আজ বিশ্ব দুগ্ধ দিবস। ২০০১ সাল থেকে বৈশ্বিক খাদ্য হিসেবে দুধ ও দুগ্ধজাত দ্রব্যের গুরুত্ব তুলে ধরার লক্ষ্যে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার উদ্যোগে প্রতিবছর ১ জুন দিবসটি আন্তর্জাতিকভাবে পালিত হয়ে আসছে। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘আসুন দুগ্ধশিল্প এবং দুধের প্রভাব উদ্‌যাপন করি’। প্রতিপাদ্যটির মূল লক্ষ্য হলো দুধের পুষ্টিগুণ, দুগ্ধশিল্পের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবদান এবং পরিবেশবান্ধব ও টেকসই চর্চার ইতিবাচক দিকগুলো তুলে ধরা।

সুষম খাবারগুলোর মধ্যে দুধ অন্যতম। এতে থাকে আমিষ, শর্করা, ফ্যাট, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, জিংক, পটাশিয়াম, ভিটামিন ডির মতো প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান। দুধ হাড় ও দাঁত মজবুত করতে, শিশুর শারীরিক বৃদ্ধি ও মানসিক বিকাশে এবং প্রাপ্তবয়স্কদের পেশিশক্তি ধরে রাখতে সহায়তা করে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রতিদিন দুধ বা দুগ্ধজাত খাবার গ্রহণ হৃদ্‌রোগ, হাড়ক্ষয় এবং কিছু হরমোনজনিত রোগ প্রতিরোধেও কার্যকর। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার খাদ্যতালিকা নির্দেশিকা অনুসারে নিয়মিত দুধ ও দুগ্ধজাত দ্রব্য খাওয়ার সুপারিশ করা হয়। এমনকি দুগ্ধজাত খাবার যেমন পনির ও দই আদর্শগতভাবে ‘হেলদি এজিং প্রোডাক্ট’ হিসেবে বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত।

ফুড অ্যান্ড নিউট্রিশন রিসার্চ–২০১৬ এর পাওয়া তথ্যমতে, খাদ্যতালিকায় দুগ্ধজাত দ্রব্য যোগ করা হলে এর গুণগত মান ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। অর্থাৎ, শিশু থেকে প্রবীণ—সব বয়সীর জন্যই দুধের ভূমিকা অনস্বীকার্য।

দুগ্ধশিল্প ও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দুগ্ধশিল্প একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ খাত। কারণ, দেশের মানুষের পুষ্টিচাহিদা মেটাতে এটি একটি প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদান। তবে দেশের সামগ্রিক কৃষিক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত হলেও দুগ্ধশিল্প এখনো আশানুরূপ বিকাশ লাভ করতে পারেনি।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, প্রাপ্তবয়স্ক একজন মানুষের দৈনিক গড় দুধের চাহিদা ২৫০ মিলিলিটার। এর বিপরীতে পর্যাপ্ততা রয়েছে ১২৫ মিলিলিটার। বাংলাদেশের দুই–তৃতীয়াংশ মানুষ এই চাহিদা মেটাতে পারেন না। এর প্রধান কারণ হলো, দেশে পর্যাপ্ত দুধ উৎপাদনের অভাব। দেশের দুগ্ধশিল্পে ব্যাপক উন্নয়নের সুযোগ থাকলেও হাতে গোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ছাড়া তেমন কোনো বৃহৎ উদ্যোগ নজরে পড়ে না।

দেশে এখনো গবাদিপশু পালনকে তেমন একটা গুরুত্ব দেওয়া হয় না। পরিবারের দুধের চাহিদা মেটাতে কেউ কেউ কেবল গাভি পালন করে থাকেন। তবে গবাদিপশু পালনকে প্রান্তিক পর্যায়ে কৃষকের মূল আয়ের উৎস হিসেবে এখনো সেভাবে ভাবা হয় না। ফলে বিদেশ থেকে আমদানিকৃত গুঁড়া দুধ দিয়ে দেশে দুধের চাহিদা মেটাতে হয়।

অবশ্য কয়েক বছর ধরে দুগ্ধ উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকরণে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে চলেছে দেশের বেশ কয়েকটি ডেইরি প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অন্যতম প্রাণ ডেইরি লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটি বর্তমানে দেশের দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে শীর্ষে রয়েছে।

এ প্রসঙ্গে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের পরিচালক (বিপণন) কামরুজ্জামান কামাল বলেন, ‘সারা দেশে আমাদের ১৬ হাজার নিবন্ধিত খামারি রয়েছেন, যাঁদের কাছ থেকে সরাসরি দুধ সংগ্রহ করা হয়। সেই সঙ্গে আমাদের সাতটি হাব ও ১০০টির বেশি মিল্ক কালেকশন সেন্টারে প্রতিদিন গড়ে দুই লাখ লিটার পর্যন্ত দুধ সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াজাত করা হয়।’

কামরুজ্জামান কামাল আরও বলেন, ‘আমরা শুধু দুধ সংগ্রহই করি না, বরং প্রশিক্ষণ, পশুখাদ্য ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার মাধ্যমে টেকসই খামার ব্যবস্থাপনায় খামারিদের সহায়তা করি। দেশে দুধ উৎপাদনের যে ঘাটতি রয়েছে, তা পূরণে পরিকল্পিতভাবে খামারিদের পাশে দাঁড়াতে পারলে ভবিষ্যতে আমদানিনির্ভরতা কমানো সম্ভব।’

সরকারি উদ্যোগ ও নীতিমালা

দুগ্ধ খাতের উন্নয়নে সরকারের পক্ষ থেকেও বিভিন্ন সময় নানা উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গ্রামীণ পর্যায়ে গবাদিপশু পালনে উৎসাহ দিতে বিভিন্ন সময়ে ভর্তুকি, প্রশিক্ষণ ও টিকা সরবরাহের ব্যবস্থা করা হয়। পাশাপাশি দেশের চাহিদা ও উৎপাদনের মধ্যে ভারসাম্য আনতে গঠিত হয়েছে ‘প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্প’। তবে এই নীতিমালা বাস্তবায়নে এখনো অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ রয়েছে। মাঠপর্যায়ে প্রযুক্তি, প্রশিক্ষণ এবং বাজার—এ তিনের সংযোগে আরও কার্যকর পদক্ষেপ প্রয়োজন বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের পরিচালক (উৎপাদন) এ বি এম খালেদুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘শুধু গবাদিপশু পালন করাই নয়, এটিকে লাভজনক উদ্যোগে পরিণত করতে হলে খামারিরা যখন যে দুগ্ধ উৎপাদন করবেন, সেটিকে সার্টিফাইড করে বাজারে আনতে হবে। এতে তাঁরা পণ্যের সঠিক মূল্য পাবেন। ফলে তাঁরা গবাদিপশু পালনে আগ্রহী হবেন।’

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘আমাদের দেশের খামারিরা এখনো সঠিকভাবে জানেন না গবাদিপশুকে কী খাওয়াতে হবে, কীভাবে পালন করতে হবে। এতে তাঁরা গবাদিপশু পালন করলেও লাভ করতে পারেন না। এ খাতে উন্নয়ন চাইলে সরকারের উদ্যোগে তাঁদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।’

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর এ বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে এবং শিগগিরই উদ্যোগটি বাস্তবায়ন হবে বলে জানান খালেদুজ্জামান। খামারিদের পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ‘যদি কেউ উদ্যোক্তা হিসেবে গবাদিপশু পালন করতে চান, তবে তাঁদের উচিত সঠিক প্রশিক্ষণ নিয়েই কাজ শুরু করা।’

প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের পরিচালক (বিপণন) কামরুজ্জামান কামাল জানান, বাংলাদেশে ভেটেরিনারি মেডিসিন ও গোখাদ্যের দাম তুলনামূলক অনেক বেশি। সরকার ভেটেরিনারি মেডিসিন ও গোখাদ্যে ভর্তুকি দিলে এই শিল্প উপকৃত হবে এবং সামনের দিকে এগিয়ে যাবে।

কামরুজ্জামান কামাল বলেন, ‘বর্তমানে দেশে গড়ে প্রতিটি গাভি থেকে দৈনিক ৬ লিটার দুধ উৎপাদিত হচ্ছে, যেখানে আগে এই পরিমাণ ছিল মাত্র ২ লিটার। যদিও এটি একটি অগ্রগতি, তবে তুলনামূলকভাবে আমরা এখনো অনেক পিছিয়ে। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে একটি গাভি প্রতিদিন গড়ে ৬০ লিটার পর্যন্ত দুধ দেয়। এই বিশাল ব্যবধান কমিয়ে আনতে এবং দুধ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে সরকারের পক্ষ থেকে আরও কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে। পৃথিবীর যেসব দেশে উন্নত জাতের গাভি আছে, সেসব দেশ থেকে প্রজাতি সংগ্রহ করে আমাদের দেশের পরিবেশের সঙ্গে কীভাবে খাপ খাওয়ানো যায়, সেটি নিয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ এখন সময়ের দাবি।’

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতে, বাংলাদেশের পুষ্টিনীতির সফল বাস্তবায়ন, দুধের ঘাটতি মোকাবিলা এবং গ্রামীণ অর্থনীতিতে টেকসই উন্নয়নের জন্য দুগ্ধখাতে সমন্বিত প্রচেষ্টা জরুরি। উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং বাজার সম্প্রসারণে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বই দীর্ঘ মেয়াদে এই খাতের অগ্রগতি ঘটাতে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে।

আরও পড়ুনবিশ্ব দুগ্ধ দিবস: বার্ধক্যে সুস্বাস্থ্য ও দুগ্ধজাত দ্রব্যের গুরুত্ব০১ জুন ২০২৩আরও পড়ুনউৎপাদন বাড়লেও দেশে দুধের ঘাটতি ০১ জুন ২০২৩.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: প রক র য় জ ত দ ধ উৎপ দ আম দ র স গ রহ গ রহণ সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

এআই প্রযুক্তির মাধ্যমে ব্যবহারকারীদের বয়স শনাক্ত করবে গুগল

ব্যবহারকারীদের বয়স শনাক্তে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তানির্ভর (এআই) প্রযুক্তি চালু করতে যাচ্ছে গুগল। নতুন এ ব্যবস্থায় ব্যবহারকারীদের সার্চ ইতিহাস ও ইউটিউবে ভিডিও দেখার ধরন বিশ্লেষণ করে বয়স শনাক্ত করবে প্রতিষ্ঠানটি। প্রাথমিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারীদের বয়স শনাক্ত করা হবে বলে জানিয়েছে গুগল।

গুগল জানিয়েছে, প্রাথমিকভাবে এ প্রযুক্তি অল্পসংখ্যক ব্যবহারকারীর ওপর প্রয়োগ করা হবে। তবে পর্যায়ক্রমে এর পরিসর বাড়ানো হবে। বয়স ১৮ বছরের কম বলে শনাক্ত হলে সংশ্লিষ্ট ব্যবহারকারীর অ্যাকাউন্টে স্বয়ংক্রিয়ভাবে অপ্রাপ্তবয়স্কদের জন্য নির্ধারিত নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা কার্যকর হবে। ফলে ইউটিউবে ঘুমের সময় মনে করিয়ে দেওয়ার সুবিধা স্বয়ংক্রিয়ভাবে চালু হয়ে যাবে। এ ছাড়া আধেয় বা কনটেন্ট সুপারিশ সীমিত করার পাশাপাশি ব্যবহারকারীদের অনলাইন কার্যকলাপের ভিত্তিতে বিজ্ঞাপন দেখানো হবে না।

গুগলের তথ্যমতে, ব্যবহারকারীদের বয়স ১৮ বছরের কম বলে শনাক্ত হলে তারা গুগল প্লে স্টোরে থাকা প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য নির্ধারিত কোনো অ্যাপে প্রবেশ করতে পারবে না। তবে কেউ যদি ভুলক্রমে অপ্রাপ্তবয়স্ক হিসেবে শনাক্ত হন, তিনি সরকার অনুমোদিত পরিচয়পত্রের ছবি বা সেলফি জমা দিয়ে বয়স যাচাইয়ের আবেদন করতে পারবেন।

বিশ্বজুড়ে শিশুদের ডিজিটাল নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর চাপ বাড়ছে। যুক্তরাষ্ট্রে এ নিয়ে নতুন করে আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে যুক্তরাজ্যে ব্লুস্কাই, রেডিট, ডিসকর্ড ও স্পটিফাইয়ের মতো জনপ্রিয় অনলাইন প্ল্যাটফর্মে ব্যবহারকারীদের বয়স যাচাই বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় এআই প্রযুক্তির মাধ্যমে ব্যবহারকারীদের বয়স শনাক্তের উদ্যোগ নিয়েছে গুগল।

সূত্র: দ্য ভার্জ

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • গুলশানে চাঁদাবাজির ঘটনায় গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের বহিষ্কৃত নেতা গ্রেপ্তার
  • এআই প্রযুক্তির মাধ্যমে ব্যবহারকারীদের বয়স শনাক্ত করবে গুগল