। চীনের মূল ভূখণ্ডের ব্লি চিপস সূচকের উত্থান হয়েছে শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ। দক্ষিণ কোরিয়ার কোসপি সূচক ১ দশমিক ৩ শতাংশ ও অস্ট্রেলিয়ার ইক্যুইটির মানদণ্ড এএক্সজেওর উত্থান হয়েছে ১ শতাংশ। তাইওয়ানের মূল সূচক টিডব্লিউআইআইয়ের গতকাল পতন হয়েছিল ১০ শতাংশ। আজও এই সূচকের পতন হয়েছে ৩ শতাংশ।

ট্রাম্প নির্ভার

বিশ্বের অন্যান্য দেশের শেয়ার সূচকের মতো গতকাল সোমবার সপ্তাহের প্রথম কর্মদিবসে প্রায় দুই হাজার পয়েন্ট পড়ে যায় মার্কিন বাজারের সূচক। ফলে আতঙ্কিত বিনিয়োগকারীদের মধ্যে শেয়ার বিক্রির হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। সেদিন লেনদেন শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ডাও জোন্স ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যাভারেজে শুরু হয় চরম অস্থিরতা। প্রথমেই ১ হাজার ৭০০ পয়েন্ট নেমে যায় এই সূচক। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যে ৮০০ পয়েন্ট লাফিয়ে ওঠে সেটি। এর পর আবার ৪১৪ পয়েন্ট নেমে যায় ওই শেয়ারের লেখচিত্র।

১৯৮৭ সালের ১৯ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ারবাজারের ইতিহাসে ‘কালো সোমবার’ (ব্ল্যাক মানডে) হিসেবে পরিচিত। সেদিন ২২ দশমিক ৬ শতাংশ পড়ে যায় ডাও জোন্স ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যাভারেজ। ৩৮ বছর পর ওয়াল স্ট্রিটে সে রকম রক্তপাত হলো গতকাল।

এত কিছু সত্ত্বেও ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বিকার। পারস্পরিক শুল্ক নীতি থেকে সরে আসতে নারাজ তিনি। তাঁর যুক্তি, ‘বিশ্বের বহু দেশ এত দিন আমেরিকাকে লুট করেছে। পারস্পরিক শুল্কের ওষুধ তাদের ওপর কাজ করছে।’ মার্কিন শেয়ারবাজারের রক্তক্ষরণের দায় এড়িয়ে গেছেন তিনি।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র শ য় রব জ র ১ দশম ক গতক ল

এছাড়াও পড়ুন:

নেই নিয়োগপত্র, আইডি কার্ড ও ছুটি

নিয়োগপত্র নেই। এ কারণে চাকরির নিশ্চয়তাও নেই। দেওয়া হয় না পরিচয়পত্র। নেই কর্ম ঘণ্টার হিসাব। তবে রয়েছে মজুরিবৈষম্য ও জীবনের ঝুঁকি। এ চিত্র খুলনার বরফকলে কর্মরত বরফ শ্রমিকদের।

অবহেলিত ও অধিকার বঞ্চিত বরফকলের শ্রমিকেরা জানেন না মে দিবসের অর্থ। তারা শুধু এটুকু জানেন, কাজ থাকলে মজুরি পাবেন, অন্যথায় জুটবে না কিছু। খুলনার নতুন বাজার, রূপসা, শিপইয়ার্ড ও নিউমার্কেটসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে বরফ শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে উঠে এসেছে ঝুঁকি ও বৈষম্যের এই চিত্র।

সরেজমিনে জানা গেছে, লবণ পানি এবং অ্যামোনিয়া গ্যাসের সংমিশ্রণে বরফের প্রতিটি ক্যান তৈরি হয়। এ কাজে প্রচণ্ড ঝুঁকি রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে- অ্যামোনিয়া গ্যাসের সিলিন্ডার লিকেজ হলে মৃত্যুসহ বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশঙ্কা। এছাড়াও অধিকাংশ সময় হাত-পা ভিজে ঠান্ডা থাকায় ক্ষত থেকে ইনফেকশন হয়। এর বাইরে বুকে ঠান্ডা লেগে সর্দি-কাশি জ্বরসহ ঠান্ডাজনিত অসুস্থতায় ভোগেন এখানকার শ্রমিকেরা। পাতলা বরফে অনেক সময় হাত-পা কেটে যায়। কিন্তু মালিক বা কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের জন্য কোন ধরনের অ্যাপ্রোন বা নিরাপত্তা সরঞ্জাম সরবরাহ করেন না। তবে দুর্ঘটনায় কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন।

আরো পড়ুন:

ফুড ডেলিভারিম্যান: খাবারের রাজ্যে অতৃপ্ত দিনরাত

মহান মে দিবস: শ্রমিকের অধিকার রক্ষায় সংস্কারে জোর সরকারের

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, খুলনা মহানগরীর নতুন বাজার, নিউমার্কেট, শিপইয়ার্ড, রায়েরমহল এবং রূপসা উপজেলার পূর্ব রূপসা এলাকায় ছোট-বড় মিলিয়ে ১৫টি বরফকল রয়েছে। এর মধ্যে নতুন বাজার ও পূর্ব রূপসায় সর্বাধিক বরফকল রয়েছে। এসব কলে গড়ে দশ জন হিসেবে দেড় শতাধিক শ্রমিক-কর্মচারী কাজ করেন।

রূপসার নতুন বাজার এলাকায় অবস্থিত ‘বেঙ্গল আইস অ্যান্ড কোল্ড স্টোরেজে’ কাজ করেন মোহাম্মদ রাসেল হোসেন। তার গ্রামের বাড়ি সাতক্ষীরার আশাশুনি হলেও পরিবার নিয়ে রূপসার জাবুসা এলাকায় বসবাস করেন। দীর্ঘ সাত বছর ধরে এই বরফকলে কাজ করছেন তিনি। রাসেল জানান, তাদের মাসিক বেতন নেই। নেই নিয়োগপত্র ও পরিচয়পত্র। মূলত উৎপাদনের উপর প্রতি পিস বরফের ক্যান অনুযায়ী ১২ টাকা হারে মজুরি পান। নামমাত্র এ মজুরিতে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির বাজারে সংসার ঠিকমতো চলে না।

‘‘তিন বছর আগে নির্ধারণ করা মজুরি এখনো চলছে। লোকসানের অজুহাতে মালিকপক্ষ মজুরি বাড়াতে চান না। তাদের মতো শ্রমিকদের কোন বেতন-বোনাস নেই। নো ওয়ার্ক, নো পে অর্থাৎ কাজ থাকলে মজুরি আছে কাজ না থাকলে নেই। মালিকদের এ সিদ্ধান্ত না মানলে চাকরিও থাকে না।’’ ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন রাসেল হোসেন।

একই প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন মোঃ জাকির হোসেন। তিনি বলেন, ‘‘গড়ে প্রতিমাসে ১২ থেকে ১৩ হাজার টাকা মজুরি পাই। কিন্তু মাসিক খাবার খরচ প্রায় ৩ হাজার টাকা। বাসা ভাড়া বাবদ ৩ হাজার টাকা চলে যায়।’’

তবে জাকির হোসেন ব্যাচেলর হওয়ায় কারখানার মধ্যেই থাকেন। বিয়ের পর এ কাজ করার ইচ্ছা নেই বলে জানান তিনি।

বেঙ্গল আইস অ্যান্ড কোল্ড স্টোরেজ-১-এ অপারেটর হিসেবে কর্মরত রয়েছেন মোঃ সেলিম শেখ। তার জন্ম নড়াইলের লক্ষ্মীপাশা হলেও কর্মসংস্থানের কারণে রুপসার বাগমারা গ্রামে বসবাস করছেন। তিনি জানান, বর্তমান বয়স ৮৪। ২০ বছর বয়স থেকেই বরফ কারখানার সঙ্গে জড়িত। প্রথমে হেলপার হিসেবে ২৫০০ টাকা বেতনে কাজ শুরু করেন। বর্তমানে অপারেটর হিসেবে মাসিক ১৫ হাজার টাকা পান। প্রতিদিন ভোর সাড়ে পাঁচটা থেকে কাজ শুরু করতে হয়। তবে সবসময় উৎপাদন না থাকলেও ২৪ ঘণ্টা কারখানায় থাকতে হয়। ছুটি পান না।

‘অ্যামোনিয়া গ্যাসের অতিরিক্ত চাপের কারণে সিলিন্ডার লিকেজ হলে মৃত্যু ঝুঁকি রয়েছে। তবে তিনি কখনো বড় ধরনের দুর্ঘটনার সম্মুখীন হননি বলে জানান তিনি।

‘মায়ের দোয়া আইস এন্ড কোল্ড স্টোরেজে’র শ্রমিক জাকারিয়া হাওলাদার বলেন, ‘‘চার বছর বরফকলে কাজ করছি। চাকরির ভবিষ্যৎ নেই। শ্রম দিতে পারলে মজুরি হয়, না হলে হয় না। নিয়োগপত্র ও পরিচয়পত্র দেন না মালিকপক্ষ। বেতন বাড়ানোর কথা বললে তারা আমলে নেন না।’’

একই এলাকার ‘ব্রাইট অ্যান্ড কোল্ড স্টোরেজে’ কাজ করছেন মোঃ মুন্না গাজী ও মোঃ হাসান শেখ। তারা নগরীর জিন্নাপাড়া এলাকায় বসবাস করেন। তারা দুজনেই মাসিক ১০ হাজার টাকা বেতন পান। এর বাইরে তেমন কোন সুযোগ সুবিধা নেই।

‘ব্রাইট অ্যান্ড কোল্ড স্টোরেজে’র ম্যানেজার আশিকুর রহমান বিষয়টি স্বীকার করে জানান, কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের সুরক্ষায় উদাসীন। এখানে অ্যামোনিয়া গ্যাসের সিলিন্ডার মাঝেমধ্যেই লিক হয়। তবে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটেনি। প্রতিষ্ঠানটিতে ৫৩২টি আইস উৎপাদনের ক্যানের প্লান্ট রয়েছে। তবে প্রতিদিন গড়ে ২৫০ ক্যান বরফ উৎপাদন হয়। ছয়জন শ্রমিক কাজ করে বলে জানান তিনি।

‘বেঙ্গল আইস অ্যান্ড কোল্ড স্টোরেজ- ২'র ম্যানেজার জামাল উদ্দিন বলেন, ‘‘বরফের মূল ক্রেতা চিংড়ি ও সাদা মাছের ব্যবসায়ীরা। এর বাইরে গ্রীষ্ম মৌসুমে ভ্রাম্যমাণ ও দোকানে শরবত বিক্রেতারাও কারখানা থেকে বরফ কিনে নেন। গ্রীষ্ম মৌসুমের ৬ মাস চাহিদা থাকে এবং কিছুটা লাভের মুখ দেখা যায়। তবে শীত মৌসুমের ছয় মাস বরফের চাহিদা কম থাকে। তখন কারখানা ভাড়া ও বিদ্যুৎ বিলসহ শ্রমিক কর্মচারীদের বেতন ও মজুরি দিয়ে লোকসান গুণতে হয়।’’

জামাল উদ্দিন স্বীকার করেন কারখানায় নিরাপত্তা ঝুঁকি থাকলেও তা এড়াতে কোন সরঞ্জাম নেই। তবে অপারেটরদের অ্যামোনিয়া গ্যাসের ঝুঁকি প্রতিরোধে মাক্স সরবরাহ করা হয়।

‘বেঙ্গল আইস অ্যান্ড কোল্ড স্টোরেজ-১'র মালিকপক্ষের প্রতিনিধি রিয়াদ-উল-জান্নাত সৈকত বলেন, ‘‘ব্যবসা খুব ভালো যাচ্ছে না। কখনো লাভ, কখনো লোকসান এভাবেই চলছে। গত বছর কারখানা ভাড়া ও বিদ্যুৎ বিলসহ অন্যান্য খরচ বাবদ ৯ লাখ টাকা লোকসান হয়েছে।’’

তবে লাভ হলে শ্রমিক কর্মচারীদের মজুরি ও অন্যান্য সুবিধা বৃদ্ধির বিষয়টি বিবেচনা করা হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

এ বিষয়ে শ্রমিকদের সংগঠন রূপসা বেড়িবাঁধ হ্যান্ডলিং শ্রমজীবী ইউনিয়নের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোঃ রিপন শেখ এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘‘নতুন বাজার এলাকায় অবস্থিত কয়েকটি বরফকলের ৪০ জন শ্রমিক তাদের ইউনিয়নের সদস্য। বিগত দেড় বছর আগে মজুরির সমস্যা নিয়ে মালিকপক্ষের বিরুদ্ধে দুই একজন শ্রমিক অভিযোগ করলে ইউনিয়নের মাধ্যমে সেটির সমাধান করে দেন তারা। কিন্তু বর্তমানে অভিযোগ নিয়ে কেউ আসে না।’’

বরফকলের শ্রমিকদের নিয়ে তারা মে দিবসের কর্মসূচি পালন করেন বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

তারা//

সম্পর্কিত নিবন্ধ