সৌদি আরব কি পারবে কূটনৈতিক শক্তি ধরে রাখতে
Published: 11th, April 2025 GMT
সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদে মুখোমুখি বসেছে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া। আলোচনার মূল বিষয় ইউক্রেনে যুদ্ধবিরতি ও কৃষ্ণসাগরে জাহাজ চলাচলের নিরাপত্তা। রিয়াদের বিলাসবহুল রিটজ-কার্লটন হোটেলে চলছে এই বৈঠক। এর আগে সৌদি আরব ইউক্রেনের একটি প্রতিনিধিদলকে স্বাগত জানিয়েছিল। এতে বোঝা যাচ্ছে, আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে সৌদি আরবের ভূমিকা বাড়ছে।
এই বৈঠক আয়োজনের অনুরোধ এসেছিল মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছ থেকে। দ্বিতীয় মেয়াদে সৌদি আরবকে কূটনৈতিক আলোচনার কেন্দ্রস্থলে আনার চেষ্টা চালাচ্ছেন তিনি। এই আলোচনায় সফলতা আসুক বা না আসুক, আরব বিশ্ব এখন সৌদি আরবের কাছ থেকে আরও সক্রিয় ভূমিকা আশা করছে। বিশেষ করে, তারা চায় সৌদি আরব ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংকটের সমাধানেও বড় ভূমিকা পালন করুক।
ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে এখন পর্যন্ত তিনবার সৌদি আরবকে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা আয়োজনের দায়িত্ব দিয়েছেন। গত ১৮ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া-যুক্তরাষ্ট্রের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের মধ্যে তিন বছর পর প্রথম বৈঠক হয়েছিল রিয়াদেই। এরপর ১১ মার্চ অনুষ্ঠিত হয় যুক্তরাষ্ট্র ও ইউক্রেনের মধ্যে আরেক দফা আলোচনা। এর আগে হোয়াইট হাউসে ট্রাম্প ও ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির মধ্যে মতবিরোধ দেখা দিয়েছিল।
ট্রাম্প কেন সৌদি আরবকেই বেছে নিচ্ছেন? এর পেছনে রয়েছে কয়েকটি কারণ। ট্রাম্প প্রক্রিয়ার চেয়ে ব্যক্তিগত সম্পর্ককে বেশি গুরুত্ব দেন। সৌদি আরব রাশিয়া ও ইউক্রেনের বন্দী মুক্তিতে সহায়তা করেছে। এ ছাড়া দেশটি একাধিক পক্ষের আলোচনায় ‘সততার মধ্যস্থতাকারী’ হিসেবে ভূমিকা রাখতে আগ্রহী।
ট্রাম্পের জন্য এটা শুধু কূটনীতি নয়, ব্যক্তিগত সম্পর্কের বিষয়প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর ট্রাম্প ভিন্ন পথে হেঁটেছিলেন। সাধারণত মার্কিন প্রেসিডেন্টরা প্রথম বিদেশ সফরে কানাডা যান। কিন্তু ট্রাম্প প্রথমেই গেলেন সৌদি আরবে। সেখানেই তিনি যুবরাজ সালমানের সঙ্গে ১০৯ বিলিয়ন ডলারের প্রতিরক্ষা চুক্তি করেন।
এই চুক্তি বাস্তবায়নে বড় ভূমিকা রেখেছিলেন ট্রাম্পের জামাতা ও ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টা জ্যারেড কুশনার। তিনি সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলেন। প্রেসিডেন্ট পদ ছাড়ার পর কুশনারের ব্যক্তিগত বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান ‘অ্যাফিনিটি পার্টনারস’ দুই বিলিয়ন ডলার পেয়েছে সৌদির সরকারি বিনিয়োগ তহবিল (পিআইএফ) থেকে। এই থেকে বোঝা যায়, ট্রাম্প সৌদি শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে নিজের ব্যক্তিগত সম্পর্ককে খুব গুরুত্ব দেন।
গাজা ইস্যুতে ট্রাম্পের কিছু বক্তব্য সৌদি আরবকে অস্বস্তিতে ফেললেও তিনি এখনো মনে করেন সৌদিরা এমন এক পরিবেশ তৈরি করতে পারে, যেখানে বড় বড় কূটনৈতিক আলোচনা সম্ভব। ট্রাম্পের দৃষ্টিতে, সৌদি নেতাদের সঙ্গে সম্পর্কটা আদর্শ বা মূল্যবোধভিত্তিক নয়, বরং লেনদেনভিত্তিক। এই ধরনের সম্পর্কই রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনার ক্ষেত্রে তার লক্ষ্য পূরণে সহায়ক বলে মনে করেন তিনি।
নিরপেক্ষতা ও অভিজ্ঞতায় সৌদি আরবের কূটনৈতিক ভাবমূর্তিরাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে চলমান আলোচনাগুলোর পেছনে রয়েছে রিয়াদের পূর্বাভিজ্ঞতা। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সৌদি আরবের মধ্যস্থতায় ইউক্রেনে আটক ১০ বিদেশিকে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। এটিই ছিল যুদ্ধ চলাকালে সবচেয়ে বড় বন্দিবিনিময়ের একটি উদাহরণ।
ইউক্রেন সংকটে সৌদি আরব ‘ইতিবাচক নিরপেক্ষতা’র নীতি গ্রহণ করায় দেশটি রাশিয়া ও ইউক্রেন—দুই পক্ষের সঙ্গেই ঘনিষ্ঠ ও কার্যকর সম্পর্ক গড়ে তুলতে পেরেছে। রাশিয়ার সঙ্গে তেল উৎপাদন জোট ওপেক প্লাসে কাজ করা এবং ২০২৩ সালে আরব লিগের শীর্ষ সম্মেলনে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কিকে আমন্ত্রণ জানানোর মাধ্যমে রিয়াদ প্রমাণ করেছে যে তারা নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য এক কূটনৈতিক অংশীদার।
শুধু ইউক্রেন যুদ্ধই নয়, সৌদি আরব এর আগেও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংকটে মধ্যস্থতার গুরুত্বপূর্ণ অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে মিলে ২০১৮ সালে সৌদি আরব ইরিত্রিয়া ও ইথিওপিয়ার মধ্যে শান্তিচুক্তি করায় বড় ভূমিকা রেখেছিল। সেই চুক্তিতে দুই দশকের পুরোনো যুদ্ধের অবসান ঘটে। তখন রিয়াদ ও আবুধাবি সরাসরি আলোচনার আয়োজন করে, আর্থিক সহায়তা ও বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দেয়, নিরাপত্তাসহায়তা দেয় এবং কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগ করে দুই পক্ষকে আলোচনায় বসায়।
২০২৩ সালে সৌদি আরব আবারও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যৌথভাবে সুদানের দুই যুদ্ধরত পক্ষের মধ্যে মধ্যস্থতা করে ‘জেদ্দা ঘোষণা’ নামের একটি লিখিত চুক্তি করায়। সুদানের সেনাবাহিনী (SAF) ও আধা সামরিক বাহিনী RSF-এর মধ্যে এটিই ছিল প্রথম আনুষ্ঠানিক চুক্তি। যদিও এই চুক্তি মাত্র সাত দিন স্থায়ী যুদ্ধবিরতি এনে দেয়, তবু এটি ভবিষ্যতের আলোচনার ভিত্তি তৈরি করেছে এবং আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে রিয়াদের ভাবমূর্তি আরও শক্ত করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট চান রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের মধ্যে সরাসরি আলোচনা হোক। তিনি রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে সামনাসামনি বৈঠকে বসতে আগ্রহী। সৌদি আরব এমন একটি সুযোগ করে দিতে পারে—একটি জাঁকজমকপূর্ণ প্রাসাদে, সৌজন্যমণ্ডিত আতিথেয়তার পরিবেশে এ ধরনের বৈঠক আয়োজন করবার সক্ষমতা তাদের আছে।ওমান ও কাতারের কূটনৈতিক পরিচিতিগত দুই দশকে উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদের (জিসিসি) সদস্যরাষ্ট্রগুলো আরও স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করতে শুরু করেছে। এর ফলে তারা আঞ্চলিক কূটনীতিতে ক্রমেই বেশ সক্রিয় হয়ে উঠেছে।
এই প্রেক্ষাপটে কাতার এখন গুরুত্বপূর্ণ মধ্যস্থতাকারী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। কাতারের বড় সাফল্যগুলোর মধ্যে রয়েছে ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতি প্রতিষ্ঠা এবং যুক্তরাষ্ট্র ও তালেবানের মধ্যে আলোচনার পথ সুগম করা।
ওমান বরাবরই নিরপেক্ষতার নীতি মেনে চলে। এই অবস্থান কাজে লাগিয়ে দেশটি কূটনৈতিক মহলে গোপনীয়, কিন্তু অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এক মধ্যস্থতাকারী হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে, ২০১৫ সালের ইরান-যুক্তরাষ্ট্র পারমাণবিক চুক্তির পেছনে থাকা গোপন আলোচনায় ওমানের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
আরও পড়ুনআফগান তালেবান ও সৌদি আরবের সম্পর্ক কি নতুন মোড় নিচ্ছে২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫এসবের সাপেক্ষে সৌদি আরব এখনো এই কূটনৈতিক অঙ্গনে নতুন খেলোয়াড়। অভিজ্ঞতা ও সক্ষমতা বাড়লেও হামাস, তালেবান কিংবা হুথিদের মতো শক্তির সঙ্গে দীর্ঘদিনের কঠিন আলোচনায় ওমান ও কাতারের যে অভিজ্ঞতা আছে, সেই রকম ‘সংঘাতের ক্ষত’ সৌদি আরবের নেই।
এই গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য ওমান ও কাতারকে বড় মূল্য দিতে হয়েছে। পশ্চিমা দেশগুলোর দৃষ্টিতে এসব গোষ্ঠী হয় নিষিদ্ধ, নয়তো তাদের স্বার্থবিরোধী। ফলে মাসকাট ও দোহাকে অনেক সময়ই কড়া সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে সৌদি আরব তুলনামূলকভাবে ‘পরিষ্কার খাতা’—যার কারণে পশ্চিমা বিশ্বের কাছে আলোচনার আয়োজক হিসেবে সৌদি আরবকে বেশি গ্রহণযোগ্য মনে হয়।
রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র বা রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে সরাসরি মধ্যস্থতা না করে সৌদি আরব বরং আলোচনার মঞ্চ প্রস্তুত করে দিচ্ছে। ট্রাম্পের দৃষ্টিতে এটাই সবচেয়ে উপযুক্ত কৌশল। কারণ, তিনি চান রুশ ও মার্কিন কর্মকর্তারা মুখোমুখি আলোচনা করুক। ভবিষ্যতে তিনি নিজেও রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে সরাসরি বৈঠকে বসতে চান। আর সেই আলোচনার জন্য সৌদি আরব একটি দৃষ্টিনন্দন প্রাসাদ ও সৌজন্যপূর্ণ আতিথেয়তায় ভরপুর পরিবেশ দিতে প্রস্তুত।
নতুন ভূমিকা, নতুন দায়িত্বআলোচনার ফলাফল যা-ই হোক, সৌদি আরব এই আন্তর্জাতিক বৈঠকের আয়োজনকে বড় সাফল্য হিসেবে দেখছে। এখন মনে হচ্ছে আঞ্চলিক প্রতিবেশীদের ছাপিয়ে সৌদি আরব আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতা, শান্তি ও নিরাপত্তার প্রশ্নে নেতৃত্বের জায়গায় উঠে আসছে।
ইউক্রেনে যুদ্ধবিরতির আলোচনায় মধ্যস্থতাকারী হিসেবে রিয়াদের এই ভূমিকা ভবিষ্যতে ইরান-যুক্তরাষ্ট্র আলোচনা পুনরায় শুরু হলে সৌদি আরবকে আলোচনার টেবিলে বসার সুযোগ এনে দিতে পারে। কয়েক বছর আগেও তা কল্পনার বাইরে ছিল। কমপক্ষে এই প্রক্রিয়া রিয়াদের অবস্থানকে আরও শক্ত করবে এবং যুক্তরাষ্ট্রকে সৌদি নিরাপত্তা ইস্যুতে সচেতন রাখবে। একই সঙ্গে এই আলোচনা আয়োজনের মাধ্যমে গাজা, লেবানন বা সিরিয়ার মতো স্পর্শকাতর ইস্যুতে ট্রাম্প প্রশাসনের ওপর যে চাপ ছিল, তা কিছুটা সরিয়ে নেওয়াও সম্ভব হচ্ছে।
তবে এই নতুন ভূমিকার সঙ্গে এসেছে নতুন দায়িত্ব, ভার ও জবাবদিহি। শুধু আন্তর্জাতিক মহল নয়, আরব দুনিয়ার মানুষও এখন সৌদি আরবের কাছে চায় যে তারা আরও সক্রিয়ভাবে আঞ্চলিক সংকট সমাধানে এগিয়ে আসুক। প্রয়োজনে বাস্তবায়ন, পর্যবেক্ষণ ও পরবর্তী পদক্ষেপেও অংশ নিক।
এই কূটনৈতিক মর্যাদা সৌদি আরব স্বাগত জানালেও, তা ধরে রাখতে হলে প্রয়োজন হবে সাহস, সংকল্প, ঝুঁকি নেওয়ার মানসিকতা এবং সমালোচনা সহ্য করার শক্তি। কারণ, এখন তাদের প্রতিটি পদক্ষেপের ওপর নজর রাখছে পৃথিবী।
নিল কুলিয়াম অ্যাসোসিয়েট ফেলো, মিডল ইস্ট অ্যান্ড নর্থ আফ্রিকা প্রোগ্রাম
চ্যাথাম হাউস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ও ইউক র ন ইউক র ন র ক ক টন ত ক টন ত ক আরব র প রথম
এছাড়াও পড়ুন:
সার্চ দুনিয়ার নতুন দিগন্ত জিইও: দেশের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো কী প্
ইন্টারনেট সার্চ দুনিয়ায় চলছে নীরব এক বিপ্লব। তথ্য খোঁজার ধরন বদলে যাচ্ছে আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে দ্রুত। আগে যেখানে গুগলে উচ্চ র্যাংকিং মানেই ছিল সাফল্য, এখন সেই জায়গা নিচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই)-নির্ভর সার্চ টুল।
সার্চ জগতের নতুন চ্যালেঞ্জ
চ্যাটজিপিটি, গুগল জেমিনি, মাইক্রোসফট কপিলট কিংবা পারপ্লেক্সিটি এআই-এগুলো আর শুধু সার্চ ইঞ্জিন নয়, বরং উত্তর তৈরিকারক ইঞ্জিন। ব্যবহারকারী এখন শুধু ‘লিংক’ নয়, বরং সরাসরি উত্তর পেতে চায়। আর এই পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার জন্যই এসেছে নতুন এক কৌশল- জিইও বা জেনারেটিভ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন।
জিইও কী?
জিইও (জেনারেটিভ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন) হলো এমন একটি প্রক্রিয়া, যেখানে আপনার ওয়েবসাইট ও কনটেন্ট এমনভাবে সাজানো হয় যাতে এআই-চালিত সার্চ ইঞ্জিন সহজেই আপনার তথ্য চিনতে, বুঝতে এবং ব্যবহারকারীর প্রশ্নের উত্তরে সেটি অন্তর্ভুক্ত করতে পারে।
আগে ব্র্যান্ডগুলোর ফোকাস ছিল গুগলের প্রথম পাতায় জায়গা করে নেওয়া। কিন্তু এখন গুরুত্ব পাচ্ছে- চ্যাটজিপিটি বা জেমিনি-এর উত্তরে আপনার ব্র্যান্ডের নাম আসছে কি না!
এসইও বনাম জিইও: সার্চ দুনিয়ার নতুন যুগের পালাবদল
অনেকেই এসইও (সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন) এবং জিইও (জেনারেটিভ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন) এক মনে করেন, কিন্তু এদের মধ্যে মূলত লক্ষ্য ও কৌশল ভিন্ন। এসইও হচ্ছে পুরোনো পদ্ধতি, অন্যদিকে জিইও হচ্ছে নতুন পদ্ধতি।
* মূল লক্ষ্য
এসইও: সার্চ ইঞ্জিনে র্যাংক বাড়ানো
জিইও: এআই সার্চের উত্তরে দৃশ্যমান হওয়া
* কাজের ধরন
এসইও: কিওয়ার্ড ও ব্যাকলিংক ভিত্তিক
জিইও: কনটেক্সট, প্রাসঙ্গিকতা ও ব্র্যান্ড অথরিটি নির্ভর
* ফলাফল
এসইও: ক্লিক ও ট্রাফিক বৃদ্ধি
জিইও: ব্র্যান্ড উল্লেখ ও আস্থা বৃদ্ধি
* প্ল্যাটফর্ম
এসইও: গুগল, বিং ইত্যাদি সার্চ ইঞ্জিন
জিইও: চ্যাটজিপিটি, জেমিনি, পারপ্লেক্সিটি, এসজিই ইত্যাদি এআই সার্চ
এসইও এখনও গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু ভবিষ্যতের সার্চ ইকোসিস্টেমে জিইও সমান অপরিহার্য হয়ে উঠছে।
বাংলাদেশি ব্যবসার জন্য জিইও-এর গুরুত্ব
বাংলাদেশে ডিজিটাল মার্কেটের ক্রমবর্ধমান প্রবৃদ্ধি স্পষ্টভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। শিক্ষা, ট্রাভেল, স্বাস্থ্যসেবা, ই-কমার্স, রিয়েল এস্টেট- প্রায় প্রতিটি খাতেই ব্যবসা অনলাইনে আরো দৃশ্যমান হতে চাচ্ছে। কিন্তু বদলেছে মানুষের সার্চ করার ধরন। এখন তারা শুধু গুগলে সার্চ করেই সন্তুষ্ট থাকছে না, তারা এআই-চালিত সার্চ টুলগুলো যেমন চ্যাটজিপিটি, জেমিনি বা পারপ্লেক্সিটি-এর মাধ্যমে সরাসরি উত্তর খুঁজছে।
গার্টনারের এক গবেষণা অনুযায়ী, ২০২৬ সালের মধ্যে প্রচলিত সার্চ ইঞ্জিনে সার্চ ভলিউম প্রায় ২৫ শতাংশ কমে যাবে- কারণ ব্যবহারকারীরা দ্রুতই এআই-চালিত সার্চ ও চ্যাটবটের দিকে ঝুঁকছে। (তথ্যসূত্র: Gartner, “Search Engine Volume Will Drop 25% by 2026, Due to AI Chatbots and Other Virtual Agents)
তবে এই পরিবর্তনের প্রভাব ব্যবসার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ধরুন, কেউ চ্যাটজিপিটি-তে লিখল, ‘ঢাকায় সেরা অ্যাকাউন্টিং ফার্ম কোনটি?’ যদি আপনার কোম্পানির নাম বা কনটেন্ট এআই-এর তৈরি উত্তরে না আসে, তাহলে সম্ভাব্য ক্লায়েন্ট ও ব্যবসার সুযোগ হাতছাড়া হচ্ছে।
মূলত এখানেই জিইও-এর গুরুত্ব উঠে আসে। জিইও ব্যবহার করে কনটেন্ট এমনভাবে সাজানো যায় যাতে এআই সার্চ সিস্টেম আপনার ব্র্যান্ডকে সহজেই চিনতে পারে, বুঝতে পারে এবং ব্যবহারকারীর প্রশ্নের উত্তরে উল্লেখ করে। অর্থাৎ, বাংলাদেশের প্রতিটি ব্যবসা যদি এআই-এর দুনিয়ায় দৃশ্যমান থাকতে চায়, জিইও’র সঙ্গে খাপ খাওয়ানো এখন আর বিকল্প নয়- এটি একান্ত প্রয়োজন।
জিইও’র জন্য কীভাবে প্রস্তুতি নেবেন?
জেনারেটিভ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন (জিইও) কোনো একদিনে শেখার মতো বিষয় না- এটি একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া, যেখানে ব্যবসাগুলোকে নিজেদের কনটেন্ট, উপস্থিতি ও বিশ্বাসযোগ্যতা এআই-বান্ধব করে গড়ে তুলতে হয়। নিচে ধাপে ধাপে দেখা যাক, কীভাবে আপনি জিইও’র পথে প্রস্তুত হতে পারবেন।
১. অনলাইন উপস্থিতি যাচাই করুন
জিইও’র প্রথম ধাপ হলো আপনার ব্যবসা বা ব্র্যান্ডের বর্তমান অনলাইন উপস্থিতি যাচাই করা। চ্যাটজিপিটি বা পারপ্লেক্সিটি-এর মতো এআই-চালিত সার্চ টুলে সার্চ দিন ‘বাংলাদেশে সেরা (আপনার ইন্ডাস্ট্রি)-এর কোম্পানিগুলো কোনগুলো?’
যদি সার্চের উত্তরে আপনার নাম না আসে, বোঝা যাবে যে আপনার এআই-দৃশ্যমানতা এখনও সীমিত। এই ক্ষেত্রে আপনাকে জিইও অনুযায়ী কনটেন্ট ও অনলাইন উপস্থিতি বাড়াতে কাজ শুরু করতে হবে।
২. বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি করুন
জেনারেটিভ এআই সার্চ সিস্টেম সেই উৎসকেই অগ্রাধিকার দেয়, যা নির্ভরযোগ্য ও যাচাইযোগ্য। তাই আপনার ওয়েবসাইটে ব্র্যান্ড, টিম, যোগাযোগ ও রিভিউসহ সব তথ্য সম্পূর্ণ ও স্বচ্ছ রাখুন।
গুগল বিজনেস প্রোফাইল নিয়মিত আপডেট করুন- ঠিকানা, সময়, পোস্ট ও রিভিউসহ।
বিশ্বস্ত সংবাদমাধ্যম ও ব্লগে ব্র্যান্ডের উল্লেখ বাড়ান।
E-E-A-T (Experience, Expertise, Authoritativeness, Trustworthiness) বজায় রাখুন।
এভাবেই এআই ও ব্যবহারকারীর কাছে আপনার ব্র্যান্ড একটি বিশ্বাসযোগ্য সোর্স হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে- যা জিইও সাফল্যের মূল চাবিকাঠি।
৩. কনভারসেশনাল কনটেন্ট লিখুন
এআই সার্চ এখন ব্যবহারকারীর প্রশ্নভিত্তিক অনুসন্ধানকে গুরুত্ব দেয়। তাই আপনার কনটেন্ট তৈরি করুন এমনভাবে যেন এটি প্রাকৃতিক প্রশ্ন ও কথোপকথনের মতো শোনায়। উদাহরণ: ‘Where can I find a trusted IELTS coaching center in Dhaka?’ ‘Where can I apply for a blue-collar job?’ এ ধরনের কনটেন্ট এআই-এর চোখে আরো সহজে বোঝার মতো হয় এবং ব্যবহারকারীর প্রশ্নের উত্তর হিসেবে উল্লেখযোগ্য।
৪. বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে সক্রিয় থাকুন
এআই শুধু ওয়েবসাইট থেকে তথ্য সংগ্রহ করে না। এটি ফেসবুক, ইউটিউব, লিংকডইন, কোরা এবং অন্যান্য সোশ্যাল প্ল্যাটফর্ম থেকেও তথ্য সংগ্রহ করে। তাই বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে আপনার উপস্থিতি নিশ্চিত করা জিইও-এর জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
৫. এসইও এবং জিইও একসাথে ব্যবহার করুন
ডিজিটাল দুনিয়ায় এখন শুধু সার্চ র্যাংকই যথেষ্ট নয়। এসইও যেমন গুগল সার্চে আপনার কনটেন্টকে শীর্ষে নিয়ে আসে, তেমনি নতুন যুগের জিইও (জেনারেটিভ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন) আপনার ব্র্যান্ডকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক সার্চে আরো দৃশ্যমান করে তোলে।
এসইও মূলত গুগল ও অন্যান্য সার্চ ইঞ্জিনে ওয়েবসাইটের অবস্থান উন্নত করে, আর জিইও শেখায়- কীভাবে এআই মডেলগুলো আপনার ব্র্যান্ডকে চিনবে, উল্লেখ করবে এবং বিশ্বাস করবে।
দুটি কৌশল একসাথে প্রয়োগ করলে অনলাইন উপস্থিতি অনেক বেশি শক্তিশালী হয়। একদিকে সার্চে দৃশ্যমানতা বাড়ে, অন্যদিকে এআই-নির্ভর প্ল্যাটফর্মগুলোতেও আপনার ব্র্যান্ডের নাম উঠে আসে স্বতঃস্ফূর্তভাবে।
ভবিষ্যতের সার্চ জগতে টিকে থাকতে হলে এখনই সময়- এসইও এবং জিইও-কে একসাথে কাজে লাগানোর।
বাংলাদেশের ব্যবসার জন্য জিইও’র নতুন সম্ভাবনা
জিইও বাংলাদেশের ব্যবসাগুলোর জন্য হতে পারে এক গেম চেঞ্জার। আগে যেখানে অনলাইন দৃশ্যমানতা মানেই ছিল গুগলে র্যাংক করা, এখন সেটি ধীরে ধীরে স্থান ছেড়ে দিচ্ছে এআই সার্চ ভিজিবিলিটি–কে।
আজ যদি কোনো ব্যবহারকারী চ্যাটজিপিটি বা জেমিনি-তে জিজ্ঞেস করে-
‘বাংলাদেশে নির্ভরযোগ্য অনলাইন বই বিক্রির সাইট কোনটা?’
অথবা, ‘ঢাকায় সেরা ডিজিটাল মার্কেটিং এজেন্সি কারা?’
যদি আপনার ব্র্যান্ডের নাম সেই উত্তরে উঠে আসে, সেটিই হবে প্রকৃত দৃশ্যমানতা- শুধু ক্লিক নয়, বরং আস্থা, প্রভাব ও ব্র্যান্ড অথরিটি–এর প্রতিফলন।
বাংলাদেশে এখন প্রতিদিন শত শত নতুন অনলাইন ব্যবসা শুরু হচ্ছে- ই–কমার্স, এডুকেশন, হেলথটেক, রিয়েল এস্টেট, ফাইন্যান্স, এমনকি ছোট স্টার্টআপরাও দ্রুত ডিজিটাল হচ্ছে। কিন্তু একইসঙ্গে প্রতিযোগিতাও বেড়ে যাচ্ছে বহুগুণে।
এই প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে শুধু এসইও নয়, জিইও–কেন্দ্রিক কৌশলও অপরিহার্য।
জিইও’র ভবিষ্যৎ
খুব শিগগিরই এআই সার্চ টেক্সটের বাইরে গিয়ে ভয়েস, ভিডিও ও ইমেজ কনটেন্ট থেকেও উত্তর তৈরি করবে। তখন জিইও কেবল ওয়েবসাইট নয়, বরং ভিডিও, পডকাস্ট, সোশ্যাল প্রোফাইল, নিউজ রিপোর্ট- সবকিছুর মধ্যেই প্রভাব ফেলবে।
তাই এখন থেকেই যারা জিইও-কেন্দ্রিক কৌশল গ্রহণ করবে, ভবিষ্যতের সার্চ রেভোলিউশনে নেতৃত্ব দেবে তারাই।
উপসংহার
জেনারেটিভ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন (জিইও) শুধু নতুন ট্রেন্ড নয়- এটি ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের পরবর্তী অধ্যায়।
এসইও যেমন আপনাকে সার্চ রেজাল্টে নিয়ে যায়, জিইও তেমনি আপনাকে নিয়ে যাবে এআই–এর উত্তরে।
‘ভবিষ্যতের সার্চে র্যাংক নয়, ব্র্যান্ডের বিশ্বাসযোগ্যতাই হবে সাফল্যের আসল মাপকাঠি।’
লেখক: হেড অব ওয়েব অ্যানালাইসিস অ্যান্ড এসইও ডিরেক্টর, ইন্টেলেক আইটি এলএলসি (ইউএসএ অ্যান্ড বাংলাদেশ)
ঢাকা/ফিরোজ