স্থলবন্দর দিয়ে নির্দিষ্ট কিছু পণ্য রপ্তানিতে ভারতের নিষেধাজ্ঞার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। শর্ত অনুযায়ী তৈরি পোশাক, ফল, ফলের স্বাদযুক্ত পানীয়, কোমল পানীয়, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, প্লাস্টিক পণ্য, সুতা, সুতার উপজাত ও আসবাব রপ্তানি করতে পারছেন না ব্যবসায়ীরা। আগে যেসব স্থলবন্দরে বিভিন্ন পণ্য নিয়ে রপ্তানিমুখী গাড়ির দীর্ঘ লাইন থাকত, এখন সেখানে শুধু কয়েকটি পণ্যবাহী গাড়িই চোখে পড়ছে। সব মিলে বন্দর-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই নিষেধাজ্ঞা অব্যাহত থাকলে ব্যবসা-বাণিজ্যে ধস নামতে পারে। 

তৈরি পোশাক রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করায় বেনাপোল বন্দরে আসা ৩৬টি ট্রাকের মধ্যে ১২টি সোমবার ফেরত গেছে ঢাকায়। ২৪টি ট্রাক এখনও বন্দরের কার্গো ইয়ার্ডে দাঁড়িয়ে আছে। ভারতের পেট্রাপোল কাস্টমস এখনও আগের এলসি বা টিটির পণ্য আমদানি বিষয়ে কোনো সমাধান দেয়নি। 

১৭ মে ভারতের বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের বৈদেশিক বাণিজ্য অধিদপ্তর (ডিজিএফটি) এক পরিপত্রের মাধ্যমে স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাকসহ কয়েকটি পণ্য আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। সেদিন বেনাপোল বন্দরে ভারতে প্রবেশের অপেক্ষায় পোশাক-বোঝাই ৩৬টি ট্রাক ছিল। কিন্তু ভারতীয় কাস্টমস পণ্য রপ্তানির অনুমতি না দেওয়ায় এসব ট্রাক বিপাকে পড়ে। শেষে গতকাল ১২টি ট্রাক ফেরত গেছে। এসব পণ্য এখন চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর দিয়ে রপ্তানি হবে বলে জানা গেছে। 

মাহমুদ সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের প্রতিনিধি জাহান আলী বলেন, ঢাকার রপ্তানিকারক আইএফএল ফ্যাক্টরি লিমিটেডের তৈরি পোশাকের ৫টি চালানের ১৫টি ট্রাক এখনও বেনাপোল বন্দরে দাঁড়িয়ে আছে। এসব চালানে ৬৩ হাজার ৩০৪ কেজি তৈরি পোশাক আছে, যার রপ্তানিমূল্য ৭ লাখ ৫৬ হাজার ১৩১ মার্কিন ডলার। 

ন্যাশনাল ফ্রেড কার্গো সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের প্রতিনিধি আশানুর রহমান বলেন, ঢাকার ডেনিম্যান লি.

নামে একটি প্রতিষ্ঠানের ৩৩ কার্টন তৈরি পোশাক রপ্তানির জন্য একটি ট্রাক বেনাপোল বন্দরে রোববার পৌঁছায়। এ চালানের রপ্তানিমূল্য ৮ হাজার ৯২৬ ডলার। পণ্যবোঝাই ট্রাকটি অপেক্ষায় রাখা হয়েছে, যদি ভারত থেকে আমদানির অনুমোদন দেয়। 

বন্ধ রয়েছে সিলেটের কয়েকটি স্থলবন্দর ও শুল্ক স্টেশন: শনিবার কিছু পণ্য ভারতে গেলেও রোববার থেকে বন্ধ রয়েছে সিলেটের কয়েকটি স্থলবন্দর ও শুল্ক স্টেশন। শেওলা স্থলবন্দর কাস্টমসের সহকারী কমিশনার বিকাশ সরকার জানান, গত শনিবার সাত ট্রাক পণ্য রপ্তানি হয়েছে। রোববার থেকে কোনো পণ্য যায়নি। এই বন্দর দিয়ে প্রাণ আরএফএলের পিভিসি পাইপ, প্লাস্টিক ডোর পণ্য এবং খাদ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ফুলকলির জুস, বিস্কুটসহ কিছু পণ্য রপ্তানি হয়ে থাকে। রোববার থেকে পিভিসি পাইপ বহনকারী তিনটি ট্রাক বন্দরে রয়েছে। 

তৈরি পোশাক ও খাদ্যসামগ্রীর মতো পণ্যের ওপর ভারতের নিষেধাজ্ঞার প্রভাব সিলেটের স্থলবন্দরগুলোতে খুব একটা পড়বে না বলে দাবি করছেন কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেটের কমিশনার তাহসিনুর রহমান। তিনি বলেন, তামাবিল স্থলবন্দরে কোনো প্রভাব পড়বে না। তবে শেওলাসহ দু’একটি শুল্ক স্টেশনে প্রভাব পড়তে পারে।
জানা গেছে, সিলেট বিভাগের চারটি স্থলবন্দর ও ৫টি শুল্ক স্টেশনের মধ্যে তামাবিল, শেওলা স্থলবন্দর এবং মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার চাতলাপুর ও জুড়ির ফুলতলা বটুলী শুল্ক স্টেশন দিয়ে কিছু তৈরি পোশাক, পানীয়, প্রক্রিয়াজাত খাবার, প্লাস্টিক ও পিভিসি সামগ্রী, তুলা, সুতা ও কাঠের আসবাব রপ্তানি হয়ে থাকে। অন্য বন্দর ও স্টেশন দিয়ে আমদানি-রপ্তানি হয় পাথর, কয়লাসহ অন্যান্য পণ্য। 

নিষেধাজ্ঞার পর কোনো গাড়ি যায়নি তামাবিল দিয়ে: সোমবার চাতলাপুর শুল্ক স্টেশন দিয়ে কিছু মাছ রপ্তানি হয়েছে। অন্য কোনো পণ্য যায়নি বলে জানিয়েছেন স্টেশনের স্টাফ মতছির আলী। এ ছাড়া জুড়ি উপজেলার বটুলী শুল্ক স্টেশন দিয়ে দুই দিন ধরে রপ্তানি বন্ধ। তামাবিল স্থলবন্দরের সহকারী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান জানান, বন্দর দিয়ে মাঝেমধ্যে খাদ্য ও প্লাস্টিক সামগ্রী রপ্তানি হয়। নিষেধাজ্ঞার পর কোনো গাড়ি যায়নি। কোনো পণ্য আটকাও পড়েনি। পাথর ও কয়লা আমদানি স্বাভাবিক। 

আখাউড়া স্থলবন্দরে অলস সময় পার করছেন কর্মকর্তা-কর্মচারী ও ব্যবসায়ীরা: আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে সোমবার শুধু মাছ, ভোজ্যতেল ও পাটজাত দ্রব্য ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলায় রপ্তানি হয়েছে। বন্দর-সংশ্লিষ্টরা জানান, কয়েক দিন আগেও যেখানে বিভিন্ন পণ্য নিয়ে রপ্তানিমুখী গাড়ির লম্বা লাইন থাকত, সেখানে শুধু তিন আইটেমের ১৬টি গাড়ি ছাড়া সোমবার অন্য কোনো গাড়ি চোখে পড়েনি। আগে মানুষের কোলাহল আর পণ্যবাহী গাড়ির হর্নের আওয়াজে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মুখরিত থাকত আখাউড়া স্থলবন্দর। এখন সেই কোলাহল নেই বন্দরের কোথাও। শুল্ক স্টেশন, বন্দরের কর্মকর্তা-কর্মচারী, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট ও ব্যবসায়ীরা অলস সময় পার করছেন।

আখাউড়া স্থলবন্দরের মৎস্য রপ্তানিকারক অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ফারুক মিয়া বলেন, ভারতের নিষেধাজ্ঞার ফলে আজ (সোমবার) প্রায় অর্ধকোটি টাকার পণ্য রপ্তানি কম হয়েছে। এখন মাছ, পাথর ও তেল বাদে বাকি সব পণ্য নেওয়া বন্ধ করেছে ভারত। এতে দুই দেশের ব্যবসায়ীরাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। দুই দেশের সরকারকে বিষয়টি দ্রুত সমাধানের জন্য অনুরোধ করছি। 

আখাউড়া স্থলবন্দর সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি নিছার উদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, ভারতের নিষেধাজ্ঞার কারণে আমাদের রপ্তানি বাণিজ্য সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যাবে। সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট, কাস্টমস, শ্রমিক, আমদানি-রপ্তানিকারক আমরা সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হবো। সরকারের উচিত দ্রুত ভারতের সঙ্গে আলোচনায় বসা। 
স্থলবন্দরের সহকারী পরিচালক মাহমুদুল হাসান বলেন, প্রতিদিন ৪০-৫০ গাড়ি পণ্য রপ্তানি হতো। আজ অনেক গাড়ি আসেনি। স্থলবন্দর দিয়ে আজ মাছ, ভোজ্যতেল ও পাটজাত দ্রব্য রপ্তানি হয়েছে।

সোনামসজিদ স্থলবন্দরে গার্মেন্টস পণ্য রপ্তানি হয়নি: চাঁপাইনবাবগঞ্জের সোনামসজিদ স্থলবন্দরেও নির্দিষ্ট পণ্যের রপ্তানি বন্ধ রয়েছে। সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকরা। তবে কাস্টমস কর্মকর্তাদের কলমবিরতি সোমবার দুপুর ৩টা পর্যন্ত থাকলেও আমদানি স্বাভাবিক। কর্মবিরতি শেষে বিকেলে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ ছাড়পত্র দেয়। জানা গেছে, সোনামসজিদ বন্দর দিয়ে ৫-৭ জন রপ্তানিকারক গার্মেন্টস পণ্য, পাটজাত পণ্য, আরএফএলের কিছু পণ্য, কিছু ফাস্টফুড পণ্য এবং তুলা জাতীয় পণ্য রপ্তানি হয়। ভারতের নিষেধাজ্ঞার কারণে এ বন্দর দিয়ে শুধু গার্মেন্টস পণ্য রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হবে। যদিও সোমবার পর্যন্ত রপ্তানিতে তেমন প্রভাব পড়েনি। রোববার ও সোমবার অন্যান্য পণ্য রপ্তানি হলেও কোনো গার্মেন্টস পণ্য রপ্তানি হয়নি।

বন্দর পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান পানামা পোর্ট লিঙ্ক লিমিটেডের অপারেশন ম্যানেজার কামাল হোসেন জানান, রোববার এ বন্দর দিয়ে ১২ ট্রাক পাটজাত পণ্য ও চটের বস্তা রপ্তানি হয়েছে। আমদানি হয়েছে ৩০০ ট্রাক বিভিন্ন পণ্য। গতকাল সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ১৯০টি ভারতীয় পণ্যবাহী ট্রাক বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। ৪টি পাটজাত পণ্যের ট্রাক ভারতে গেছে। গত রোববার পোশাকবাহী একটি ট্রাক ভারতে প্রবেশ করতে না পেরে বন্দর থেকে ফেরত গেছে। 

সোনামসজিদ বন্দর দিয়ে গার্মেন্টস পণ্য রপ্তানিকারক রওশন আলী জানান, শনিবার তাঁর ৩টি পণ্যের ট্রাক ভারতে গেছে। তবে রোববার কোনো পণ্য পাঠাতে পারেননি। আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত আরও ৬০/৭০ ট্রাক গার্মেন্ট পণ্য রপ্তানির আদেশ ছিল। কিন্তু ভারতের হঠাৎ সিদ্ধান্তের কারণে তিনি ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়বেন। 

ক্ষুব্ধ রওশন আলী বলেন, সাপটা চুক্তির আওতায় চলতি বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত তাঁর ৬০/৭০ ট্রাক পণ্য রপ্তানির আদেশ ছিল। কিন্তু ভারতের হঠাৎ এ আদেশ হতাশাজনক। গার্মেন্টস পণ্যের আদেশের বিষয়টি সংশ্লিষ্ট আমদানিকারকসহ ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে বিবেচনার জন্য জানানো হয়েছে।

হিলি স্থলবন্দরে পণ্য রপ্তানিতে গতি নেই: ভারতের নিষেধাজ্ঞার দুই দিনেও কোনো প্রভাব পড়েনি দিনাজপুরের হিলি স্থলবন্দরে। এখন পর্যন্ত এই বন্দর দিয়ে রপ্তানিযোগ্য কোনো পণ্য আটকা নেই বলে জানা গেছে। হিলি কাস্টমস সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ফেরদৌস রহমান বলেন, ভারতের যে নিষেধাজ্ঞা, তাতে ব্যবসা কমে যাবে। যদিও এই স্থলবন্দর দিয়ে পণ্য রপ্তানিতে তেমন গতি নেই। এর পরও নতুন করে পণ্য রপ্তানির ট্রাক এলে আটকা পড়ার আশঙ্কায় রয়েছি।

বুড়িমারী স্থলবন্দরে ১৩ ট্রাক আটকা পড়েছে: লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার বুড়িমারী স্থলবন্দরে জুস, বিস্কুট, নুডলস নিয়ে প্রাণ আরএফএল গ্রুপের ১৩টি ট্রাক আটকা পড়েছে। রপ্তানির উদ্দেশ্যে ট্রাকগুলো বন্দরে এসেছিল। তবে বন্দরে ভুটান থেকে পাথর আমদানি এবং ভারত ও নেপালে অন্যান্য পণ্য রপ্তানি স্বাভাবিক বলে জানা গেছে। 

প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন সংশ্লিষ্ট ব্যুরো ও প্রতিনিধি
 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: পণ য স ন মসজ দ ব যবস য় র ক স টমস স মব র আমদ ন রহম ন

এছাড়াও পড়ুন:

সার্চ দুনিয়ার নতুন দিগন্ত জিইও: দেশের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো কী প্

ইন্টারনেট সার্চ দুনিয়ায় চলছে নীরব এক বিপ্লব। তথ্য খোঁজার ধরন বদলে যাচ্ছে আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে দ্রুত। আগে যেখানে গুগলে উচ্চ র‌্যাংকিং মানেই ছিল সাফল্য, এখন সেই জায়গা নিচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই)-নির্ভর সার্চ টুল।

সার্চ জগতের নতুন চ্যালেঞ্জ

চ্যাটজিপিটি, গুগল জেমিনি, মাইক্রোসফট কপিলট কিংবা পারপ্লেক্সিটি এআই-এগুলো আর শুধু সার্চ ইঞ্জিন নয়, বরং উত্তর তৈরিকারক ইঞ্জিন। ব্যবহারকারী এখন শুধু ‘লিংক’ নয়, বরং সরাসরি উত্তর পেতে চায়। আর এই পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার জন্যই এসেছে নতুন এক কৌশল- জিইও বা জেনারেটিভ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন।

জিইও কী?

জিইও (জেনারেটিভ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন) হলো এমন একটি প্রক্রিয়া, যেখানে আপনার ওয়েবসাইট ও কনটেন্ট এমনভাবে সাজানো হয় যাতে এআই-চালিত সার্চ ইঞ্জিন সহজেই আপনার তথ্য চিনতে, বুঝতে এবং ব্যবহারকারীর প্রশ্নের উত্তরে সেটি অন্তর্ভুক্ত করতে পারে।

আগে ব্র্যান্ডগুলোর ফোকাস ছিল গুগলের প্রথম পাতায় জায়গা করে নেওয়া। কিন্তু এখন গুরুত্ব পাচ্ছে- চ্যাটজিপিটি বা জেমিনি-এর উত্তরে আপনার ব্র্যান্ডের নাম আসছে কি না!

এসইও বনাম জিইও: সার্চ দুনিয়ার নতুন যুগের পালাবদল

অনেকেই এসইও (সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন) এবং জিইও (জেনারেটিভ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন) এক মনে করেন, কিন্তু এদের মধ্যে মূলত লক্ষ্য ও কৌশল ভিন্ন। এসইও হচ্ছে পুরোনো পদ্ধতি, অন্যদিকে জিইও হচ্ছে নতুন পদ্ধতি।

* মূল লক্ষ্য
এসইও: সার্চ ইঞ্জিনে র‌্যাংক বাড়ানো
জিইও: এআই সার্চের উত্তরে দৃশ্যমান হওয়া

* কাজের ধরন
এসইও: কিওয়ার্ড ও ব্যাকলিংক ভিত্তিক
জিইও: কনটেক্সট, প্রাসঙ্গিকতা ও ব্র্যান্ড অথরিটি নির্ভর

* ফলাফল
এসইও: ক্লিক ও ট্রাফিক বৃদ্ধি
জিইও: ব্র্যান্ড উল্লেখ ও আস্থা বৃদ্ধি

* প্ল্যাটফর্ম
এসইও: গুগল, বিং ইত্যাদি সার্চ ইঞ্জিন
জিইও: চ্যাটজিপিটি, জেমিনি, পারপ্লেক্সিটি, এসজিই ইত্যাদি এআই সার্চ

এসইও এখনও গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু ভবিষ্যতের সার্চ ইকোসিস্টেমে জিইও সমান অপরিহার্য হয়ে উঠছে।

বাংলাদেশি ব্যবসার জন্য জিইও-এর গুরুত্ব

বাংলাদেশে ডিজিটাল মার্কেটের ক্রমবর্ধমান প্রবৃদ্ধি স্পষ্টভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। শিক্ষা, ট্রাভেল, স্বাস্থ্যসেবা, ই-কমার্স, রিয়েল এস্টেট- প্রায় প্রতিটি খাতেই ব্যবসা অনলাইনে আরো দৃশ্যমান হতে চাচ্ছে। কিন্তু বদলেছে মানুষের সার্চ করার ধরন। এখন তারা শুধু গুগলে সার্চ করেই সন্তুষ্ট থাকছে না, তারা এআই-চালিত সার্চ টুলগুলো যেমন চ্যাটজিপিটি, জেমিনি বা পারপ্লেক্সিটি-এর মাধ্যমে সরাসরি উত্তর খুঁজছে। 

গার্টনারের এক গবেষণা অনুযায়ী, ২০২৬ সালের মধ্যে প্রচলিত সার্চ ইঞ্জিনে সার্চ ভলিউম প্রায় ২৫ শতাংশ কমে যাবে- কারণ ব্যবহারকারীরা দ্রুতই এআই-চালিত সার্চ ও চ্যাটবটের দিকে ঝুঁকছে। (তথ্যসূত্র: Gartner, “Search Engine Volume Will Drop 25% by 2026, Due to AI Chatbots and Other Virtual Agents)

তবে এই পরিবর্তনের প্রভাব ব্যবসার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ধরুন, কেউ চ্যাটজিপিটি-তে লিখল, ‘ঢাকায় সেরা অ্যাকাউন্টিং ফার্ম কোনটি?’ যদি আপনার কোম্পানির নাম বা কনটেন্ট এআই-এর তৈরি উত্তরে না আসে, তাহলে সম্ভাব্য ক্লায়েন্ট ও ব্যবসার সুযোগ হাতছাড়া হচ্ছে।

মূলত এখানেই জিইও-এর গুরুত্ব উঠে আসে। জিইও ব্যবহার করে কনটেন্ট এমনভাবে সাজানো যায় যাতে এআই সার্চ সিস্টেম আপনার ব্র্যান্ডকে সহজেই চিনতে পারে, বুঝতে পারে এবং ব্যবহারকারীর প্রশ্নের উত্তরে উল্লেখ করে। অর্থাৎ, বাংলাদেশের প্রতিটি ব্যবসা যদি এআই-এর দুনিয়ায় দৃশ্যমান থাকতে চায়, জিইও’র সঙ্গে খাপ খাওয়ানো এখন আর বিকল্প নয়- এটি একান্ত প্রয়োজন।

জিইও’র জন্য কীভাবে প্রস্তুতি নেবেন?

জেনারেটিভ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন (জিইও) কোনো একদিনে শেখার মতো বিষয় না- এটি একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া, যেখানে ব্যবসাগুলোকে নিজেদের কনটেন্ট, উপস্থিতি ও বিশ্বাসযোগ্যতা এআই-বান্ধব করে গড়ে তুলতে হয়। নিচে ধাপে ধাপে দেখা যাক, কীভাবে আপনি জিইও’র পথে প্রস্তুত হতে পারবেন।

১. অনলাইন উপস্থিতি যাচাই করুন

জিইও’র প্রথম ধাপ হলো আপনার ব্যবসা বা ব্র্যান্ডের বর্তমান অনলাইন উপস্থিতি যাচাই করা। চ্যাটজিপিটি বা পারপ্লেক্সিটি-এর মতো এআই-চালিত সার্চ টুলে সার্চ দিন ‘বাংলাদেশে সেরা (আপনার ইন্ডাস্ট্রি)-এর কোম্পানিগুলো কোনগুলো?’

যদি সার্চের উত্তরে আপনার নাম না আসে, বোঝা যাবে যে আপনার এআই-দৃশ্যমানতা এখনও সীমিত। এই ক্ষেত্রে আপনাকে জিইও অনুযায়ী কনটেন্ট ও অনলাইন উপস্থিতি বাড়াতে কাজ শুরু করতে হবে।

২. বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি করুন

জেনারেটিভ এআই সার্চ সিস্টেম সেই উৎসকেই অগ্রাধিকার দেয়, যা নির্ভরযোগ্য ও যাচাইযোগ্য। তাই আপনার ওয়েবসাইটে ব্র্যান্ড, টিম, যোগাযোগ ও রিভিউসহ সব তথ্য সম্পূর্ণ ও স্বচ্ছ রাখুন।

গুগল বিজনেস প্রোফাইল নিয়মিত আপডেট করুন-  ঠিকানা, সময়, পোস্ট ও রিভিউসহ।

বিশ্বস্ত সংবাদমাধ্যম ও ব্লগে ব্র্যান্ডের উল্লেখ বাড়ান।

E-E-A-T (Experience, Expertise, Authoritativeness, Trustworthiness) বজায় রাখুন।

এভাবেই এআই ও ব্যবহারকারীর কাছে আপনার ব্র্যান্ড একটি বিশ্বাসযোগ্য সোর্স হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে- যা জিইও সাফল্যের মূল চাবিকাঠি।

৩. কনভারসেশনাল কনটেন্ট লিখুন

এআই সার্চ এখন ব্যবহারকারীর প্রশ্নভিত্তিক অনুসন্ধানকে গুরুত্ব দেয়। তাই আপনার কনটেন্ট তৈরি করুন এমনভাবে যেন এটি প্রাকৃতিক প্রশ্ন ও কথোপকথনের মতো শোনায়। উদাহরণ: ‘Where can I find a trusted IELTS coaching center in Dhaka?’ ‘Where can I apply for a blue-collar job?’ এ ধরনের কনটেন্ট এআই-এর চোখে আরো সহজে বোঝার মতো হয় এবং ব্যবহারকারীর প্রশ্নের উত্তর হিসেবে উল্লেখযোগ্য।

৪. বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে সক্রিয় থাকুন

এআই শুধু ওয়েবসাইট থেকে তথ্য সংগ্রহ করে না। এটি ফেসবুক, ইউটিউব, লিংকডইন, কোরা এবং অন্যান্য সোশ্যাল প্ল্যাটফর্ম থেকেও তথ্য সংগ্রহ করে। তাই বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে আপনার উপস্থিতি নিশ্চিত করা জিইও-এর জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

৫. এসইও এবং জিইও একসাথে ব্যবহার করুন

ডিজিটাল দুনিয়ায় এখন শুধু সার্চ র‌্যাংকই যথেষ্ট নয়। এসইও যেমন গুগল সার্চে আপনার কনটেন্টকে শীর্ষে নিয়ে আসে, তেমনি নতুন যুগের জিইও (জেনারেটিভ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন) আপনার ব্র্যান্ডকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক সার্চে আরো দৃশ্যমান করে তোলে।

এসইও মূলত গুগল ও অন্যান্য সার্চ ইঞ্জিনে ওয়েবসাইটের অবস্থান উন্নত করে, আর জিইও শেখায়- কীভাবে এআই মডেলগুলো আপনার ব্র্যান্ডকে চিনবে, উল্লেখ করবে এবং বিশ্বাস করবে।

দুটি কৌশল একসাথে প্রয়োগ করলে অনলাইন উপস্থিতি অনেক বেশি শক্তিশালী হয়। একদিকে সার্চে দৃশ্যমানতা বাড়ে, অন্যদিকে এআই-নির্ভর প্ল্যাটফর্মগুলোতেও আপনার ব্র্যান্ডের নাম উঠে আসে স্বতঃস্ফূর্তভাবে।

ভবিষ্যতের সার্চ জগতে টিকে থাকতে হলে এখনই সময়- এসইও এবং জিইও-কে একসাথে কাজে লাগানোর।

বাংলাদেশের ব্যবসার জন্য জিইও’র নতুন সম্ভাবনা

জিইও বাংলাদেশের ব্যবসাগুলোর জন্য হতে পারে এক গেম চেঞ্জার। আগে যেখানে অনলাইন দৃশ্যমানতা মানেই ছিল গুগলে র‌্যাংক করা, এখন সেটি ধীরে ধীরে স্থান ছেড়ে দিচ্ছে এআই সার্চ ভিজিবিলিটি–কে।

আজ যদি কোনো ব্যবহারকারী চ্যাটজিপিটি বা জেমিনি-তে জিজ্ঞেস করে- 

‘বাংলাদেশে নির্ভরযোগ্য অনলাইন বই বিক্রির সাইট কোনটা?’

অথবা, ‘ঢাকায় সেরা ডিজিটাল মার্কেটিং এজেন্সি কারা?’

যদি আপনার ব্র্যান্ডের নাম সেই উত্তরে উঠে আসে, সেটিই হবে প্রকৃত দৃশ্যমানতা- শুধু ক্লিক নয়, বরং আস্থা, প্রভাব ও ব্র্যান্ড অথরিটি–এর প্রতিফলন।

বাংলাদেশে এখন প্রতিদিন শত শত নতুন অনলাইন ব্যবসা শুরু হচ্ছে- ই–কমার্স, এডুকেশন, হেলথটেক, রিয়েল এস্টেট, ফাইন্যান্স, এমনকি ছোট স্টার্টআপরাও দ্রুত ডিজিটাল হচ্ছে। কিন্তু একইসঙ্গে প্রতিযোগিতাও বেড়ে যাচ্ছে বহুগুণে।

এই প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে শুধু এসইও নয়, জিইও–কেন্দ্রিক কৌশলও অপরিহার্য।

জিইও’র ভবিষ্যৎ

খুব শিগগিরই এআই সার্চ টেক্সটের বাইরে গিয়ে ভয়েস, ভিডিও ও ইমেজ কনটেন্ট থেকেও উত্তর তৈরি করবে। তখন জিইও কেবল ওয়েবসাইট নয়, বরং ভিডিও, পডকাস্ট, সোশ্যাল প্রোফাইল, নিউজ রিপোর্ট- সবকিছুর মধ্যেই প্রভাব ফেলবে।

তাই এখন থেকেই যারা জিইও-কেন্দ্রিক কৌশল গ্রহণ করবে, ভবিষ্যতের সার্চ রেভোলিউশনে নেতৃত্ব দেবে তারাই।

উপসংহার

জেনারেটিভ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন (জিইও) শুধু নতুন ট্রেন্ড নয়- এটি ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের পরবর্তী অধ্যায়।

এসইও যেমন আপনাকে সার্চ রেজাল্টে নিয়ে যায়, জিইও তেমনি আপনাকে নিয়ে যাবে এআই–এর উত্তরে।

‘ভবিষ্যতের সার্চে র‌্যাংক নয়, ব্র্যান্ডের বিশ্বাসযোগ্যতাই হবে সাফল্যের আসল মাপকাঠি।’

লেখক: হেড অব ওয়েব অ্যানালাইসিস অ্যান্ড এসইও ডিরেক্টর, ইন্টেলেক আইটি এলএলসি (ইউএসএ অ্যান্ড বাংলাদেশ)

ঢাকা/ফিরোজ

সম্পর্কিত নিবন্ধ