যে পন্থীই হোন না কেন, একাত্তর আমার ইতিহাসের অংশ: ফরহাদ মজহার
Published: 1st, May 2025 GMT
ভাষা–সংস্কৃতি ও ধর্মের মধ্যে বিভাজন টিকিয়ে রাখলে দেশ আবার গৃহযুদ্ধের মধ্যে চলে যাবে বলে মন্তব্য করেছেন কবি ও রাষ্ট্রচিন্তক ফরহাদ মজহার। তিনি বলেন, ‘একাত্তরকে যদি আমরা মুছে দিতে চাই, এটা আমরা মারাত্মক ভুল করব। আমি একটা কথা সবাইকে বলি, আপনি যে পন্থীই হোন না কেন, একাত্তর নিয়ে কোনো দেনদরবার চলবে না, একাত্তর আমার ইতিহাসের অংশ। আমি বাংলাভাষী, বাংলা আমার সংস্কৃতি এবং একই সঙ্গে ইসলাম আমার ধর্ম। আমাকে ইসলাম থেকে যেমন আপনি বঞ্চিত করতে পারবেন না, আমার বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি থেকেও আপনি আমাকে বঞ্চিত করতে পারবেন না। এই বিভাজন যদি টিকিয়ে রাখেন, আমরা আরেকবার গৃহযুদ্ধের মধ্যে চলে যাব। যারা অতীতে ভুল করেছিল, তাদের ভুলটা যদি তারা স্বীকার করে, তাদের মধ্যে অনুশোচনা আসে, তাদের অন্তর্গত করে নিন বৃহত্তর সমাজের মধ্যে।’
গতকাল বুধবার রাতে পঞ্চগড় সরকারি অডিটরিয়ামে পঞ্চগড়ের নাট্যসংগঠন ভূমিজের আয়োজনে ‘শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক চেতনায় নতুন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের আকাঙ্ক্ষা: রাষ্ট্র ও সমাজের ভূমিকা’ শীর্ষক একক বক্তৃতা অনুষ্ঠানের মুখ্য আলোচক হিসেবে ফরহাদ মজহার এ কথাগুলো বলেন। ভূমিজের প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক সরকার হায়দারের সঞ্চালনায় আলোচনা সভায় উপস্থিত ছিলেন লেখক ও গবেষক মাহবুব সিদ্দিকী।
ফরহাদ মজহার বলেন, ‘মনে রাখতে হবে, একাত্তরে আমরা ভুল করিনি। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির জন্য যে লড়াই, এটা অবশ্যই সঠিক ছিল। কিন্তু ভুল কোথায় করেছিলাম? ভুল করেছি যে একাত্তরে যখন সংগ্রাম করেছি, তখন আমরা বলেছি কি মুক্তিযুদ্ধ করেছি, সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য? আপনাদের মনে আছে না? মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা। তাহলে মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণাকে অস্বীকার করে যখন আপনি বাহাত্তরের সংবিধান চাপিয়ে দিলেন, দিল্লির প্ররোচণায়, বাঙালি জাতিবাদীদের প্ররোচণায়, আপনি ঢোকালেন বাঙালি জাতিবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। না, এটা তো আমাদের সে সময় আন্দোলনের অংশ ছিল না। এটার জন্য তো আমরা একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ করিনি। আপনারা চাপিয়ে দিয়েছেন, অতএব বাহাত্তর সালের সংবিধানকে অবশ্যই বাতিল করতে হবে। নতুন গঠনতন্ত্র প্রণয়ন করতে হবে। আর এই নতুন গঠনতন্ত্রের সূত্র-শুরু-আরম্ভ হবে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার কায়েম করার জন্য।’
গত ৫ আগস্ট ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে আংশিক বিজয় হয়েছে উল্লেখ করে ফরহাদ মজহার বলেন, ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার কায়েম করা মানেই হলো ফ্যাসিবাদ, ফ্যাসিস্ট শক্তি ও ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে সংগ্রাম। এই সংগ্রামেই আমরা জয়ী হলাম ৫ আগস্টে। অল্প বিজয় হয়েছে, পূর্ণ বিজয় হয়নি। কেন পূর্ণ বিজয় হয়নি? কারণ, আমরা এই বিজয়কেও ঢুকিয়ে ফেলেছি আবার ফ্যাসিস্ট সংবিধানের অধীন। আমরা একটা সরকার গঠন করলাম, পুরোনো ফ্যাসিস্ট সংবিধানের অধীন। মানে, আওয়ামী লীগ কিন্তু ক্ষমতায়। আমার কথা শুনে অবাক হবেন না। আওয়ামী লীগ কিন্তু ক্ষমতায়, আমরা আওয়ামী লীগকে উৎখাত করতে পারিনি। আওয়ামী লীগের ভূত এখনো জারি রয়েছে। সেই আওয়ামী লীগের ভূতের নাম হচ্ছে সংবিধান, বাহাত্তরের সংবিধান। এটা কোত্থাও দাহ দেওয়া হয়নি। সব অটুট রয়েছে।’
নতুন গঠনতন্ত্র প্রণয়নের দাবি জানিয়ে ফরহাদ মজহার বলেন, ছাত্ররা যখন প্রোক্লেমেশন করতে চেয়েছে, একটা নুতন ঘোষণা দিতে চেয়েছে, সেই নতুন ঘোষণা দিতে দেননি। অধ্যাপক ইউনূস ঠিক করেননি। আমি তাঁকে কাতরভাবে অনুরোধ করব, দেরি হওয়ার আগে আপনি অবশ্যই যে ঘোষণা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি আমাদের দিয়েছেন, সেই ঘোষণা দিতে হবে। ৫ আগস্টের পরে গণসার্বভৌমত্বের যে নীতি, সেই নীতির অধীন নতুন গঠনতন্ত্র প্রণয়ন করা হবে এবং সেই নতুন গঠনতন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ তিনটা নীতি থাকবে জনগণের পক্ষে, যে নীতি বা আদর্শকে লঙ্ঘন করা যাবে না। এর মধ্যে এক নম্বর, রাষ্ট্র এমন কোনো আইন বা নীতি প্রণয়ন করতে পারবে না, যার দ্বারা ব্যক্তির অধিকার ও মর্যাদা ক্ষুণ্ন করা হয়। দুই নম্বর, রাষ্ট্র এমন কোনো আইন বা নীতি প্রণয়ন করতে পারবে না, যার দ্বারা প্রাণ-প্রকৃতি ও পরিবেশ ধ্বংস হয়। তিন নম্বর, জীবন ও জীবিকা ধ্বংস করে—রাষ্ট্র এমন কোনো আইন বা নীতি প্রণয়ন করতে পারবে না।’
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ফরহ দ মজহ র প রণয়ন করত র জন য ভ ল কর আওয় ম
এছাড়াও পড়ুন:
কর অব্যাহতির রাস্তা সামনে কঠিন হবে
কর অব্যাহতির বিষয়ে নীতি প্রণয়ন করা হবে জানিয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান বলেছেন, ব্যবসায়ীরা শুধু করছাড় চাচ্ছেন। তবে সামনে কর অব্যাহতির রাস্তা কঠিন হয়ে যাবে। গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর পল্টনে ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের (ইআরএফ) অডিটোরিয়ামে ‘সামষ্টিক অর্থনীতির দৃষ্টিভঙ্গি এবং রাজস্ব ব্যবস্থা’ শীর্ষক সেমিনারে এমন মন্তব্য করেন তিনি। সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ড. মাসরুর রিয়াজ।
এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, অর্থ উপদেষ্টা নির্দেশনা দিয়েছেন কর অব্যাহতি বিষয়ে নীতি তৈরি করতে। সেই নীতি আইনে প্রতিফলিত হবে। এ ক্ষেত্রে এনবিআরের প্রস্তাব হলো, সরকার কিংবা এনবিআর কোনো কর অব্যাহতি দিতে পারবে না। এ ক্ষমতা যাবে সংসদের হাতে। এর মানে হলো— কারও সঙ্গে একটু ভালো সম্পর্ক হলে অথবা বোঝাতে সক্ষম হলে কর অব্যাহতি পেয়ে যাবে– এমনটা থাকছে না। কর অব্যাহতির রাস্তা সামনের দিনে কঠিন হয়ে যাবে। এই ধরনের নীতি প্রণয়নের দিকে যাচ্ছে সরকার।
তিনি বলেন, দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়াতে এতদিন ব্যাপক কর অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে এর দরকারও ছিল। এখন নতুন করে ভাবতে হবে। রাজস্ব আয়ের চেয়ে ব্যয় অনেক বেশি। দেশের চাহিদা মেটানোর মতো রাজস্ব আয় হচ্ছে না। রাজস্ব কম কেন– সেই প্রশ্নও তুলছে জনগণ। এসব জায়গায় আরেকটু সচেতন হলে আগামী বাজেটের আকার কিছুটা ছোট হতে পারে।
এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, রাজস্ব আয়ের মধ্যে পরোক্ষ করের পরিমাণ অনেক বেশি, যা সভ্য দেশের লক্ষণ নয়। প্রত্যক্ষ কর আদায় বাড়াতে হবে। যে পরিমাণ কর আদায় করার কথা ছিল, তা হচ্ছে না। করযোগ্য সবার থেকে কর আদায় করতে না পারার কারণে করজাল সংকুচিত। কর আদায় বাড়ানোর বিষয়ে নতুন করে ভাবা হচ্ছে।
এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, একদিকে আয় বাড়ানো, অন্যদিকে নীতি-সহায়তা দেওয়ার মধ্যে ভারসাম্য আনা বড় চ্যালেঞ্জ। সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো সুশাসনের ঘাটতি। যার যে কাজ করা দরকার, তিনি তা করছেন না। ফলে পদে পদে ভোগান্তি হচ্ছে। সে জন্য আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা জরুরি। এ বিষয়ে কাজ চলছে।
তিনি বলেন, অর্থনীতির খারাপ সময়েও রাজস্ব আদায় আগের চেয়ে বাড়ছে। এপ্রিলে প্রবৃদ্ধি আরও ভালো হবে। যারা কর দিচ্ছেন না, তাদের নোটিশ করা হচ্ছে। আগামী বছর থেকে কোম্পানির কর রিটার্ন অনলাইনে দাখিলের নিয়ম করা হবে।
মাসরুর রিয়াজ বলেন, রমজানের আগে নিত্যপণ্যে করছাড়, পর্যাপ্ত আমদানি এবং সরবরাহ পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় খাদ্য মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমেছে। গত জুলাইয়ের আগ পর্যন্ত টাকা ছাপিয়ে যেভাবে ব্যাংকে তারল্য সহায়তা দেওয়া হয়েছে, এখন তা কমে আসছে। টাকা পাচার কমেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ডলার বিক্রি কমেছে। এর ফলে রিজার্ভ ইতিবাচক। তিনি বলেন, যারা ১৫ থেকে ২০ বছর ধরে কর অব্যাহতি পেয়ে আসছেন, তাদের বিষয়ে এনবিআরকে নতুন করে ভাবা দরকার।
সেমিনারে আরও বক্তব্য দেন ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির নির্বাহী পরিচালক নুরুল কবীর। ইআরএফ প্রেসিডেন্ট দৌলত আক্তার মালা সভাপতিত্ব করেন। সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম সঞ্চালনা করেন।