বাংলাদেশে সরকারের উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয় উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে। কিন্তু দেখা যায়, উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে ঘন ঘন মেয়াদ বৃদ্ধি ও সংশোধনের প্রয়োজন হয়। এর অন্যতম কারণ হলো উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) প্রণয়নে তাড়াহুড়া করা, উত্তোলিত অর্থের ব্যয় সক্ষমতা ও কাজের অগ্রগতির ফলোআপ না থাকা। এতে সরকারের নেওয়া বিভিন্ন বার্ষিক উন্নয়ন প্রকল্পের (এডিপি) মোট ব্যয়ের প্রায় ২ শতাংশ লস হয়।

এ তথ্য পাওয়া গেছে ড.

রনজিৎ কুমার সরকারের ‘প্রকল্পের মেয়াদ নির্ণয়, ভৌত অগ্রগতি পরিমাপ এবং সময়ের দক্ষতা পরিমাপ’ লেখা থেকে। ড. সরকার আরও জানান, ডিপিপি প্রণয়নে সবচেয়ে দুর্বল দিক হলো কর্মপরিকল্পনা না করে ডিপিপি প্রণয়ন করা। ডিপিপি প্রণয়নের যে জিনিসগুলো মনে রাখা দরকার, তা নিয়ে আলোচনা নিচে পেশ করা হলো।

মোট কর্মপরিকল্পনা ও মেয়াদকাল

কর্মপরিকল্পনা হলো একটি প্রকল্পের হৃৎপিণ্ড। প্রকল্পের কোন অংশে কী কী কাজ করা প্রয়োজন এবং সেসব শেষ করতে কত সময় লাগতে পারে, তা দেখানো থাকে লগ ফ্রেম বা কর্মপরিকল্পনা ছকে। অধিকাংশ প্রকল্প প্রণয়নের সময় মোট কর্মপরিকল্পনা করে ডিপিপি প্রণয়ন করা হয় না। ফলে প্রকল্প প্রণয়নের সময় সঠিক মেয়াদকাল নির্ণয় করা প্রায় অসম্ভব হয়। সঠিক মেয়াদকাল নির্ণয় না করার ফলে প্রকল্প শেষ হতে দীর্ঘসূত্রতা হয়।

ভৌত অগ্রগতির পরিমাণ

একটি প্রকল্পে গড়ে সাধারণত ৭০ শতাংশ বিনিয়োগ ও ৩০ শতাংশ পরিচালনা ব্যয় হয়ে থাকে। দেখা যায়, মোট বিনিয়োগের অর্ধেকের বেশি ব্যয় হয় ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন ও তদারকিতে। এ কাজ যত দ্রুত হয়, প্রকল্প পরিচালনা ব্যয় তত সাশ্রয় হয়। আমাদের দেশে পেশ করা ডিপিপিগুলোতে ভৌত অগ্রগতি পরিমাপের কোনো জুতসই পরিমাপক বা মানদণ্ড না থাকায় আনুমানিক পদ্ধতি বা যে সূত্রটি ব্যবহার করা হচ্ছে, তা সঠিক নয়। দৃশ্যত এখানে আর্থিক অগ্রগতির সঙ্গে সমন্বয় করে বাস্তব অগ্রগতি দেখা হয় বলে আশানুরূপ ফল পাওয়া যায় না। তাই ভৌত অগ্রগতি পরিমাপের সুনির্দিষ্ট পরিমাপক বের করা এখন সময়ের দাবি।

অভিজ্ঞতা

আমাদের দেশে টপ-ডাউন অ্যাপ্রোচে বা ওপর থেকে চুইয়ে পড়া পদ্ধতিতে প্রকল্প প্রণয়ন করা হয়। সহজ কথায়, টাকা কীভাবে খরচ হবে, তা দেখানো হয়। কিন্তু সত্যিকার প্রজেক্ট পরিকল্পনায় যা থাকা উচিত, তা হলো সমস্যা কী, সমস্যার কতটুকু ইতিমধ্যে স্পর্শ করা হয়েছে, কী পদ্ধতিতে তা সমাধান করা হয়েছিল, এখন কী করা দরকার, কীভাবে ও কাজের পর্যায় কী হবে? পেশ করা প্রকল্পের ব্যয় কীভাবে কোন তরিকায় ধরতে হবে? আউটপুট কী আসবে? ভবিষ্যৎ ভাবনায় তা কি ইতিবাচক ফল আনবে? সোজা কথায় দক্ষ, অভিজ্ঞ এবং বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করার সক্ষমতা যাচাই করে ৫০ কোটি বা একনেকে পাস হওয়ার মতো ডিপিপিগুলো ছাড় দেওয়া দরকার।

অযাচিত ঝামেলা

প্রকল্পের সময় যত বাড়ে, পদে পদে ভোগান্তি তত বাড়ে। যেনতেনভাবে প্রকল্পটি দাঁড় করানোর ফলে বিষয়ভিত্তিক মন্ত্রণালয়/বিভাগ বা সংস্থায় ফাইলটি পাস করতে অনেক সময় নেওয়া হয় (আদর্শ অনুমোদন সময় ১৬৭ দিন)। অনেক সময় বিশেষজ্ঞ মতামত নিতে হয় প্রকল্পের সংশোধনের প্রয়োজন হলে। বিভিন্ন পর্যায়ে প্রেজেন্টেশনের সময় যদি প্রকল্পটি স্বব্যাখ্যায়িত হয়, লজিস্টিক সাপোর্ট কম লাগে, যথাযথ নিয়ম নীতি প্রয়োগ করা হয়ে থাকে, তবে ঝামেলা কম পোহাতে হয়।

বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমডি) মনিটরিং ফরমেট সংশোধন

আইএমইডির মোট পাঁচটি ফরমেট রয়েছে। এর মধ্যে চারটি ফরমেটের মাধ্যমে প্রকল্পের বাস্তবায়নকালের অগ্রগতির তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এসব ফরমেট পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, যেকোনো ফরম্যাট প্রকল্পের মোট বাস্তব অবস্থা বা ভৌত অগ্রগতি পরিমাপের তথ্য সংগ্রহের ব্যবস্থা নেই। এ ছাড়া ফরমেটের মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে মোট অগ্রগতি পরিমাপ করা যায় না। তাই আইএমইডির ছকসমূহ সংশোধন ও অধিকতর উন্নয়নের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হোক।

শেষ কথা হলো, প্রতিটি ডিপিপির টাকা আসে নাগরিকদের আয়করের অংশ বা বৈদেশিক লোন দিয়ে। এ টাকা দিনশেষে টানতে হবে আমাদের সবাইকে। তাই সঠিক ভৌত অগ্রগতি নিরূপণ, সময়ের সদ্ব্যবহার, আর্থিক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি এবং প্রকল্পসংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অযাচিত চাপ রোধই পারে ডিপিপি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন।

ড. মো. আবুল কালাম আজাদ গবেষক ও অধ্যাপক, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: প রকল প প প রকল প র প রণয়ন পর ম প সরক র ফরম ট র সময়

এছাড়াও পড়ুন:

কর অব্যাহতির রাস্তা সামনে কঠিন হবে

কর অব্যাহতির বিষয়ে নীতি প্রণয়ন করা হবে জানিয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান বলেছেন, ব্যবসায়ীরা শুধু করছাড় চাচ্ছেন। তবে সামনে কর অব্যাহতির রাস্তা কঠিন হয়ে যাবে। গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর পল্টনে ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের (ইআরএফ) অডিটোরিয়ামে ‘সামষ্টিক অর্থনীতির দৃষ্টিভঙ্গি এবং রাজস্ব ব্যবস্থা’ শীর্ষক সেমিনারে এমন মন্তব্য করেন তিনি। সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ড. মাসরুর রিয়াজ।
এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, অর্থ উপদেষ্টা নির্দেশনা দিয়েছেন কর অব্যাহতি বিষয়ে নীতি তৈরি করতে। সেই নীতি আইনে প্রতিফলিত হবে। এ ক্ষেত্রে এনবিআরের প্রস্তাব হলো, সরকার কিংবা এনবিআর কোনো কর অব্যাহতি দিতে পারবে না। এ ক্ষমতা যাবে সংসদের হাতে। এর মানে হলো— কারও সঙ্গে একটু ভালো সম্পর্ক হলে অথবা বোঝাতে সক্ষম হলে কর অব্যাহতি পেয়ে যাবে– এমনটা থাকছে না। কর অব্যাহতির রাস্তা সামনের দিনে কঠিন হয়ে যাবে। এই ধরনের নীতি প্রণয়নের দিকে যাচ্ছে সরকার। 
তিনি বলেন, দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়াতে এতদিন ব্যাপক কর অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে এর দরকারও ছিল। এখন নতুন করে ভাবতে হবে। রাজস্ব আয়ের চেয়ে ব্যয় অনেক বেশি। দেশের চাহিদা মেটানোর মতো রাজস্ব আয় হচ্ছে না। রাজস্ব কম কেন– সেই প্রশ্নও তুলছে জনগণ। এসব জায়গায় আরেকটু সচেতন হলে আগামী বাজেটের আকার কিছুটা ছোট হতে পারে। 
এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, রাজস্ব আয়ের মধ্যে পরোক্ষ করের পরিমাণ অনেক বেশি, যা সভ্য দেশের লক্ষণ নয়। প্রত্যক্ষ কর আদায় বাড়াতে হবে। যে পরিমাণ কর আদায় করার কথা ছিল, তা হচ্ছে না। করযোগ্য সবার থেকে কর আদায় করতে না পারার কারণে করজাল সংকুচিত। কর আদায় বাড়ানোর বিষয়ে নতুন করে ভাবা হচ্ছে। 
এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, একদিকে আয় বাড়ানো, অন্যদিকে নীতি-সহায়তা দেওয়ার মধ্যে ভারসাম্য আনা বড় চ্যালেঞ্জ। সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো সুশাসনের ঘাটতি। যার যে কাজ করা দরকার, তিনি তা করছেন না। ফলে পদে পদে ভোগান্তি হচ্ছে। সে জন্য আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা জরুরি। এ বিষয়ে কাজ চলছে। 
তিনি বলেন, অর্থনীতির খারাপ সময়েও রাজস্ব আদায় আগের চেয়ে বাড়ছে। এপ্রিলে প্রবৃদ্ধি আরও ভালো হবে। যারা কর দিচ্ছেন না, তাদের নোটিশ করা হচ্ছে। আগামী বছর থেকে কোম্পানির কর রিটার্ন অনলাইনে দাখিলের নিয়ম করা হবে। 
মাসরুর রিয়াজ বলেন, রমজানের আগে নিত্যপণ্যে করছাড়, পর্যাপ্ত আমদানি এবং সরবরাহ পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় খাদ্য মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমেছে। গত জুলাইয়ের আগ পর্যন্ত টাকা ছাপিয়ে যেভাবে ব্যাংকে তারল্য সহায়তা দেওয়া হয়েছে, এখন তা কমে আসছে। টাকা পাচার কমেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ডলার বিক্রি কমেছে। এর ফলে রিজার্ভ ইতিবাচক। তিনি বলেন, যারা ১৫ থেকে ২০ বছর ধরে কর অব্যাহতি পেয়ে আসছেন, তাদের বিষয়ে এনবিআরকে নতুন করে ভাবা দরকার। 
সেমিনারে আরও বক্তব্য দেন ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির নির্বাহী পরিচালক নুরুল কবীর। ইআরএফ প্রেসিডেন্ট দৌলত আক্তার মালা সভাপতিত্ব করেন। সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম সঞ্চালনা করেন। 

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • যে পন্থীই হোন না কেন, একাত্তর আমার ইতিহাসের অংশ: ফরহাদ মজহার
  • বিভিন্ন সম্প্রদায়ের হারিয়ে যাওয়া ভাষা সংরক্ষণের তাগিদ পার্বত্য উপদেষ্টার
  • কর অব্যাহতির রাস্তা সামনে কঠিন হবে
  • দেশের সব পলিটেকনিকে ইনস্টিটিউটে শাটডাউন কর্মসূচি
  • নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করল কারিগরি শিক্ষার্থীরা
  • চট্টগ্রামে হকারদের পুনর্বাসন ও ট্রেড লাইসেন্সের দাবি
  • ‘সড়ক নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন ছাড়া সড়ক সংস্কার সম্ভব নয়’