যুদ্ধের আবহে বিজেপি সরকারের জাতগণনার ঘোষণা ও ‘শুভংকরের ফাঁকি’
Published: 10th, May 2025 GMT
পেহেলগামের ‘বদলা’ কবে কীভাবে নেওয়া হবে, সেই আলোচনা যখন তুঙ্গে, তখন আচমকাই ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার ঘোষণা করে, পরবর্তী জনগণনার সময় জাতগণনাও করা হবে। ‘যুদ্ধ যুদ্ধ’ আবহে প্রত্যাঘাতের ব্যাপ্তি ও চরিত্র জল্পনায় মশগুল ভারতীয়দের কাছে এ ঘোষণার আকস্মিকতা ছিল অভাবিত। তার কারণও ছিল।
প্রথমত, এমন অস্থির সময়ে ওই রকম এক ঘোষণা যে হতে পারে, সে প্রত্যাশা কারও ছিল না। দ্বিতীয়ত, ঘোষণাটি করল সেই দলের সরকার, যারা আবহমান কাল ধরে জাতগণনার বিরোধিতা করে এসেছে। যুদ্ধের আবহে এই ‘অ্যান্টিক্লাইম্যাক্স’ নিয়ে চলছে রাজনৈতিক চর্চা। শুরু হয়েছে কৃতিত্বের দাবি ঘিরে চাপান–উতোর।
অতীত প্রেক্ষাপট ও বর্তমানের বাস্তবতাএ ঘোষণা নিয়ে বিস্ময়ও অন্তহীন। আরএসএসের পক্ষপুটে লালিত, পালিত ও আশ্রিত ‘ব্রাহ্মণ্যবাদী’ বিজেপি বরাবর নীতি ও আদর্শগতভাবে জাতগণনার বিরোধিতা করে এসেছে। তারাই কেন ভোল পাল্টে এ সিদ্ধান্ত নিল—এ প্রশ্ন আলোড়ন তুলেছে। কংগ্রেস দু-তিন বছর ধরে নিয়মিত জাতগণনার দাবি জানাচ্ছে। কিন্তু অতীতে তারাও এর পক্ষে ছিল না।
জওহরলাল নেহরু ১৯৫১ সালের প্রথম জনগণনার সময় জাতগণনা না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ‘জাতপাতহীন নতুন ভারত’ গড়ে তোলার তাগিদে। ২০১১ সালে মনমোহন সিংয়ের জমানায় জাত–ঘোষণার বিষয়টি ‘ঐচ্ছিক’ রাখা হয়েছিল। গণনা শেষে সরকার নানাবিধ ‘ভুলভ্রান্তির’ কারণ দেখিয়ে জাত-তথ্য প্রকাশ করেনি।
তার পর থেকে মোদির উত্থান কংগ্রেসকে যত কমজোরি করেছে, ততই তারা আঁকড়ে ধরতে চেয়েছে জাতগণনার দাবি। ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটে জাতভিত্তিক দলগুলোর মতো রাহুল গান্ধীও স্লোগান দেন ‘জিতনি আবাদি উতনা হক’। অর্থাৎ যার জনসংখ্যা যত, তার প্রাপ্যও তত।
সে দাবিই ক্রমে মুখ্য হয়ে এখন কংগ্রেসের হাতিয়ার। শতাব্দীপ্রাচীন দল এখন সারা দেশে প্রচার করছে, তাদের চাপেই মোদি সরকার জাতগণনায় রাজি হয়েছে। তারাই মোদিকে মাথা নোয়াতে বাধ্য করেছে। হোর্ডিং ও পোস্টার পড়েছে জায়গায় জায়গায়। কৃতিত্বের মুখ্য দাবিদার হয়ে উঠেছেন রাহুল গান্ধী।
বিজেপিও ছেড়ে কথা কইছে না। তাদের দাবি, কংগ্রেস কোনো দিন যা করতে চায়নি, নরেন্দ্র মোদির সরকার তা করার সাহস দেখাল। কৃতিত্বের এই দাবি ও পাল্টা দাবির মধ্যেই ‘যুদ্ধ যুদ্ধ’ আবহে রাজনৈতিক জল্পনা ও বিতর্কের জন্ম দিয়েছে সরকারের এই সিদ্ধান্ত।
সরকারি ঘোষণা ও ‘শুভংকরের ফাঁকি’যদিও এর মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে ‘শুভংকরের ফাঁকি’; কেননা সরকারি ঘোষণায় বলা হয়নি জনগণনা কবে হবে। এ–ও বলা হয়নি, জনগণনার ফলের ওপর নির্ভর করে দেশের বিদ্যমান সংরক্ষণব্যবস্থায় বদল ঘটানো হবে কি না কিংবা হলেও কবে থেকে। কাজ হলো কি না পরের কথা, আসল কথা কাজ হওয়ার ঘোষণা! ওটাই আসল; বিশেষ করে ভোটের মুখে।
সরকারিভাবে এ ঘোষণার পর প্রধানমন্ত্রী দ্বিতীয়বার বিহারে গেছেন। বেশ বোঝা যাচ্ছে, পাকিস্তানকে জবাব দেওয়ার চেয়েও বিহারের ভোটে উতরানো তাঁর কাছে জরুরি। কেন তিনি পেহেলগাম নিয়ে সর্বদলীয় বৈঠকে না থেকে গোটা দিন বিহারে কাটিয়েছিলেন, সেটাও এখন বেশ বোঝা যাচ্ছে।
■ আরএসএসের পক্ষপুটে লালিত, পালিত ও আশ্রিত ‘ব্রাহ্মণ্যবাদী’ বিজেপি বরাবর নীতি ও আদর্শগতভাবে জাতগণনার বিরোধিতা করে এসেছে। তারাই কেন ভোল পাল্টে এই সিদ্ধান্ত নিল—এ প্রশ্ন আলোড়ন তুলেছে। ■ বিজেপি এতকালের আদর্শ ও নীতি পাশে সরিয়ে জাতগণনার ঘোষণা দিয়েছে। ভবিষ্যতে সিদ্ধান্ত রূপায়িত হোক না হোক, এ বছরের শেষে বিধানসভার ভোটে জিততে ঘোষণাটুকু যথেষ্ট বলে মনে করছে তারা।স্বাধীন ভারতে প্রথম জনগণনা হয়েছিল ১৯৫১ সালে। সেই থেকে প্রতি ১০ বছর অন্তর জনগণনা হয়ে আসছে। শেষবার হয় ২০১১ সালে। ২০২১ সালের গণনা স্থগিত থাকে কোভিডের কারণে। ২০২৬ সালে সরকারের জানানোর কথা, কবে হবে জনগণনা।
এই যে এতগুলো দশক কেটে গেল, এতবার জনগণনা হলো, একবারও কিন্তু জাতগণনা হয়নি। এখন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হলে তা কখন হতে পারে? সেটাও জরুরি বিষয়। কারণ, গণনা যখনই হোক, তার ফল বেরোতে অন্তত দু–তিন বছর লাগার কথা।
গণনা ২০৩১ সালে হলে ২০৩৪ সালের আগে জাতগণনার তথ্য না পাওয়ার কথা। সেই তথ্য অনুযায়ী জাত অনুপাতে নতুন সংরক্ষণব্যবস্থা চালু হবে কি না, হলেও কীভাবে ও কখন, সেসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজা এখন বৃথা।
কারণ, এসব প্রশ্নের কোনো উত্তরই সরকার দেয়নি। মন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণব কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত ঘোষণার পর গণমাধ্যমকে কোনো প্রশ্ন করার সুযোগ দেননি। কাজেই হেঁয়ালি ও বিভ্রমের শেষ নেই।
সুপ্রিম কোর্ট মোট সংরক্ষণ সর্বোচ্চ কত হবে তা নির্ধারণ করে রেখেছেন। সব ধরনের সংরক্ষণ মিলিয়ে শতাংশের হার কখনো ৫০–এর বেশি হবে না। জাতগণনায় যখন দেখা যাবে অনগ্রসর সম্প্রদায়ের মানুষ সবচেয়ে বেশি, তখন সংরক্ষণের হার বাড়াতে সরকার কী পদক্ষেপ নেবে?
এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই। আপাতত চলছে বিজেপি ও কংগ্রেসের তরজার লড়াই। অতীত ভুলে দুই পক্ষই এখন নিজের পিঠ চাপড়াচ্ছে।
ভোট বড় বালাই, বিহার কঠিন ঠাঁইজাতগণনা বরাবর বিজেপির দুই চোখের বিষ। ‘মনুবাদী’ দল বলে তারা পরিচিত। বর্ণপ্রথা ও ব্রাহ্মণ্যবাদে বরাবরের বিশ্বাসী তারা। আজন্ম তাই তারা জাতগণনার বিরোধিতা করে গেছে।
২০২১ সালেও মোদি সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী নিত্যানন্দ রাই লোকসভায় প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, ‘সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তফসিলি জাতি ও উপজাতি ছাড়া জনগণনার সময় জাতভিত্তিক গণনা হবে না। সরকারের এই সিদ্ধান্ত নীতিগত।’
ওই বছরেই সুপ্রিম কোর্টে হলফনামা দিয়েও মোদি সরকার বলেছিল, ‘এ ধরনের গণনা প্রশাসনিক দিক থেকে কঠিন ও অসুবিধাজনক।’
সেই বিজেপি এখন ঢাকঢোল পিটিয়ে জাতগণনা নিয়ে তুমুল প্রচারে নেমেছে। কেন? সেই উত্তর খুঁজতে হলে বিহারের দিকে তাকাতে হবে।
এই বিহারেই সাম্প্রতিক অতীতে দেশের প্রথম জাতগণনা হয়েছিল। তা করিয়ে ছিলেন নীতীশ কুমার। ২০২৩ সালে। তখন তিনি আরজেডি ও কংগ্রেসের জোটসঙ্গী।
সেই সময় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছিলেন, ‘দেশবাসীর মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করে নীতীশের জেডিইউ পাপ করছে।’
তারপর জাতগণনা হয় কংগ্রেস–শাসিত কর্ণাটক ও তেলেঙ্গানাতেও। প্রতিবারই প্রবল বিরোধিতা করে আসা বিজেপি ও তার নেতা নরেন্দ্র মোদির কণ্ঠে এখন ভিন্ন সুর কেন? কারণ, তিনি বুঝেছেন, বিহারে ক্ষমতা ধরে রাখতে হলে জেডিইউসহ অন্য শরিকদের তুষ্ট রাখা জরুরি।
বিহারের জেডিইউ, এলজেপি ও হিন্দুস্তানি আওয়ামি মোর্চা (হাম)—তিন দলই জাতগণনার পক্ষে। কংগ্রেস-আরজেডি-বামপন্থীদের জোটও জাতগণনার অঙ্গীকার করে বসে আছে। একদিকে বিরোধী ‘ইন্ডিয়া’ জোটের এই প্রচার, অন্যদিকে নীতীশ কুমারের ফিকে হয়ে আসা ভাবমূর্তি বিজেপিকে অসহায় করে তুলছিল।
বিপদটা বুঝতে পেরে নরেন্দ্র মোদির বিজেপি এতকালের আদর্শ ও নীতি পাশে সরিয়ে জাতগণনার ঘোষণা দিল। ভবিষ্যতে সিদ্ধান্ত রূপায়িত হোক না হোক, এ বছরের শেষে বিধানসভার ভোটে জিততে এই ঘোষণা যথেষ্ট বলে মনে করছে তারা। ভোট বড় দায়।
ওয়াক্ফ আইন, জাতগণনা ও পসমন্দা মুসলমানবিজেপির উদ্যোগী হওয়ার আরও এক কারণ ওয়াক্ফ আইন। জেডিইউ, এলজেপি, হাম বা দক্ষিণি শরিক টিডিপি ওয়াক্ফ আইন সমর্থন করায় মুসলমান সমাজ ক্ষিপ্ত। দিল্লিতে সম্প্রতি মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড আয়োজিত এক সম্মেলনে বিভিন্ন মুসলিম নেতা এই দলগুলোকে সতর্ক করে জানিয়ে দিয়েছেন, তারা যদি আইন রদ করাতে সরকারকে বাধ্য না করে, তাহলে মুসলমান সমাজের রোষের মোকাবিলা করতে হবে।
সুপ্রিম কোর্ট বিরুদ্ধে না গেলে ওয়াক্ফ আইন খারিজ করতে বিজেপি রাজি নয়। তারা এখনো মনে করে, ভোটের আগে ওয়াক্ফ আইনের সমর্থনে তাদের প্রচার ক্ষুরধার করে তুলবে, যাতে ধর্মীয় মেরুকরণ তীব্রতর হয়। তবে তার আগে প্রয়োজন কোণঠাসা শরিকদের তুষ্ট করা। জাতগণনায় সম্মত হওয়া ছাড়া বিজেপির কাছে তাই দ্বিতীয় উপায় ছিল না।
নীতি ও আদর্শগতভাবে জাতগণনার বিরোধী বিজেপির সর্বেসর্বা নরেন্দ্র মোদি কিছুদিন আগেও জানিয়েছিলেন, তাঁর দৃষ্টিতে দেশের সবচেয়ে বড় জাত দারিদ্র্য। পরে কিঞ্চিৎ ব্যাখ্যা করে বলেছিলেন, তাঁর কাছে ভারতীয়দের জাত মাত্র চারটি—দরিদ্র, নারী, কৃষক ও যুবসমাজ।
সেই মোদি জাতগণনার ঘোষণার মধ্য দিয়ে অনগ্রসর হিন্দুদের শুধু নয়, মুসলমান সমাজকেও কাছে টানতে কোমর কষতে শুরু করেছেন। সেই ইঙ্গিত ইতিমধ্যেই দলীয় নেতারা দিতে শুরু করেছেন।
পসমন্দা, অর্থাৎ মুসলমানদের মধ্যে সবচেয়ে অনগ্রসর শ্রেণিকে কাছে টানতে নরেন্দ্র মোদি অনেক দিন থেকেই সক্রিয়। মণ্ডল কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী, মুসলমানদের কোনো কোনো অংশ কেন্দ্র ও রাজ্যের অনগ্রসর তালিকাভুক্ত।
বিজেপির অনগ্রসর মোর্চার সভাপতি কে লক্ষ্মণ বলেছেন, এসব গোষ্ঠী জাতগণনায় নিজেদের অনগ্রসর বলে অন্তর্ভুক্ত করবে। বিজেপির সংখ্যালঘু মোর্চার সভাপতি জামাল সিদ্দিকিও সেই সুরে বলেছেন, জাতগণনায় পসমন্দা মুসলমানরা নিজেদের অনগ্রসর বলে নথিবদ্ধ করবেন।
বিজেপি কিছুদিন ধরেই বলতে শুরু করেছে, ধর্মগতভাবে মুসলিম সমাজ ‘জাতভিত্তিক’ না হলেও সেখানে ‘উচ্চবর্ণের’ উপস্থিতি মাত্র ২০ শতাংশ। বাকি ৮০ শতাংশই অনগ্রসর। তারাই পসমন্দা মুসলমান।
২০১১ সাল পর্যন্ত জনগণনায় সব মুসলমান ‘সম্প্রদায়’ হিসেবে গণ্য হয়ে এসেছে; জাতভিত্তিক নয়। বিজেপি এখন প্রচারে নেমেছে, জাতগণনায় মুসলমানদের মধ্যে অনগ্রসররা নিজেদের নথিভুক্ত করলে পসমন্দা মুসলমানরাই সংরক্ষণের বেশি সুবিধা ভোগ করবেন।
সাচার কমিটির রিপোর্টে দেশের মুসলমানদের মধ্যে তফসিলি জাতি, উপজাতি ও অনগ্রসর শ্রেণি ছিল ৪০ শতাংশ। যদিও পসমন্দা মুসলমানদের দাবি, তাঁরা ৮০ শতাংশ। বিহারের জাতগণনায় অনগ্রসর মুসলমানের সংখ্যা ছিল ৭১ শতাংশ। তেলেঙ্গানায় ওই হার ছিল ৮১।
স্পষ্টতই, নীতি ও আদর্শকে পাশে সরিয়ে নরেন্দ্র মোদি এমনি এমনি জাতগণনায় রাজি হননি। হিন্দুদের সঙ্গে মুসলমান সমর্থন আদায়েও এটা হতে চলেছে তাঁর অস্ত্র। তাঁর চোখে এটাই হবে ওই সমাজের উন্নয়নের সোপান।
‘শুভংকরের ফাঁকি’ মোকাবিলাবিরোধীদের ‘হাতিয়ার’ ছিনতাই করে মোদির বিজেপি আপাতত এক কদম এগিয়ে গেল। রাজনীতিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণই বড় কথা, দাবি জানানো নয়। কিছুটা হতোদ্যম কংগ্রেস এবং ‘ইন্ডিয়া’ জোটের শরিকেরা এখন তাই বিজেপিকে চেপে ধরতে চাইছে।
তাদের দাবি, আলগোছে ঘোষণা নয়, জাতগণনার নির্দিষ্ট রোডম্যাপ সরকার দিক। সেই সঙ্গে জানানো হোক, গণনা অনুযায়ী দেশের সংরক্ষণের ছবিটা কেমন হবে। সেই সংরক্ষণ শুধু সরকারি সংস্থায় শিক্ষা ও চাকরিতে নয়, ওই পরিধি বেসরকারি ক্ষেত্রেও বিস্তার করতে হবে।
এই প্রথম দেশের সব দল জাতগণনার প্রশ্নে এককাতারে দাঁড়াল। কিন্তু সরকারি ঘোষণায় ‘শুভংকরের ফাঁকি’র মোকাবিলা বিজেপি কীভাবে করে, তা দেখার আগ্রহ বাড়ছে; যদিও সেই মীমাংসার ঢের আগে চুকেবুকে যাবে বিহার বিধানসভার ভোট।
●সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র অনগ রসর শ ভ কর র ফ সরক র র বল ছ ল মন ত র ফ আইন বর বর ও আদর আদর শ প রথম র সময়
এছাড়াও পড়ুন:
পিডিবির ভুলে ২৪৫ কোটি টাকা জরিমানা দিতে হলো বাংলাদেশকে
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন সংস্থা বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) খামখেয়ালিজনিত এক ভুল সিদ্ধান্তের কারণে বাংলাদেশকে দুই কোটি মার্কিন ডলার, অর্থাৎ ২৪৫ কোটি টাকা জরিমানা দিতে হয়েছে।
খামখেয়ালিটি হলো বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ২০০০ সালে হওয়া ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্সের (আইসিসি) আরবিট্রেশন ট্রাইব্যুনালে (বিরোধ নিষ্পত্তির আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা) একটি মামলায় পক্ষভুক্ত না হওয়া। পক্ষভুক্ত হতে গেলে বাংলাদেশকে ৬০ হাজার মার্কিন ডলার খরচ করতে হতো। তা করেনি পিডিবি। ফলে আইসিসি আরবিট্রেশন ট্রাইব্যুনালে একতরফা রায় হয়েছে। দুই যুগ পর এখন বাংলাদেশকে জরিমানা দিতে হয়েছে ৩৩৩ গুণ বেশি অর্থ।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ গত ১৯ মে পিডিবিকে চিঠি দিয়ে জানিয়ে দিয়েছে, এ টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে ঋণ হিসেবে পিডিবিকে দেওয়া হবে, যা তারা দেবে যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি স্মিথ কো-জেনারেশন (বাংলাদেশ) প্রাইভেট লিমিটেডকে। হরিপুরে ১০০ মেগাওয়াটের একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের স্পনসর (পৃষ্ঠপোষক) ছিল এই স্মিথ কো-জেনারেশন।
আইনজীবী ও পিডিবির তৎকালীন পর্ষদের খামখেয়ালির কারণে আজ এত বড় অঙ্কের অর্থ গচ্চা দিতে হলো। আইসিসির আরবিট্রেশন ট্রাইব্যুনালে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ না করাটা ছিল মস্ত ভুল। ফলে একতরফা রায় হয়েছে, যা বাংলাদেশের বিপক্ষে গেছে।বিদ্যুৎ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খানঅবশ্য পিডিবি অর্থ বিভাগের ঋণ নেয়নি। সংস্থাটি নিজের তহবিল থেকে গত ২৩ মে ২৪৫ কোটি টাকা পরিশোধ করে দিয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে থাকা সব মামলা প্রত্যাহার করে নিয়েছে কোম্পানিটি।
এই পাওনা টাকাকে কেন্দ্র করেই ২০২৪ সালের অক্টোবরে যুক্তরাষ্ট্রে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুরের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছিল। জটিলতা এড়াতে তাঁরা দুজন পরে হোটেল থেকে যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের বাসায় (বাংলাদেশ হাউস) গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন।
বিদ্যুৎ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আইনজীবী ও পিডিবির তৎকালীন পর্ষদের খামখেয়ালির কারণে আজ এত বড় অঙ্কের অর্থ গচ্চা দিতে হলো। আইসিসির আরবিট্রেশন ট্রাইব্যুনালে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ না করাটা ছিল মস্ত ভুল। ফলে একতরফা রায় হয়েছে, যা বাংলাদেশের বিপক্ষে গেছে।’
ঘটনা শুরু যেভাবেমূল ঘটনা ১৯৯৭ সালের অক্টোবরের। তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার হরিপুরে বেসরকারি খাতে ১০০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের স্মিথ কো-জেনারেশন ইন্টারন্যাশনালের সহযোগী প্রতিষ্ঠান স্মিথ কো-জেনারেশন (বাংলাদেশ) প্রাইভেট লিমিটেডের সঙ্গে দুটি চুক্তি করে বাংলাদেশ। কোম্পানিটির সঙ্গে পিডিবির একটি চুক্তি হয় ১৯৯৭ সালের ১৪ অক্টোবর। দুই দিন পর ১৬ অক্টোবর সরকারের সঙ্গে আরেকটি চুক্তি হয় বিদ্যুৎ কেনার (পিপিএ)।
চুক্তি অনুযায়ী বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হওয়ার কথা ১৯৯৮ সালের ১৫ আগস্ট। কিন্তু কোম্পানিটি তা পারেনি। শর্ত ছিল নির্ধারিত দিন থেকে উৎপাদন করতে না পারলে দুই মাস মেয়াদ বাড়াবে সরকার, তবে প্রতিদিনের জন্য ১০ হাজার মার্কিন ডলার করে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। কোম্পানিটি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন তো দূরের কথা, কোনো নির্মাণকাজ করতে পারেনি; বরং আরও ৬ মাস ২০ দিন সময় চায়। সরকার তা না মেনে ১৯৯৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি পিপিএ ও জমির ইজারা চুক্তি বাতিল করে দেয়। শুধু তা–ই নয়, ব্যাংক নিশ্চয়তার (পিজি) ১৫ লাখ ডলারও নিয়ে নেয় পিডিবি।
সচিবালয়ে গত ২৯ এপ্রিল অনুষ্ঠিত অর্থনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির বৈঠক থেকে মার্কিন কোম্পানিটিকে ২ কোটি ডলার দেওয়ার জন্য যে প্রস্তাব উপস্থাপন করা হয়েছে, তাতে এ ঘটনার উল্লেখ রয়েছে। বিদ্যুৎসচিব ফারজানা মমতাজ এ প্রস্তাব উপস্থাপন করেন। এতে দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করার কথা আসেনি। যদিও সম্প্রতি আলাদা এক চিঠিতে অর্থ বিভাগ এ ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে বলেছে বিদ্যুৎ বিভাগকে।
বিদ্যুৎসচিবের সঙ্গে গত ১৫ মে তাঁর কার্যালয়ে দেখা করে জানতে চাওয়া হয় যে যাঁদের কারণে বাংলাদেশকে এখন ২৪৫ কোটি টাকা গচ্চা দিতে হচ্ছে, তাঁদের তিনি বাঁচিয়ে দিলেন কেন। তিনি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে অপারগতা জানান।
ঘটনাটা শেষ হয়েছে। তবে পিডিবির ভুল ছিল অনেক বড়অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদবিষয়টি যেভাবে আদালতে গড়ালঅর্থনৈতিক বিষয়-সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটিতে পাঠানো বিদ্যুৎসচিবের প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়েছে, চুক্তি বাতিলের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিটি ২০০০ সালে ঢাকার সাব জজ পঞ্চম আদালতে আরবিট্রেশন মিসকেইস (বিবিধ মামলা) এবং নারায়ণগঞ্জের সাব জজ প্রথম আদালতে আরেকটি আরবিট্রেশন বিবিধ মামলা করে। উভয় মামলাই আদালত খারিজ করে দেন। আদালতে মামলার পাশাপাশি কোম্পানিটি পরে পিপিএ বাতিল ও পিজি নগদায়নের বিরুদ্ধে আইসিসি আরবিট্রেশনে যেতে পিডিবিকে নোটিশ দেয়। নোটিশের পরিপ্রেক্ষিতে পিডিবি যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিটিকে চিঠি দিয়ে জানায়, আইনজীবী আজমালুল হোসেন কিউসি হতে পারেন আরবিট্রেটর।
কিন্তু আইসিসি বিদেশে আরবিট্রেশন মামলায় অংশগ্রহণের জন্য ট্রাইব্যুনাল খরচ বাবদ নির্ধারণ করে ৯ লাখ ৫০ হাজার ডলার, যা উভয় পক্ষকে সমানভাবে বহন করতে হবে। এর মধ্যে ১ লাখ ২০ হাজার ডলার দিতে হবে অগ্রিম। অর্ধেক হিসেবে তখন পিডিবির খরচ করতে হতো অগ্রিমের ৬০ হাজার ডলার।
তখনকার পিডিবির পরিচালনা পর্ষদ সিদ্ধান্ত নেয়, তারা ট্রাইব্যুনাল খরচের কোনো অর্থ দেবে না। পিডিবির তৎকালীন আইনজীবী প্যানেল একই পরামর্শ দেয়। আইনজীবীরা আরও মত দেন, দেশে আরবিট্রেশন আইন হয়েছে ২০০১ সালে। এর আগে আইসিসির আরবিট্রেশনের রায় বাংলাদেশের বাইরে কার্যকর হবে না। তাঁরা মামলায় পক্ষভুক্ত না হতে পিডিবিকে পরামর্শ দেন।
পরে একপক্ষীয় শুনানি শেষে আইসিসি আরবিট্রেশন আদালত ২০০৩ সালের ৩০ অক্টোবর রায় দেন। রায়ে বলা হয়, পিডিবি বছরে ৪ শতাংশ সুদসহ মোট ১ কোটি ৩০ লাখ ৬০ হাজার মার্কিন ডলার ক্ষতিপূরণ দেবে স্মিথ কো-জেনারেশনকে।
রায় বাস্তবায়নের ছয় মামলাআইসিসি আরবিট্রেশন ট্রাইব্যুনালের রায় বাস্তবায়নে স্মিথ কো-জেনারেশন পরে ছয়টি মামলা করে। এগুলো হয় যুক্তরাষ্ট্রের ডিস্ট্রিক্ট কোর্ট ফর দ্য ডিস্ট্রিক্ট অব অব কলাম্বিয়া, ডিস্ট্রিক্ট কোর্ট ফর দ্য নর্দার্ন ডিস্ট্রিক্ট অব নিউইয়র্ক, সুপ্রিম কোর্ট অব নিউইয়র্ক, স্কটল্যান্ডের এডিনবার্গের কোর্ট অব সেশন, সুইজারল্যান্ডের ডিস্ট্রিক্ট কোর্ট অব বাডেন এবং ঢাকার আদালতে।
আইসিসির রায় বাস্তবায়নে ২০০৭ সালের ২০ জুলাই রায় দেন যুক্তরাষ্ট্রের ডিস্ট্রিক্ট কোর্ট অব কলাম্বিয়া। স্মিথ কো-জেনারেশন এ আদালতে বিষয়টি আবার উত্থাপন করে। এরপর ২০২৪ সালের ১৯ মে পিডিবির বিরুদ্ধে সংশোধিত চূড়ান্ত রায় দেন আদালত। এবারের রায়ে বলা হয়, পিডিবি ৩ কোটি ১৭ লাখ ১০ হাজার ডলার পরিশোধ করবে স্মিথ কো-জেনারেশনকে। কোম্পানিটি তখন তার আইনি প্রতিষ্ঠান ডোয়ান মরিস এলএলপিকে বিষয়টি জানায়। কিন্তু রায় আর বাস্তবায়ন হচ্ছিল না।
বিষয়টি নিয়ে জানতে গত ২৮ মে পিডিবির চেয়ারম্যান মো. রেজাউল করিমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তিনিও কোনো কথা বলতে রাজি হননি।
অর্থ উপদেষ্টা ও গভর্নর যে বিপদে পড়েছিলেনআন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও বিশ্বব্যাংকের বার্ষিক সভায় যোগ দিতে ২০২৪ সালের ২০ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন যায় উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বাধীন একটি দল, যেখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুরও ছিলেন। ২১-২৬ অক্টোবর (২০২৪) ছিল এ বার্ষিক সভা।
বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, উপদেষ্টা ও গভর্নরের ওয়াশিংটন যাওয়ার বিষয়টি জানতে পেরে স্মিথ কো-জেনারেশন আরেকটি মামলা করে ডিস্ট্রিক্ট কোর্ট ফর ডিস্ট্রিক্ট অব কলাম্বিয়ায়। আদালত তখন অর্থ উপদেষ্টা ও গভর্নরের জবানবন্দি নেওয়ার নির্দেশ দেন। কিন্তু যেহেতু অর্থ উপদেষ্টা ও গভর্নরের কূটনৈতিক অনাক্রম্যতা আছে এবং তাঁরা পিডিবির সঙ্গে সম্পর্কিত নন, তাই তাঁরা জবানবন্দি দেননি।
স্মিথ কো-জেনারেশন তখন আবার আদালতে (যুক্তরাষ্ট্র) যায়। আদালত ২৫ অক্টোবর (২০২৪) গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন এবং সালেহউদ্দিন আহমেদ ও আহসান এইচ মনসুরকে আটক করে আদালতে নিয়ে আসতে ইউএস মার্শাল সার্ভিসকে নির্দেশ দেন। গ্রেপ্তার এড়াতে তাঁরা দুজন তখন আশ্রয় নেন যুক্তরাষ্ট্রের ম্যারিল্যান্ডে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের সরকারি বাসভবনে। তাঁরা ছিলেন ওয়াশিংটন ডিসির ১০ নম্বর সড়কে অবস্থিত অ্যাম্বাসি স্টু হোটেলে। দূতাবাসের গাড়িতে করে তাঁরা ম্যারিল্যান্ডে রাষ্ট্রদূতের বাসায় চলে যান।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশ দূতাবাস ২০২৪ সালের ১৮ অক্টোবর এ ব্যাপারে বাংলাদেশের পক্ষে কাজ করতে আইনি প্রতিষ্ঠান ফলি হোয়াগ এলএলপিকে নিয়োগ দেয়। তারা আপিল করলে আদালত গ্রেপ্তারি পরোয়ানা স্থগিত করেন এবং শুনানির দিন ধার্য করেন ২৮ অক্টোবর (২০২৪)। ফলি হোয়াগ এলএলপি বিষয়টি আদালতের বাইরে নিষ্পত্তির জন্য মধ্যস্থতার আবেদন জানায় বিচারকের কাছে এবং বিচারক তা গ্রহণ করেন। এভাবেই অর্থ উপদেষ্টা ও গভর্নর ওই যাত্রায় রক্ষা পান।
অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ গত ৩০ জুন প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঘটনাটা শেষ হয়েছে। তবে পিডিবির ভুল ছিল অনেক বড়।’
বিদ্যুৎ বিভাগ বলেছে, ২ কোটি ডলারের বাইরে বাংলাদেশের পক্ষে কাজ করা আইনি প্রতিষ্ঠান ফলি হোয়াগকে ৩ লাখ ৯৬ হাজার ডলার দিতে হয়েছে।নিষ্পত্তির পথ খুলল যেভাবেমধ্যস্থতার মাধ্যমে নিষ্পত্তির জন্য যুক্তরাষ্ট্রের আদালতের রায়কে ভিত্তি ধরে দেশে তখন গুরুত্বের সঙ্গে কাজ শুরু করেন বিদ্যুৎ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। ২০২৪ সালের ৪ নভেম্বর এ বিষয়ে নীতিগত সম্মতি দেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।
এরপর স্মিথ কো-জেনারেশনের মধ্যস্থতাকারী, বিদ্যুৎ বিভাগ ও পিডিবির কর্মকর্তা এবং অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান অনলাইনে ৫টি বৈঠক করেন। শুরুতে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে প্রস্তাব দেওয়া হয়, জব্দ করা ব্যাংক নিশ্চয়তার ১৫ লাখ ডলার ফেরত দেওয়ার মাধ্যমে বিষয়টি নিষ্পত্তি করা হোক। বিপরীতে স্মিথ কো-জেনারেশন দাবি করে ৩ কোটি ১৭ লাখ ১০ হাজার ডলার। আরও দাবি করে, মামলার খরচ বাবদ আরও ১ কোটি ৮০ লাখ ডলার তাদের দিতে হবে।
বাংলাদেশের পক্ষ থেকে পাল্টা প্রস্তাবে কোম্পানিটিকে বলা হয়, ১৫ লাখ ডলার ফেরত দেওয়ার পাশাপাশি দেশের বিদ্যমান আইনের আওতায় বিদ্যুৎ খাতে তাদের বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া হবে। এতেও রাজি হয়নি স্মিথ কো–জেনারেশন। বাংলাদেশ পরে ১ কোটি ডলারে বিরোধ নিষ্পত্তির প্রস্তাব দেয়। স্মিথ কো-জেনারেশন তখন নতুন প্রস্তাব দেয়। সেটি হলো, এককালীন ২ কোটি ৫০ লাখ ডলারে বিরোধ নিষ্পত্তি হতে পারে। অথবা ২ কোটি ৪০ লাখ ডলার ও দুটি বিদ্যুৎ প্রকল্পে বিনিয়োগের সুযোগ দিলে তারা মেনে নেবে।
বিষয়টি নিয়ে মধ্যস্ততায় থাকা বাংলাদেশের অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামানের সঙ্গে গত ২৬ মে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হয়। তবে তিনিও কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
অবশ্য অর্থ বিভাগ ও পিডিবি সূত্র জানায়, পরে স্মিথ কো-জেনারেশন ২ কোটি ডলারে রাজি হয়। বাংলাদেশ সরকারও সিদ্ধান্ত নেয়, এই পরিমাণ অর্থ ওই কোম্পানিকে দিয়ে দেওয়া হবে। এ বিষয়ে আগেই সম্মতি দিয়ে রেখেছিলেন (গত ১৮ ফেব্রুয়ারি) প্রধান উপদেষ্টা ও অর্থ উপদেষ্টা। গত ২৮ এপ্রিল দুই পক্ষের মধ্যে এ বিষয়ে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
বিদ্যুৎ বিভাগ বলেছে, ২ কোটি ডলারের বাইরে বাংলাদেশের পক্ষে কাজ করা আইনি প্রতিষ্ঠান ফলি হোয়াগকে ৩ লাখ ৯৬ হাজার ডলার দিতে হয়েছে।
ঘটনা শুনে মনে হচ্ছে আইসিসি আরবিট্রেশন ট্রাইব্যুনালে অংশ নিলে বাংলাদেশেরই জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি ছিল, যেহেতু নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাজটি তারা (যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি) পারেনি। অথচ আজ বড় অঙ্কের জরিমানা তো গুনতে হচ্ছেই, মাঝখানে বিব্রতকর অবস্থা তৈরি হলো এবং দেশের বদনাম হলো।ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান ‘দেশের বদনাম হলো’১৯৯৬-৯৯ সময়ে পিডিবির চেয়ারম্যান ছিলেন নুরউদ্দিন মাহমুদ কামাল, তিনি ২০২২ সালের ৩ ডিসেম্বর মারা যান। ১৯৯৯-০০ সময়ে চেয়ারম্যান ছিলেন সাবেক সচিব কামরুল ইসলাম সিদ্দিক, যিনি মারা যান ২০০৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর। ২০০০-০২ সময়ে চেয়ারম্যান ছিলেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম এ মালেক, যিনি মারা যান ২০১৬ সালের ৮ জানুয়ারি।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঘটনা শুনে মনে হচ্ছে আইসিসি আরবিট্রেশন ট্রাইব্যুনালে অংশ নিলে বাংলাদেশেরই জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি ছিল, যেহেতু নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাজটি তারা (যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি) পারেনি। অথচ আজ বড় অঙ্কের জরিমানা তো গুনতে হচ্ছেই, মাঝখানে বিব্রতকর অবস্থা তৈরি হলো এবং দেশের বদনাম হলো।’
ইফতেখারুজ্জামান বলেন, দায়ী ব্যক্তিদের মধ্যে কেউ জীবিত থাকলে শাস্তি দিতে হবে। এমনকি প্রতিষ্ঠান হিসেবে পিডিবিরও শাস্তি পাওয়া উচিত। অর্থ বিভাগের পরামর্শ মেনে অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত হবে এ ব্যাপারে যথাযথ তদন্ত করা।