বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর শ্রমশক্তি জরিপের ফল থেকে দেখা যায়, ২০২৪ সালে দেশে বেকারত্বের হার বেড়েছে। ২০২৩ সালে যা ছিল ৪.১৫ শতাংশ, ২০২৪ সালে তা হয়েছে ৪.৪৮ শতাংশ। ২০২৪ সালের অক্টোবর-ডিসেম্বর সময়ে দেশে বেকারত্বের হার ছিল ৪.৬৩, যা ২০২৩ সালের একই সময়ে ছিল ৩.৯৫ শতাংশ। অন্যদিকে ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে এই হার ওইসিডি দেশগুলোতে ছিল ৪.

৯ শতাংশ, ইউরোপীয় ইউনিয়নে ৫.৯ শতাংশ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৪.১ শতাংশ এবং সেসব দেশের নীতিনির্ধারকরা সংখ্যা নিয়ে বেশ সন্তুষ্ট ছিলেন। দুই বছর ধরে সেসব দেশ উচ্চ মূল্যস্ফীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়ে সুদের হার ক্রমান্বয়ে বাড়ানোর পরও যে বেকারত্বের হার এই পর্যায়ে রয়ে গিয়েছে, সে কারণে তারা সন্তুষ্ট। তাহলে আমি কেন বাংলাদেশের বর্তমান বেকারত্বের হার নিয়ে চিন্তিত? 

প্রথমত, জরিপে বেকারত্বের যে সংজ্ঞা ব্যবহার করা হয়, তাতে শ্রমবাজারের প্রকৃত ছবি পাওয়া যায় না। এসব দেশে মানুষ জীবিকার জন্য ‘কিছু একটা’ করে আয়ের ব্যবস্থা করে নেন। বাংলাদেশে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও আনুষ্ঠানিক খাতে কর্মসংস্থান তেমন বাড়েনি। তার ফলে বহুদিন ধরে কর্মসংস্থানের একটা বড় অংশ (প্রায় ৮৫ শতাংশ) অনানুষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত রয়েছে।
বাংলাদেশে প্রায় দুই দশক ধরে দেখা যায়, বেকারত্বের হার ৪-৫ শতাংশের মধ্যে ওঠানামা করে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে এই হার বেড়ে যাওয়া চিন্তার বৈকি। তদুপরি যুবকদের মধ্যে বেকারত্বের হার অনেক বেশি এবং সাম্প্রতিককালে বেড়েছে। এটি বিশেষ দুশ্চিন্তার। কারণ তাদের অর্থনৈতিকভাবে কাজে লাগাতে না পারার অর্থ বিনিয়োগের অপচয় এবং ‘ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড’-এর সুযোগ হারানো। তা ছাড়া সামাজিক অসন্তোষ বাড়ার পেছনেও রয়েছে এ সমস্যা।

বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে আশা করা হয়, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে শিল্পে কর্মসংস্থান বাড়বে এবং কৃষির মতো গতানুগতিক খাত থেকে শ্রমিক শিল্প খাতে গিয়ে আয় বাড়াতে পারবেন। বাংলাদেশে এই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল, কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেখা যাচ্ছে বিপরীতমুখী প্রবণতা। মোট কর্মসংস্থানে কৃষির অংশ বাড়ছে, শিল্পের অংশ কমছে। ২০২৪ সালে শিল্পের অংশ সামান্য বেড়েছে, কিন্তু মোট সংখ্যাটি না বেড়ে বরং কমেছে (২০২৩ সালের ১.২২ কোটি থেকে ২০২৪ সালে ১.২০ কোটিতে)। 

ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্পে নিয়োজিতদের সংখ্যা ২০১৬ সালের ৮৮ লাখ থেকে ২০২৩ সালে ৮২ লাখে নেমেছে। যে শিল্প এক সময় ছিল কর্মসংস্থানের বড় উৎস, সেই তৈরি পোশাক খাতে এই সাত বছরে কর্মসংস্থান বেড়েছে মাত্র ১ লাখ ৮৩ হাজার। অথচ সে সময় (কভিড মহামারির বছর বাদে) শিল্পটির রপ্তানি এবং উৎপাদন উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছিল। এসব সংখ্যা থেকে একটিই উপসংহারে আসা যায়: প্রবৃদ্ধি হয়েছে কর্মসংস্থানবিহীন। কভিড মহামারির আগেই আমরা এ ধরনের প্রবৃদ্ধির কথা বলে আসছিলাম। ২০২৩ ও ’২৪ সালের শ্রমশক্তি জরিপ থেকে দেখা যায়, সেই প্রবণতা এখনও চলছে। মোট কর্মসংস্থানে বেশি বেড়েছে সেবা খাতের অংশ। তবে কি বলতে হবে, শিল্প ছেড়ে অর্থনীতির কাঠামো এখনই সেবা খাতের দিকে ঝুঁকছে? অর্থনীতিতে কি বিশিল্পায়ন শুরু হয়েছে?  
শ্রমবাজার নিয়ে দুশ্চিন্তার আরও একটি কারণ, ২০২৪ সালে মোট শ্রমশক্তি আগের বছরের চেয়ে কমে গিয়েছে। এটি কি কোনো সংজ্ঞাজনিত কারণে হয়েছে, নাকি আসলেই কমে গিয়েছে? শিক্ষায় নিয়োজিত তরুণের সংখ্যা বাড়লে তা অবশ্য ইতিবাচক। কিন্তু কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা কম বলে হতাশায় অনেকের কাজের চেষ্টা থেকে বিরত থাকার কারণে যদি মোট শ্রমশক্তির সংখ্যা কমে গিয়ে থাকে তাহলে সেটি দুশ্চিন্তার কারণ। সংখ্যাটি বেশি কমেছে নারীর ক্ষেত্রে। তাই নেতিবাচক ব্যাখ্যাটির আশঙ্কা বেশি বলে মনে হয়। 

বাংলাদেশে ৯০ দশক থেকে প্রবৃদ্ধির হার বাড়তে শুরু করলেও কর্মসংস্থানের দিকে কোনো সরকারই নজর দেয়নি। শুরুতে শিল্প খাতে প্রবৃদ্ধি ঘটেছে মূলত শ্রমঘন তৈরি পোশাক খাতের ওপর ভর করে। তবে কালক্রমে তুলনামূলক কম শ্রমঘন নিট পোশাকের হিস্যা বেড়েছে; তাতে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির হার কমতে শুরু করে। সঙ্গে এসেছে প্রযুক্তিগত পরিবর্তন। প্রায় এক দশক ধরে পোশাক খাতের মোট কর্মসংস্থান তেমন বাড়েনি। এমনকি বিজিএমইএর ওয়েবসাইটে কর্মসংস্থানের উপাত্তও আর পাওয়া যায় না। 

দেশের অর্থনীতি বিশেষ করে রপ্তানি একটি মাত্র শিল্পের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল হওয়ায় গবেষক-বিশ্লেষকরা বহুবার শিল্পের বৈচিত্র্যকরণের কথা বললেও নীতিকৌশল পর্যায়ে কোনো দৃশ্যমান উদ্যোগ দেখা যায়নি। ফল যা হওয়ার তা-ই হয়েছে। এখন রপ্তানি বাড়লেও শিল্প খাতের কর্মসংস্থান প্রায় স্থবির। তার ওপর দুই বছর ধরে অর্থনীতি ভুগছে উচ্চ মূল্যস্ফীতির ব্যাধিতে। সেই রোগ সারানোর জন্য বর্তমান সরকারের নীতিনির্ধারকরা প্রয়োগ করছেন সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির (পড়ুন সুদহার বাড়ানো) মতো গতানুগতিক এবং রক্ষণশীল ওষুধ। এই ব্যবস্থাপনায় রোগী সুস্থ হলেও দুর্বল হয়ে পড়ে। অর্থাৎ অর্থনীতিতে দেখা দেয় নিম্নগতি। প্রবৃদ্ধির খুব ক্ষতি না করে কীভাবে মূল্যস্ফীতির লাগাম টানা যায়, সে ব্যবস্থাপনা সহজ নয়। সেখানেই চ্যালেঞ্জ নীতিনির্ধারকদের। এ চ্যালেঞ্জ সাফল্যের সঙ্গে মোকাবিলা না করতে পারলে কী হয়, তা বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থায় বেশ পরিষ্কার। 

এখন জরুরি হলো, প্রথমত অর্থনীতির চাকা সচল করে গাড়িকে আবার প্রবৃদ্ধির পথে তোলা। দ্বিতীয়ত, প্রবৃদ্ধি হলেও তা যেন কর্মসংস্থানহীন না হয়, সেদিকে দৃষ্টি দেওয়া। তার জন্য প্রয়োজন হবে গাড়িটিকে তিন চাকার (অর্থাৎ কৃষি, রেমিট্যান্স আর পোশাক রপ্তানিভিত্তিক) ছোট গাড়ি থেকে অনেক চাকার বড় ট্রাকে রূপান্তর করা। তৈরি পোশাকের পাশাপাশি এ ধরনের আরও কয়েকটি শ্রমঘন শিল্প গড়ে তুলতে পারলে শ্রমবাজারের চাকা সচল হবে। তার সঙ্গে দৃষ্টি দিতে হবে হতাশ মানুষকে শ্রমবাজারে ফিরিয়ে শ্রমশক্তি বাড়ানো এবং নারী ও যুবকদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ানোর মতো চ্যালেঞ্জগুলোর দিকে। 

রিজওয়ানুল ইসলাম: অর্থনীতিবিদ, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার এমপ্লয়মেন্ট সেক্টরের সাবেক বিশেষ উপদেষ্টা 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: প রব দ ধ র শ রমব জ র ২০২৪ স ল ২০২৩ স ল শ রমশক ত র জন য

এছাড়াও পড়ুন:

১০০ কোটি টাকার পাচারের অভিযোগ, জাহাঙ্গীরের নামে মামলা

ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দপ্তরের সাবেক পিয়ন জাহাঙ্গীর আলম ওরফে পানি জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে ১০০ কোটি টাকা পাচারের অভিযোগে মামলা করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।

শুক্রবার (৩১ অক্টোবর) নোয়াখালীর চাটখিল থানায় মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে এই মামলা করেছে সিআইডির ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিট।

আরো পড়ুন:

নাফিসা কামালসহ ৮ ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অর্থপাচারের মামলা

সাজিদ হত্যার তদন্তে সিআইডিকে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমোদন 

সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার (মিডিয়া) জসীম উদ্দিন খান জানান, প্রাথমিক অনুসন্ধানে উল্লেখযোগ্য প্রমাণ পাওয়ায় নোয়াখালীর চাটখিল থানায় জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে।

তিনি আরো জানান, নোয়াখালীর চাটখিল উপজেলার এক নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান জাহাঙ্গীর আলম জাতীয় সংসদ সচিবালয়ে দৈনিক মজুরিভিত্তিক কর্মচারী হিসেবে কাজ করতেন। পরে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর তিনি অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে স্বল্প সময়ের জন্য ‘ব্যক্তিগত সহকারী’ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এই দায়িত্বই তাকে আর্থিকভাবে লাভবান করেছে মর্মে প্রাথমিক অনুসন্ধানে উঠে এসেছে।

জসীম উদ্দিন খান জানান, ২০১০ সালে জাহাঙ্গীর ‘স্কাই রি অ্যারেঞ্জ লিমিটেড’ নামে একটি কোম্পানি গঠন করে বিকাশের ডিস্ট্রিবিউশন ব্যবসা নেন। কিন্তু এর আড়ালে তিনি অসংখ্য সন্দেহজনক ব্যাংকিং কার্যক্রম করেন। কোম্পানির নামে একাধিক ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অস্বাভাবিক অঙ্কের টাকা জমা হয়, যার বৈধ উৎস পাওয়া যায়নি ও ব্যবসার সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ।

সিআইডির এই কর্মকর্তা জানান, প্রতিষ্ঠানটির অ্যাকাউন্টগুলোতে ২০১০ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে বিভিন্ন ব্যাংকে মোট ৫৬৫ কোটিরও বেশি টাকা লেনদেন হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশ নগদে জমা হয়েছে দেশের নানা স্থান থেকে। এসব অর্থের উৎস অজানা এবং হুন্ডি ও মানিলন্ডারিং কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত বলে প্রাথমিক প্রমাণ মেলে।

বিশেষ পুলিশ সুপার জসীম উদ্দীন জানান, জাহাঙ্গীর আলম তার স্ত্রী কামরুন নাহার ও ভাই মনির হোসেনের সহায়তায় দীর্ঘদিন ধরে অবৈধ অর্থ লেনদেন করতেন। জাহাঙ্গীর আলম ও তার স্ত্রী ২০২৪ সালের জুন মাসে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান এবং বর্তমানে ভার্জিনিয়ায় অবস্থান করছেন। বিদেশে তাদের বিনিয়োগ বা সম্পদ ক্রয়ের কোনো সরকারি অনুমোদন না পাওয়া গেলেও তারা যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমিয়েছেন বলে প্রাথমিক অনুসন্ধানে প্রমাণ মেলে।

অনুসন্ধানে প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে, জাহাঙ্গীর আলম, তার স্ত্রী কামরুন নাহার, ভাই মনির হোসেন এবং প্রতিষ্ঠান স্কাই রি অ্যারেঞ্জ লিমিটেড যৌথভাবে ২০১০ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে প্রায় ১০০ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছেন। অপরাধের পূর্ণাঙ্গ তথ্য উদঘাটন, অপরাপর সদস্যদের শনাক্ত ও গ্রেপ্তার করার স্বার্থে সিআইডির তদন্ত ও অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

ঢাকা/মাকসুদ/সাইফ 

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • যশোরে জিআই পণ্য খেজুর গুড় তৈরির রস সংগ্রহে গাছ প্রস্তুতির উদ্বোধন
  • ১০০ কোটি টাকার পাচারের অভিযোগ, জাহাঙ্গীরের নামে মামলা
  • সুদানে কারা গণহত্যা চালাচ্ছে, আরব আমিরাতের ভূমিকা কী