Narayanganj Times:
2025-11-03@07:52:16 GMT

মে দিবসের গোড়ার কথা

Published: 29th, April 2025 GMT

মে দিবসের গোড়ার কথা

১৮০০ সালের কিছু আগে থেকে ইউরোপ ও আমেরিকার শ্রমিকরা কর্মঘণ্টা কমানোর দাবি করে আসছিল। তখন সূর্য ওঠা থেকে সূর্য ডুবে সন্ধ্যা হওয়া পর্যন্ত শ্রমিকদের কাজ করতে হতো। নিপীড়নমূলক এক পরিবেশে বছরের পর বছর শ্রমিকরা ক্রীতদাসের মত খুব অল্প মজুরিতে কাজ করতে বাধ্য হত।

ঐ শতকের মাঝামাঝি ইংল্যান্ড ও আমেরিকায় বারে বারে শ্রমিকরা বড় বড় বিদ্রোহ করতে থাকলো। শিল্পান্নত বিভিন্ন দেশে শ্রমিকরা শ্রমঘণ্টা কমানোর জোর দাবি করতে থাকল। কোথাও ৮ ঘণ্টা, কোথাও ১০ ঘণ্টার দাবি তোলা হল। শ্রমিকদের ট্রেড ভিত্তিক ঐক্য থাকলেও তখনো জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের কোন ঐক্য ছিল না। শ্রমিক আন্দোলনে অনৈক্য ও বিশৃঙ্খলা লেগেই থাকত।

১৮৬৪ সালের আগেই ইংলেন্ড, আমেরিকা ও ফ্রান্সসহ কয়েকটি উন্নত দেশে শ্রমিকরা আন্দোলনের ভিতর দিয়ে ট্রেড ইউনিয়ন গড়ে তুলেছিল। তারা কর্মঘণ্টা কমানো, কাজের ভালো পরিবেশ, নির্যাতন বন্ধ ও মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে আন্দোলন করে আসছিল।

১৮৬৪ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর লন্ডনে সেন্ট মার্টিন হলে ট্রেড ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দের এক সম্মেলনে শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ করার লক্ষ্যে কার্ল মার্কস ও এঙ্গেলস (আন্তর্জাতিক) শ্রমজীবী মানুষের আন্তর্জাতিক সমিতি গড়ে তুললেন। বেশ কয়েকটি শিল্পান্নত দেশের শ্রমিক নেতৃবৃন্দ এতে অংশগ্রহণ করেছিলেন। শ্রমজীবী মানুষ ও শ্রমিক শ্রেণির এটাই প্রথম আন্তর্জাতিক ঐক্য।

কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাসে একে ‘প্রথম আন্তর্জাতিক’ বলা হয়ে থাকে। কার্ল মার্কস ও এঙ্গেলস ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’ এই শ্লোগানটি আবিস্কার করেছিলেন এবং বিভিন্ন দেশে শ্রমিকদের মধ্যে চালু করেছিলেন। শ্রমজীবী মানুষের আন্তর্জাতিক সমিতির নির্ধারিত শ্লোগান ছিল এটা।

দেশে দেশে শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ করার জন্য শ্রমজীবী মানুষের আন্তর্জাতিক সমিতির সম্মেলনে আট ঘণ্টা কর্মদিবসের দাবি তোলা হয়। এর আগে ভিন্ন ভিন্ন স্থানে ভিন্ন ভিন্ন কর্মদিবসের দাবি করে আসছিল শ্রমিকরা।


আমরা জানি, মে দিবসের প্রধান আন্দোলনটি সংগঠিত হয়েছিল ১৮৮৬ সালে আমেরিকার শিকাগো শহরের হে-মার্কেটে। কিন্তু এটা শেষ কথা নয় - এর একটা ধারাবাহিকতা আছে; ৮ঘণ্টা কাজের দাবি কিভাবে সামনে এসেছে সে বিষয়টি জানতে হবে। কার্ল মার্কস ও এঙ্গেলস এর গড়া শ্রমজীবী মানুষের আন্তর্জাতিক সমিতি ১৮৬৬ সালে জেনেভা সম্মেলনে প্রথম ৮ঘণ্টা শ্রমদিবস চালুর আন্দোলন ঘোষনা করে। তখন প্রায় ২০টি দেশে এই দাবি প্রচার হয়েছিল।

এর পর নতুন নতুন দেশে এই দাবিটি পৌছে গেছে। শ্রমিক আন্দোলনে নানা উত্থান-পতন হয়েছে কিন্তু ৮ঘণ্টা কাজের দাবি জোরালো হয়েছে। এরপর শ্রমজীবী মানুষের আন্তর্জাতিক সমিতি ১৮৭৬ সালে বিলুপ্ত হয়ে যায়, কিন্তু ৮ঘণ্টা কাজের দাবি শ্রমিকদের মাঝে থেকে যায়। ১৮৮৬ সালে আমেরিকার বিভিন্ন শহরে নানান দাবি নিয়ে শ্রমিক বিক্ষোভ চলতে থাকে।

এর মধ্যে ৮ঘণ্টা কাজের দাবিও ছিল। মে মাসের শুরুতে শিকাগো শহরের হে-মার্কেটে রুটি কারখানার শ্রমিকরা কয়েক দিন ধরে রক্তক্ষয়ী আন্দোলনে জীবনের বিনিময়ে দাবি আদায় করে। এখানেই শেষ নয়। এ আন্দোলন বিভিন্ন শহর এবং আমেরিকার বাইরেও অন্য দেশে ছড়িয়ে পড়ে।

১৮৮৯ সালে শ্রমজীবী মানুষের আন্তর্জাতিক সমিতি আবার এঙ্গেলসের নেতৃত্বে পুনর্গঠন করা হয়। তখন কার্ল মার্কস বেঁচে নেই, তাই নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এঙ্গেলস। কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাসে এই সংগঠনকে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক বলা হয়ে থাকে।

এবার আরো অনেকগুলো দেশ যুক্ত হয়ে বড় আকার ধারন করে। ১৮৮৯ সালে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে এই দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের সম্মেলনে ১৯৯০ সালের পহেলা মে তারিখ সারা পৃথিবীতে আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংহতি দিবস হিসেবে মে দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ১৮৯০ সালের পহেলা মে এ সিদ্ধান্ত অনেকগুলো দেশে বাস্তবায়ন হয়।

এরপর থেকে পর্যায়ক্রমে পৃথিবীর দেশে দশে পহেলা মে তারিখে এই মে দিবস পালন হতে থাকে। ১৮৮৯ সালে অনুষ্ঠিত শ্রমজীবী মানুষের আন্তর্জাতিক সমিতির সম্মেলনে (দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক) মূলত এ প্রস্তাবটা এনেছিলেন কমরেড এঙ্গেলস।

১৮৮৬ সালের মে মাসের প্রথম সপ্তাহে আমেরিকার শিকাগো শহরের হে-মার্কেটে শ্রমিকদের আন্দোলন সফল হয়েছিল নেতৃবৃন্দের জীবনের বিনিময়ে। এই আন্দোলনের নেতাদের ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল। শুধুমাত্র এতটুকুতেই সারা দুনিয়ায় মে দিবস প্রতিষ্ঠিত হয়নি। প্রথমে আমেরিকায় কয়েকটি শিল্পাঞ্চলে মালিক শ্রেণি ৮ ঘণ্টা কাজের দাবি মেনে নেয়।

সে আন্দোলন আমেরিকার গন্ডি ছাড়িয়ে জার্মান, ফ্রান্স, পোল্যান্ড সহ শ্রমজীবী মানুষের আন্তর্জাতিক সমিতির সহযোগিতায় শিল্পোন্নত দেশেগুলেতে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। এটা ছিল আন্তর্জাতিক শ্রমিক শ্রেণির একটা ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস। এঙ্গেলস যতদিন বেঁচে ছিলেন তিনি এ আন্দোলন এগিয়ে নিয়েছেন, নেতৃত্ব দিয়েছেন। অন্যদিকে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক টিকেছিল ১৯১৪ সাল পর্যন্ত।

বিলুপ্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত এই সংগঠন ৮ঘণ্টা কাজের দাবি ও মে দিবসকে সারা পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করে গেছে। এরপর ১৯১৭ সালে রাশিয়ায় শ্রমিক শ্রেণি অক্টোবর বিপ্লবের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র কায়েম করে এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে মে দিবস পালনের ঘোষণা দেয়। তারও পরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সমাজতান্ত্রিক রাশিয়া জয়লাভ করে এবং আরো ১২/১৩ টি দেশে কমিউনিস্ট পার্টি রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে।

ঐ দেশগুলোতেও রাষ্ট্রীয়ভাবে মে দিবস পালনের ঘোষণা দেয়। এর কিছু পর ১৯৪৯ সালে চীনে কমিউনিস্ট পার্টি ক্ষমতা দখল করে এবং তারাও রাষ্ট্রীয়ভাবে মে দিবস পালন শুরু করে। এরপর উত্তর কোরিয়া, আলবেনিয়া, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, কিউবাসহ যেসকল দেশে কমিউনিস্ট পার্টি রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেছে সব দেশেই রাষ্ট্রীয়ভাবে মে দিবস পালন করা হয়েছে, পহেলা মে সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবীতে একটি সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব গড়ে ওঠার কারণে মে দিবস প্রতিষ্ঠিত হতে পেরছে। মে দিবসকে প্রতিষ্ঠা করতে যেয়ে আমেরিকার শিকাগো শহরের চেয়ে বহগুন বেশি শ্রমিকের জীবন দিয়েছে। তখন আজকের দিনের মত মে দিবস এত সহজে পালন করা যেত না। এক সময় দেশে দেশে মে দিবস পালন নিষিদ্ধ ছিল।

মে দিবসের সভা-সমাবেশে ১৪৪ ধারা জারি রাখা হত। মে দিবস পালন করতে গিয়ে অনেক দেশে শ্রমিকদের জীবন দিতে হয়েছে। আইএলও গঠনের পর দেশে দেশে মে দিবস পালন আইনসম্মত করা হয়েছে। যে দেশগুলো আইএলওি-র সদস্য হয়েছে সে দেশগুলোতে সরকার মে দিবস পালনের অনুমতি দিয়েছে।

এহান মে দিবসের আন্দোলনে মূল লক্ষ্য ছিল শ্রমিকদের কাজের ঘণ্টা (কর্ম-দিবস) কমানো। পরবর্তীতে এ আন্দোলনের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে আছে মে দিবসের সকল ইতিহাস। কাজের ঘণ্টা কমাবার এ দাবী শ্রমিক শ্রেণির কাছে ছিল খুব তাৎপর্যপূর্ণ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কারখানা ব্যবস্থা চালু হবার পর থেকেই কাজের ঘণ্টা কমাবার এ আন্দোলনের প্রকাশ দেখা যায়।

প্রধানত মজুরি বাড়াবার দাবিতেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রথমদিকে ধর্মঘটগুলো শুরু হয়। সেখানে ১৮৮৫-৮৬ সালে যতগুলো ধর্মঘট হয়েছে তার সঙ্গে পূর্ববর্তী বছরের ধর্মঘটের সংখ্যা তুলনা করলেই বোঝা যায়, কী অভূতপূর্ব সংগ্রামী চেতনা তখন শ্রমিকদের ছিল। ১৮৮১সাল থেকে ১৮৮৪ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অঞ্চলে বছরে গড়ে ৫০০ ধর্মঘট হয়, আর এগুলোতে অংশগ্রহণ করে গড়ে ১ লক্ষ ৫০ হাজার শ্রমিক।

পরবর্তী বছরে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৭০০ এবং সেই ধর্মঘটে যোগদানকারীর সংখ্যা বেড়ে দাড়ায় গড়ে ২ লক্ষ ৫০ হাজার। যখনই শ্রমিকরা নিজেদের দাবী দাওয়া নিয়ে তাদের কোন দলিলে-লিফলেটে লিপিবদ্ধ করছে বিশেষ করে তখনই কাজের ঘণ্টা কমানোর সংগঠন বা ট্রেড ইউনিয়ন গড়ে তোলার তাগিদ সেই দলিলে স্থান পেয়েছে।

একদিকে কাজের ঘণ্টা কমানো ও শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার আদায়ের আন্দোলন বাড়তে থাকে, অন্যদিকে মালিকের শোষণের মাত্রাও বাড়তে থাকে। কাজের ঘণ্টা অত্যাধিক বেশী হওয়ায় অমানুষিক চাপে শ্রমিকরা যেমনি পিষ্ট হতে লাগলো ঠিক তেমনি নির্যাতন ও  শ্রম-যন্ত্রণার হাত থেকে মুক্তির দাবিতে শ্রমিকরা বিক্ষোভে ফেটে পড়তে লাগলো।

সকল প্রকার শোষণ থেকে চিরস্থায়ী মুক্তির প্রশ্নও শ্রমিক শ্রেণির চেতনায় আসতে থাকে। ততদিনে বিভিন্ন দেশের বড় বড় শিল্পাঞ্চলগুলোতে মার্কসবাদ ও সমাজতান্ত্রিক মতবাদ শ্রমিকদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে। বিভিন্ন দেশে কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে উঠেছে। পুঁজিবাদ উচ্ছেদের শ্লোগান জোরালো হয়েছে।

'সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত'- এই ছিল তখনকার দিনে কাজের ঘণ্টা। উনিশ শতকের গোড়ার দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমিকরা এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে শুরু করে। চৌদ্দ, ষোল এমনকি আঠারো ঘণ্টা কাজের দিনও তখন চালু ছিল। ১৮০৬ সালে ‘ফিলাডেলফিয়ার’ ধর্মঘটী জুতা শ্রমিক নেতাদের বিরুদ্ধে তখন মালিক পুঁজিপতি শ্রেণির ষড়যন্ত্রমূলক মিথ্যা মামলা দেয়া হয়।

তখন শ্রমিকদের ১৯ থেকে ২০ ঘণ্টা পর্যন্ত খাটানো হচ্ছিল, তা পরবর্তী মেহনতি মানুষের মুখপত্র (ওয়ার্কিং মেনস্ অ্যাডভোকেট) নামক পত্রিকায় প্রকাশ পায়। ১৮২০ সাল থেকে ১৮৪০ সাল পর্যন্ত কাজের ঘণ্টা কমানোর দাবীতে ধর্মঘটের পর ধর্মঘট চলছিল। দৈনিক ৮ বা ১০ ঘণ্টা কাজের নিয়ম চালুর সুনির্দিষ্ট দাবি শ্রমিকদের পক্ষ থেকে ধারাবাহিকভাবে উঠতে থাকে।

১৮২৭ সালে ইংল্যান্ডের ফিলাডেলফিয়ার মেকানিকদের নিয়ে বিশ্বে প্রথম ট্রেডইউনিয়নের জন্ম হয়। ১৮৩৪ সালে নিউইয়র্কে রুটি কারখানার শ্রমিকদের ধর্মঘট চলতে থাকে। গৃহনির্মাণ শ্রমিকরা ১০ ঘণ্টা কাজের দাবিতে একের পর এক ধর্মঘটের ডাক দিয়ে বসে।

নিউইয়র্ক, বাল্টিমোর, ওয়াশিংটন, মিলওয়াতি, সিনসিনাটি, সেন্ট লুই, পিটার্সবার্গ - এইসব অঞ্চলে দশ ঘণ্টা কাজের দাবির আওয়াজ দ্রুতবেগে একটা তীব্র রাজনৈতিক আন্দোলনের মত দাবানল আকারে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে।

অতঃপর ১৮৩৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি ভ্যান ব্যুরেনের আমলে যুক্তরাষ্ট্র সরকার সরকারি কাজে নিযুক্ত শ্রমিকদের জন্য ১০ ঘণ্টা কাজের সময় বেঁধে দিতে বাধ্য হয়। এই আইন দুনিয়ার সমস্ত অঞ্চলে রাজনৈতিক আন্দোলনকে সম্প্রসারিত করার সংগ্রামে ভূমিকা রাখে। ১৮৫০ সাল পরবর্তী বছরগুলোতে শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন গড়ে তোলার ব্যাপারে প্রবল উদ্দীপনা দেখা দেয়।

ইতিমধ্যে মার্কস ও এঙ্গেলসের কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার প্রকাশ ও প্রচার শুরু হয়ে গেছে। কয়েকটি শিল্পোন্নত দেশে কমিউনিস্ট পার্টিও গড়ে তোলা শুরু হয়েছে। এর সাথে সাথে ৮ ঘণ্টা কাজের দাবি ক্রমশ জোরদার হতে থাকে।

১৮৫৭ সালে পুঁজিবাদের সংকটকালে এই আন্দোলন বাধাগ্রস্ত হলেও কয়েকটি সুসংগঠিত শিল্প কারখানায় এই দাবী বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়েছিল। কাজের ঘণ্টা কমানোর আন্দোলন শুধু যুক্তরাষ্ট্রে হয়েছে তা নয়, উদীয়মান পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থায় অবাধ প্রতিযোগীতার যুগে বুর্জোয়া শ্রেণির ঊষালগ্নে যেখানেই শিল্পের বিকাশ হয়েছে, শ্রমিকরা নিষ্পেষিত হয়েছে, সেখানেই এ আন্দোলনের জন্ম হয়েছে।

সুদূর অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশে গৃহ নির্মাণ শ্রমিকরা একই আওয়াজ তুলেছিল, ‘আট ঘণ্টা কাজ, আট ঘণ্টা আমোদ প্রমোদ, আট ঘণ্টা বিশ্রাম।’ এই দাবি মূলত প্রথম তুলেছিল ১৮৬৬ সালে ‘শ্রমজীবী মানুষের আন্তর্জাতিক সমিতি’ যাকে প্রথম আন্তর্জাতিক বলা হয়। এই দাবির পক্ষে বিশ্বের দেশে দেশে সাধারণ জনগণ তখন যুক্ত হয়েছিল।

যেভাবে মে-দিবস সংগঠিত হয়েছিল

১৮৮৬ সালের ১লা মে ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিতে আমেরিকার শিকাগো শহরের হে মার্কেটে শ্রমিকরা ঐক্যবদ্ধ হয়। ৮ ঘণ্টা কর্মদিবস, ন্যায্য মজুরি, নিরাপদ কর্মপরিবেশসহ বেঁচে থাকার দাবিতে ১মে থেকে ধর্মঘট শুরু করে। ৩ মে মালিক শ্রেণির পেটোয়া বাহিনী অস্ত্র ও বোমা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে আন্দোলনরত শ্রমিকদের উপর। ১১ জন শ্রমিককে হত্যা করে।

এর প্রতিবাদে ৪ মে দলে দলে শ্রমিকরা রাস্তায় নেমে আসতে শুরু করলে সরকার ও মালিক পক্ষ ষড়যন্ত্র শুরু করে। একজন পুলিশ কর্মকর্তাকে নিজেরা হত্যা করে শ্রমিকদের ওপর দোষ চাপায় এবং অসংখ্য শ্রমিকদের গ্রেফতার করে খুনের মামলা দেয়। এরপর এক প্রহসনমূলক বিচারে প্রথম সারির ৭ জন শ্রমিক নেতাকে ফাঁসি দেয়।

বিচারের নামে প্রহসনে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয় স্পাইজ, এঙ্গেলস, ফিসারসহ ৭ জন শ্রমিক নেতাকে। তখন থেকেই আরো জোরালো লড়াই সংগ্রাম শুরু হয়। আমেরিকায় ৮ ঘণ্টা কর্মদিবসের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়।

১৮৮৯ সালে জেল-জুলুম-ফাঁসির বিরুদ্ধে সর্বহারার মহান নেতা ফ্রেডরিক এঙ্গেলস দ্বিতীয় কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক এর সভায় এক প্রস্তাব আনেন। তিনি বিশ্বব্যাপী একই দিনে মে দিবস পালনের প্রস্তাব করেন। সে প্রস্তাব সভায় সিন্ধান্তাকারে গৃহীত হয়।

১৮৯০ সালে শিল্পোন্নত দেশগুলোতে দ্বিতীয় কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক এর সিদ্ধান্ত মোতাবেক একসাথে বিশ্বব্যাপী মে দিবস পালিত হয়। সেই থেকে আজ পর্যন্ত শ্রমিক শ্রেণির আন্তর্জাতিক সংহতি দিবস হিসেবে পৃথিবীর দেশে দেশে মে দিবস পালিত হয়ে আসছে।

আজ ১৩৯ বছর পরেও আমাদের বাংলাদেশের শ্রমিকরা এতো কম মজুরি পায় যে, ৮ ঘণ্টা কাজের পরিবর্তে ১২ ঘণ্টা থেকে ১৬ ঘণ্টা (ওভারটাইম সহ) কাজ না করলে তার পেট চলে না। আমরা শ্রমিকদের জন্য এমন মজুরি চাই যাতে ৮ ঘণ্টা কাজ করেই তারা সংসার চালাতে পারে। তাই বাংলাদেশের শ্রমিকদের জন্য ৩০ হাজার টাকা ন্যূনতম মজুরি দাবি করা হয়েছে।

দেশের সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে শ্রমিক কর্মচারীদের আত্মত্যাগ আছে। তাদের রক্ত ঘামে গড়ে উঠেছে এই সভ্যতা। অথচ স্বাধীন দেশে তাদের নেই জীবন-জীবিকার অধিকার, কাজের অধিকার, ন্যায্য মজুরির পাবার অধিকার, সাংবিধানিক গণতান্ত্রিক অধিকার, ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার। এর কোনটাই এখনও পর্যন্ত পায়নি তারা।

অন্যদিকে কলে-কারখানার শ্রমিক ছাড়াও রয়েছে রিক্সা শ্রমিক, অটোরিক্সা শ্রমিক, সি.

এন.জি চালক, নির্মাণ শ্রমিক, হোটেল শ্রমিক, গৃহপরিচারিকা, প্রাইভেটকার চালক, রাজমিস্ত্রী, কাঠমিস্ত্রী, রংমিস্ত্রী, মৎস্যজীবী, দিনমজুরসহ অনেক শ্রেণি পেশার শ্রমিক। তাদের জীবনের নিরাপত্তা নেই, ন্যূনতম মজুরি, নির্ধারিত কর্মঘণ্টা, পরিচয়পত্র, নিয়োগপত্র, প্রভিডেন্ট ফান্ড নেই। আছে শ্রমিকদের উপর পুঁজিপতি মালিক শ্রেণির নির্মম শোষণ ও অত্যাচার।

এ ছাড়াও আছে ভবন ধ্বসে মৃত্যু, আগুনে পুড়ে মৃত্যু, অনাহার ও বিনাচিকিৎসায় মৃত্যু ইত্যাদি। শ্রমিকদের সাথে দুর্ব্যবহার, নামে-বেনামে তোলাবাজি, অবৈধ টোল আদায়, ঘরে বাহিরে নারী শ্রমিকদের উপর যৌনহয়রানিসহ জীবন জীবিকার বহুবিধ সমস্যায় আছে তারা।

তারা বছরের পর বছর ভবিষ্যৎ হতাশায় দুর্বিষহ এক স্বপ্নহীন জীবন বয়ে চলেছে। শ্রমিকদের জীবনে বড় অভিশাপ হলো বেকারত্ব ও কম মজুরি যা পুঁজিবাদী আর্থসামাজিক ব্যবস্থার অমোঘ ফল।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসেব মতে দেশে বর্তমানে কর্মযোগ্য বেকারের সংখ্যা ৪কোটি ৮২ লক্ষ। অন্যদিকে প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিকদের বেতন (মজুরি) নির্ধারনে আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংস্থা আইএলও (ওখঙ) এর নীতিমালায় স্বাক্ষরকারী দেশ হয়েও বাংলাদেশ সরকার শ্রমিকদের মনুষ্যোচিত মজুরি নির্ধারনে ব্যার্থ।

সরকার কোথাও এর বাস্তবায়নে ন্যূনতম ভূমিকা পালন করেনি। বরং মালিকদের সুরে সুর মিলিয়ে শ্রমিক ঠকানোর কাজে সহায়তা করে যাচ্ছে। শুধু তাই নয়, একের পর এক শ্রমিকদের আইনী অধিকারগুলো কেড়ে নিচ্ছে। মালিক ও পুঁজিপতি শ্রেণির স্বার্থে শ্রমিক স্বার্থবিরোধী আইন তৈরি করা হচ্ছে। ব্রিটিশ আমল, পাকিস্তান আমলে যতটুকু অধিকার ছিল, স্বাধীন দেশে সে অধিকারটুকু রাখা হয়নি।

১৯৯০ এর দশকে সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের বিপর্যয়ের পর থেকে দেশে দেশে ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শ্রমিক শোষণ বহুগুণ বাড়ানো হয়েছে। শ্রমিকশ্রেণি খুব নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। এর শেষ কোথায়?

মে দিবসের চেতনায় দুর্বিষহ বর্তমানকে দূরে ঠেলে সমাজ-সভ্যতায় এক উজ্জ্বল ভবিষ্যতের অন্বেষণে শ্রমজীবী মানুষ সংগ্রাম করে চলেছে। শ্রমিক শ্রেণির সে সংগ্রামে বিশ্বময় অনুপ্রাণিত করেছে ‘মে দিবস’। শ্রমিক শ্রেণির এই আন্তর্জাতিক ঐক্য ও লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাবে সমাজ বদলের রাজনৈতিক লক্ষ্য, এগিয়ে যাবে মহান মে দিবস।


লেখক :

সাধারণ সম্পদাক
বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র, নারায়ণগঞ্জ জেলা কমিটি
 

উৎস: Narayanganj Times

কীওয়ার্ড: ন র য়ণগঞ জ শ ল প ন নত দ শ আম র ক র শ ক গ প রস ত ব দ র জ বন ব যবস থ শহর র হ শ রমজ ব পরবর ত স ল পর হয় ছ ল এই দ ব কম ন র র জন য ত হয় ছ সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

সার্চ দুনিয়ার নতুন দিগন্ত জিইও: দেশের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো কী প্

ইন্টারনেট সার্চ দুনিয়ায় চলছে নীরব এক বিপ্লব। তথ্য খোঁজার ধরন বদলে যাচ্ছে আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে দ্রুত। আগে যেখানে গুগলে উচ্চ র‌্যাংকিং মানেই ছিল সাফল্য, এখন সেই জায়গা নিচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই)-নির্ভর সার্চ টুল।

সার্চ জগতের নতুন চ্যালেঞ্জ

চ্যাটজিপিটি, গুগল জেমিনি, মাইক্রোসফট কপিলট কিংবা পারপ্লেক্সিটি এআই-এগুলো আর শুধু সার্চ ইঞ্জিন নয়, বরং উত্তর তৈরিকারক ইঞ্জিন। ব্যবহারকারী এখন শুধু ‘লিংক’ নয়, বরং সরাসরি উত্তর পেতে চায়। আর এই পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার জন্যই এসেছে নতুন এক কৌশল- জিইও বা জেনারেটিভ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন।

জিইও কী?

জিইও (জেনারেটিভ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন) হলো এমন একটি প্রক্রিয়া, যেখানে আপনার ওয়েবসাইট ও কনটেন্ট এমনভাবে সাজানো হয় যাতে এআই-চালিত সার্চ ইঞ্জিন সহজেই আপনার তথ্য চিনতে, বুঝতে এবং ব্যবহারকারীর প্রশ্নের উত্তরে সেটি অন্তর্ভুক্ত করতে পারে।

আগে ব্র্যান্ডগুলোর ফোকাস ছিল গুগলের প্রথম পাতায় জায়গা করে নেওয়া। কিন্তু এখন গুরুত্ব পাচ্ছে- চ্যাটজিপিটি বা জেমিনি-এর উত্তরে আপনার ব্র্যান্ডের নাম আসছে কি না!

এসইও বনাম জিইও: সার্চ দুনিয়ার নতুন যুগের পালাবদল

অনেকেই এসইও (সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন) এবং জিইও (জেনারেটিভ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন) এক মনে করেন, কিন্তু এদের মধ্যে মূলত লক্ষ্য ও কৌশল ভিন্ন। এসইও হচ্ছে পুরোনো পদ্ধতি, অন্যদিকে জিইও হচ্ছে নতুন পদ্ধতি।

* মূল লক্ষ্য
এসইও: সার্চ ইঞ্জিনে র‌্যাংক বাড়ানো
জিইও: এআই সার্চের উত্তরে দৃশ্যমান হওয়া

* কাজের ধরন
এসইও: কিওয়ার্ড ও ব্যাকলিংক ভিত্তিক
জিইও: কনটেক্সট, প্রাসঙ্গিকতা ও ব্র্যান্ড অথরিটি নির্ভর

* ফলাফল
এসইও: ক্লিক ও ট্রাফিক বৃদ্ধি
জিইও: ব্র্যান্ড উল্লেখ ও আস্থা বৃদ্ধি

* প্ল্যাটফর্ম
এসইও: গুগল, বিং ইত্যাদি সার্চ ইঞ্জিন
জিইও: চ্যাটজিপিটি, জেমিনি, পারপ্লেক্সিটি, এসজিই ইত্যাদি এআই সার্চ

এসইও এখনও গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু ভবিষ্যতের সার্চ ইকোসিস্টেমে জিইও সমান অপরিহার্য হয়ে উঠছে।

বাংলাদেশি ব্যবসার জন্য জিইও-এর গুরুত্ব

বাংলাদেশে ডিজিটাল মার্কেটের ক্রমবর্ধমান প্রবৃদ্ধি স্পষ্টভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। শিক্ষা, ট্রাভেল, স্বাস্থ্যসেবা, ই-কমার্স, রিয়েল এস্টেট- প্রায় প্রতিটি খাতেই ব্যবসা অনলাইনে আরো দৃশ্যমান হতে চাচ্ছে। কিন্তু বদলেছে মানুষের সার্চ করার ধরন। এখন তারা শুধু গুগলে সার্চ করেই সন্তুষ্ট থাকছে না, তারা এআই-চালিত সার্চ টুলগুলো যেমন চ্যাটজিপিটি, জেমিনি বা পারপ্লেক্সিটি-এর মাধ্যমে সরাসরি উত্তর খুঁজছে। 

গার্টনারের এক গবেষণা অনুযায়ী, ২০২৬ সালের মধ্যে প্রচলিত সার্চ ইঞ্জিনে সার্চ ভলিউম প্রায় ২৫ শতাংশ কমে যাবে- কারণ ব্যবহারকারীরা দ্রুতই এআই-চালিত সার্চ ও চ্যাটবটের দিকে ঝুঁকছে। (তথ্যসূত্র: Gartner, “Search Engine Volume Will Drop 25% by 2026, Due to AI Chatbots and Other Virtual Agents)

তবে এই পরিবর্তনের প্রভাব ব্যবসার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ধরুন, কেউ চ্যাটজিপিটি-তে লিখল, ‘ঢাকায় সেরা অ্যাকাউন্টিং ফার্ম কোনটি?’ যদি আপনার কোম্পানির নাম বা কনটেন্ট এআই-এর তৈরি উত্তরে না আসে, তাহলে সম্ভাব্য ক্লায়েন্ট ও ব্যবসার সুযোগ হাতছাড়া হচ্ছে।

মূলত এখানেই জিইও-এর গুরুত্ব উঠে আসে। জিইও ব্যবহার করে কনটেন্ট এমনভাবে সাজানো যায় যাতে এআই সার্চ সিস্টেম আপনার ব্র্যান্ডকে সহজেই চিনতে পারে, বুঝতে পারে এবং ব্যবহারকারীর প্রশ্নের উত্তরে উল্লেখ করে। অর্থাৎ, বাংলাদেশের প্রতিটি ব্যবসা যদি এআই-এর দুনিয়ায় দৃশ্যমান থাকতে চায়, জিইও’র সঙ্গে খাপ খাওয়ানো এখন আর বিকল্প নয়- এটি একান্ত প্রয়োজন।

জিইও’র জন্য কীভাবে প্রস্তুতি নেবেন?

জেনারেটিভ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন (জিইও) কোনো একদিনে শেখার মতো বিষয় না- এটি একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া, যেখানে ব্যবসাগুলোকে নিজেদের কনটেন্ট, উপস্থিতি ও বিশ্বাসযোগ্যতা এআই-বান্ধব করে গড়ে তুলতে হয়। নিচে ধাপে ধাপে দেখা যাক, কীভাবে আপনি জিইও’র পথে প্রস্তুত হতে পারবেন।

১. অনলাইন উপস্থিতি যাচাই করুন

জিইও’র প্রথম ধাপ হলো আপনার ব্যবসা বা ব্র্যান্ডের বর্তমান অনলাইন উপস্থিতি যাচাই করা। চ্যাটজিপিটি বা পারপ্লেক্সিটি-এর মতো এআই-চালিত সার্চ টুলে সার্চ দিন ‘বাংলাদেশে সেরা (আপনার ইন্ডাস্ট্রি)-এর কোম্পানিগুলো কোনগুলো?’

যদি সার্চের উত্তরে আপনার নাম না আসে, বোঝা যাবে যে আপনার এআই-দৃশ্যমানতা এখনও সীমিত। এই ক্ষেত্রে আপনাকে জিইও অনুযায়ী কনটেন্ট ও অনলাইন উপস্থিতি বাড়াতে কাজ শুরু করতে হবে।

২. বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি করুন

জেনারেটিভ এআই সার্চ সিস্টেম সেই উৎসকেই অগ্রাধিকার দেয়, যা নির্ভরযোগ্য ও যাচাইযোগ্য। তাই আপনার ওয়েবসাইটে ব্র্যান্ড, টিম, যোগাযোগ ও রিভিউসহ সব তথ্য সম্পূর্ণ ও স্বচ্ছ রাখুন।

গুগল বিজনেস প্রোফাইল নিয়মিত আপডেট করুন-  ঠিকানা, সময়, পোস্ট ও রিভিউসহ।

বিশ্বস্ত সংবাদমাধ্যম ও ব্লগে ব্র্যান্ডের উল্লেখ বাড়ান।

E-E-A-T (Experience, Expertise, Authoritativeness, Trustworthiness) বজায় রাখুন।

এভাবেই এআই ও ব্যবহারকারীর কাছে আপনার ব্র্যান্ড একটি বিশ্বাসযোগ্য সোর্স হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে- যা জিইও সাফল্যের মূল চাবিকাঠি।

৩. কনভারসেশনাল কনটেন্ট লিখুন

এআই সার্চ এখন ব্যবহারকারীর প্রশ্নভিত্তিক অনুসন্ধানকে গুরুত্ব দেয়। তাই আপনার কনটেন্ট তৈরি করুন এমনভাবে যেন এটি প্রাকৃতিক প্রশ্ন ও কথোপকথনের মতো শোনায়। উদাহরণ: ‘Where can I find a trusted IELTS coaching center in Dhaka?’ ‘Where can I apply for a blue-collar job?’ এ ধরনের কনটেন্ট এআই-এর চোখে আরো সহজে বোঝার মতো হয় এবং ব্যবহারকারীর প্রশ্নের উত্তর হিসেবে উল্লেখযোগ্য।

৪. বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে সক্রিয় থাকুন

এআই শুধু ওয়েবসাইট থেকে তথ্য সংগ্রহ করে না। এটি ফেসবুক, ইউটিউব, লিংকডইন, কোরা এবং অন্যান্য সোশ্যাল প্ল্যাটফর্ম থেকেও তথ্য সংগ্রহ করে। তাই বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে আপনার উপস্থিতি নিশ্চিত করা জিইও-এর জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

৫. এসইও এবং জিইও একসাথে ব্যবহার করুন

ডিজিটাল দুনিয়ায় এখন শুধু সার্চ র‌্যাংকই যথেষ্ট নয়। এসইও যেমন গুগল সার্চে আপনার কনটেন্টকে শীর্ষে নিয়ে আসে, তেমনি নতুন যুগের জিইও (জেনারেটিভ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন) আপনার ব্র্যান্ডকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক সার্চে আরো দৃশ্যমান করে তোলে।

এসইও মূলত গুগল ও অন্যান্য সার্চ ইঞ্জিনে ওয়েবসাইটের অবস্থান উন্নত করে, আর জিইও শেখায়- কীভাবে এআই মডেলগুলো আপনার ব্র্যান্ডকে চিনবে, উল্লেখ করবে এবং বিশ্বাস করবে।

দুটি কৌশল একসাথে প্রয়োগ করলে অনলাইন উপস্থিতি অনেক বেশি শক্তিশালী হয়। একদিকে সার্চে দৃশ্যমানতা বাড়ে, অন্যদিকে এআই-নির্ভর প্ল্যাটফর্মগুলোতেও আপনার ব্র্যান্ডের নাম উঠে আসে স্বতঃস্ফূর্তভাবে।

ভবিষ্যতের সার্চ জগতে টিকে থাকতে হলে এখনই সময়- এসইও এবং জিইও-কে একসাথে কাজে লাগানোর।

বাংলাদেশের ব্যবসার জন্য জিইও’র নতুন সম্ভাবনা

জিইও বাংলাদেশের ব্যবসাগুলোর জন্য হতে পারে এক গেম চেঞ্জার। আগে যেখানে অনলাইন দৃশ্যমানতা মানেই ছিল গুগলে র‌্যাংক করা, এখন সেটি ধীরে ধীরে স্থান ছেড়ে দিচ্ছে এআই সার্চ ভিজিবিলিটি–কে।

আজ যদি কোনো ব্যবহারকারী চ্যাটজিপিটি বা জেমিনি-তে জিজ্ঞেস করে- 

‘বাংলাদেশে নির্ভরযোগ্য অনলাইন বই বিক্রির সাইট কোনটা?’

অথবা, ‘ঢাকায় সেরা ডিজিটাল মার্কেটিং এজেন্সি কারা?’

যদি আপনার ব্র্যান্ডের নাম সেই উত্তরে উঠে আসে, সেটিই হবে প্রকৃত দৃশ্যমানতা- শুধু ক্লিক নয়, বরং আস্থা, প্রভাব ও ব্র্যান্ড অথরিটি–এর প্রতিফলন।

বাংলাদেশে এখন প্রতিদিন শত শত নতুন অনলাইন ব্যবসা শুরু হচ্ছে- ই–কমার্স, এডুকেশন, হেলথটেক, রিয়েল এস্টেট, ফাইন্যান্স, এমনকি ছোট স্টার্টআপরাও দ্রুত ডিজিটাল হচ্ছে। কিন্তু একইসঙ্গে প্রতিযোগিতাও বেড়ে যাচ্ছে বহুগুণে।

এই প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে শুধু এসইও নয়, জিইও–কেন্দ্রিক কৌশলও অপরিহার্য।

জিইও’র ভবিষ্যৎ

খুব শিগগিরই এআই সার্চ টেক্সটের বাইরে গিয়ে ভয়েস, ভিডিও ও ইমেজ কনটেন্ট থেকেও উত্তর তৈরি করবে। তখন জিইও কেবল ওয়েবসাইট নয়, বরং ভিডিও, পডকাস্ট, সোশ্যাল প্রোফাইল, নিউজ রিপোর্ট- সবকিছুর মধ্যেই প্রভাব ফেলবে।

তাই এখন থেকেই যারা জিইও-কেন্দ্রিক কৌশল গ্রহণ করবে, ভবিষ্যতের সার্চ রেভোলিউশনে নেতৃত্ব দেবে তারাই।

উপসংহার

জেনারেটিভ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন (জিইও) শুধু নতুন ট্রেন্ড নয়- এটি ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের পরবর্তী অধ্যায়।

এসইও যেমন আপনাকে সার্চ রেজাল্টে নিয়ে যায়, জিইও তেমনি আপনাকে নিয়ে যাবে এআই–এর উত্তরে।

‘ভবিষ্যতের সার্চে র‌্যাংক নয়, ব্র্যান্ডের বিশ্বাসযোগ্যতাই হবে সাফল্যের আসল মাপকাঠি।’

লেখক: হেড অব ওয়েব অ্যানালাইসিস অ্যান্ড এসইও ডিরেক্টর, ইন্টেলেক আইটি এলএলসি (ইউএসএ অ্যান্ড বাংলাদেশ)

ঢাকা/ফিরোজ

সম্পর্কিত নিবন্ধ