দারিদ্র্য জয় করে জাতীয় দলে সোনালী, খেলবেন জর্ডানে!
Published: 30th, May 2025 GMT
পঞ্চগড়ের অজপাড়া গ্রামের ভ্যানচালকের মেয়ে ফেরদৌসি আক্তার সোনালী এখন দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। দারিদ্র্য, প্রতিকূলতা ও সামাজিক বাধা অতিক্রম করে তিনি জায়গা করে নিয়েছেন বাংলাদেশ জাতীয় নারী ফুটবল দলে। বর্তমানে তিনি অবস্থান করছেন জর্ডানে, যেখানে আগামীকাল (৩১ মে) ইন্দোনেশিয়ার বিপক্ষে আন্তর্জাতিক প্রীতি সিরিজে মাঠে নামবে বাংলাদেশ দল।
সোনালী বেড়ে উঠেছেন পঞ্চগড় সদর উপজেলার হাড়িভাসা ইউনিয়নের বনগ্রামে। তার বাবা ফারুক ইসলাম একজন ব্যাটারিচালিত ভ্যানচালক এবং মা মেরিনা বেগম একজন গৃহিণী। তিন ভাই-বোনের মধ্যে সোনালী বড়। দারিদ্র্যসঙ্কুল পরিবেশে বেড়ে ওঠা এই কিশোরী ছোটবেলা থেকেই ফুটবলের প্রতি আগ্রহী ছিলেন।
সোনালী প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করেন স্থানীয় গইচপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এরপর হাড়িভাসা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়াকালীন বিভিন্ন ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশ নেন এবং বিদ্যালয়ের পক্ষে আন্তঃবিদ্যালয় ফুটবল প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন। এখান থেকেই সুযোগ মেলে পঞ্চগড়ের টুকু ফুটবল একাডেমিতে প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ গ্রহণের।
আরো পড়ুন:
৬ বছরের চুক্তিতে রিয়াল মাদ্রিদে আলেকজান্ডার-আর্নল্ড
ফুটবল দলবদল
ফিরে আসার গল্পে মার্টিনেজ, র্যাশফোর্ডকে ঘিরে বার্সার কৌশল
২০২৩ সালে ফুটবলে প্রতিভার স্বীকৃতি হিসেবে সোনালী ভর্তি হন বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে (বিকেএসপি)। বর্তমানে তিনি নবম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত এবং বিকেএসপিতে গোলরক্ষক হিসেবে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন।
জানা গেছে, জাতীয় দলে ডাক পাওয়ার পর সোনালী বর্তমানে জর্ডানে অবস্থান করছেন। বাংলাদেশ দল সেখানে আয়োজিত একটি ত্রিদেশীয় আন্তর্জাতিক সিরিজে অংশ নিচ্ছে। আগামীকাল (৩১ মে) বাংলাদেশ নারী ফুটবল দল ইন্দোনেশিয়ার বিপক্ষে প্রথম ম্যাচ খেলবে এবং ৩ জুলাই দ্বিতীয় ম্যাচে স্বাগতিক জর্ডানের মুখোমুখি হবে। সেখানে গোলবারের নিচে সোনালীকে দেখা যেতে পারে বাংলাদেশের রক্ষাকবচ হিসেবে।
সোনালীর বাবা ফারুক ইসলাম বলেন, “ছোটবেলা থেকেই সোনালীর ফুটবলের প্রতি আগ্রহ ছিল। অনেকেই নানান কথা বলত, আমার মেয়ে এসবে পাত্তা দিত না। অনেক সময় আমিও নিষেধ করতাম, তারপরও ফুটবল নিয়েই পড়ে থাকত। টানাপোড়নের সংসারে তাকে সেভাবে আর্থিক সহায়তা দিতে পারিনি, খেয়ে না খেয়ে অনুশীলনে যেত। আজকে আমার মেয়ে জাতীয় দলে জায়গা পেয়েছে, দেশের হয়ে বিদেশে খেলবে—এটাই সবচেয়ে বড় আনন্দ।”
সোনালীর মা মেরিনা বেগম জানান, “মেয়ের ফুটবল খেলা নিয়ে অনেক প্রতিবন্ধকতা ছিল। আমরা তাকে সবসময় উৎসাহ দিয়েছি। আজ সে জাতীয় দলে, আমাদের বিশ্বাস সে দেশের মুখ উজ্জ্বল করবে।”
টুকু ফুটবল একাডেমির পরিচালক টুকু রেহমান বলেন, “সোনালী সম্ভাবনাময় একজন খেলোয়াড়। কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে সে আজকের জায়গায় এসেছে। আমি তাকে নিয়ে বেশ আশাবাদী ছিলাম, সে আমার আশা পূর্ণ করেছে। সোনালীর মতো আরও অনেকেই এভাবে উঠে আসুক—এই প্রত্যাশা আমার।”
উল্লেখ্য, জাতীয় নারী দলের আরেক গোলরক্ষক ইয়ারজান বেগমের বাড়িও পঞ্চগড় সদর উপজেলার হাড়িভাসা ইউনিয়নের খোপড়াবান্দি গ্রামে। তিনিও একই একাডেমিতে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন।
এ বিষয়ে হাড়িভাসা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাইয়েদ নূর-ই-আলম বলেন,
“আমাদের ইউনিয়নের দুটি গ্রামের দুই মেয়ে জাতীয় দলে খেলছে—এটি আমাদের জন্য শুধু গর্ব নয়, সামাজিক অগ্রগতিরও প্রতীক।”
ঢাকা/নাঈম/আমিনুল
.উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ফ টবল জ ত য় দল ফ টবল
এছাড়াও পড়ুন:
৫০ শয্যার থানচি হাসপাতাল চলছে একজন চিকিৎসকে
বান্দরবানের থানচি উপজেলার প্রায় ৩০ হাজার মানুষের একমাত্র ভরসার জায়গা ৫০ শয্যার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসক, নার্স ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির সংকটে এই হাসপাতাল কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। বর্তমানে পুরো হাসপাতাল চালাচ্ছেন মাত্র একজন চিকিৎসক। গত পাঁচবছরে চিকিৎসাধীন ও রেফার্ড করা ২৪ জন রোগী মারা গেছেন।
হাসপাতাল সূত্র জানায়, ১৯৯৫ সালে ৩১ শয্যার থানচি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স যাত্রা শুরু করে। পরে এটি ৫০ শয্যায় উন্নীত হয়। এই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১২ জন চিকিৎসক থাকার কথা থাকলেও কর্মরত আছেন মাত্র দুইজন। তাদের মধ্যে একজন ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন। এ কারণে রোগীদের সেবা দিতে পারছেন না। ১৮ জন নার্স পদে রয়েছেন মাত্র চারজন। চারজন মিডওয়াইফ থাকার কথা, নেই একজনও।
আরো পড়ুন:
ফরিদপুরে পাগলা ঘোড়ার কামড়ে আহত ২০
বক্তব্য দেওয়ার সময় অসুস্থ হয়ে পড়লেন কাদের সিদ্দিকী
প্রাথমিক থেকে শুরু করে জরুরি চিকিৎসার জন্য এই হাসপাতালে ছুটে যান পাহাড়ি ও বাঙালিরা। তাদের অভিযোগ, হাসপাতালটি ৫০ শয্যায় উন্নীত হলেও আধুনিক চিকিৎসা সুবিধা যোগ হয়নি। প্রয়োজনীয় সংখ্যক চিকিৎসক না থাকায় গর্ভবতী নারী, শিশু ও বৃদ্ধ রোগীরা সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়ছেন।
দুর্গম এলাকার রোগীরা অনেক সময় নদীপথ কিংবা পাহাড়ি রাস্তা পাড়ি দিয়ে হাসপাতালে এলেও কাঙ্ক্ষিত চিকিৎসা সেবা পান না। বরং তাদের বান্দরবান সদর হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। অনেক সময় বান্দরবানে যাওয়ার পথে রোগীরা মারা যান। এ কারণে জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসক, নার্স ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সরবরাহের দাবি জানিয়েছেন তারা।
হাসপাতালের পরিসংখ্যানবীদ পঙ্কজ বড়ুয়া জানান, ২০২০ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত এখানে ভর্তি হয়েছেন ৫ হাজার ১৯৮ জন রোগী। এর মধ্যে ৪৫৬ জনকে রেফার্ড করা হয় বান্দরবান সদর হাসপাতালে। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন ১৭ জন রোগী।
থানচি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অ্যাম্বুলেন্স চালক মংক্যসিং মারমা বলেন, “২০১৯ সালে চাকরিতে যোগদান করার পর থেকে অন্তত সাতজন রেফার্ড করা রোগী মাঝপথে আমার গাড়িতেই মারা গেছেন।”
শৈসাই মং মারমা তিন বছর আগে বিনা চিকিৎসায় তার মাকে মারা যেতে দেখেছেন। তিনি জানান, তার মা শৈমেপ্রু মারমা (৩৪) অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। ২০২২ সালের ১৪ নভেম্বর হঠাৎ তিনি অচেতন হয়ে পড়েন। রেমাক্রী বাজার থেকে নদীপথে থানচি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান মাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাকে জেলা সদর হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। ভাড়া গাড়িতে জেলা হাসপাতালে যাওয়ার সময় চিম্বুক বারো মাইল এলাকায় তার মা মারা যান।
লেংরু ম্রো নামে চার সন্তানের মা হারিয়েছেন স্বামীকে। তিনি জানান, তার স্বামী রেং য়ুং ম্রো (৪৫) কিডনি জটিলতা নিয়ে থানচি হাসপাতালে যান। সঙ্গে সঙ্গে সেখান থেকে তাকে বান্দরবান সদর হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। থানচি থেকে বান্দরবান যাওয়ার মাঝপথে মারা যান তার স্বামী।
স্থানীয় বাসিন্দা মংমে মারমা বলেন, “হাসপাতালে চিকিৎসক, ওষুধ ও যন্ত্রপাতির সংকট দীর্ঘদিন ধরেই চলছে। বিশেষজ্ঞ ডাক্তার বদলি হলেও অনেকেই থানচিতে যোগ দেন না, ডিপুটেশনে থেকে যান সদর হাসপাতালে। ফলে এ অঞ্চলের পাহাড়ি ও বাঙালি প্রায় ৩০ হাজার মানুষ স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।”
রিয়েং ম্রো নামে অপর বাসিন্দা বলেন, “পাহাড়ে বসবাসকারীদের অধিকাংশ গরিব। জেলা সদর হাসপাতালে রোগী নিয়ে যাওয়া ব্যয়বহুল ও কষ্টকর। রেমাক্রি, বড় মোদক, তিন্দু থেকে থানচি সদরে রোগী আনতেই অনেক টাকা খরচ হয়ে যায়। এরপর আবার বান্দরবান সদর হাসপাতালে রেফার্ড করলে সাধারণ মানুষ কীভাবে চিকিৎসা করাবে?”
থানচি উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা (ইউএইচএফপিও) ডা. মো. ওয়াহিদুজ্জামান মুরাদ বলেন, “বর্তমানে হাসপাতালে আমিসহ দুইজন চিকিৎসক রয়েছেন। একজন ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসাধীন। তিন রোগীদের সেবা দিতে পারছেন না। ফলে পুরো হাসপাতাল পরিচালনার দায়িত্ব আমাকে একাই সামলাতে হচ্ছে।”
তিনি আরো বলেন, “জনবল ও সরঞ্জাম সংকটের কারণে গুরুতর রোগীদের রেফার্ড করা ছাড়া উপায় থাকে না। দীর্ঘ পথের কারণে অনেকেই জীবিত অবস্থায় সদর হাসপাতালে পৌঁছাতে পারেন না।”
বান্দরবান জেলা সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ শাহীন হোসাইন চৌধুরী বলেন, “শুধু বান্দরবান নয়, পুরো তিন পার্বত্য জেলাতেই চিকিৎসক সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। নতুন করে ৪৮তম বিসিএসের ডাক্তার পদায়ন না হওয়া পর্যন্ত এই সংকট পুরোপুরি সমাধান করা সম্ভব হচ্ছে না। তারপরও বিভাগীয় প্রধানকে বিষয়টি চিঠির মাধ্যমে জানানো হয়েছে। ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের আট-দশজন চিকিৎসককে বান্দরবানে বদলি করার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।”
ঢাকা/মাসুদ