মুসলিম সভ্যতায় খাওয়ার সংস্কৃতি কথা তখনকার সাহিত্যকে প্রভাবিত করেছে। সাহিত্যিকদের অনেকে রান্নার স্বাদ, রস ও প্রকার বিভিন্ন উপমায় বর্ণনা করেছেন। অনেকে ভোজনশালার পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করেছেন চটুল ও রহস্যময় বর্ণনায়। কেউ কেউ বুদ্ধিবৃত্তিক সমালোচনাও করেছেন। তাঁদের বইয়ে রান্নার সঠিক নিয়ম কী হওয়া উচিত এবং সুস্বাদু খাবারের পূর্বশর্ত কী, তা অনুসন্ধান করেছেন। আবু বাকার আল-রাযির (৩১১ হিজরি, ৯২৩ খ্রিষ্টাব্দ) মুনাফি আল-গিজা ওয়াদাফিউল আযমারাহ এ বিষয়ে একটি অনন্য গ্রন্থ।
বাগদাদি লেখক ‘মিসাল বাগদাদ’ বাগদাদের রন্ধনশিল্পের বিশালতা কাব্যিক ঢঙে বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘যেখানে কালো সিসা রুটির ওপর ছড়িয়ে দেওয়া ছিল, সেটি দেখলে মনে হতো যেন পূর্ণ চাঁদ, এবং তার স্বাদ এত মিষ্টি ছিল যেন এক গ্রাসে খেয়ে ফেলা যেত।’
ইবন তাইফুর মারভেজি (২৮০ হিজরি, ৮৯৩ খ্রিষ্টাব্দ) তাঁর কিতাব বাগদাদ গ্রন্থে মাওমুন নামে এক বাগদাদি বিশেষজ্ঞের বাড়িতে খাবারের সময়ে উপস্থিত ছিলেন। তিনি সেখানে কী কী দেখেছেন, তার সরস বর্ণনা দিয়েছেন। সে সময় মাওমুনের অতিথিশালায় প্রায় তিন শ ধরনের খাবার পরিবেশন করা হয় এবং মাওমুন প্রতিটি খাবারের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করে বোঝান।
আরও পড়ুনমন্দ প্রবৃত্তি নিয়ন্ত্রণের উপায়০৬ এপ্রিল ২০২৫বাদশাদের মতো অনেক মন্ত্রীদেরও খাবারের প্রতি আগ্রহ ছিল গভীর। জাহাজি (২১৬ হিজরি, ৮৩১ খ্রিষ্টাব্দ) একটি উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করেন, পারস্যের গভর্নর আমর ইবন লাইস তার ব্যক্তিগত রন্ধনশালায় সাড়ে ছয় শ উট ব্যবহার করতেন। এগুলো ছিল মন্ত্রীর প্রাসাদে খাবার প্রস্তুত করার জন্য প্রয়োজনীয় উপাদানের বিশাল নির্দেশ।
এ ছাড়া বিশেষজ্ঞদের উপস্থিতিতে খাবার প্রতিযোগিতার কথাও শোনা যায়। এই ধরনের প্রতিযোগিতা কেবল যে খাবার প্রস্তুতির জন্য ছিল তা নয়, এটি ছিল একটি আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিক ধারণা ছিল, যেখানে রান্নার শৈলী ও খাবারের বৈচিত্র্য চিহ্নিত করার উদ্যোগ নেওয়া হতো।
কঠোর নজরদারি ও মান নিয়ন্ত্রণ
ইসলামি সভ্যতায় রেস্তোরাঁয় ও খাদ্য উৎপাদনে কঠোর নজরদারি চালানো হতো। খাদ্যে ভেজাল প্রতিরোধ, তৈরির পাত্রের পরিচ্ছন্নতা, রাঁধুনির ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য, উপকরণের বিশুদ্ধতা—এসব ছিল বাধ্যতামূলক।
আলাদা চুলা: আলাদা খাবারের জন্য আলাদা চুলা বরাদ্দ থাকত। যেমন যেখানে মাছ ভাজা হয়, সেখানে রুটি বানানো নিষেধ ছিল। তেল বারবার ব্যবহার করাও নিষিদ্ধ ছিল।
অপ্রাপ্তবয়স্ক সরবরাহকারী: একটি মজার তথ্য হলো—যেসব রুটি বিক্রেতা ‘সরবরাহকারী’ রাখত, তাদের বলা হতো অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলেদেরই নিয়োগ দিতে, যাতে তারা গৃহস্থালির নারীদের সামনে যাওয়া হলেও কোনো সামাজিক অস্বস্তি না হয়।
আরও পড়ুনসুরা সাফে মন্দ আচরণ নিয়ে আল্লাহর বক্তব্য৩১ জুলাই ২০২৩ওজনে কারচুপি: তখন বেশির ভাগ খাবার বিক্রি হতো ওজনে। তাই ওজনে কারচুপি ঠেকাতে ‘মুহতাসিব’ বা বাজার তদারকি কর্মকর্তারা নজরদারি করতেন। যেমন, মাংস রান্নার আগে-পরে ওজন করে দেখা হতো, যেন অতিরিক্ত শুকিয়ে না যায় বা ভেতরে লোহা জাতীয় কিছু ঢুকিয়ে ওজন না বাড়ানো হয়।
ভেজাল-নিরোধ: বিভিন্ন ভেজালের কৌশলও ধরা পড়েছে। কেউ কেউ কিমার ভেতরে ভুঁড়ি, পেঁয়াজ ও বুটলতাও ঢুকিয়ে দিত। কেউবা সমুচার ভেতরে মাছ ও মসলা দিয়ে মাংসের বিকল্প বানাত। এগুলো ধরা হতো ভাজনের আগেই কেটে দেখে।
রসায়ন ব্যবহার: এক ধরনের খাদ্যভিত্তিক ‘রাসায়নিক ভেজাল’ও ছিল। রঙিন মাংস বানানো হতো আসল মাংস ছাড়াই। কলিজা, ডিম, এমনকি মধু বা চিনি ছাড়া মিষ্টিও তৈরি হতো। একজন প্রাচীন চিকিৎসক—ইবন আল-কিন্দি—এমন প্রযুক্তির উল্লেখ করেন তাঁর কেমিস্ট্রি অব কুকিং বইতে। তবে এসব গোপন রাখা হতো, যাতে কেউ শিখে অনৈতিকভাবে না ব্যবহার করে।
ফাতেমি যুগে নারী রাঁধুনিরাও (দাসী) ছিলেন বিশিষ্ট। কেউ কেউ ৮০ রকম ভাজাভুজি বানাতে পারতেন। এমন দক্ষতা দেখে এক তুর্কি রাজা তাঁর রাঁধুনিদের কায়রোতে পাঠিয়ে প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন।
আরও পড়ুনশয়তানের মন্দ প্ররোচনা থেকে বাঁচার দোয়া২৭ এপ্রিল ২০২৩আধুনিক রান্নার আগমনী
বিখ্যাত ‘বিফ বোর্গুইনিয়ন’ ফরাসি রান্না, যা ধীরে ধীরে রান্না করা হয়, সেটি ৭০০ বছর আগেই আরব অঞ্চলে প্রচলিত ছিল ‘স্কবাজ’ নামে। এতে মাংস, মসলা, খেজুরের রস ও জাফরান দিয়ে ট্যানুরে সারা রাত রান্না হতো।
রমজান উপলক্ষে নানা খাবার, যেমন: কাতায়েফ, হরিরা, কুসকুস, সামোসা, লুকাইমাত (লালমোহন জাতীয় মিষ্টি) ও সোবিয়া (একধরনের মিষ্টি পানীয়)—এই সব খাবার বহু শতাব্দী ধরে প্রচলিত।
আন্দালুসীয়রা খাবার একসঙ্গে পরিবেশন করতেন না। একে একে পরিবেশন করতেন—প্রথমে ডাল, তারপর মিষ্টি, মাঝে মাঝে আচার, সবশেষে পুনরায় মিষ্টি। এ রেওয়াজ এখনো মরক্কোসহ কিছু অঞ্চলে প্রচলিত।
ইরাকের সংগীতজ্ঞ জেরিয়াব শুধু সুর নয়, খাবারের রুচিতেও বিপ্লব এনেছিলেন আন্দালুসিয়ায়। তিনি খাবারের পরিবেশনা, থালার সাজসজ্জা, গ্লাসের ব্যবহার (সোনা-রুপার বদলে কাচের), ও চামচ-কাঁটা ছুরি ব্যবহারে সৌন্দর্যবোধের পরিচয় দেন। তাঁর কৌশল পরবর্তীতে ইউরোপেও ছড়িয়ে পড়ে।
খাদ্য শুধু পেট ভরানোর বিষয় নয়, বরং তা সংস্কৃতি, স্বাস্থ্য, সৌন্দর্য ও নৈতিকতারও বহিঃপ্রকাশ। ইসলামি সভ্যতার রন্ধনশৈলী আমাদের শিখিয়ে দেয়—ভালো খাবার মানে বিশুদ্ধতা, রুচিশীলতা এবং সামাজিক সচেতনতার এক অনন্য মিশেল।
আলজাজিরা ডট নেট অবলম্বনে
আরও পড়ুনঅহংকারের পরিণতি মন্দ২৬ মার্চ ২০২৪.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ব যবহ র কর ছ ন করত ন
এছাড়াও পড়ুন:
বাংলাদেশ পরিবর্তনের মধ্যে রয়েছে: আইরিন খান
জাতিসংঘের মুক্তচিন্তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাবিষয়ক বিশেষ র্যাপোর্টিয়ার আইরিন খান বলেছেন, ‘আমাদের যে বিষয়গুলো মনে রাখতে হবে, তার একটি হলো ঠিক এই মুহূর্তে বাংলাদেশ একটি স্বাভাবিক গণতন্ত্রের দেশ নয়। এখানে গণতন্ত্র চলছে না। কার্যত এটা পরিবর্তনের মধ্যে রয়েছে।’
টেক গ্লোবাল ইনস্টিটিউট (টিজিআই) আয়োজিত এক ওয়েবিনারে আইরিন খান এ কথা বলেন। বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে গত বুধবার ‘আইন থেকে অধিকার: বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক উত্তরণে ডিজিটাল স্বাধীনতার সুরক্ষা’ শীর্ষক এ ওয়েবিনারের আয়োজন করা হয়। গতকাল রোববার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।
ওয়েবিনারে বিদ্যমান ও নতুন সাইবার আইন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া এবং নাগরিকদের ওপর নজরদারিসহ ডিজিটাল সুশাসন-সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় ও উদ্বেগ নিয়ে আলোচনা হয়। টিজিআই–এর সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ১৫ বছরে বাংলাদেশ রাষ্ট্রীয়ভাবে নজরদারি সরঞ্জাম কেনার জন্য ১৯ কোটি ডলারের বেশি অর্থ ব্যয় করেছে।
ওয়েবিনারে সূচনা বক্তব্য দেন টিজিআই–এর নির্বাহী পরিচালক সাবহানাজ রশীদ দিয়া। গত বছরের জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের পর থেকে বাংলাদেশে বেশ কিছু সংস্কার হয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি। সাবহানাজ রশীদ বলেন, ‘আমরা দেখেছি, গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের মতো বিষয়গুলোর ব্যাপারে কিছু উল্লেখযোগ্য তদন্ত, কমিশন ও প্রক্রিয়া করা হয়েছে। কিন্তু একই সঙ্গে আমরা নির্বিচার গ্রেপ্তার হতেও দেখেছি।’
টিজিআই–এর নির্বাহী পরিচালক বলেন, ‘গত কয়েক মাসে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনের প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে। অতীতে আমাদের বিশ্লেষণে আমরা দেখেছি, এই আইন বাংলাদেশে নজরদারির সবচেয়ে সহায়ক এবং একই সঙ্গে এটি মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জন্য একটি বড় বাধা হিসেবে কাজ করেছে।’
আলোচনায় বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের পরিস্থিতি ও নিরাপত্তা খাতের বিষয়গুলো নিয়ে আইরিন খান বলেন, ‘আমাদের একটি অন্তর্বর্তী সরকার আছে, যার কর্তৃত্ব সীমিত। আমাদের একটি নিরাপত্তা খাত আছে; এই একটি মাত্র খাতে অভ্যুত্থান ও পরিবর্তনের কোনো প্রভাব পড়েনি। তাই এ ধরনের পরিস্থিতিতে নিরাপত্তা খাতে সংস্কার নিশ্চিত করতে আমরা কী করতে পারি?’
জাতিসংঘের বিশেষ এই র্যাপোর্টিয়ার বলেন, ‘এই রূপান্তর বাস্তবায়নের জন্য নিরাপত্তা খাতকেই সহায়তা করতে এগিয়ে আসতে হবে (বর্তমান সরকারকে)। এখনো তাদের কাছে সব ধরনের (নজরদারি) সরঞ্জাম রয়েছে। আর সে কারণে পরবর্তী সরকারের নেতৃত্ব কে দেবে, তা নির্ধারণে অন্য সবার চেয়ে তাদের বাড়তি সুবিধা রয়েছে।’
পরবর্তী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে ডিজিটাল পরিসরে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষায় বর্তমান সরকার কী করতে পারে, সে বিষয়ে আলোচনায় আইরিন খান বলেন, ‘ডিজিটাল নিয়ে ভাবুন। আমি মনে করি না, সরকার তা করছে। তবে অন্য সবাই ডিজিটাল নিয়ে ভাবছে। তাই সরকারের ডিজিটাল নিয়ে এবং ডিজিটাল পরিসরে কীভাবে কাজ করবে, সে বিষয়ে ভাবা দরকার। (ইন্টারনেট) কোম্পানিগুলোকে ডাকুন, তাদের সঙ্গে কথা বলুন এবং ডিজিটাল পরিসর কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা মানুষকে এবং রাজনৈতিক দলগুলোকেও বুঝতে দিন।’
আলোচনায় অংশ নিয়ে যুক্তরাজ্যভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা আর্টিকেল নাইনটিনের প্রোগ্রাম অফিসার ডায়নাহ ফন ডার গেস্ট বলেন, ‘আমি মনে করি, নজরদারি নিজে থেকে অবৈধ নয়। সর্বত্র রাষ্ট্রগুলোর জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, অপরাধের তদন্ত করা এবং নাগরিকদের সুরক্ষা দেওয়ার দায়িত্ব রয়েছে। কিন্তু নজরদারি যখন ব্যাপক, অস্বচ্ছ ও অনিয়ন্ত্রিত হয়ে যায়, তখন তা একটি বিপজ্জনক সীমা অতিক্রম করে।’
ওয়েবিনারে বলা হয়, বাংলাদেশের পরবর্তী জাতীয় নির্বাচন যত এগিয়ে আসছে, ডিজিটাল স্বাধীনতা যেমন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, তথ্যে প্রবেশাধিকার এবং অনলাইনে নাগরিকদের অংশগ্রহণ নিয়ে আলোচনা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি জরুরি হয়ে উঠেছে। এই প্রেক্ষাপটে সাইবার আইন ও এর প্রয়োগের ফলে সৃষ্ট চ্যালেঞ্জ; ডিজিটাল পরিসরে গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করা এবং মানুষের অধিকার সুরক্ষায় সংস্কারের সম্ভাবনা নিয়ে এতে আলোচনা হয়েছে।