ফেসবুকে উপদেষ্টা ও এনসিপিসহ বিভিন্ন দলের নেতাদের পোস্ট
Published: 22nd, May 2025 GMT
ব্যক্তির আদর্শ, সম্মান ও আবেগের চেয়ে দেশ বড় বলে মনে করেন অন্তর্বর্তী সরকারের তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম। তিনি বলেন, দেশপ্রেমিক শক্তির ঐক্য অনিবার্য। আগেকার যেকোনো বক্তব্য ও শব্দচয়ন, যা বিভাজনমূলক ছিল, সেগুলোর জন্য আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত।
আজ বৃহস্পতিবার বিকেল পাঁচটার দিকে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক অ্যাকাউন্টে এক পোস্টে তিনি এসব কথা বলেন। উপদেষ্টা মাহফুজ আলম এমন এক সময় এই ফেসবুক পোস্ট দিলেন, যখন নানা কারণে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন বেশ উত্তপ্ত।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র হিসেবে বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনের দায়িত্ব গ্রহণের দাবি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদল নেতা শাহরিয়ার আলম সাম্য হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে বেশ কয়েক দিন ধরেই জোরালো আন্দোলন চলছে। অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া ও মাহফুজ আলমের পদত্যাগের দাবিও করে আসছে বিএনপি। অন্যদিকে জাতীয় নাগরিক পার্টিও (এনসিপি) নির্বাচন কমিশনের পদত্যাগ চেয়ে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটির কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ করেছে। আবার গত বুধবার ঢাকা সেনানিবাসের সেনা প্রাঙ্গণে অফিসার্স অ্যাড্রেসে কথা বলেছেন সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। সেখানে সেনাপ্রধান আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের ওপর জোর দিয়েছেন। এ রকম অবস্থায় সরকারের উপদেষ্টা এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতারা তাঁদের মতামত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তুলে ধরেছেন। তাঁদের বক্তব্যে ভেদাভেদ ভুলে ঐক্যের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।
উপদেষ্টা মাহফুজ আলম তাঁর ফেসবুক পেজে আরও লেখেন, ‘সরকারে আর এক দিনও থাকলে অভ্যুত্থানের সব শক্তির প্রতি সম্মান ও সংবেদনশীলতা রেখে কাজ করতে চাই। পুরাতন বন্দোবস্তের বিভেদকামী স্লোগান ও তকমাবাজি, যা বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে হত্যাযোগ্য করে তোলে, সেগুলো পরিহার করলেই আশা করি, ভবিষ্যৎ রাষ্ট্র গণতান্ত্রিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক হবে।’
বাংলাদেশের শত্রুরা ঐক্যবদ্ধ ও আগ্রাসী উল্লেখ করে মাহফুজ আলম লেখেন, ‘সার্বভৌমত্ব ও গণতান্ত্রিক সব প্রতিষ্ঠান হুমকির মুখে। দেশপ্রেমিক জনগণ যাঁরা জুলাই অভ্যুত্থানে ঐক্যবদ্ধ ছিলেন, তাঁদের সামনে দীর্ঘ পরীক্ষা। এ পরীক্ষা ঐক্যের ও ধৈর্যের। এ পরীক্ষা উতরে যেতেই হবে।’
সব পক্ষকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনের অনুরোধ
দেশের বিদ্যমান পরিস্থিতিতে জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান তাঁর ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে আজ দুটি পোস্ট দেন। প্রথম পোস্টে তিনি লেখেন, ‘জাতীয় স্বার্থে স্পর্শকাতর ও বিতর্কিত বিষয়গুলো আসুন সবাই এড়িয়ে চলি। সংকট উত্তরণে ইতিবাচক ভূমিকা কেবল জাতিকে উপকৃত করবে। নেতিবাচক ভূমিকা কখনোই কল্যাণ বয়ে আনে না।’
প্রথম পোস্টের প্রায় পাঁচ ঘণ্টা পর শফিকুর রহমান ফেসবুকে দ্বিতীয় পোস্ট করেন। তাতে তিনি লেখেন, ‘ফ্যাসিবাদবিরোধী সকল পক্ষকে মান, অভিমান ও ক্ষোভ একদিকে রেখে, জাতীয় স্বার্থে দূরদর্শী ও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনের জন্য আন্তরিকভাবে অনুরোধ জানাই। যার যার অবস্থান থেকে সর্বোচ্চ দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করি। আল্লাহ তায়ালা এই জাতিকে সাহায্য করুন এবং সব ধরনের ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করুন।’
‘স্বাধীনতাকে বিপন্ন হতে দেওয়া হবে না’
ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে দীর্ঘ সময় লড়াই করে নতুন বাংলাদেশ পেয়েছেন বলে ফেসবুকে লেখেন এনসিপির সদস্যসচিব আখতার হোসেন। তাতে তিনি আরও লেখেন, ‘ফ্যাসিবাদবিরোধীরা নিজেদের রাজনৈতিক মতাদর্শের বৈচিত্র্যের উপরে বাংলাদেশকে প্রাধান্য দিয়েছে। জুলাইতে তার সর্বোচ্চ সমাবেশ ঘটেছে। জুলাইয়ের বেঁচে ফেরা যোদ্ধারা এদেশের স্বাধীনতাকে বিপন্ন হতে দেবে না। গণতান্ত্রিক এই যাত্রাকে ব্যাহত হতে দেবে না। বাংলাদেশ জিন্দাবাদ।’
অমার্জনীয় ‘ভুল’
আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জুও তাঁর ফেসবুকে একটি পোস্ট করেছেন আজ। তিনি লেখেন, ‘জুলাই-আগস্টে সবাই মিলে উপড়ে ফেলেছিল ফ্যাসিবাদের মূল! এখন আমরা সবাই মিলে যা করছি তা হলো অমার্জনীয় “ভুল”।’
এই দায় আইন উপদেষ্টা কি এড়াতে পারেন, প্রশ্ন সারজিসের
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম আজ ফেসবুকে দুটি পোস্ট করেন। একটি পোস্টে তিনি বলেন, ‘টাকা আর রাজনৈতিক দলের সুপারিশে অনেক হত্যাকারী আওয়ামী লীগারের জামিন হয়ে যায়। টাকা আর রাজনৈতিক সুপারিশ নাই বলে আওয়ামী আমলে জুলুমের শিকার অনেক মজলুমের জামিন হয় না।’
২০১৩ সালে রাজধানীর মতিঝিলে হেফাজতে ইসলামীর সমাবেশের বিষয়ে সারজিস আলম বলেন, ‘শাপলা হত্যাকাণ্ডে হেফাজতের উপরে চাপানো মিথ্যা মামলায় অনেক মজলুম আলেম এখনো আদালতে চক্কর কাটে, কারাগারে বন্দী থাকে। অথচ এমন অনেক দাগী আসামি বিগত কয়েক মাসে জামিন পেয়েছে যারা, বিএনপির সাথে সংযুক্ত হলেও বিএনপির সময়ে তাদের কৃতকর্ম ও অপরাধের জন্য জেলে গিয়েছে। এগুলো কীভাবে হয়? কার সুপারিশে হয়? কোন আইনজীবী এবং বিচারকের প্রত্যক্ষ মদদে হয়?’
সারজিস আলম বলেন, ‘প্রকাশ্য দিবালোকে হাসিনার নির্দেশে এতগুলো মানুষ খুন হলো, এতগুলো মানুষের রক্ত ঝরল, তার পরও ৯ মাসে একটা বিচারকার্য সম্পন্ন হয় না! একটা খুনের বিচার হয় না! এই দায় আইন উপদেষ্টা হিসেবে আসিফ নজরুল স্যার কি কোনোভাবে এড়াতে পারে? তাহলে কি আমাদের এখন তার পদত্যাগ চাওয়া উচিত নয়?’
আরেক ফেসবুক পোস্টে সারজিস আলম লেখেন, ‘মব তৈরি করে যদি হাইকোর্টের রায় নেওয়া যায়, তাহলে এই হাইকোর্টের দরকার কি?’
‘রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ মেনে নেওয়া হবে না’
দেশের এই পরিস্থিতিতে এনসিপির দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহও ফেসবুকে পোস্ট করেছেন। এনসিপিকে নির্বাচনবিরোধী আখ্যা দিয়ে সচেতনভাবেই একধরনের কলঙ্ক দেওয়ার চেষ্টা চলছে বলে তিনি তাঁর ফেসবুক পোস্টে উল্লেখ করেন। হাসনাত আবদুল্লাহ আরও বলেন, ‘ছাত্র উপদেষ্টারা দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকতে চায়—এমন গুজব ছড়িয়ে নেতিবাচক ইমেজ তৈরি করার নানা কার্যক্রমও চলমান। এই চক্রান্ত কয়েকটি দিক থেকে পরিচালিত হচ্ছে।’
এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম নির্বাচন নিয়ে দলের অবস্থান স্পষ্ট করেছেন বলে উল্লেখ করেন হাসনাত আবদুল্লাহ। চলতি বছরের ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের জুনের মধ্যে নির্বাচন করার কথা যে অন্তর্বর্তী সরকার বলে আসছে, সেটি সমর্থন করে নাহিদ ইসলাম ও উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের বক্তব্যও তুলে ধরেন তিনি।
হাসনাত আবদুল্লাহ ফেসবুক পোস্টে আরও লেখেন, ‘তার পরও দুই ছাত্র উপদেষ্টার পদত্যাগের দাবিতে রাস্তা অবরোধ করে আন্দোলন করা কীভাবে গ্রহণযোগ্য হতে পারে? অভ্যুত্থানের নেতৃত্বে থাকা এবং ইন্টারিম সরকারের অংশ হওয়া দুজন ছাত্র উপদেষ্টার পদত্যাগ চাওয়া মোটেও স্বাভাবিক কোনো বিষয় বলে মনে করি না।’
সেনাবাহিনীকে রাজনৈতিক সালিশের ক্ষমতা দেওয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে উল্লেখ করে হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, ‘আমাদের সাব-কনসাস মাইন্ডে (অবচেতন মনে) আর্মিকে (সেনাবাহিনী) রাজনৈতিক সালিসের ক্ষমতা দিয়ে দেওয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। অথচ বিএনপি ঐতিহাসিকভাবে সেনাবাহিনীর রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের ভুক্তভোগী একটা দল। আমরা এখনো ওয়ান-ইলেভেনের ইতিহাস ভুলে যাইনি, এখনো তারেক রহমানের নির্যাতনের ঘটনা আমাদের স্মরণে রয়েছে।’
সেনাবাহিনী স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সদা সতর্ক পাহারাদার বলেও উল্লেখ করেন হাসনাত আবদুল্লাহ। তিনি আরও লেখেন, ‘দেশের প্রয়োজনে, সার্বভৌমত্বের প্রয়োজনে, আমরা প্রয়োজন হলে সেনাবাহিনীর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করব; কিন্তু গণতান্ত্রিক অধিকার এবং সুষ্ঠু ক্ষমতা হস্তান্তরের যে আকাঙ্ক্ষা থেকে ২০২৪-এর অভ্যুত্থান ঘটেছে, সেখানে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপকে আমরা মেনে নেব না। রাজনৈতিক সালিসের সুযোগ দিয়ে আরেকটি ওয়ান-ইলেভেনের পথ কেউ প্রশস্ত করছে কি না, তা নিয়ে সতর্ক হওয়া প্রয়োজন।’
আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করার আন্দোলনে যাঁদের পাশে পেয়েছেন, তাঁদের প্রতি ঐতিহাসিক কৃতজ্ঞতা থাকবে বলেও জানান এনসিপির এই নেতা। হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, ‘আওয়ামী লীগের বিচারের দাবিতেও সব পক্ষকে এক থাকতে হবে। এই দাবিতে বড় কোনো দলের নির্লিপ্ততা আমাদের হতাশ করে।’
গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক চর্চা, আওয়ামী লীগের বিচার এবং রাষ্ট্রীয় সংস্কার নিশ্চিত করে দ্রুত নির্বাচনে যাওয়ার লক্ষ্যে সব রাজনৈতিক দলের একসঙ্গে কাজ করা জরুরি বলেও উল্লেখ করেন হাসনাত আবদুল্লাহ। তিনি বলেন, ক্ষণস্থায়ী ফায়দা লুটতে গিয়ে ২০২৪-এর অভ্যুত্থানের পর উদ্ভূত বিপুল সম্ভাবনার জন–আকাঙ্ক্ষাকে নষ্ট করা হলে তা হবে একটি ঐতিহাসিক ব্যর্থতা।
নিজেরাই বিভাজনের পথ বেছে নিয়ে অন্য কাউকে যেন এজেন্ডা বাস্তবায়নের সুযোগ না দেন, সেদিকে গুরুত্বারোপ করে হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, ‘বাইরের কাউকে রাজনৈতিক মাতব্বরি করার সুযোগ দিয়ে দেশের শুদ্ধ গণতান্ত্রিক সম্ভাবনাকে হুমকির মুখে না ফেলি। বৈদেশিক হস্তক্ষেপ ও দেশীয় ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে একটি স্থিতিশীল, গণতান্ত্রিক ও সমৃদ্ধ দেশ গড়তে আধিপত্যবাদবিরোধী এবং ফ্যাসিবাদবিরোধী সব শক্তিকে এক হতে হবে।’
‘নিজ স্বার্থে জুলাইকে ধ্বংস করা হয়েছে’
এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আবদুল হান্নান মাসউদ আজ সন্ধ্যায় এক ফেসবুক পোস্টে লেখেন, ‘নিজ স্বার্থে আপনারাই জুলাইকে ধ্বংস করেছেন। বহুবার বলেছি ঐক্য বিনষ্ট করবেন না, উপরন্তু শুধু দেখেছি স্বেচ্ছাচারিতা আর অহংকার। বারবার অপ্রিয় কথাগুলো বলায় সব ক্ষেত্রেই হয়েছি কোনঠাসা।’
যে মিডিয়া শেখ হাসিনাকে ‘দানব’ বানাল তার সংস্কার কতদূর, সেই প্রশ্ন রেখে আবদুল হান্নান মাসউদ বলেন, ‘কয়টা মিডিয়া আওয়ামী আমলের দুনীতি, গুম-খুন কিংবা সন্ত্রাস-চাঁদাবাজি নিয়ে নিয়মিত রিপোর্ট করছে? কিন্তু ঠিকই আসিফ মাহমুদ কিংবা মাহফুজ, হাসনাত কিংবা হান্নান সবাইকেই টার্গেট করা হয়েছে।’
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ফ সব ক প স ট গণত ন ত র ক র জন ত ক স র র জন ত ক আরও ল খ ন র পদত য গ র উপদ ষ ট প স ট কর এনস প র সরক র র আম দ র র জন য কর ছ ন রহম ন ইসল ম ক ষমত ব এনপ আওয় ম
এছাড়াও পড়ুন:
এই সরকারও আমলাতন্ত্রের চাপে!
চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান নতুন যে জন-আকাঙ্ক্ষা তৈরি করেছে, সেখানে নিশ্চিত করেই জনপ্রশাসন সংস্কারের প্রশ্নটি নাগরিকদের কেন্দ্রীয় একটি চাহিদা। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার যেভাবে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের মতোই পদ ছাড়া পদোন্নতি দিচ্ছে, তাতে উদ্বিগ্ন না হওয়ার কোনো কারণ নেই। কেননা, আগের সরকার কর্তৃত্ববাদী ও স্বৈরাচারী হয়ে উঠেছিল যে কয়টা স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে, তার অন্যতম আমলাতন্ত্র।
জনপ্রশাসনকে রাজনীতিকরণের বৃত্ত ভেঙে জনবান্ধব করার একটা বড় সুযোগ এনে দিয়েছিল অভ্যুত্থান। কিন্তু শুরু থেকেই অন্তর্বর্তী সরকার আমলাতন্ত্রের ওপর অতিনির্ভরশীল হয়ে ওঠায় সেই সুযোগ অনেকটাই হাতছাড়া হয়েছে। সরকারি কর্মকর্তাদের বিরোধিতার কারণে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের বড় কোনো সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে পারেনি সরকার। অন্যদিকে বেতন বাড়াতে গঠন করা হয়েছে বেতন কমিশন। কিছু মুখকে সরিয়ে দেওয়া ছাড়া জনপ্রশাসনে সেই পুরোনো চর্চা অব্যাহত রয়েছে। বিশেষ করে পদ ছাড়া পদায়নের ক্ষেত্রে জনপ্রশাসনে যেভাবে আগের সরকারের চর্চার ধারাবাহিকতা বজায় রাখা হয়েছে, সেটা যারপরনাই দুঃখজনক।
প্রথম আলোর খবর জানাচ্ছে, উপসচিব স্তরে যেখানে আগে থেকেই পদের চেয়ে ৬০০ কর্মকর্তা বেশি রয়েছেন, সেখানে আগস্ট মাসে নতুন করে ২৬৮ জনকে এই পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। অতিরিক্ত সচিব পদেও পদোন্নতির আলোচনা শুরু হয়েছে। রাজনৈতিক সরকারের আমলে জনপ্রশাসনে হরেদরে পদোন্নতি দেওয়ার অনেক নজির আছে। এর কারণ একটাই, আমলাতন্ত্রকে তুষ্ট রাখা। অন্তর্বর্তী সরকার এই চর্চায় ছেদ ঘটাতে পারবে, সেটাই সবাই প্রত্যাশা করেছিল।
পরিহাসের বিষয় হচ্ছে, জনপ্রশাসনে পদ ছাড়া পদোন্নতি দেওয়ার পর বেশির ভাগ কর্মকর্তাকে আগের জায়গাতেই রেখে দেওয়া হয়। এর মানে হচ্ছে তাঁরা আগের দায়িত্বই পালন করেন, কিন্তু মাঝখান থেকে বেতন-ভাতা বাড়ে। উপসচিব পর্যায়ের কর্মকর্তারা তিন বছর চাকরি পাওয়ার পর বিনা সুদে গাড়ি কেনার জন্য ঋণসুবিধা পান। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে অবসরে যাওয়া সরকারি কর্মকর্তাদের যেভাবে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে, তার দৃষ্টান্তও খুব বেশি নেই। অবসরে যাওয়া প্রশাসন ক্যাডারের ‘বঞ্চিত’ ৭৬৪ জন কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে ও অন্য ক্যাডারের ‘বঞ্চিত’ ৭৮ জন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতির সুপারিশ করা হয়েছে।
জনপ্রশাসনের মেধাবী ও যোগ্য কর্মকর্তারা পদোন্নতি পেয়ে পরের ধাপে যাবেন, সেটা স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু পদ না থাকার পরও কেন পদায়ন করা হবে? এ ক্ষেত্রে সরকারকে পর্যালোচনা করে দেখা প্রয়োজন, জনপ্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে পদ বাড়ানো যায় কি না। আবার যেখানে এমনিতেই পদের বিপরীতে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সংখ্যা বেশি, সেখানে অবসরে যাওয়া কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়া কতটা যৌক্তিক?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও জনপ্রশাসনবিশেষজ্ঞ সালাউদ্দিন এম আমিনুজ্জামান বলেছেন, জনপ্রশাসনে পদ ছাড়া পদোন্নতি দেওয়া যায় না। তবে বিশেষ ক্ষেত্রে মেধাবীদের পদোন্নতি দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। এরপরও কেন এমন পদোন্নতি—সেই ব্যাখ্যায় তিনি বলেছেন, সরকার সম্ভবত আমলাতন্ত্রের চাপে রয়েছে। এই ধারণা শুধু তাঁর একার নয়, নাগরিক পরিসরের
বিস্তৃত একটি ধারণাও। অন্তর্বর্তী সরকারকে অবশ্যই এর পরিষ্কার ব্যাখ্যা হাজির করা উচিত।
মাথাভারী আমলাতন্ত্র সরকারি সেবা নাগরিকের কাছে ঠিকভাবে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে বড় একটা বাধা। অন্যদিকে সরকারকে এখানে বিশাল ব্যয়ের বোঝা বহন করতে হয়। ফলে মাঠ প্রশাসন থেকে শুরু করে সিনিয়র সচিব পর্যন্ত একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ ও গতিশীল জনপ্রশাসনই সবাই প্রত্যাশা করে। জনপ্রশাসনের সব স্তরে পদোন্নতি রাজনৈতিক বিবেচনায় নয়, মেধার ভিত্তিতেই হতে হবে।