পুলিশকে কে না ভয় করে! বিগত দিনগুলোতে রাষ্ট্রকে বলা হতো পুলিশি রাষ্ট্র। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর সেই পুলিশকে বিব্রত ও হতোদ্যম মনে হচ্ছিল। এখন মনে হয়, তার পুরাতন স্মার্টনেস ফিরে পেয়েছে। সম্প্রতি সংবাদপত্রে স্বল্পমাত্রায় হলেও ওই স্মার্টনেসের খবর দেখা গেছে। নারী নির্যাতন বৃদ্ধির প্রতিবাদমুখর একটি মিছিল যাচ্ছিল প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের দিকে। পুলিশ বাধা দিয়েছে। বাধা দেবারই তো কথা। কিন্তু তার পরে যা করেছে; গণঅভ্যুত্থানের পরে তা একেবারেই অপ্রত্যাশিত। সাদা পোশাক পরিহিত পুলিশ মিছিলকারীদের বেধড়ক প্রহার করেছে। কয়েকটি দৈনিকে ছাপা ছবিতে দেখা গেছে, উগ্রমূর্তি এক পুলিশ একটি মেয়ের চুল ধরে টানছে। এ রকম হৃদয়বিদারক ছবি আমরা আগেও দেখেছি। শেখ হাসিনার ১৫-১৬ বছরে অবশ্য রাজপথে নারীদের ওপর পুলিশের এ রকম আক্রমণ ঘন ঘন দেখা যায়নি। তার কারণ একটাই– মানুষ, বিশেষ করে মেয়েরা পথে নামতেই সাহস করত না। শেষ পর্যন্ত অবশ্য নেমেছিল গত জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে। ছেলেরা নেমেছিল, মেয়েরাও নেমেছিল। মেয়েদের প্রতিবাদটাই ছিল বিশেষরূপে কার্যকর।
বিগত সরকারের শাসনামলে একটা প্রশ্ন বেশ আলোচিত হতো। এর পরে কী? একটা বক্তব্য চালু ছিল যে, নৈরাজ্য দেখা দেবে। তেমনটা ঘটবার আগেই অবশ্য গণআন্দোলনের মুখে সরকারের পতন ঘটেছে। কিন্তু পতনের পরে অবস্থাটা এখন যে খুব শান্ত ও শান্তিপূর্ণ হয়েছে, তা তো নয়। না-হওয়ার প্রধান কারণ এটা, অভ্যুত্থানের পেছনে কোনো সংগঠিত রাজনৈতিক দল ছিল না; কেউ নেতৃত্ব দেয়নি। স্বতঃস্ফূর্ততাই ছিল এর প্রধান বৈশিষ্ট্য।
হাল ধরার তো দরকার ছিল। কিন্তু সেটা কারা ধরবেন, সে বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত ছিল না। এর ফলে অনেক ক’টি মন্দ উপসর্গ দেখা দিয়েছে। একটা হলো মামলা দেওয়া এবং পরে অভিযুক্তদের তালিকা থেকে নাম কেটে দেওয়ার বাণিজ্য। প্রতিহিংসার অনুপ্রেরণায় মামলার আসামি করার ঘটনা নিশ্চয়ই ঘটেছে। কিন্তু এর মধ্যে বাণিজ্যও ঢুকে পড়েছে। টাকা-পয়সা আদান-প্রদানের যেসব খবর শোনা গেছে, তার সবটাই যে ভুয়া, তা নয়; সত্যও আছে। দ্বিতীয় উপসর্গটি হলো মব ভায়োলেন্স এবং মব জাস্টিস। খবর বলছে, গত ১০ মাসে মব ভায়োলেন্সে নিহত হয়েছেন অসংখ্য মানুষ। মানুষ ক্ষুব্ধ ছিল, তাই আগুন দিয়েছে; বাড়িঘর ভাঙচুর করেছে; লুটতরাজও ঘটিয়েছে। কিন্তু মব তো মুভমেন্টের অংশ নয়; মুভমেন্টের বিচ্যুতি বৈকি।
রাজধানীতে ঘটা একটি ঘটনাই অন্য বহু ঘটনার প্রতিনিধিত্ব করছে। সেটা হলো গুলশান এলাকায় পলাতক সাবেক প্রধানমন্ত্রীর পরলোকগত সাবেক এক উপদেষ্টার পুত্রের সাবেক স্ত্রীর বাসগৃহে আক্রমণ। গুজব রটিয়ে দেওয়া হয়েছিল– ওই আবাসে ২০০-৩০০ কোটি টাকা লুকানো আছে। সেই সঙ্গে স্বৈরাচারের দোসরদের কয়েকজন লুকিয়েও রয়েছে। এতে মব সংগঠিত হতে কোনো অসুবিধা ঘটেনি। প্রচুরসংখ্যক লোক প্রথমে বাড়ির দেয়াল টপকে, পরে ফ্ল্যাটের দরজা ভেঙে ভেতরের সবকিছু তছনছ করেছে। লুকিয়ে-থাকা কাউকে পাওয়া যায়নি। টাকা-পয়সাও নাকি তেমন ছিল না; তবে মূল্যবান সামগ্রী নিশ্চয় বেশ কিছু ছিল। সেগুলো বীরত্বপূর্ণভাবে হস্তগত করতে ঘটনায় অংশগ্রহণকারীরা বিলম্ব করেনি। ওই সময়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অবশ্য কোনো স্মার্টনেস দেখা যায়নি।
ঊনসত্তরের অভ্যুত্থানের সময় তখনকার পূর্ববঙ্গে বহু জায়গায় গণআদালত বসেছে; কিন্তু সেখানে এক ধরনের শৃঙ্খলা ছিল এবং অভিযুক্তরা অপরাধী হিসেবে সামাজিকভাবে চিহ্নিত ছিল। মব জাস্টিসে সেসব ব্যাপার নেই। লুটপাটের বাইরে এর ভেতরে হিংস্রতা এবং সক্ষমতা প্রদর্শনের ব্যাপারও থাকে; এবার যেমনটা ঘটেছে। চোর সন্দেহে কাউকে ধরে প্রথমে হাত-পা ভাঙা, পরে এমনকি চোখ উপড়ে ফেলার খবরও পাওয়া গেছে বৈকি। এ ধরনের ভায়োলেন্সে রাজনীতি থাকে না, তবে প্রতিহিংসা থাকে। ধানমন্ডিতেও হাক্কানী প্রকাশনীর মালিককে যেভাবে হেনস্তা করা হয়েছে; সেটা কারা করেছে, তাও গোপন থাকেনি।
বিশেষভাবে বিপন্ন এখন নারী ও কন্যাশিশুরা। এবারকার গণঅভ্যুত্থানে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ ছিল ব্যাপক এবং সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল মেয়েদের অংশগ্রহণ। এমন বিপুলসংখ্যক মেয়ের অবিচলিত অংশগ্রহণ আগের কোনো আন্দোলনে দেখা যায়নি। অথচ আন্দোলনের শেষে এখন দেখা যাচ্ছে নারী নির্যাতন কমে তো না-ই, বরঞ্চ বেড়েছে। মেয়েরা নিরাপদে নেই। সড়কে নেই, গৃহেও নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটা একজন ছাত্রীকে হেনস্তা করার ঘটনা পত্রিকা এবং সামাজিক মাধ্যমে সম্প্রতি বেশ ভালো রকমের চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। কোনো বড় মাপের ঘটনা নয়; হামেশাই ঘটে থাকে; মানুষ শুনেও শোনে না। তবে ওই ঘটনা মানুষকে নাড়া দিয়েছে একাধিক কারণে। প্রথমত এটি ঘটল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, যেটি সকল গণআন্দোলনের সূচনাবিন্দু হিসেবে কাজ করে এবং এবারের অভ্যুত্থানে তো ছিল একেবারে প্রাণকেন্দ্র; এবং সে অভ্যুত্থান অমন সর্বজনীন রূপ নিত না, মেয়েরা যদি এগিয়ে না আসত। দ্বিতীয়ত, নারী হেনস্তাকরণ ঘটিয়েছে যে ব্যক্তি, সে ওই বিশ্ববিদ্যালয়েরই একজন নিম্নবেতনভুক্ত কর্মচারী। তৃতীয়ত, উত্ত্যক্তকারীকে থানা থেকে ছাড়িয়ে নেবার জন্য তৌহিদি জনতা নামে একটি মৌলবাদী গোষ্ঠীর থানায় গিয়ে উপস্থিত হওয়া এবং উত্ত্যক্তকারীর জামিনে ছাড়া পাওয়া। মেয়েটি সাহসী; বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে সে নালিশ করে। কর্তৃপক্ষ পুলিশে খবর দেয়, দুর্বৃত্তকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। তারপর থানায় তার সমর্থক কিছু লোকের উপস্থিতি। দুর্বৃত্তটির আপত্তি ছিল মেয়েটির গায়ে যথাযথরূপে ওড়না না-থাকা নিয়ে। মূল প্রশ্নটা কিন্তু একেবারেই মৌলিক; সেটা হলো, বিশ্ববিদ্যালয়ের অত্যন্ত ছোটমাপের একজন কর্মচারী হয়ে অত বড় একটা সাহস পেল কোথা থেকে? জবাবটা কিন্তু সোজা; পেয়েছে পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা থেকে। এই ব্যবস্থা যে কোনো পুরুষকে একজন নারীর– তা তিনি যে মর্যাদারই হোন না কেন, চেয়ে অধিক ক্ষমতাবান ভাববার অনুপ্রেরণা জোগায়, এমনকি ওই ভাবনাকে সমর্থনও করে।
সমাজজুড়ে এখন ভয়াবহতা বিরাজ করছে। আতঙ্কে রয়েছে মানুষ। জরিপ বলছে, সহিংসতার যারা শিকার হন তাদের মধ্যে ৭০ শতাংশই নারী ও শিশু। বাংলাদেশের মানুষ সুখে নেই। কয়েক বছর ধরে সুখের মাপে বিশ্বের দেশগুলোর অবস্থান বিষয়ে জাতিসংঘের একটি সংস্থার বার্ষিক জরিপের যে তালিকা বের হয়েছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, চার বছর ধরে বাংলাদেশের অবস্থান ক্রমে নামছেই। আগের বছরের তুলনায় এ বছর নেমেছে পাঁচ ধাপ, যার দরুন বাংলাদেশের অবস্থান এখন ১৪৭টি দেশের মধ্যে ১৩৪তম স্থানে। ইকোনমিস্ট পত্রিকার জরিপ বলছে, বৈশ্বিক গণতান্ত্রিক সূচকেও বাংলাদেশের অবনতি ঘটেছে ২০ ধাপ। সুখ এবং গণতন্ত্র পরস্পর আত্মীয় বৈকি। কিন্তু বাংলাদেশে তার কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
.উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
এমন বৃষ্টিমাখা ভোগান্তির দিন জীবনে না আসুক
আমি একজন স্কুলশিক্ষক। দীর্ঘদিন এ পেশায় যুক্ত আছি। শীত হোক বা গরম, আমাকে সব ধরনের আবহাওয়া সহ্য করে স্কুলে যেতে হয় সময়মতো। এটা অনেকের জন্য হয়তো স্বাভাবিক, তবে পরিবেশ পরিস্থিতি সবার সমান হয় না। শুধু একজন নারী হিসেবে নয়, মানুষ হিসেবে চলার পথে মাঝেমধ্যে এমন কিছু পরিস্থিতিতে পড়তে হয়, যাতে বিড়ম্বনা বাড়ে বৈ কমে না।
বৃহস্পতিবারের (২৯ মে ২০২৫) কথাই ধরা যাক, সকাল থেকে বৃষ্টি শুরু হলো। আমি যেহেতু স্কুলে চাকরি করি, তাই সকাল ৯টার আগেই আমাকে স্কুলে থাকতে হয়। সকালে রেডি হয়ে বের হতে গিয়ে দেখলাম, এই বৃষ্টিতে ছাতা ছাড়া যাওয়া সম্ভব নয়। ছাতা নিয়ে নাহয় বের হলাম। রাস্তায় গিয়ে অবস্থা দেখে তো চোখ কপালে ওঠার দশা। একে বৃষ্টি, তার ওপর রাস্তায় কাদা, যেতে হবে অটোরিকশায় করে—কী বেসামাল অবস্থা! অটোরিকশা খুঁজে পেতেই জীবন শেষ হয়ে যাবে মনে হচ্ছিল। এর মধ্যে ভাড়া চায় দুই থেকে তিন গুণ। যাহোক, ধৈর্যের অসীম পরীক্ষা দিয়ে অটোরিকশা পেলাম। বৃষ্টি তখনো চলমান। আমার গন্তব্য সাটিরপাড়া কালীকুমার ইনস্টিটিউশন।
স্কুলটি আমাদের নরসিংদী সদর উপজেলার বেশ পুরোনো প্রতিষ্ঠান। আমি সম্প্রতি এই স্কুলে বাংলা বিষয়ে অতিথি শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছি। স্কুলের দূরত্ব আমাদের বাড়ি থেকে বেশি নয়। কিন্তু বৃষ্টির মধ্যে এটাকেই মনে হচ্ছে শত মাইল। কারণ, সকালে সবাই অফিসে যায়, গাড়ির চাপ থাকে, মানুষের চলাচলও থাকে অনেক। কখনো সামান্য কারণেই ঝগড়া লেগে যায় অটোরিকশা আর নছিমনের চালকদের মধ্যে, মাঝখান থেকে আমাদের মতো সাধারণ যাত্রীদের ভোগান্তি। গতকালও (বৃহস্পতিবার) যখন অটোরিকশায় করে বৃষ্টির মধ্যে যাচ্ছিলাম, তখন আমাদের নরসিংদী পৌরসভার মোড়ে এসে দেখি, বিশাল যানজট। বড় দু-তিনটা মালবাহী ট্রাক এসে আটকে গেছে। অথচ আমরা জানি, এসব মালবাহী ট্রাক আসে গভীর রাতে, তখন রাস্তায় যানজট থাকে না।
বৃষ্টির কারণে সড়কে পানি জমে যাওয়ায় অনেকে ভিজে যাতায়াত করেন