ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের বয়স হয়েছে। এখন তাঁর উত্তরসূরি বেছে নিতে চাপে বাড়ছে প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের (পিএলও) ওপর। এ অবস্থায় ২৪ এপ্রিল জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের সঙ্গে একটি বৈঠক শেষে পিএলও ভাইস প্রেসিডেন্ট নামে নতুন এক পদ সৃষ্টি করেছে।

ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের (পিএ) প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস গত মার্চে একটি ভাইস প্রেসিডেন্ট পদ সৃষ্টির প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। মার্চের শুরুতে এক জরুরি আরব সম্মেলনে তিনি এই প্রতিশ্রুতি দেন।

আব্বাসের পর পিএ প্রেসিডেন্ট কে হবেন, তা নিয়ে ক্ষমতার লড়াই বন্ধ করতে ভাইস প্রেসিডেন্টের পদ সৃষ্টি করা হয়েছে। কারণ, ইসরায়েল এমন পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে পিএকে শেষ করে দিতে পারে। এমনকি ইসরায়েল অধিকৃত পশ্চিম তীরের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিতে ও গাজায় জাতিগত নির্মূল অভিযান চালাতে পারে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

যদিও কানাডীয় আইনজীবী ডায়ানা বুট্টু বলেছেন, আব্বাস চলে যাওয়ার পর পিএতে ভাইস প্রেসিডেন্ট পদ তৈরি করলেও ক্ষমতার দ্বন্দ্ব এড়ানো যাবে না; বরং এটি সংঘাতকে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে। আইনজীবী ডায়ানা পিএলওর আইনবিষয়ক পরামর্শক ছিলেন।

ডায়ানা সতর্ক করে আরও বলেছেন, ‘পিএ যত বেশি খণ্ডিত হবে, তত বেশি ক্ষমতার শূন্যতা তৈরি হবে.

..এবং বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের মতো বাইরের শক্তি দিয়ে সেই শূন্যতা পূরণ হতে পারে।’

আব্বাসের পর ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের প্রেসিডেন্ট কে হবেন, তা নিয়ে ক্ষমতার লড়াই বন্ধ করতে ভাইস প্রেসিডেন্টের পদ সৃষ্টি করা হয়েছে। কারণ, ইসরায়েল এমন পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে এই কর্তৃপক্ষকে শেষ করে দিতে পারে। এমনকি ইসরায়েল অধিকৃত পশ্চিম তীরের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিতে ও গাজায় জাতিগত নির্মূল অভিযান চালাতে পারে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।বৈধতার সংকট

মাহমুদ আব্বাসের বয়স এখন ৮৯ বছর। ২০০৪ সালের নভেম্বরে ফিলিস্তিনের অবিসংবাদী নেতা ইয়াসির আরাফাতের মৃত্যুর পর আব্বাস পিএলও এবং পিএর নিয়ন্ত্রণ নেন। ২০০৭ সালে ফিলিস্তিনি পার্লামেন্ট বিলুপ্ত ঘোষণা করার পর জনমত যাচাই ছাড়াই আব্বাস ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। পিএ এবং পিএলও জোটে তাঁর ফাতাহ পার্টি সবচেয়ে প্রভাবশালী।

দীর্ঘদিন ধরে বিলুপ্ত থাকায় পিএ পার্লামেন্ট এখন অনেকটাই ম্লান হয়ে গেছে। সমালোচকেরা এমন পরিস্থিতির জন্য আব্বাসকে দায়ী করেন। তাঁরা মনে করেন, পার্লামেন্টকে পুনরুজ্জীবিত করতে নির্বাচন অনুষ্ঠানের যে প্রচেষ্টা হয়েছিল, আব্বাস তা দুর্বল করে দিয়েছেন। পার্লামেন্ট না থাকায় পিএলওর প্রেসিডেন্টের উত্তরসূরি নির্বাচন করার কথা। কিন্তু আব্বাস এ কাজটি স্থগিত রেখেছেন। এমনকি তিনি গত বছর একটি ডিক্রি জারি করে বলেছেন, কোনো কারণে যদি হঠাৎ প্রেসিডেন্টের পদ খালি হয়, তবে নির্বাচনের আগ পর্যন্ত যেন একজন অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট দায়িত্ব পালন করেন। অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট হবেন প্যালেস্টিনিয়ান ন্যাশনাল কাউন্সিলের প্রধান রাওহি ফাত্তৌহ।

জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর কনটেম্পোরারি আরব স্টাডিজের শিক্ষক খালেদ এজিন্দি বলেন, ‘যদি কাউকে সামনে নিয়ে আসেন, তবে তিনি তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠতে পারেন—এই আশঙ্কা থেকে আব্বাস এ (উত্তরসূরি নির্বাচন) উদ্যোগ স্থগিত রেখেছেন।’

অসলো শান্তি চুক্তি দিয়ে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ (পিএ) গঠিত হয়েছিল। ফিলিস্তিনি নেতা ইয়াসির আরাফাত এবং ইসরায়েলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী আইজ্যাক রবিন ১৯৯৩ ও ১৯৯৫ সালে ওই চুক্তিতে সই করেন।

যদি কাউকে সামনে নিয়ে আসেন, তবে তিনি তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠতে পারেন, এ আশঙ্কা থেকে আব্বাস এই (উত্তরসূরি নির্বাচন) উদ্যোগ স্থগিত রেখেছেন।খালেদ এজিন্দি, জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক

পিএ সরকারের দায়িত্ব ছিল ইসরায়েলের পাশাপাশি একটি ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠিত না হওয়া পর্যন্ত তারা পশ্চিম তীর ও গাজা শাসন করবে। কিন্তু পিএ গঠিত হওয়ার পর ইসরায়েলের দখলদারি আরও বেড়ে যায় এবং তারা নিপীড়নও বাড়িয়ে দেয়। অবৈধ ইহুদি বসতি স্থাপনের জন্য ইসরায়েল ফিলিস্তিনি ভূমি দখলও অব্যাহত রাখে।

অসলো চুক্তির পর ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইহুদি বসতি স্থাপনকারীর সংখ্যা ২ লাখ থেকে বেড়ে সাড়ে ৭ লাখে পৌঁছেছে। অথচ আন্তর্জাতিক আইনে ইহুদিদের এই বসতি স্থাপন অবৈধ।

২০০৭ সালে গাজার শাসকগোষ্ঠী হামাসের সঙ্গে একটি সহিংস বিভাজনের ফলে অধিকৃত পশ্চিম তীরের কিছু অংশে পিএর কর্তৃত্ব সীমিত হয়ে পড়ে। আন্তর্জাতিক মঞ্চেও পিএ নিজেদের ফিলিস্তিনের একক প্রতিনিধি হিসেবে তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছে।

ফিলিস্তিনিদের মধ্যেও আব্বাসের জনপ্রিয়তা হ্রাস পেয়েছে। কারণ, ফিলিস্তিনি জনগণের ওপর নিপীড়ন যখন দিন দিন বাড়ছে, তখন পিএ ইসরায়েলের সঙ্গে নিরাপত্তা সমন্বয় অব্যাহত রেখেছে।

ইসরায়েলি সেনা ও ইহুদি বসতি স্থাপনকারীদের হাত থেকেও পিএ ফিলিস্তিনিদের রক্ষা করতে পারছে না। অন্যদিকে বেসামরিক জনগণের বিক্ষোভ ও বিরোধীদের দমনে নিপীড়ন চালাচ্ছে পিএ।

এজিন্দি বলেন, ফলে এমন এক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে যে আব্বাস যাঁকেই তাঁর উত্তরসূরি হিসেবে বেছে নেন, তিনি খুব সম্ভবত জনগণের মন জয় করতে পারবেন না। আব্বাসের পছন্দের উত্তরসূরি হিসেবে যাঁর নাম প্রায়ই শোনা গেছে, তিনি হলেন পিএলও নির্বাহী কমিটির মহাসচিব হুসেইন আল-শেখ।

মাহমুদ আব্বাসের বয়স এখন ৮৯ বছর। ২০০৪ সালের নভেম্বরে ফিলিস্তিনের অবিসংবাদী নেতা ইয়াসির আরাফাতের মৃত্যুর পর আব্বাস পিএলও এবং পিএর নিয়ন্ত্রণ নেন। ২০০৭ সালে ফিলিস্তিনি পার্লামেন্ট বিলুপ্ত ঘোষণা করার পর জনমত যাচাই ছাড়াই আব্বাস ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। পিএ এবং পিএলও জোটে তাঁর ফাতাহ পার্টি সবচেয়ে প্রভাবশালী।

আল-শেখ পিএর জেনারেল অথরিটি ফর সিভিল অ্যাফেয়ার্সেরও প্রধান। পিএর এই অধিদপ্তর থেকে ইসরায়েল অনুমোদিত পারমিট দেওয়া হয়। অল্প কয়েকজন ফিলিস্তিনি এ পারমিট পান ও পশ্চিম তীরে বিনা বাধায় ভ্রমণ করতে পারেন। ইসরায়েল অধিকৃত এ অঞ্চলে ফিলিস্তিনিদের চলাচলের ওপর নানা বিধিনিষেধ আরোপ করে রেখেছে।

নানা মানবাধিকার সংগঠন ও আন্তর্জাতিক বিচার আদালত ফিলিস্তিনিদের ওপর আরোপ করা ইসরায়েলের ওই বিধিনিষেধকে বর্ণবাদ বলে সংজ্ঞায়িত করেছে।

বাইরের চাপ

অনেক বছর ধরেই আব্বাসের ওপর উত্তরসূরি নির্বাচনের চাপ তেমন একটা ছিল না। তবে গত কয়েক মাসে আরব দেশগুলো একজন উত্তরসূরি নির্বাচনের জন্য আব্বাসের ওপর চাপ বাড়িয়েছে। রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার মধ্যে পড়ে পিএ বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া আটকাতেই আরব দেশগুলো এ চাপ দিচ্ছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা। বিশেষ করে মিসর আব্বাসের একজন উত্তরসূরি নিশ্চিত করতে উদ্‌গ্রীব।

এ জন্য মার্চে মিসর আরব লিগের একটি জরুরি সম্মেলন ডাকে। মিসরে ওই সম্মেলনে গাজা কীভাবে পুনর্গঠন করা হবে সেই পরিকল্পনা প্রকাশ করা হয়।

প্রস্তাবিত পরিকল্পনায় গাজায় পিএর নজরদারিতে একটি ফিলিস্তিনি টেকনোক্র্যাট প্রশাসন গঠনের কথা বলা হয়। ওই প্রশাসন কাউকে বাস্তুচ্যুত না করে গাজা পুনর্গঠনের কাজ করবে।

আরও পড়ুনহামাসকে ভাষায় প্রকাশযোগ্য নয়, এমন গালি দিলেন ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট আব্বাস২৪ এপ্রিল ২০২৫

যদিও গাজায় পিএর চলার পথ মোটেও মসৃণ হবে না। হামাস ও ইসরায়েল উভয় পক্ষ থেকেই বাধা আসবে। হামাস এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে গাজার প্রশাসক। গাজা নিয়ে ইসরায়েলেরও পরিকল্পনা রয়েছে।

অনেক আরব দেশ হামাসের সঙ্গে ফাতাহর বিরোধ মিটমাটে ব্যর্থতার জন্য আব্বাসকে দায়ী করেন। যে কারণে আরব দেশগুলো পিএর নেতৃত্বে পরিবর্তন আনতে উদ্‌গ্রীব হয়ে উঠেছে বলে মনে করেন তাহানি মুস্তফা।

তাহানি ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের ফিলিস্তিন আন্তরাজনীতি বিষয়ের একজন বিশেষজ্ঞ।

এমনকি ফাতাহর ভেতরও অনেকে ভাইস প্রেসিডেন্ট পদ তৈরির বিপক্ষে। তাঁরা সবাই এর পরিবর্তে নির্বাচন আয়োজন করার কথা বলেছেন। আব্বাস এমন একটি ক্ষতের ওপর পট্টি দিয়ে রেখেছেন, যেখানে আসলে অস্ত্রোপচার দরকার। —ডায়ানা বুট্টু, কানাডীয় আইনজীবী

নিজেদের মধ্যে বিরোধ কমিয়ে আনতে ২০০৭ সালের পর হামাস ও ফাতাহ বেশ কয়েকটি চুক্তি সই করেছে।

আল–জাজিরাকে তাহানি মুস্তফা বলেন, ‘আমার ধারণা, আব্বাসকে নিয়ে সেখানে বড় ধরনের হতাশা তৈরি হয়েছে। একটি ঐক্যবদ্ধ ফিলিস্তিনি ফ্রন্ট তৈরির প্রচেষ্টায় আব্বাসকে বাধা ও বিনষ্টকারী বলে মনে করা হচ্ছে। গাজায় ইসরায়েল যা করছে, তা তাকে চালিয়ে যেতে একটি অজুহাত এনে দিয়েছে তাঁর এমন ভূমিকা।’

ডায়ানা বুট্টু বিশ্বাস করেন, এই পরিস্থিতি সামাল দিতে নতুন একটি রাজনৈতিক পদ তৈরি করার পরিবর্তে মাহমুদ আব্বাসের একটি নির্বাচন দেওয়া উচিত। এতে ফাতাহ, পিএলও এবং পিএ সবার জন্য ভালো হবে বলেও মনে করেন এই আইনজীবী।

আরও পড়ুনফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস কেন এখন উত্তরসূরি বেছে নিলেন০১ ডিসেম্বর ২০২৪

হামাস ও ফাতাহর মধ্যে লড়াইয়ের আগে ফিলিস্তিনে সর্বশেষ নির্বাচন হয়েছিল ২০০৬ সালে। ওই নির্বাচনে বড় ব্যবধানে জিতেছিল হামাস।

ডায়ানা বুট্টুর আশঙ্কা, আব্বাস সরে গেলে পিএর ভেতর যে বৈধতার সংকট বা ক্ষমতার শূন্যতা তৈরি হবে, তা নতুন একটি ভাইস প্রেসিডেন্ট পদ দিয়ে পূরণ করা সম্ভব হবে না। ফিলিস্তিনি প্রতিষ্ঠানগুলোকে পুনরুজ্জীবিত করতে আব্বাসের রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব আছে বলেও মনে করেন তিনি।

অসলো শান্তি চুক্তি দিয়ে পিএ গঠিত হয়েছিল। ফিলিস্তিনি নেতা ইয়াসির আরাফাত ও ইসরায়েলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী আইজ্যাক রবিন ১৯৯৩ এবং ১৯৯৫ সালে ওই চুক্তিতে সই করেন। পিএ সরকারের দায়িত্ব ছিল ইসরায়েলের পাশাপাশি একটি ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠিত না হওয়া পর্যন্ত পশ্চিম তীর ও গাজার শাসন পরিচালনা করা।

তবে ডায়ানা বুট্টু এ–ও স্বীকার করেছেন, গাজায় ইসরায়েল যে ধ্বংসাত্মক অভিযান চালাচ্ছে, গণহত্যা করছে এবং পাশাপাশি পশ্চিম তীরে যে নৃশংসতা চালাচ্ছে ও চলাচলের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করেছে, তাতে এ সময়ে একটি নির্বাচন আয়োজন কৌশলগতভাবে অনেক কঠিন। এরপরও ফিলিস্তিনিরা ভোট দেওয়ার একটি উপায় খুঁজে নেবে, মনে করেন তিনি।

ডায়ানা আল–জাজিরাকে বলেন, ‘এমনকি ফাতাহর ভেতরও অনেকে একটি ভাইস প্রেসিডেন্ট পদ তৈরির বিপক্ষে। তাঁরা এর পরিবর্তে নির্বাচন আয়োজনের কথা বলেছেন। আব্বাস এমন একটি ক্ষতের ওপর পট্টি দিয়ে রেখেছেন, যেখানে আসলে অস্ত্রোপচার দরকার।’

আরও পড়ুনইসরায়েলি গণহত্যা নিয়ে মাহমুদ আব্বাস কেন এমন চুপ০৮ জুন ২০২৪

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ইসর য় ল র ২০০৭ স ল পদ স ষ ট পর স থ ত আরব দ শ ক ষমত র আইনজ ব শ ষ কর বল ছ ন পদ ত র র জন ত হয় ছ ল র জন য প এর ন ন একট র ওপর র একট

এছাড়াও পড়ুন:

অনশনের পর ডিবি কার্যালয় থেকে ছাড়া পেলেন ছয় সমন্বয়ক

নিরাপত্তার অজুহাতে গোয়েন্দা (ডিবি) কার্যালয়ে আটকে রাখা হয়েছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সম্মুখসারির ছয়জন সমন্বয়ককে। আটক থাকার এক পর্যায়ে তাঁরা অনশন শুরু করেন। ৩২ ঘণ্টা অনশনের পর ১ আগস্ট (২০২৪ সাল) দুপুরে ছয় সমন্বয়ককে ডিবি কার্যালয় থেকে কালো রঙের দুটি গাড়িতে করে যাঁর যাঁর ঠিকানায় পৌঁছে দেওয়া হয়।

সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া ও আবু বাকের মজুমদারকে ছয় দিন; সারজিস আলম ও হাসনাত আবদুল্লাহকে পাঁচ দিন এবং নুসরাত তাবাসসুমকে চার দিন ডিবি কার্যালয়ে তখন আটক রাখা হয়েছিল। এই ছয় সমন্বয়কের মধ্যে নাহিদ এখন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক। আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা। সারজিস, হাসনাত ও নুসরাত এনসিপির গুরুত্বপূর্ণ নেতা। আবু বাকের এখন গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের আহ্বায়ক।

ডিবি কার্যালয় থেকে ছাড়া পাওয়ার সেই ঘটনা সম্পর্কে সমন্বয়ক আবু বাকের মজুমদার গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি আমার বোনের বাসার লোকেশন (ঠিকানা) দিয়েছিলাম ডিবিকে। ১ আগস্ট (২০২৪ সাল) ডিবি তাদের তত্ত্বাবধানেই আমাদের ছয়জনকে যার যার গন্তব্যে পৌঁছে দেয়। বোনের বাসায় পৌঁছানোর কিছুক্ষণ পর আমি প্রথমে আসিফ ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে মানিকনগরের একটা জায়গায় দেখা করি। আমরা পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করি। কীভাবে এক দফার (সরকার পতনের) ঘোষণায় যাওয়া যায়, সে বিষয়েও সেদিন আমরা চিন্তা করি।’

সেদিন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে নিহত ব্যক্তিদের স্মরণ ও হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে ‘রিমেম্বারিং আওয়ার হিরোজ’ কর্মসূচি পালিত হয়। এ কর্মসূচির আওতায় গণসংগীত, পথনাটক, দেয়াললিখন, স্মৃতিচারণা ও বিক্ষোভ সমাবেশ হয় রাজধানী ঢাকাসহ অন্তত ১৬টি জেলা ও মহানগরে। এসব কর্মসূচিতে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি কিছু জায়গায় শিক্ষক ও আইনজীবীরা অংশ নেন। তবে কোথাও কোথাও কর্মসূচিতে বাধা দেয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। কোথাও কোথাও পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। অনেক জায়গায় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের আটক করা হয়।

প্রতিবাদ, বিক্ষোভ

সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সাতটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের উদ্যোগে পৃথক সমাবেশ-মানববন্ধন ও মিছিল করা হয়। পাশাপাশি সেদিন দেশের বিভিন্ন স্থানে সড়ক ও মহাসড়ক অবরোধ করে ছাত্র-জনতা।

‘কোটা সংস্কার আন্দোলনে সরকারের কঠোর দমনপ্রক্রিয়া ও গুলিতে ছাত্র-জনতা হত্যা’র প্রতিবাদে ১ আগস্ট বেলা ১১টায় মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে জাতীয় সংসদের সামনে সমাবেশের কর্মসূচি ছিল শিল্পী ও কলাকুশলীদের। ‘দৃশ্যমাধ্যম শিল্পীসমাজ’-এর ব্যানারে তাঁরা প্রথমে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ–সংলগ্ন ইন্দিরা রোডের প্রান্তে সমবেত হন। সেদিন সকাল থেকেই প্রবল বৃষ্টি হচ্ছিল। বৃষ্টি উপেক্ষা করে শিল্পীরা ব্যানার-পোস্টার নিয়ে স্লোগান দিতে দিতে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউর দিকে এগিয়ে যেতে থাকলে পুলিশের বাধার মুখে পড়েন।

পরে শিল্পীরা ইন্দিরা রোড দিয়ে শোভাযাত্রা করে ফার্মগেটে আনন্দ সিনেমা হলের কাছে সমবেত হন। প্রবল বৃষ্টির মধ্যেই তাঁরা সেখানে সড়কের পাশে ব্যানার-পোস্টার নিয়ে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে স্লোগান দিতে থাকেন। শিল্পী, নির্মাতা ও কলাকুশলীরা ছাত্র-জনতার হত্যার প্রতিবাদ জানিয়ে বক্তব্য দেন। তাঁরা বলেন, যে বর্বর পন্থায় শিক্ষার্থীদের ন্যায়সংগত আন্দোলনকে দমন করা হচ্ছে, তা কোনো গণতান্ত্রিক সভ্য সমাজে ঘটতে পারে না।

দৃশ্যমাধ্যমের শিল্পীদের সমাবেশ থেকে সেদিন শিক্ষার্থীদের ৯ দফা দাবির প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানানো হয়। একই সঙ্গে হত্যাকাণ্ডের বিচার, গণগ্রেপ্তার, মামলা ও হয়রানি বন্ধের দাবি করা হয়। সমাবেশ থেকে আরও জানানো হয়, শিল্পীরা তাঁদের প্রতিবাদ কর্মসূচি অব্যাহত রাখবেন।

সেদিন বিকেলে ঢাকায় ডিবি কার্যালয়ের সামনে ‘বিক্ষুব্ধ নাগরিক সমাজ’–এর ব্যানারে মানববন্ধন করেন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা। মানববন্ধনে অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছিলেন, গুলি করে শিশুসহ নির্বিচার মানুষ হত্যার তদন্ত জাতিসংঘের অধীনে করতে হবে।

সেই মানববন্ধনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আসিফ নজরুল (এখন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা) বলেন, হত্যার বিচার করতে হবে। হুকুমদাতাদেরও বিচার করতে হবে।

কূটনীতিকদের ‘ব্রিফ’

জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরকে রাজনৈতিক দল ও সংগঠন হিসেবে নিষিদ্ধ করে ১ আগস্ট বিকেলে প্রজ্ঞাপন জারি করেছিল তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। সেদিন বিকেলে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় তৎকালীন সরকারের পক্ষ থেকে জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিসহ বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের ব্রিফ করা হয়। সেই ব্রিফিংয়ে বিদেশি কূটনীতিকেরা সহিংসতায় হতাহতের ঘটনা ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির বিশ্বাসযোগ্য তদন্তের দাবি জানান।

সম্পর্কিত নিবন্ধ