রাত নামলেই সড়কবাতির মনোমুগ্ধকর আলোয় ঝলমল করে রাজশাহী শহরের বিভিন্ন সড়ক। রাতের নিস্তব্ধতায় এতে মুগ্ধ হন পথচারী, ভ্রমণপিপাসু ও সৌন্দর্যপ্রেমীরা। ‘আলোর শহর রাজশাহী’ বলে প্রশংসা করেন নগর ব্যবস্থাপনাকে। তবে এই আলো নিয়ে চিন্তিত পরিবেশবাদীরা। তাদের দাবি, অপরিকল্পিত আলোকায়নে রাজশাহীতে হচ্ছে ‘আলো দূষণ’।

তাদের ভাষ্য, অতিরিক্ত ও ঊর্ধ্বমুখী কৃত্রিম আলোর কারণে রাজশাহীর রাতের পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিশেষ করে নিশাচর প্রাণি ও পরিযায়ী পাখিরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। রাতের প্রাকৃতিক পরিবেশে চলাফেরা করা এসব প্রাণি কৃত্রিম আলোর সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারছে না। এতে দিকভ্রান্ত হয়ে তারা পথ হারিয়ে ফেলছে। প্রাণিচক্রের ভারসাম্যে তৈরি হচ্ছে বড় ধরনের সমস্যা। আলো দূষণের ফলে নিশাচর প্রাণি কমে যাওয়ার আশঙ্কাও করছেন তারা।

প্রকৃতি ও প্রাণি বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রাতে পরিযায়ী পাখিরা প্রাকৃতিক তারা বা চাঁদের আলোয় পথ অনুসরণ করে চলাফেরা করে। রাজশাহী শহরের অতিরিক্ত আলোর সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষা করতে পারছে না নিশাচর প্রাণি ও পরীযায়ী পাখিরা। বিশেষ করে ঊর্ধ্বমুখী লাইটের আলো তাদের গতিপথ বদলে দিচ্ছে। ফলে শহর তো বটেই, শহর লাগোয়া পদ্মার পাড় এমনকি নদীর চরেও কমে যাচ্ছে নিশাচর প্রাণি ও পরিযায়ী পাখিদের আনাগোনা। তাদের মধ্যে আছে বিভিন্ন প্রজাতির পেঁচা, বাদুড়, পানকৌড়ি, শালিক, সান বার্ড, চখাচখিসহ নানা জাতের পাখি। ঊর্ধ্বমুখী আলোয় দিশেহারা হয়ে যাচ্ছে তারা।

রাজশাহী সিটি করপোরেশনের (রাসিক) প্রকৌশল শাখায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০২০ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে শহরের প্রায় প্রতিটি সড়কেই দৃষ্টিনন্দন সড়কবাতি লাগানো হয়েছে। এর মধ্যে শহরের কাশিয়াডাঙ্গা মোড় থেকে বিলশিমলা রেলক্রসিং পর্যন্ত চার দশমিক দুই কিলোমিটার সড়কটিতে ১৭৪টি দৃষ্টিনন্দন পোলে বাসানো হয়েছে ৩৪৮টি আধুনিক এলইডি বাল্ব। 

উপশহর মোড় থেকে দড়িখরবোনা, কাদিরগঞ্জ, মহিলা কলেজ, মালোপাড়া পুলিশ ফাঁড়ি হয়ে সোনাদিঘী মোড় এবং মালোপাড়া মোড় থেকে রানীবাজার মোড় পর্যন্ত সড়কে মোট ৯৬টি ডেকোরেটিভ পোলে ৯৬টি দৃষ্টিনন্দন এলইডি সড়কবাতি লাগানো হয়েছে। আলিফ লাম মীম ভাটার মোড় থেকে নাদের হাজির মোড় পর্যন্ত ২ দশমিক ৫ কিলোমিটার সড়কের আইল্যান্ডে ৮৭টি পোলে বসেছে ১৭৪টি অত্যাধুনিক এলইডি বাল্ব। বন্ধ গেট থেকে সিটিহাট পর্যন্ত সড়কে বসেছে ২১৮টি এলইডি বাল্ব।

সবচেয়ে ক্ষতি করছে শহরের কল্পনা সিনেমা হলের মোড় (স্বচ্ছ টাওয়ার) থেকে তালাইমারি এবং তালাইমারি থেকে ভদ্রা হয়ে রেলগেট ও সাহেববাজার থেকে কোর্ট এলাকা পর্যন্ত সড়কে থাকা অসংখ্য নান্দনিক সড়কবাতি ‘রাজমুকুট’। প্রতিটি পোলের মাথায় লাগানো হয়েছে ১৩টি আধুনিক লাইট। ঝাড়বাতির মতো দেখতে ঊর্ধ্বমুখী লাইটগুলো ‘রাজমুকুট’ নামে পরিচিতি পেয়েছে। আগে প্রতিটি পোলের প্রতিটি লাইটই সারারাত জ্বলত। আওয়ামী সরকারের পতনের পর বিদ্যুতের বিল কমাতে একটি পোল পর পর লাইট জ্বালানো হচ্ছে।

তারপরও অতি উচ্চ রোশনাই সমৃদ্ধ এসব আলোর কারণে পাখি ও নিশাচর প্রাণিদের সংখ্যা কমেছে বলে জানান পাখিপ্রেমী হাসনাত রনি। তিনি বলেন, ‘‘আমি দীর্ঘ সময় ধরে পাখি নিয়ে কাজ করছি। গত কয়েকবছর ধরে ঊর্ধ্বমুখী আলোর কারণে পাখির সংখ্যা অনেক কমে যাচ্ছে। বক, নিশিবক, পানকৌড়ি, পেঁচা এরা রাতে ওড়াউড়ি করে। এদের চলাচলের জন্য নির্দিষ্ট গতিপথ আছে। কিন্তু আলোর কারণে তারা দিকভ্রান্ত হয়ে যাচ্ছে। এর ফলে তাদের স্বাভাবিক জীবনধারা বদলে যাচ্ছে।’’

রনি বলেন, ‘‘কয়েক বছর আগেও পদ্মা নদী ও তার আশেপাশের চরে প্রচুর পাখি পাওয়া যেত। চরগুলো এখন ফাঁকা। সরালি, বালিহাঁস, পাতিসরালি, ঘুঘু- এরা নদীর চরে ছিলো ঝাঁকে ঝাঁকে। গত দুই বছর ধরে আমার চোখে পড়েনি। এমনকি, পদ্মার নদীর চরে হাঁস ছিলো ঝাঁকে ঝাঁকে। এখন হাঁসগুলোও দেখা যায় না।’’

তিনি আরও বলেন, ‘‘বার হেডেড গুজ একমাত্র পাখি যে এভারেস্টের ওপর উঠতে পারে। এরা পরিযায়ী পাখি। এই পাখি একটা সময় পদ্মার চরে পাওয়া যেত। এখন নেই। কাজলা, মাজারদিয়া চরে পানকৌড়ি, রেড শ্যাংক, গ্রিন শ্যাংক, লাল পাপিউ দেখতে পাওয়া যেত। সেগুলোও নেই।’’

একই ধরনের কথা বলেন ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফার আসাদুজ্জামান জুয়েল। তিনি বলেন, ‘‘বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত ১১ প্রজাতির পেঁচা আছে এবং এগুলোর বেশিরভাগই রাজশাহী শহরেই পাওয়া গেছে। ধারাবাহিকভাবে প্রতিবছর পেঁচা নিয়ে কাজ করতাম। কিন্তু বিগত কয়েক বছর ধরে এই পেঁচাগুলো দেখতে পাচ্ছি না।’’

তিনি আরও বলেন, ‘‘পেঁচা রাতে খাবার সংগ্রহ করতে বের হয়। প্রাকৃতিক আলোয় তারা চলাচল করে। কিন্তু শহরের এই কৃত্তিম আলোর সঙ্গে তারা খাপ খাওয়াতে পারছে না। ফলে তাদের প্রজননের হারও কমে যাচ্ছে। তাই স্বাভাবিকভাবেই অন্য জায়গায় চলে যাচ্ছে।’’

শালিকের মতো সাধারণ পাখিও কমে যাচ্ছে জানিয়ে জুয়েল বলেন, ‘‘আমাদের দেশে সাধারণত ১১৪ প্রজাতির পাখি আছে। বেশিরভাগই রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে দেখা যেত। কিন্তু এখন অনেক কমে গেছে। এমনকি কাক ছিলো রাজশাহীর অন্যতম পরিচিত পাখি। এখন কাকের সংখ্যাও অনেক কমে এসেছে। খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না টিয়া, চখাচখি, সান বার্ড। শালিকের মতো পাখিও কমে গেছে।’’

বিশ্ব পরিব্রাজক তারেক অনু বলেন, ‘‘হিমালয় থেকে অনেক পাখি পদ্মার পাড় ধরে শহরের বিভিন্ন জায়গায় চলাচল করে। তবে এই কৃত্রিম আলো তাদের যাতায়াতে সমস্যা তৈরি করছে। কারণ, শহরে এমন আলো দেওয়া হয়েছে যেগুলোর আলো উপরের দিকে যাচ্ছে। ফলে নিশাচর ও পরিযায়ী পাখি স্বাভাবিকভাবে চলাচল করতে পারছে না। তাই দিন দিন পাখিদের সংখ্যা কমেছে। তবে কী পরিমাণ ক্ষতি হচ্ছে পাখিদের, এটা গবেষণা করে বের করার মতো অবস্থায় আমরা এখনও পৌঁছাইনি। এটা নিয়ে গবেষণাও দরকার।’’

তার মতে, লাইটের নিম্নমুখী হলে পাখিদের সমস্যা হবে না। শহরে এখন যে ঊর্ধ্বমুখী আলো আছে এর উপরে যদি শেড দেওয়া যায়, তাহলে অসুবিধা হবে না।

আলো দূষণ কমানোর তাগিদ দিয়ে তারেক অনু বলেন, ‘‘সারা পৃথিবীতে এখন আলো দূষণ কীভাবে কমানো যায় সেই চেষ্টা চলছে। নিউইয়র্ক এবং লন্ডনে বিভিন্ন জায়গায় গবেষণা হয়েছে পাখিদের নিয়ে। সেখানেও দেখা গেছে আলোর কারণে পাখিদের চলাচলে সমস্যা হচ্ছে। সারা পৃথিবীতে ৫২টি ন্যাশনাল পার্ক করা হচ্ছে যেগুলোতে আলো নেই। আমাদেরও আলো দূষণ কমানো উচিত।’’

এ বিষয়ে রাজশাহী সিটি করপোরেশনের (রাসিক) প্রধান প্রকৌশলী আহমেদ আল মইন পরাগ বলেন, ‘‘নিশাচর প্রাণি কমছে এটা ঠিক। আমরা জেনেছি এবং শুনেছি। শব্দ দূষণের মতো আলো দূষণ বলেও একটি শব্দ আছে। আলো দূষণের কারণে নিশাচর প্রাণি কমছে বলে অনেকেই মনে করছেন।’’
 
সমাধানের উপায় কী, জানতে চাইলে এই কর্মকর্তা বলেন, ‘‘আলোর ওপর শেড দিলে নিশাচর প্রাণির ক্ষতি হবে না। এমন কথার পক্ষে-বিপক্ষে দুটোই আলোচনা আছে। আমাদের কাছে এখন পর্যন্ত পরিবেশবাদীরা অভিযোগ করেনি। যদি করে তবে আমরা পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে ভাবব।’’

ঢাকা/এস

.

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ন শ চর প র ণ ও পর য য় পর ব শ পদ ম র সমস য শহর র

এছাড়াও পড়ুন:

সার্চ দুনিয়ার নতুন দিগন্ত জিইও: দেশের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো কী প্

ইন্টারনেট সার্চ দুনিয়ায় চলছে নীরব এক বিপ্লব। তথ্য খোঁজার ধরন বদলে যাচ্ছে আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে দ্রুত। আগে যেখানে গুগলে উচ্চ র‌্যাংকিং মানেই ছিল সাফল্য, এখন সেই জায়গা নিচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই)-নির্ভর সার্চ টুল।

সার্চ জগতের নতুন চ্যালেঞ্জ

চ্যাটজিপিটি, গুগল জেমিনি, মাইক্রোসফট কপিলট কিংবা পারপ্লেক্সিটি এআই-এগুলো আর শুধু সার্চ ইঞ্জিন নয়, বরং উত্তর তৈরিকারক ইঞ্জিন। ব্যবহারকারী এখন শুধু ‘লিংক’ নয়, বরং সরাসরি উত্তর পেতে চায়। আর এই পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার জন্যই এসেছে নতুন এক কৌশল- জিইও বা জেনারেটিভ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন।

জিইও কী?

জিইও (জেনারেটিভ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন) হলো এমন একটি প্রক্রিয়া, যেখানে আপনার ওয়েবসাইট ও কনটেন্ট এমনভাবে সাজানো হয় যাতে এআই-চালিত সার্চ ইঞ্জিন সহজেই আপনার তথ্য চিনতে, বুঝতে এবং ব্যবহারকারীর প্রশ্নের উত্তরে সেটি অন্তর্ভুক্ত করতে পারে।

আগে ব্র্যান্ডগুলোর ফোকাস ছিল গুগলের প্রথম পাতায় জায়গা করে নেওয়া। কিন্তু এখন গুরুত্ব পাচ্ছে- চ্যাটজিপিটি বা জেমিনি-এর উত্তরে আপনার ব্র্যান্ডের নাম আসছে কি না!

এসইও বনাম জিইও: সার্চ দুনিয়ার নতুন যুগের পালাবদল

অনেকেই এসইও (সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন) এবং জিইও (জেনারেটিভ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন) এক মনে করেন, কিন্তু এদের মধ্যে মূলত লক্ষ্য ও কৌশল ভিন্ন। এসইও হচ্ছে পুরোনো পদ্ধতি, অন্যদিকে জিইও হচ্ছে নতুন পদ্ধতি।

* মূল লক্ষ্য
এসইও: সার্চ ইঞ্জিনে র‌্যাংক বাড়ানো
জিইও: এআই সার্চের উত্তরে দৃশ্যমান হওয়া

* কাজের ধরন
এসইও: কিওয়ার্ড ও ব্যাকলিংক ভিত্তিক
জিইও: কনটেক্সট, প্রাসঙ্গিকতা ও ব্র্যান্ড অথরিটি নির্ভর

* ফলাফল
এসইও: ক্লিক ও ট্রাফিক বৃদ্ধি
জিইও: ব্র্যান্ড উল্লেখ ও আস্থা বৃদ্ধি

* প্ল্যাটফর্ম
এসইও: গুগল, বিং ইত্যাদি সার্চ ইঞ্জিন
জিইও: চ্যাটজিপিটি, জেমিনি, পারপ্লেক্সিটি, এসজিই ইত্যাদি এআই সার্চ

এসইও এখনও গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু ভবিষ্যতের সার্চ ইকোসিস্টেমে জিইও সমান অপরিহার্য হয়ে উঠছে।

বাংলাদেশি ব্যবসার জন্য জিইও-এর গুরুত্ব

বাংলাদেশে ডিজিটাল মার্কেটের ক্রমবর্ধমান প্রবৃদ্ধি স্পষ্টভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। শিক্ষা, ট্রাভেল, স্বাস্থ্যসেবা, ই-কমার্স, রিয়েল এস্টেট- প্রায় প্রতিটি খাতেই ব্যবসা অনলাইনে আরো দৃশ্যমান হতে চাচ্ছে। কিন্তু বদলেছে মানুষের সার্চ করার ধরন। এখন তারা শুধু গুগলে সার্চ করেই সন্তুষ্ট থাকছে না, তারা এআই-চালিত সার্চ টুলগুলো যেমন চ্যাটজিপিটি, জেমিনি বা পারপ্লেক্সিটি-এর মাধ্যমে সরাসরি উত্তর খুঁজছে। 

গার্টনারের এক গবেষণা অনুযায়ী, ২০২৬ সালের মধ্যে প্রচলিত সার্চ ইঞ্জিনে সার্চ ভলিউম প্রায় ২৫ শতাংশ কমে যাবে- কারণ ব্যবহারকারীরা দ্রুতই এআই-চালিত সার্চ ও চ্যাটবটের দিকে ঝুঁকছে। (তথ্যসূত্র: Gartner, “Search Engine Volume Will Drop 25% by 2026, Due to AI Chatbots and Other Virtual Agents)

তবে এই পরিবর্তনের প্রভাব ব্যবসার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ধরুন, কেউ চ্যাটজিপিটি-তে লিখল, ‘ঢাকায় সেরা অ্যাকাউন্টিং ফার্ম কোনটি?’ যদি আপনার কোম্পানির নাম বা কনটেন্ট এআই-এর তৈরি উত্তরে না আসে, তাহলে সম্ভাব্য ক্লায়েন্ট ও ব্যবসার সুযোগ হাতছাড়া হচ্ছে।

মূলত এখানেই জিইও-এর গুরুত্ব উঠে আসে। জিইও ব্যবহার করে কনটেন্ট এমনভাবে সাজানো যায় যাতে এআই সার্চ সিস্টেম আপনার ব্র্যান্ডকে সহজেই চিনতে পারে, বুঝতে পারে এবং ব্যবহারকারীর প্রশ্নের উত্তরে উল্লেখ করে। অর্থাৎ, বাংলাদেশের প্রতিটি ব্যবসা যদি এআই-এর দুনিয়ায় দৃশ্যমান থাকতে চায়, জিইও’র সঙ্গে খাপ খাওয়ানো এখন আর বিকল্প নয়- এটি একান্ত প্রয়োজন।

জিইও’র জন্য কীভাবে প্রস্তুতি নেবেন?

জেনারেটিভ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন (জিইও) কোনো একদিনে শেখার মতো বিষয় না- এটি একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া, যেখানে ব্যবসাগুলোকে নিজেদের কনটেন্ট, উপস্থিতি ও বিশ্বাসযোগ্যতা এআই-বান্ধব করে গড়ে তুলতে হয়। নিচে ধাপে ধাপে দেখা যাক, কীভাবে আপনি জিইও’র পথে প্রস্তুত হতে পারবেন।

১. অনলাইন উপস্থিতি যাচাই করুন

জিইও’র প্রথম ধাপ হলো আপনার ব্যবসা বা ব্র্যান্ডের বর্তমান অনলাইন উপস্থিতি যাচাই করা। চ্যাটজিপিটি বা পারপ্লেক্সিটি-এর মতো এআই-চালিত সার্চ টুলে সার্চ দিন ‘বাংলাদেশে সেরা (আপনার ইন্ডাস্ট্রি)-এর কোম্পানিগুলো কোনগুলো?’

যদি সার্চের উত্তরে আপনার নাম না আসে, বোঝা যাবে যে আপনার এআই-দৃশ্যমানতা এখনও সীমিত। এই ক্ষেত্রে আপনাকে জিইও অনুযায়ী কনটেন্ট ও অনলাইন উপস্থিতি বাড়াতে কাজ শুরু করতে হবে।

২. বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি করুন

জেনারেটিভ এআই সার্চ সিস্টেম সেই উৎসকেই অগ্রাধিকার দেয়, যা নির্ভরযোগ্য ও যাচাইযোগ্য। তাই আপনার ওয়েবসাইটে ব্র্যান্ড, টিম, যোগাযোগ ও রিভিউসহ সব তথ্য সম্পূর্ণ ও স্বচ্ছ রাখুন।

গুগল বিজনেস প্রোফাইল নিয়মিত আপডেট করুন-  ঠিকানা, সময়, পোস্ট ও রিভিউসহ।

বিশ্বস্ত সংবাদমাধ্যম ও ব্লগে ব্র্যান্ডের উল্লেখ বাড়ান।

E-E-A-T (Experience, Expertise, Authoritativeness, Trustworthiness) বজায় রাখুন।

এভাবেই এআই ও ব্যবহারকারীর কাছে আপনার ব্র্যান্ড একটি বিশ্বাসযোগ্য সোর্স হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে- যা জিইও সাফল্যের মূল চাবিকাঠি।

৩. কনভারসেশনাল কনটেন্ট লিখুন

এআই সার্চ এখন ব্যবহারকারীর প্রশ্নভিত্তিক অনুসন্ধানকে গুরুত্ব দেয়। তাই আপনার কনটেন্ট তৈরি করুন এমনভাবে যেন এটি প্রাকৃতিক প্রশ্ন ও কথোপকথনের মতো শোনায়। উদাহরণ: ‘Where can I find a trusted IELTS coaching center in Dhaka?’ ‘Where can I apply for a blue-collar job?’ এ ধরনের কনটেন্ট এআই-এর চোখে আরো সহজে বোঝার মতো হয় এবং ব্যবহারকারীর প্রশ্নের উত্তর হিসেবে উল্লেখযোগ্য।

৪. বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে সক্রিয় থাকুন

এআই শুধু ওয়েবসাইট থেকে তথ্য সংগ্রহ করে না। এটি ফেসবুক, ইউটিউব, লিংকডইন, কোরা এবং অন্যান্য সোশ্যাল প্ল্যাটফর্ম থেকেও তথ্য সংগ্রহ করে। তাই বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে আপনার উপস্থিতি নিশ্চিত করা জিইও-এর জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

৫. এসইও এবং জিইও একসাথে ব্যবহার করুন

ডিজিটাল দুনিয়ায় এখন শুধু সার্চ র‌্যাংকই যথেষ্ট নয়। এসইও যেমন গুগল সার্চে আপনার কনটেন্টকে শীর্ষে নিয়ে আসে, তেমনি নতুন যুগের জিইও (জেনারেটিভ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন) আপনার ব্র্যান্ডকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক সার্চে আরো দৃশ্যমান করে তোলে।

এসইও মূলত গুগল ও অন্যান্য সার্চ ইঞ্জিনে ওয়েবসাইটের অবস্থান উন্নত করে, আর জিইও শেখায়- কীভাবে এআই মডেলগুলো আপনার ব্র্যান্ডকে চিনবে, উল্লেখ করবে এবং বিশ্বাস করবে।

দুটি কৌশল একসাথে প্রয়োগ করলে অনলাইন উপস্থিতি অনেক বেশি শক্তিশালী হয়। একদিকে সার্চে দৃশ্যমানতা বাড়ে, অন্যদিকে এআই-নির্ভর প্ল্যাটফর্মগুলোতেও আপনার ব্র্যান্ডের নাম উঠে আসে স্বতঃস্ফূর্তভাবে।

ভবিষ্যতের সার্চ জগতে টিকে থাকতে হলে এখনই সময়- এসইও এবং জিইও-কে একসাথে কাজে লাগানোর।

বাংলাদেশের ব্যবসার জন্য জিইও’র নতুন সম্ভাবনা

জিইও বাংলাদেশের ব্যবসাগুলোর জন্য হতে পারে এক গেম চেঞ্জার। আগে যেখানে অনলাইন দৃশ্যমানতা মানেই ছিল গুগলে র‌্যাংক করা, এখন সেটি ধীরে ধীরে স্থান ছেড়ে দিচ্ছে এআই সার্চ ভিজিবিলিটি–কে।

আজ যদি কোনো ব্যবহারকারী চ্যাটজিপিটি বা জেমিনি-তে জিজ্ঞেস করে- 

‘বাংলাদেশে নির্ভরযোগ্য অনলাইন বই বিক্রির সাইট কোনটা?’

অথবা, ‘ঢাকায় সেরা ডিজিটাল মার্কেটিং এজেন্সি কারা?’

যদি আপনার ব্র্যান্ডের নাম সেই উত্তরে উঠে আসে, সেটিই হবে প্রকৃত দৃশ্যমানতা- শুধু ক্লিক নয়, বরং আস্থা, প্রভাব ও ব্র্যান্ড অথরিটি–এর প্রতিফলন।

বাংলাদেশে এখন প্রতিদিন শত শত নতুন অনলাইন ব্যবসা শুরু হচ্ছে- ই–কমার্স, এডুকেশন, হেলথটেক, রিয়েল এস্টেট, ফাইন্যান্স, এমনকি ছোট স্টার্টআপরাও দ্রুত ডিজিটাল হচ্ছে। কিন্তু একইসঙ্গে প্রতিযোগিতাও বেড়ে যাচ্ছে বহুগুণে।

এই প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে শুধু এসইও নয়, জিইও–কেন্দ্রিক কৌশলও অপরিহার্য।

জিইও’র ভবিষ্যৎ

খুব শিগগিরই এআই সার্চ টেক্সটের বাইরে গিয়ে ভয়েস, ভিডিও ও ইমেজ কনটেন্ট থেকেও উত্তর তৈরি করবে। তখন জিইও কেবল ওয়েবসাইট নয়, বরং ভিডিও, পডকাস্ট, সোশ্যাল প্রোফাইল, নিউজ রিপোর্ট- সবকিছুর মধ্যেই প্রভাব ফেলবে।

তাই এখন থেকেই যারা জিইও-কেন্দ্রিক কৌশল গ্রহণ করবে, ভবিষ্যতের সার্চ রেভোলিউশনে নেতৃত্ব দেবে তারাই।

উপসংহার

জেনারেটিভ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন (জিইও) শুধু নতুন ট্রেন্ড নয়- এটি ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের পরবর্তী অধ্যায়।

এসইও যেমন আপনাকে সার্চ রেজাল্টে নিয়ে যায়, জিইও তেমনি আপনাকে নিয়ে যাবে এআই–এর উত্তরে।

‘ভবিষ্যতের সার্চে র‌্যাংক নয়, ব্র্যান্ডের বিশ্বাসযোগ্যতাই হবে সাফল্যের আসল মাপকাঠি।’

লেখক: হেড অব ওয়েব অ্যানালাইসিস অ্যান্ড এসইও ডিরেক্টর, ইন্টেলেক আইটি এলএলসি (ইউএসএ অ্যান্ড বাংলাদেশ)

ঢাকা/ফিরোজ

সম্পর্কিত নিবন্ধ