আগামী বাজেটে মোবাইল ফোনে ভ্যাট বাড়তে পারে
Published: 22nd, May 2025 GMT
দেশে উৎপাদিত মোবাইল ফোনের ওপর মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট বাড়তে পারে। বর্তমানে দেশে উৎপাদিত মোবাইল ফোনের ওপর উৎপাদন পর্যায়ে বৈশিষ্ট্যভেদে ৫ ও ৭ দশমিক ৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ আছে। এই হার আরও ২ দশমিক ৫ শতাংশ করে বাড়তে পারে।
আগামী ২ জুন আগামী অর্থবছরের বাজেটে মোবাইল ফোনের ওপর ভ্যাট বাড়ানোর এই নতুন প্রস্তাব করা হতে পারে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে কোনো মোবাইল ফোন উৎপাদনকারী কোম্পানি যদি নিজেরা কমপক্ষে দুটি কম্পোনেন্ট বা উপকরণ বানায় এবং বাকি উপকরণ আমদানি করে দেশে সংযোজন করে, তাহলে উৎপাদন পর্যায়ে ৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হয়। এই হার বাড়িয়ে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ করা হতে পারে। আবার কোনো প্রতিষ্ঠান যদি সব উপকরণ আমদানি করে দেশে শুধু সংযোজন করে, তাহলেও এখন ৭ দশমিক ৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হয়। এটি বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হতে পারে।
এনবিআর কর্মকর্তারা জানান, প্রযুক্তি দিন দিন সুলভ হচ্ছে, তাই বাড়তি ভ্যাট দিলেও দামের ওপর প্রভাব না–ও পড়তে পারে।
স্মার্টফোনের চাহিদার বড় অংশ দেশে উৎপাদিত হয়। ফলে দেশে স্মার্টফোনের ব্যবহার গত কয়েক বছরে ব্যাপক হারে বেড়েছে।
দেশে এখন ১৭টির মতো প্রতিষ্ঠান স্মার্টফোন উৎপাদন ও সংযোজন করে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, স্মার্টফোনের যন্ত্রাংশ আমদানি ও উৎপাদন বিক্রির ক্ষেত্রে কর কমাতে হবে।
মোবাইল ফোন ইন্ডাস্ট্রি ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (এমআইওবি) সহসভাপতি রেজওয়ানুল হক প্রথম আলোকে বলেন, সরকার যে উদ্দেশ্যে ভ্যাট বাড়াতে চাইছে, তা পূরণ হবে না, যতক্ষণ অবৈধ উপায়ে স্মার্টফোন আসা বন্ধ না হয়। স্মার্টফোনের ৫০ শতাংশের বেশি এই অবৈধ বাজারের দখলে। দেশীয় ফোনের ওপর ভ্যাট বাড়ালে অবৈধ ফোনের বাজার আরও বড় হবে। তাঁর মতে, নতুন করে ভ্যাট বাড়লে প্রতিটি মোবাইল ফোনে ৫০০ টাকা বাড়তে পারে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, দেশে স্মার্টফোন ব্যবহার করে ৭০ শতাংশ পরিবার। অন্যদিকে মুঠোফোন সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর বৈশ্বিক সংগঠন গ্লোবাল সিস্টেম ফর মোবাইল কমিউনিকেশনস অ্যাসোসিয়েশন (জিএসএমএ) গত বছরের অক্টোবরে ‘দ্য স্টেট অব মোবাইল ইন্টারনেট কানেকটিভিটি ২০২৪’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তাতে বলা হয়, বাংলাদেশে শহরের ৪১ শতাংশ এবং গ্রামের ২৬ শতাংশ মানুষ স্মার্টফোন ব্যবহার করেন।
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
ঝুঁকির মুখে প্রযুক্তিপণ্য উৎপাদন শিল্পের বিকাশ, সংকুচিত হবে কর্মসংস্থান
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) শিল্পবান্ধব সহায়ক নীতি ও কর সহায়তাকে দেশীয় শিল্পোদ্যাক্তারা সঠিকভাবে কাজে লাগিয়ে দেশের ইলেকট্রনিক্স ও প্রযুক্তিপণ্য শিল্প খাতকে এগিয়ে নিয়েছে উৎপাদনশীলতার দিকে। বিকশিত হয়েছে ফ্রিজ, এসি, টিভির মতো ইলেকট্রনিক্স পণ্যের পুরোপুরি উৎপাদনমুখী দেশীয় শিল্প খাত। শুধু তাই নয়; দেশীয় রেফ্রিজারেটর, ফ্রিজার ও এয়ার কন্ডিশনার উৎপাদন খাতের শিল্প উদ্যোক্তারা বিশাল অঙ্কের অর্থ বিনিয়োগ করে কারখানায় ব্যাপক পরিসরে অত্যাধুনিক সব মেশিনারিজ স্থাপনের মাধ্যমে আনুষঙ্গিক প্রায় সব উপকরণ ও খুচরা যন্ত্রাংশ এখন দেশেই তৈরি করছে। তারপরও উৎপাদনমুখী স্থানীয় ফ্রিজ ও এসি শিল্পে তৈরিকৃত সমজাতীয় উপকরণ ও খুচরা যন্ত্রাংশ আমদানির ক্ষেত্রে সমুদয় সম্পূরক শুল্ক প্রত্যাহার করেছে এনবিআর।
শিল্প খাত সংশ্লিষ্টদের মতে, এই সিদ্ধান্তের ফলে স্থানীয় ইলেকট্রনিক্স উৎপাদন শিল্পে দেশীয় শিল্প উদ্যোক্তাদের বিদ্যমান কয়েক হাজার কোটি টাকার বিশাল বিনিয়োগই শুধু নয়; লক্ষাধিক লোকের কর্মসংস্থানও ঝুঁকির সম্মুখীন হবে। বাধাগ্রস্ত হবে সম্পূর্ণ উৎপাদনমুখী দেশীয় ইলেকট্রনিক্স ও প্রযুক্তিপণ্য শিল্প খাতের টেকসই বিকাশ। ইলেকট্রনিক্স খাতে উদ্ভাবনী ও প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতায় বাংলাদেশের অগ্রগতি থমকে যাবে। তৈরি হয়েছে উৎপাদন শিল্পের আড়ালে আমদানি নির্ভর সংযোজন শিল্প বিকাশের পথ।
উল্লেখ্য, গত ২৭ মে দেশীয় রেফ্রিজারেটর, ফ্রিজার ও এয়ার কন্ডিশনার উৎপাদন শিল্পে ব্যবহৃত প্রয়োজনীয় যেসব উপকরন ও খুচরা যন্ত্রাংশ দেশে উৎপাদিত হয় না, সেসব পণ্য আমদানিতে সম্পূরক শুল্ক প্রত্যাহার করে প্রজ্ঞাপন (এস.আর.ও. নং-১৭৬-আইন/২০২৫/৩০৪-মূসক) জারি করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এই শুল্ক নীতিমালাকে সাধুবাদ জানায় দেশীয় ফ্রিজ ও এসি উৎপাদন খাতের শিল্পোদ্যাক্তারা। কিন্তু গত ২৪ জুন পূর্বের ওই এস.আর.ও এর সংশেীধনী আরেকটি এস.আর.ও নম্বর-২৭৪-আইন/২০২৫/৩১৭-মুসক জারি করেছে এনবিআর।
আরো পড়ুন:
কমিশনারসহ এনবিআরের আরো ৫ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে দুদক
এনবিআরের ৩ সদস্য ও এক কমিশনারকে অবসরে পাঠাল সরকার
সংশোধিত ওই এস.আর.ও তে ৮৪.১৮ শিরোনাম সংখ্যার অধীনে এইচ.এস কোড: ৮৪১৮.৯৯.০০ এর আওতায় দেশীয় রেফ্রিজারেটর ও ফ্রিজার উৎপাদন শিল্পে ব্যবহৃত উপকরণ ও খুচরা যন্ত্রাংশ আমদানিতে সম্পূরক শুল্ক প্রত্যাহারের তালিকায় বর্তমানে দেশে উৎপাদিত হচ্ছে-এমন বেশ কয়েকটি নতুন যন্ত্রাংশ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে স্টোপার ব্লক, ডিয়োডোরেন্ট ব্লক, পিপি বটম প্লেট, ক্রিস্পার কভার, ড্রেইনেজ পাইপ কভার, কভার অফ কম্প্রেসার হাউজ, সাপোর্ট অব ক্রিস্পার কভার, কটন প্যাড ফর শেলফ, রেফ্রিজারেটর/ফ্রিজার শেলফ, পিপি বেল্ট এবং ডাম্পিং ব্লক। এছাড়া শিরোনাম সংখ্যা ৮৫.৩৬ এর অধীনে এইচ.এস কোড-৮৫৩৬.৬১.০০ এর অধীনে লাইট হোল্ডার যন্ত্রাংশ আমদানিতেও সম্পূরক শুল্ক প্রত্যাহার করা হয়েছে।
ফ্রিজের পাশাপাশি দেশীয় এয়ার কন্ডিশনার উৎপাদন শিল্পের ক্ষেত্রেও শিরোনাম সংখ্যা ৮৪.১৫ এর অধীনে এইচ.এস. কোড-৮৪১৫.৯০.৯০ এর আওতায় দেশে উৎপাদিত হচ্ছে এমন বেশ কয়েকটি উপকরণ ও খুচরা যন্ত্রাংশ আমদানির ক্ষেত্রেও সম্পূরক শুল্ক প্রত্যাহার করা হয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে ফ্যান ব্লোয়ার, কানেকটিং পাইপ, এক্সিয়াল ফ্যান, ক্যাসিং ফর ইনডোর, এয়ার গাইড প্লেট, টিউব প্লেট, এয়ার ফিল্টার, আইডিইউ প্যানেল, ডিস্ট্রিবিউশন পাইপ এবং ক্রস ফ্লো ফ্যান।
ফ্রিজ ও এসি উৎপাদন শিল্প খাতের সংশ্লিষ্টরা জানান, সম্পূরক শুল্ক প্রত্যাহার তালিকায় সংশোধিত এস.আর.ও তে রেফ্রিজারেটর, ফ্রিজার ও এসির যেসব উপকরণ ও খুচরা যন্ত্রাংশ নতুনভাবে যুক্ত করা হয়েছে তার প্রত্যেকটি পণ্যেই এখন দেশীয় শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো তৈরি করছে। যদিও সংশোধনীর আগে জারিকৃত প্রথম এস.আর.ও এর শর্তাবলীতে উল্লেখ করা হয়েছে, ফ্রিজ ও এসি সংযোজনকারী প্রতিষ্ঠান খুচরা যন্ত্রাংশ আমদানিতে সম্পূরক শুল্ক প্রত্যাহারের এই সুবিধা পাবে না।
তবে এ খাতের দেশীয় শিল্প উদ্যোক্তাদের প্রশ্ন- যেসব দেশীয় ফ্রিজ ও এসি প্রতিষ্ঠান আমদানি বিকল্প উপকরণ ও খুচরা যন্ত্রাংশ তৈরি করছে ও উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় মেশিনারিজ এবং প্ল্যান্টস রয়েছে তবে কেন এবং কাদের স্বার্থে ওসব যন্ত্রাংশ আমদানিতে সম্পূরক শুল্ক প্রত্যাহার করা হলো? এই শুল্ক নীতিমালা দেশীয় ফ্রিজ, এসি উৎপাদন শিল্পের জন্য কতটুকু সহায়ক? এই সিদ্ধান্তে এ খাতে খুচরা যন্ত্রাংশের আমদানি কি বাড়বে না? উৎপাদন শিল্পের আড়ালে কি সংযোজন শিল্প বিকাশের পথ তৈরি হয়নি? এসব বিষয়গুলো গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করে স্থানীয় ফ্রিজ, এসি উৎপাদন শিল্পের তৈরিকৃত সমজাতীয় উপকরণ ও খুচরা যন্ত্রাংশ আমদানিতে সম্পূরক শুল্ক প্রত্যাহারের সুবিধা বাতিল করার জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কাছে আহ্বান জানাচ্ছে দেশীয় শিল্প উদ্যোক্তারা।
শিল্প বিশেষজ্ঞদের মতে, ফিনিশড গুডস এর পাশাপাশি আনুষঙ্গিক উপকরণ ও খুচরা যন্ত্রাংশ তৈরিতে দেশীয় শিল্পকে উৎসাহিত করার লক্ষ্যেই তো এতদিন ওসব পণ্য আমদানিতে নিয়ন্ত্রণমূলক সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। যার পরিপ্রেক্ষিতে দেশীয় ফ্রিজ, এসি উৎপাদন শিল্পের উদ্যোক্তারা বিশাল অঙ্কের অর্থ বিনিয়োগ করে অত্যাধুনিক মেশিনারিজ ও প্রোডাকশন প্ল্যান্টস আনুষঙ্গিক প্রায় সকল খুচরা যন্ত্রাংশ তৈরি করছে। এ খাতে প্রচুর লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে। দেশীয় শিল্প উদ্যোক্তাদের এই বিশাল বিনিয়োগ সুযোগ ও কর্মসংস্থানের সুযোগ প্রসারিত করতে যেখানে সরকারের উচিৎ স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত সমজাতীয় খুচরা যন্ত্রাংশ আমদানিতে নিয়ন্ত্রণমূলক সম্পূরক শুল্কের হার আরো বৃদ্ধি করা; তার পরিবর্তে উল্টো সম্পূরক শুল্ক সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করেছে। কোন যুক্তিতে এবং কাদের স্বার্থে দেশীয় শিল্প বিকাশের পরিপন্থি এমন এক আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। উপকরণ ও খুচরা যন্ত্রাংশ তৈরির প্রয়োজনীয় মেশিনারিজ ও প্রোডাকশন প্ল্যান্টস থাকা সত্ত্বেও যেসব প্রতিষ্ঠান ওই সব পণ্য আমদানি করবে তাদের সঙ্গে সংযোজনকারী প্রতিষ্ঠানের আর কোনো পার্থক্যেই থাকবে না।
তাদের আশঙ্কা, এতদিন যেসব দেশীয় উৎপাদকরা ফ্রিজ ও এসির আনুষঙ্গিক উপকরণ ও খুচরা যন্ত্রাংশ তৈরি করে আসছে, সম্পূরক শুল্ক প্রত্যাহার করায় তাদের কাছে ওসব যন্ত্রাংশ উৎপাদনের চেয়ে বরং আমদানি করাই বেশি লাভজনক হয়ে উঠবে। তাই তারা এখন আমদানি প্রতি ঝুঁকবেন। ফলে বাড়বে আমদানি ব্যয়, চাপে পড়বে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। এছাড়া এ খাতের খুচরা যন্ত্রাংশ উৎপাদনেও আসবে না নতুন কোনো বিনিয়োগ। ফলে শুধু এ খাতের ভবিষ্যৎ বিনিয়োগই নয়; কর্মসংস্থান সৃষ্টির পথও সংকুচিত হবে। তাই দেশীয় প্রতিষ্ঠানে বর্তমানে ফ্রিজ ও এসির যেসব খুচরা যন্ত্রাংশ তৈরি হচ্ছে সেসব পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে সম্পূরক শুল্ক প্রত্যাহারের বিষয়টি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের গুরুত্ব সহকারে পুনর্বিবেচনা করে তা বাতিল করা উচিৎ বলে অভিমত জানিয়েছেন শিল্প সংশ্লিষ্টরা।
দেশীয় শিল্প সংশ্লিষ্টদের অভিমত, দেশীয় উৎপাদনমুখী ইলেকট্রনিক্স শিল্প খাতের টেকসই বিকাশের স্বার্থে এবং এ খাতের দেশীয় শিল্প উদ্যোক্তাদের বিশাল বিনিয়োগ সুরক্ষা নিশ্চিতকল্পে ফ্রিজ, এসির যেসব খুচরা যন্ত্রাংশ এখন দেশেই উৎপাদিত হচ্ছে, সেসব আমদানিতে সম্পূরক শুল্ক অব্যাহতির সুবিধা বাতিল করে আগের মতো সন্তোষজনক হারে সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা অত্যন্ত জরুরি।
ঢাকা/এস/এসবি