ভৈরবে ৪০ দোকানে আগুন, ২ কোটি টাকার ক্ষতি
Published: 24th, May 2025 GMT
কিশোরগঞ্জের ভৈরবে একটি জুতার বাজারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। এতে কমপক্ষে ৪০টি দোকান পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। দোকানিদের দাবি, আগুনে পুড়ে প্রায় দুই কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
শুক্রবার (২৩ মে) দিবাগত রাত একটার দিকে উপজেলা পরিষদসংলগ্ন জলপরী পার্ক রোডের লালু-কালু মার্কেটে এ দুর্ঘটনা ঘটে। খবর পেয়ে ভৈরব বাজার ফায়ার সার্ভিস ও নদী ফায়ার সার্ভিসের তিনটি ইউনিট প্রায় এক ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।
ক্ষতিগ্রস্ত মার্কেটের মালিক কাজী মাসুদ বলেন, “যতটুকু জেনেছি বিদ্যুতের শর্টসার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে। আমাদের মার্কেটে সামনের সারির প্রায় সব কয়টি দোকান পুড়ে গেছে। আনুমানিক দুই কোটি টাকা ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ব্যবসায়ীদের।”
ভৈরব ফায়ার সার্ভিসের ওয়্যারহাউজ ইন্সপেক্টর রাজন আহমেদ ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে জানান, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ও আগুনের সূত্রপাতের বিষয়টি তদন্ত ছাড়া বলা সম্ভব নয়। তবে প্রাথমিক ধারণা করা হচ্ছে, প্রায় এক কোটি টাকা ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে।
ঢাকা/রুমন/এস
.উৎস: Risingbd
এছাড়াও পড়ুন:
মাওবাদীদের বিরুদ্ধে বিজেপি সরকারের এই ‘সর্বাত্মক যুদ্ধ’ কেন
ভারতের ছত্তিশগড় রাজ্যে মাওবাদী বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে দেশটির কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকার যে সামরিক অভিযান শুরু করেছে, তা কার্যত এক রণাঙ্গনে পরিণত হয়েছে। রাজ্যের করিগাট্টা পাহাড়ি জঙ্গলে মোতায়েন করা হয়েছে ১০ হাজারের বেশি সেনা। হেলিকপ্টারসহ তল্লাশি চলছে গভীর বনাঞ্চলে। ‘অপারেশন জিরো’ বা ‘অপারেশন কাগার’ নামে পরিচিত এই অভিযানকে মাওবাদী দমনের সবচেয়ে বড় পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।
এ অভিযান সরাসরি পরিচালনা করছে ভারতের ক্ষমতাসীন হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকার। তারা ছত্তিশগড়ের রাজ্য সরকার ও কেন্দ্র—উভয় স্তরেই ক্ষমতায় রয়েছে। এ বছরের শুরু থেকেই সরকার মাওবাদীদের ওপর দমন–পীড়ন জোরদার করেছে। নিহত হয়েছেন কমপক্ষে ২০১ জন বিদ্রোহী। নিহত ব্যক্তিদের অনেকেই আদিবাসী। শুধু গত বুধবারেই মারা গেছেন ২৭ জন, যাঁদের মধ্যে মাওবাদী সংগঠনের সর্বশেষ সাধারণ সম্পাদক নম্বালা কেশবা রাও রয়েছেন।
তবে মানবাধিকার সংগঠন ও বিরোধী দলগুলো এই অভিযানে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তাদের অভিযোগ, ‘মাওবাদী’ আখ্যায় অনেক নিরীহ আদিবাসীকেও হত্যা করা হচ্ছে। তারা সরকারের কাছে যুদ্ধ বন্ধ করে আলোচনার আহ্বান জানিয়েছে।
সরকারি তথ্য অনুসারে, ২০০০ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে মাওবাদী সংঘর্ষে নিহত হয়েছেন ১১ হাজারের বেশি মানুষ, যাঁদের মধ্যে রয়েছে সাধারণ মানুষ ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরাও। এর মধ্যে নিহত বিদ্রোহীর সংখ্যা অন্তত ৬ হাজার ১৬০ জন।
মাওবাদীরা কারা, কী চায় তারাভারতে সশস্ত্র মাওবাদী আন্দোলনের সূচনা হয় ১৯৬৭ সালে পশ্চিমবঙ্গের নকশালবাড়িতে কৃষকদের এক বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে। এই ‘নকশাল’ আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন চারু মজুমদার, কানু সান্যাল প্রমুখ। তাঁদের দাবি ছিল—ভূমিহীন কৃষকদের জমি দিতে হবে এবং জমিদারদের শোষণের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।
এই আন্দোলন থেকেই জন্ম নেয় ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী), যারা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার বাইরে গিয়ে সশস্ত্র বিদ্রোহে বিশ্বাস করত। চীনা নেতা মাও সে–তুংয়ের বিপ্লবী দর্শন ছিল তাদের মূল অনুপ্রেরণা। তবে সময়ের সঙ্গে এই দল ভেঙে যায় বহু অংশে। মূল সিপিআই (এমএল) এখন একটি নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল। তারা নির্বাচনে অংশ নেয়।
যারা কয়েক যুগ ধরে ভারতীয় রাষ্ট্রের উন্নয়ননীতি, ভূমি অধিগ্রহণ ও আদিবাসী শোষণের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলেছে, তাদের বিরুদ্ধে সেনা অভিযান কি স্থায়ী শান্তি আনবে?অন্যদিকে ২০০৪ সালে দুটি বড় সশস্ত্র সংগঠন—পিপলস সেন্টার ও মাওয়িস্ট কমিউনিস্ট সেন্টার এক হয়ে তৈরি করে বর্তমানের সবচেয়ে প্রভাবশালী বিদ্রোহী সংগঠন—সিপিআই (মাওয়িস্ট)। ভারত রাষ্ট্র এই দলকে বর্তমানে ভারতের ‘সবচেয়ে বড় অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা হুমকি’ হিসেবে মনে করে।
বহু বছর ধরে ছত্তিশগড়, ঝাড়খণ্ড, ওডিশা, অন্ধ্র প্রদেশ, তেলেঙ্গানা ও মহারাষ্ট্রে এদের প্রভাব ছিল ব্যাপক। একসময় প্রায় ১২৬টি জেলায় সক্রিয় থাকলেও বর্তমানে তাদের উপস্থিতি ৩৮টি জেলায় সীমিত হয়েছে।
বস্তার সংঘাত: মাওবাদ বনাম খনিজ লোভের রাজনীতি২০০০ সালে পৃথক রাজ্য হিসেবে ছত্তিশগড় গঠনের পর থেকেই বস্তারে সংঘাত তীব্রতর হয়েছে। সালওয়া জুদুম নামের বিতর্কিত রাষ্ট্রীয় প্রতিক্রিয়াশীল বাহিনীর মাধ্যমে শুরু হয় আদিবাসী গ্রাম উচ্ছেদের অভিযান। আদিবাসীদের অভিযোগ, খনিজসমৃদ্ধ এই অঞ্চলে সেনা ক্যাম্প বসিয়ে সরকার আসলে করপোরেট খনন কোম্পানিগুলোর স্বার্থ রক্ষা করছে।
দেশের ১৯ শতাংশ লৌহ আকরিক মজুত রয়েছে ছত্তিশগড়ে, যার অধিকাংশই বস্তারে। আদিবাসী নেতা মনীষ কুঞ্জম বলছেন, ২০০৫ সালে টাটা ও এসার কোম্পানি খনিজ উত্তোলনের চেষ্টা শুরু করলে অভিযান চালিয়ে প্রায় সাড়ে তিন লাখ মানুষকে উচ্ছেদ করা হয়। তবে প্রবল প্রতিরোধের মুখে কোম্পানিগুলো পিছিয়ে যায়। আইনে বলা আছে, গ্রাম পরিষদের সম্মতি ছাড়া খননকাজ শুরু করা যায় না। যাঁরা প্রতিবাদ করেন, তাঁদের মাওবাদী বা তাঁদের সমর্থক হিসেবে দাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে। বস্তারে দারিদ্র্যের হার প্রায় ৮০ শতাংশ।
এই পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠছে—বস্তারে সংঘাত কি আদৌ মাওবাদ দমনের লড়াই, নাকি তা আদিবাসীদের মাটি ও অধিকার বাঁচানোর এক মরিয়া প্রতিরোধ, যার মুখে লেবেল সেঁটে দেওয়া হচ্ছে ‘নকশাল’?
বিজেপির আগ্রাসী রণকৌশলছত্তিশগড়ে কংগ্রেস সরকার থাকাকালীন (২০২০-২০২৩) ১৪১ জন বিদ্রোহী নিহত হন। কিন্তু বিজেপি সরকার আসার পর ২০২৪ সালেই নিহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২২৩ জনে। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বিষ্ণু দেব সাই বলছেন, ‘এখন চূড়ান্ত পর্ব চলছে, আমরা দ্রুত নকশালমুক্ত ভারতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি।’
কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহও এই অভিযান ঘিরে নিয়মিত মাঠে যাচ্ছেন, সেনা শিবিরে রাত কাটাচ্ছেন। তাঁর ঘোষণা—২০২৬ সালের ৩১ মার্চের মধ্যে ভারতকে ‘নকশালমুক্ত’ করে তোলা হবে।
বর্তমানে শুধু বস্তার অঞ্চলেই রয়েছে সরকারের ৩২০টি নিরাপত্তা শিবির। শিবিরগুলোতে সব মিলিয়ে আছে প্রায় ৩০ লাখ নিরাপত্তাকর্মী। গোটা ছত্তিশগড়ে মোতায়েন রয়েছে ৬৬ হাজারের বেশি নিরাপত্তাকর্মী। ড্রোন, থার্মাল ইমেজিং, উপগ্রহ-নিরীক্ষণসহ নানা আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে নজরদারি চলছে ঘন জঙ্গলে।
অভিযোগ: আদিবাসীদের ভুয়া এনকাউন্টারে হত্যাতবে এ অভিযান নিয়ে সবচেয়ে গুরুতর প্রশ্ন উঠেছে মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে। ‘পিপলস ইউনিয়ন ফর সিভিল লিবার্টিজ’-এর মতে, গত দেড় বছরে অন্তত ১১টি ভুয়া এনকাউন্টারের প্রমাণ পাওয়া গেছে। যেমন মার্চে বিজাপুর জেলার বর্ডগা গ্রামে তিনজন বিদ্রোহীকে গুলি করে হত্যার দাবি করে পুলিশ। কিন্তু স্থানীয় লোকজন বলেন, ওই তিনজনকে রাতে তুলে নিয়ে গিয়ে পরে গুলি করে ‘মাওবাদী’ তকমা দেওয়া হয়।
২০১২ সালে সাড়েকে গুডা গ্রামে ১৭ আদিবাসী এবং ২০১৩ সালে ৮ জন আদিবাসী নিহত হন নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে। পরবর্তী তদন্তে উচ্চ আদালতের বিচারকেরা জানান, নিহত সবাই নিরপরাধ ছিলেন। অথচ আজও কোনো পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা হয়নি।
মাওবাদীদের সক্ষমতা কি কমে আসছে২০১১ সালে ছত্তিশগড়ের তৎকালীন পুলিশ মহাপরিদর্শক বিশ্বরঞ্জন অনুমান করেছিলেন যে বস্তার অঞ্চলে প্রায় ১০ হাজার সশস্ত্র মাওবাদী এবং ৪০ হাজার জন মিলিশিয়া সদস্য সক্রিয় ছিল। যদিও এই সংখ্যাগুলো নির্ভুলভাবে নির্ধারণ করা বেশ কঠিন। সেই সময় মাওবাদীরা নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর ভয়াবহ হামলা চালাতে সক্ষম ছিল। ২০১০ সালে তারা ছত্তিশগড়ের এক বনাঞ্চলে অতর্কিত হামলা চালিয়ে ৭৬ জন আধাসামরিক সদস্যকে হত্যা করে। তিন বছর পর আরেকটি হামলায় বহু মানুষ নিহত হন, যাঁদের মধ্যে কংগ্রেস নেতাও ছিলেন।
বর্তমানে বস্তারের আইজিপি সুন্দররাজ পি জানাচ্ছেন, এখন প্রায় এক হাজার সশস্ত্র মাওবাদী এবং তাদের সঙ্গে জড়িত আরও ১৫ হাজার ব্যক্তি সক্রিয় আছেন।
মাওবাদীদের অভ্যন্তরীণ প্রতিবেদনে স্বীকার করা হয়েছে যে তাদের সদস্য সংগ্রহ কমে গেছে। ইউনিটগুলো ছোট হয়ে গেছে এবং গোলাবারুদের ঘাটতি দেখা দিচ্ছে। একসময় যে কেন্দ্রীয় কমিটি ও পলিটব্যুরোতে ৪০ জন সদস্য ছিল, এখন তার মধ্যে কেবল ১৮ জন মুক্ত আছেন। বাকি সবাই গ্রেপ্তার হয়েছেন বা নিহত।
ছত্তিশগড়ে মাওবাদীরা দুর্বল হয়ে পড়েছে ঠিকই, কিন্তু তারা পাশের রাজ্য মধ্যপ্রদেশে আবার প্রভাব বিস্তার করছে। মাওবাদ হচ্ছে একটি আদর্শ—একে কেবল শক্তি দিয়ে শেষ করা যাবে না। যত দিন না অর্থনৈতিক বৈষম্যহীন সমাজ গড়া যায়, তত দিন এই আদর্শ নতুনরূপে ফিরে আসতে পারে।
সাবেক মাওবাদীদের নিয়োগ: সরকারের ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’?বিভিন্ন শান্তিপূর্ণ আন্দোলনও দমন করা হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ‘মূলবাসি বাঁচাও মঞ্চ’ নামের একটি আদিবাসী সংগঠনকে গত বছর নিষিদ্ধ করা হয়েছে ‘উন্নয়নবিরোধিতা’ ও ‘সেনাবিরোধিতা’র অভিযোগে। এর সদস্য বহু তরুণ এখন কারাবন্দী।
সরকার ২০০৮ সাল থেকে সাবেক মাওবাদীদের জেলা রিজার্ভ গার্ডে (ডিআরসি) নিয়োগ দেওয়া শুরু করে। উদ্দেশ্য ছিল—এদের স্থানীয় বন ও ভূগোল ভালোভাবে চেনা। তারা মাওবাদীদের গতিবিধি সম্পর্কে অবহিত। কিন্তু মানবাধিকারকর্মীদের শঙ্কা, এই প্রক্রিয়া আদিবাসী সমাজে বিভাজন তৈরি করছে এবং ভবিষ্যতে সহিংসতা আরও বাড়াতে পারে।
শান্তি না গভীরতর সংকটসরকার বলছে, তারা ভারতের নিরাপত্তার স্বার্থে একটি নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে মাওবাদীদের দমন করে শান্তি ফিরিয়ে আনতে চায়। কিন্তু যারা কয়েক যুগ ধরে ভারতীয় রাষ্ট্রের উন্নয়ননীতি, ভূমি অধিগ্রহণ ও আদিবাসী শোষণের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলেছে, তাদের বিরুদ্ধে সেনা অভিযান কি স্থায়ী শান্তি আনবে? নাকি আরও ভীত, বিচ্ছিন্ন ও নিপীড়িত হবে ভারতের আদিবাসী জনগোষ্ঠী?
এই প্রশ্নই এখন বস্তারের গভীর বন থেকে দিল্লির উচ্চপদস্থ মহলে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।
অলোক পুতুল সাংবাদিক
আল–জাজিরা থেকে নেওয়া ইংরেজির সংক্ষেপিত অনুবাদ