আহসান উল্লাহ ও আলতাফ হোসেনের বয়স ৩০ বছর। গ্রামে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কৃষিকাজ করতেন। সংসারের অভাব দূর করতে তাঁরা দুজন দালালের মাধ্যমে ইতালি যাত্রা করেন। কিন্তু দালাল চক্রের খপ্পরে পড়ে নিঃস্ব হয়ে তাঁদের দেশে ফিরতে হয়েছে। 

দুই দফা মুক্তিপণ দিয়ে তাঁদের দুজনকে ফিরিয়ে আনতে পরিবারের ব্যয় করতে হয়েছে ১ কোটি ৩০ লাখ টাকা। আহসান উল্লাহ ও আলতাফ হোসেনের বাড়ি শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ উপজেলার মনুয়া গ্রামে। 

ওই দুই তরুণের স্বজন ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, মনুয়া গ্রামের কৃষক গনি বলির ছেলে আহসান উল্লাহ ও দুলাল ছৈয়ালের ছেলে আলতাফ হোসেনের মাঝপথে পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যায়। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে তাঁরা কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ শুরু করেন। গত বছর পাশের বাংলাবাজার এলাকার হারুন লস্করের মাধ্যমে ইতালি যাওয়ার জন্য ১৬ লাখ টাকা করে চুক্তি করেন।

আহসান ও আলতাফ জানান, গত বছরের ১৬ সেপ্টেম্বর তাঁরা ইতালি যাওয়ার উদ্দেশে বাড়ি ছাড়েন। প্রথমে তাঁদের নেওয়া হয় শ্রীলঙ্কা। সেখানে ২৪ দিন রাখার পর সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মিসর হয়ে নেওয়া হয় লিবিয়ার ত্রিপোলিতে। ত্রিপোলি এলাকা থেকে সমুদ্রপথে ইতালি পাঠানোর জন্য গত বছরের ১৬ নভেম্বর একটি ইঞ্জিনচালিত নৌযানে ওঠানো হয়। নৌযানটি ২০ মিনিট চলার পর পুলিশ তাঁদের আটক করে। পুলিশের কাছ থেকে চুক্তি করা দালাল তাঁদের ছাড়িয়ে আনেন। এরপর তাঁদের লিবিয়ার জাওয়াইয়া এলাকার একটি স্থানে আটকে রাখা হয়। নির্যাতন করে তাঁদের কাছ থেকে টাকা আদায় করা হয়। ওই দুই তরুণ আবার ওই দালালদের মাধ্যমে ইতালি যাওয়ার জন্য চুক্তিবদ্ধ হন। সে অনুযায়ী, গত ১ জানুয়ারি আবার জোয়ারা নামক সমুদ্র তীরবর্তী একটি স্থান থেকে নৌযানে ওঠানো হয়। এবারও ২০ মিনিট নৌযানটি চলার পরে পুলিশ সমুদ্র থেকে তাঁদের আটক করে। দালালেরা তাঁদের আবার জাওয়াইয়া এলাকার আরেকটি স্থানে আটকে রাখেন। আটকের পর তাঁদের  নির্যাতন করা হয়। ভিডিও কলে ওই নির্যাতনের দৃশ্য পরিবারের সদস্যদের দেখিয়ে মুক্তিপণ আদায় করা হয়। মুক্তিপণ দেওয়ার পর দালালেরা তাঁদের ছেড়ে দেন। পরে ওই দুই তরুণ ৭ মে দেশে ফিরে আসেন। 

পাঁচ ভাই, দুই বোন ও বাবা-মাকে নিয়ে ৯ সদস্যের বড় পবিরার আহসান উল্লাহর। পরিবারটিতে অর্থনৈতিক সচ্ছলতা ছিল না। পরিবারের সচ্ছলতা ফেরাতে জমি বন্ধক রেখে ও ঋণ করে তাঁকে ইতালি পাঠানোর উদ্যোগ নেয় পরিবার। 

আহসান উল্লাহ বলেন, ‘সচ্ছলতা ফিরবে, এমন স্বপ্ন নিয়ে ইতালি যাওয়ার জন্য ঘর ছেড়েছিলাম। প্রথমে দালালের হাতে ১৬ লাখ টাকা তুলে দিই। এরপর লিবিয়া পৌঁছানোর পর দালালের খপ্পরে পড়ে দুই দফায় পাতানো গেমের খপ্পরে পড়ি। দুই দফায় জিম্মি হই। গেম ও বন্দিদশা থেকে মুক্ত করার জন্য ওই চক্রকে চার দফায় আরও ৪৯ লাখ টাকা দেয় পরিবার। ওই টাকা জোগান দিতে ফসলি জমি বিক্রি করতে হয়েছে। আমাকে বাঁচাতে পরিবার এখন নিঃস্ব হয়ে গেল।’ 

আলতাফ হোসেনের চার ভাই ও বাবা-মাকে নিয়ে সংসার। বাবা কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। পরিবারের অভাব দূর করতে তাঁকেও ইতালি পাঠানোর জন্য দালালের সঙ্গে লিবিয়া পাঠানো হয়। পাঁচ দফায় ৬৫ লাখ টাকা ব্যয় করে নিঃস্ব আলতাফের পরিবার। 

আলতাফ বলেন, ‘দালালের ট্র্যাপে পড়েছি, তা বুঝতে পারিনি। সমুদ্রপথে ইঞ্জিনচালিত বোটে করে ইতালি নেওয়ার পাতানো গেমের কথা বলে দুবার আমাদের যাত্রা শুরু করা হয়। কিছু দূর যাওয়ার পর পুলিশ ধরে, আবার দালালের লোকজন ছাড়িয়ে এনে ঘরে আটকে রেখে নির্যাতন চালায়। সেই অমানুষিক নির্যাতনের কথা মনে হলে এখনো আঁতকে উঠি।  পরিবারকে নিঃস্ব করে দিয়ে জীবন নিয়ে দেশে ফিরেছি।’ 

ভেদরগঞ্জের বাংলাবাজার এলাকার হারুন লস্করের মাধ্যমে ওই দুই তরুণ লিরিয়া যান। ভেদরগঞ্জ থানায় তাঁর বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ করেছে আহসান উল্লাহর পরিবার। জানতে চাইলে হারুন লস্কর বলেন, ‘তাদের কোন দালাল চক্র হয়রানি করেছে বা জিম্মি করেছে, তা আমি জানি না। আমরা এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত নই।’ 

শরীয়তপুরের পুলিশ সুপার নজরুল ইসলাম বলেন, ‘শরীয়তপুরের বিভিন্ন এলাকার মানুষ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে থাকেন। এ এলাকার তরুণদের মধ্যে ইউরোপে যাওয়ার প্রবণতা রয়েছে। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে বেশ কিছু চক্র অবৈধভাবে মানব পাচারের সঙ্গে যুক্ত। আমরা কিছু মামলা নিয়ে কাজ করছি। কয়েকজনকে আইনের আওতায় আনা হয়েছে। ভেদরগঞ্জের ওই ঘটনাটিও তদন্ত করা হবে।’ 

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: আলত ফ হ স ন র ভ দরগঞ জ পর ব র র র জন য ক জ কর এল ক র সদস য

এছাড়াও পড়ুন:

শরীয়তপুরে নিঃস্ব হয়ে ফিরলেন দুই তরুণ 

আহসান উল্লাহ ও আলতাফ হোসেনের বয়স ৩০ বছর। গ্রামে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কৃষিকাজ করতেন। সংসারের অভাব দূর করতে তাঁরা দুজন দালালের মাধ্যমে ইতালি যাত্রা করেন। কিন্তু দালাল চক্রের খপ্পরে পড়ে নিঃস্ব হয়ে তাঁদের দেশে ফিরতে হয়েছে। 

দুই দফা মুক্তিপণ দিয়ে তাঁদের দুজনকে ফিরিয়ে আনতে পরিবারের ব্যয় করতে হয়েছে ১ কোটি ৩০ লাখ টাকা। আহসান উল্লাহ ও আলতাফ হোসেনের বাড়ি শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ উপজেলার মনুয়া গ্রামে। 

ওই দুই তরুণের স্বজন ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, মনুয়া গ্রামের কৃষক গনি বলির ছেলে আহসান উল্লাহ ও দুলাল ছৈয়ালের ছেলে আলতাফ হোসেনের মাঝপথে পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যায়। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে তাঁরা কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ শুরু করেন। গত বছর পাশের বাংলাবাজার এলাকার হারুন লস্করের মাধ্যমে ইতালি যাওয়ার জন্য ১৬ লাখ টাকা করে চুক্তি করেন।

আহসান ও আলতাফ জানান, গত বছরের ১৬ সেপ্টেম্বর তাঁরা ইতালি যাওয়ার উদ্দেশে বাড়ি ছাড়েন। প্রথমে তাঁদের নেওয়া হয় শ্রীলঙ্কা। সেখানে ২৪ দিন রাখার পর সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মিসর হয়ে নেওয়া হয় লিবিয়ার ত্রিপোলিতে। ত্রিপোলি এলাকা থেকে সমুদ্রপথে ইতালি পাঠানোর জন্য গত বছরের ১৬ নভেম্বর একটি ইঞ্জিনচালিত নৌযানে ওঠানো হয়। নৌযানটি ২০ মিনিট চলার পর পুলিশ তাঁদের আটক করে। পুলিশের কাছ থেকে চুক্তি করা দালাল তাঁদের ছাড়িয়ে আনেন। এরপর তাঁদের লিবিয়ার জাওয়াইয়া এলাকার একটি স্থানে আটকে রাখা হয়। নির্যাতন করে তাঁদের কাছ থেকে টাকা আদায় করা হয়। ওই দুই তরুণ আবার ওই দালালদের মাধ্যমে ইতালি যাওয়ার জন্য চুক্তিবদ্ধ হন। সে অনুযায়ী, গত ১ জানুয়ারি আবার জোয়ারা নামক সমুদ্র তীরবর্তী একটি স্থান থেকে নৌযানে ওঠানো হয়। এবারও ২০ মিনিট নৌযানটি চলার পরে পুলিশ সমুদ্র থেকে তাঁদের আটক করে। দালালেরা তাঁদের আবার জাওয়াইয়া এলাকার আরেকটি স্থানে আটকে রাখেন। আটকের পর তাঁদের  নির্যাতন করা হয়। ভিডিও কলে ওই নির্যাতনের দৃশ্য পরিবারের সদস্যদের দেখিয়ে মুক্তিপণ আদায় করা হয়। মুক্তিপণ দেওয়ার পর দালালেরা তাঁদের ছেড়ে দেন। পরে ওই দুই তরুণ ৭ মে দেশে ফিরে আসেন। 

পাঁচ ভাই, দুই বোন ও বাবা-মাকে নিয়ে ৯ সদস্যের বড় পবিরার আহসান উল্লাহর। পরিবারটিতে অর্থনৈতিক সচ্ছলতা ছিল না। পরিবারের সচ্ছলতা ফেরাতে জমি বন্ধক রেখে ও ঋণ করে তাঁকে ইতালি পাঠানোর উদ্যোগ নেয় পরিবার। 

আহসান উল্লাহ বলেন, ‘সচ্ছলতা ফিরবে, এমন স্বপ্ন নিয়ে ইতালি যাওয়ার জন্য ঘর ছেড়েছিলাম। প্রথমে দালালের হাতে ১৬ লাখ টাকা তুলে দিই। এরপর লিবিয়া পৌঁছানোর পর দালালের খপ্পরে পড়ে দুই দফায় পাতানো গেমের খপ্পরে পড়ি। দুই দফায় জিম্মি হই। গেম ও বন্দিদশা থেকে মুক্ত করার জন্য ওই চক্রকে চার দফায় আরও ৪৯ লাখ টাকা দেয় পরিবার। ওই টাকা জোগান দিতে ফসলি জমি বিক্রি করতে হয়েছে। আমাকে বাঁচাতে পরিবার এখন নিঃস্ব হয়ে গেল।’ 

আলতাফ হোসেনের চার ভাই ও বাবা-মাকে নিয়ে সংসার। বাবা কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। পরিবারের অভাব দূর করতে তাঁকেও ইতালি পাঠানোর জন্য দালালের সঙ্গে লিবিয়া পাঠানো হয়। পাঁচ দফায় ৬৫ লাখ টাকা ব্যয় করে নিঃস্ব আলতাফের পরিবার। 

আলতাফ বলেন, ‘দালালের ট্র্যাপে পড়েছি, তা বুঝতে পারিনি। সমুদ্রপথে ইঞ্জিনচালিত বোটে করে ইতালি নেওয়ার পাতানো গেমের কথা বলে দুবার আমাদের যাত্রা শুরু করা হয়। কিছু দূর যাওয়ার পর পুলিশ ধরে, আবার দালালের লোকজন ছাড়িয়ে এনে ঘরে আটকে রেখে নির্যাতন চালায়। সেই অমানুষিক নির্যাতনের কথা মনে হলে এখনো আঁতকে উঠি।  পরিবারকে নিঃস্ব করে দিয়ে জীবন নিয়ে দেশে ফিরেছি।’ 

ভেদরগঞ্জের বাংলাবাজার এলাকার হারুন লস্করের মাধ্যমে ওই দুই তরুণ লিরিয়া যান। ভেদরগঞ্জ থানায় তাঁর বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ করেছে আহসান উল্লাহর পরিবার। জানতে চাইলে হারুন লস্কর বলেন, ‘তাদের কোন দালাল চক্র হয়রানি করেছে বা জিম্মি করেছে, তা আমি জানি না। আমরা এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত নই।’ 

শরীয়তপুরের পুলিশ সুপার নজরুল ইসলাম বলেন, ‘শরীয়তপুরের বিভিন্ন এলাকার মানুষ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে থাকেন। এ এলাকার তরুণদের মধ্যে ইউরোপে যাওয়ার প্রবণতা রয়েছে। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে বেশ কিছু চক্র অবৈধভাবে মানব পাচারের সঙ্গে যুক্ত। আমরা কিছু মামলা নিয়ে কাজ করছি। কয়েকজনকে আইনের আওতায় আনা হয়েছে। ভেদরগঞ্জের ওই ঘটনাটিও তদন্ত করা হবে।’ 

সম্পর্কিত নিবন্ধ