ধরুন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি নতুন বিভাগ খোলা হবে। এ ক্ষেত্রে প্রক্রিয়াটি মোটামুটি এ রকম:

কোনো একটি প্রতিষ্ঠিত বিভাগের কয়েকজন শিক্ষক একত্রিত হয়ে উদ্যোগটি নেন। তার মধ্যে একজন থাকেন প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান। এরপর বিভাগটি পরিচালনার জন্য কিছু লোক নিয়োগ দিতে হবে। তাই নতুন পদ সৃষ্টি করতে হবে।

এ প্রক্রিয়ায় অনুষদের ডিন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের মাধ্যমে কয়েকটি পদ সৃষ্টি করেন। তবে বাস্তবতা হলো, পদ সৃষ্টির আগে থেকেই বিভাগে কয়েকজন লোক খুবই কম বেতনে চাকরি করতে থাকেন। তাঁদের বেশির ভাগই শিক্ষকদের কম যোগ্যতাসম্পন্ন আত্মীয় বা পরিচিতজন। ভবিষ্যতে স্থায়ী চাকরির আশায় তাঁরা কাজ করতে থাকেন। পরে সৃষ্ট পদে নিয়োগ পেয়ে যান। নিয়ম মেনে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। অন্যরা আবেদন করলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে চাকরি তাঁদেরই হয়, যাঁরা আগে থেকে কম বেতনে কাজ করে থাকেন।

এ প্রক্রিয়ায় বেশির ভাগ নিয়োগ কম যোগ্যতাসম্পন্ন লোকদের হয়ে থাকে।

আরও পড়ুনতরুণ শিক্ষকেরা কেন বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে দেন২৬ জুন ২০২৪

এভাবেই রেজিস্ট্রার অফিসেও জনবল নিয়োগ দেওয়া হয়। তাঁদের কাছ থেকে কাঙ্ক্ষিত সেবা পাওয়া যায় না। তাঁদের অনেকেই কম্পিউটারের প্রাথমিক কাজও জানেন না; ইন্টারনেট ব্যবহার সম্পর্কে তাঁদের ধারণা কম।

তাঁদের কেউ কেউ আবার বিভিন্ন দলের নেতা এবং দায়িত্বে অবহেলা করেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক হাজারের বেশি কর্মকর্তা রয়েছেন; কিন্তু তাঁদের একটি বড় অংশের ভালো মানের শিক্ষাগত যোগ্যতার অভাব রয়েছে।

এই বিশ্ববিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী থেকেও পদোন্নতি পেয়ে কেউ কেউ কর্মকর্তা হয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী একে অপরের আত্মীয় হওয়ায় দাপ্তরিক গোপনীয়তা ও পেশাদারি বজায় রাখা কঠিন।

একসময় ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদে চারটি বিভাগ ছিল: অ্যাকাউন্টিং, ম্যানেজমেন্ট, ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং এবং মার্কেটিং। বর্তমানে বিভাগ সংখ্যা নয়টি। যেমন ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগ থেকে ভাগ হয়ে ব্যাংকিং অ্যান্ড ইনস্যুরেন্স নামে একটি নতুন বিভাগ খোলা হয়েছে। অথচ ফিন্যান্স, ব্যাংকিং অ্যান্ড ইনস্যুরেন্স মাস্টার্সে আলাদা ধারা হিসেবেই থাকতে পারত।

মার্কেটিং বিভাগের একটি ধারাকে অবলম্বন করে ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ খোলা হয়। মার্কেটিংয়ের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো সার্ভিস মার্কেটিং, যা ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটিকে অন্তর্ভুক্ত করে। এর জন্য আলাদা বিভাগ প্রয়োজন ছিল না।

হাস্যকর একটি বিষয় হলো, প্রায় একই রকম ডিগ্রি একই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন জায়গা থেকে দেওয়া। বিবিএ ও এমবিএ ডিগ্রি ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদ ও আইবিএ থেকে দেওয়া হয়। আবার ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের নয়টি বিভাগ আলাদাভাবে বিবিএ ও এমবিএ ডিগ্রি প্রদান করে।

দেখা যায়, বিবিএতে প্রায় ৫০ শতাংশ কোর্স সব বিভাগেই পড়ানো হয়। আরও অদ্ভুত ব্যাপার হলো, ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে দুটি বিভাগ ও একটি ইনস্টিটিউট ডিগ্রি প্রদান করে। এক অর্থনীতি বিষয়ে দুটি বিভাগ ও একটি ইনস্টিটিউট ডিগ্রি প্রদান করে।

অর্থনীতি নিজেই উন্নয়ন অর্থনীতিকে অন্তর্ভুক্ত করে। উন্নয়ন অর্থনীতির জন্য কি আলাদা বিভাগ প্রয়োজন?

ইংরেজি বিভাগ থেকে যেমন চার বছর মেয়াদি অনার্স ডিগ্রি দেওয়া হয়, তেমনি ইনস্টিটিউট অব মডার্ন ল্যাঙ্গুয়েজ থেকেও ইংরেজিতে চার বছর মেয়াদি অনার্স ডিগ্রি প্রদান করা হয়।

সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের অধীন জাপানিজ স্টাডিজ বিভাগ যেমন চার বছর মেয়াদি অনার্স ডিগ্রি প্রদান করে, তেমনি ইনস্টিটিউট অব মডার্ন ল্যাঙ্গুয়েজ থেকেও জাপানিজ ল্যাঙ্গুয়েজে চার বছর মেয়াদি অনার্স ডিগ্রি প্রদান করা হয়। সামগ্রিকভাবে বিজ্ঞান অনুষদেও এ রকম অনেক অপ্রয়োজনীয় ও সমজাতীয় বিভাগ রয়েছে।

এভাবে বিভাগ খোলার কারণে অতি অল্প সময়ে প্রচুরসংখ্যক শিক্ষক যোগ্যতার সঙ্গে আপস করে ও রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তাঁদের অনেকেই রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নে নিয়োজিত থাকত; তাঁদের কাছে পড়াশোনা ছিল গৌণ। তাঁদেরই কেউ কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের ন্যায়ভিত্তিক আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের টুঁটি চেপে ধরেছে। কেউ ওয়ার্ড কমিশনার নির্বাচনের সময় লিফলেট বিলি করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির বিভিন্ন নির্বাচনে তাঁদের বেশির ভাগ ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের চেয়েও বেশি তৎপরতা দেখিয়েছেন।

আরও পড়ুনবিশ্ববিদ্যালয়ের মানসংকট ও শিক্ষক নিয়োগে ‘ঘরজামাই’ পদ্ধতি০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২

যেসব শিক্ষক রাজনীতির সঙ্গে জড়িত তাঁদের অনেকেই ফাঁকিবাজ ও ক্লাসে অনিয়মিত। বর্তমানে যাঁরা শিক্ষার্থীদের নিষেধাজ্ঞার কারণে ক্লাস নিতে পারছেন না তাঁদের অনেকেই রাজনৈতিক ক্ষমতায় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছেন। শিক্ষক রাজনীতি এ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার উৎকর্ষ সাধনে একটি বড় বাধা।

এ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করে যে বেতন পান, আরেকজন শিক্ষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করেও একই পরিমাণ বেতন পান। এমনকি একজন পিএইচডি করা অধ্যাপক যে বেতন পান, পিএইচডি ছাড়াও একজন অধ্যাপক একই পরিমাণ বেতন পান।

গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশের ক্ষেত্রে বিশ্বের নামীদামি জার্নালের মর্যাদা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনুষদের জার্নালের মর্যাদার সমান।

বিভাগের সংখ্যার সঙ্গে তাল মিলিয়ে শিক্ষার্থী ভর্তির আসনসংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে কম যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষার্থীদের ভর্তির সুযোগ বেড়েছে। এমন অনেক বিভাগ আছে যেখানে একজন শিক্ষার্থীকে মাসেও এক মুহূর্তের জন্য বই স্পর্শ করতে হয় না।

বর্তমান বেতনকাঠামোয় একজন শিক্ষকের পক্ষে সচ্ছল জীবনযাপন সম্ভব নয়। তাই তাঁরা কেউ কেউ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন কোর্স পড়ান। একসময় কেউ কেউ ইংরেজি মাধ্যম স্কুলেও পড়াতেন। একমাত্র আর্থিক কারণেই এ বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ছেড়ে একজন ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে যোগদান করেছেন। এ রকম আর্থিক অনটন থেকেই এ বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা রকম সান্ধ্য কোর্স চালু হয়েছে, যেখানে অনেক নিম্নমানের শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ পায়।

এ ধরনের শিক্ষার্থী তাহলে ক্লাসের বাইরের সময়ে কী করবে? রাজনীতি একটি বড় বিকল্প; তার সঙ্গে মাস্তানি, ক্ষমতা প্রদর্শন, ফাউ খাওয়া, আধিপত্য বিস্তার এবং সবশেষে খুনোখুনি। শিক্ষার্থীদের রাজনীতিও এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান কমানোর জন্য যথেষ্ট দায়ী। আবার অতিরিক্ত বিভাগ, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর কারণে নতুন হল ও আবাসিক ভবন নির্মাণ করতে হচ্ছে।

ফলে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দিন দিন ম্লান হচ্ছে।

আরও পড়ুনবিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা কি নিরপেক্ষ হতে পারবেন১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪

বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা অধ্যয়ন করে তাদের মধ্যে অনেকেই মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত। তাদের বেশির ভাগ এসএসসি ও এইচএসসি পাস করতে গিয়ে গড়ে অনেক টাকা খরচ করেছে। কিন্তু তারাও এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩০ টাকা বেতনেই পড়াশোনা করে।

অথচ ‘পরিশোধের সামর্থ্য’ অনুযায়ী তাদের বেতন ধার্য করলে সরকারের ওপর যেমন চাপ কমবে, তেমনি বিশ্ববিদ্যালয়ও নিজস্ব তহবিলে অনেকটাই চলতে পারবে। আর্থিক সক্ষমতার ফলে বিশ্ববিদ্যালয় গরিব শিক্ষার্থীদের বৃত্তি প্রদান করতে পারবে, গবেষণায় প্রয়োজনীয় টাকা বরাদ্দ দিতে পারবে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য ব্যয় করার সুযোগ বাড়বে।

বর্তমান বেতনকাঠামোয় একজন শিক্ষকের পক্ষে সচ্ছল জীবনযাপন সম্ভব নয়। তাই তাঁরা কেউ কেউ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন কোর্স পড়ান। একসময় কেউ কেউ ইংরেজি মাধ্যম স্কুলেও পড়াতেন। একমাত্র আর্থিক কারণেই এ বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ছেড়ে একজন ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে যোগদান করেছেন।

এ রকম আর্থিক অনটন থেকেই এ বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা রকম সান্ধ্য কোর্স চালু হয়েছে, যেখানে অনেক নিম্নমানের শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ পায়।

এ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিদিন হাজার হাজার বহিরাগত আড্ডা দিতে আসে, বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালায়, গভীর রাত পর্যন্ত আবাসিক এলাকা–সংলগ্ন রাস্তায় আড্ডা দেয়, উচ্চ স্বরে গানবাজনা করে, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক পরিবেশকে বিশেষ করে আবাসিক পরিবেশকে ব্যাহত করে।

আমরা যদি এ বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে বড় রকমের স্বপ্ন দেখতে চাই, তাহলে এ বিষয়গুলোর সমাধান করতেই হবে। অনেকগুলো বিভাগ একত্রীকরণের সময় এসেছে। বিভাগগুলোতে সিলেবাস এমন হওয়া উচিত যেখানে একজন শিক্ষার্থী দৈনিক গড়ে ৪-৫ ঘণ্টা পড়াশোনা করবে। বিভিন্ন জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর শিক্ষার্থী ভর্তির চাপ কমিয়ে আনতে হবে। কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ ও পদোন্নতির নীতিমালা ঢেলে সাজাতে হবে, যাতে যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগ পায়।

এ বিশ্ববিদ্যালয়ের আলাদা বেতনকাঠামো প্রয়োজন, যা কোনোভাবেই আমলাদের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে হবে না। কারণ, এটি দেশের প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়; এখনো এখানে দেশসেরা শিক্ষার্থীরাই শিক্ষক হন। দেশে-বিদেশে অনেক সুযোগ বাদ দিয়ে তাঁরা অনেকে এখানে কাজ করেন। শিক্ষকদের আর্থিক সুযোগ-সুবিধা বাড়িয়ে তাঁদের শিক্ষাগত ও অন্যান্য যোগ্যতার মানও বাড়ানো দরকার।

আমরা চাই এ বিশ্ববিদ্যালয়ে আর্থিক সংকটকে পুঁজি করে শিক্ষক রাজনীতি জিইয়ে রাখার ফাঁদ বন্ধ হোক। শিক্ষকেরা রাজনীতির ক্রীড়নক হিসেবে ব্যবহৃত হবেন না। তাঁরা বিশ্বমানের গবেষণা করবেন এবং শুভবুদ্ধি দ্বারা চালিত হবেন। শিক্ষার্থীরাও গভীর মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করবে। শিক্ষার্থীদের বহনকারী লাল বাসগুলো ঢাকা শহরে আতঙ্কের প্রতীক হয়ে উঠবে না। উল্টো পথে তো নয়ই, সঠিক পথেই আইন মেনে চলাচল করবে। নীলক্ষেত থেকে টিএসসি পর্যন্ত রাস্তাটি সিটি করপোরেশনের হলেও দেশের প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থে এটি যান চলাচলের জন্য সীমিত করতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তাব্যক্তিদের বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে ধারণা থাকতে হবে। তাঁদের বুঝতে হবে বিশ্ববিদ্যালয় ঘুরতে আসা কোনো উন্মুক্ত স্থান নয়। এ–ও বুঝতে হবে, অপ্রয়োজনীয় বিভাগ খোলা ও অতিরিক্ত শিক্ষার্থী ভর্তি করার মধ্যে কোনো কৃতিত্ব নেই। আরও বুঝতে হবে রাজনীতির কাছে নতজানু না হয়ে বিবেক দ্বারা পরিচালিত হলে এ বিশ্ববিদ্যালয় তাঁদের দীর্ঘদিন শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে।

ড.

মো. মাইন উদ্দিন অধ্যাপক ও সাবেক চেয়ারম্যান, ব্যাংকিং অ্যান্ড ইনস্যুরেন্স বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: চ র বছর ম য় দ অন র স ড গ র একজন শ ক ষ দ র অন ক ই কর মকর ত য গ যত র প এইচড ভর ত র কর ছ ন আর থ ক র জন ত র জন য র একট এ রকম

এছাড়াও পড়ুন:

নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গো শুধু লেখকই নন, একজন যোদ্ধাও

নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গো নাচতে ভালোবাসতেন। সবকিছুর চেয়ে, এমনকি লেখালেখির চেয়ে তিনি নাচ বেশি পছন্দ করতেন।

আশির কোঠায় তাঁর বয়স পৌঁছালে কিডনিজনিত অসুখে তাঁর শরীর যখন শ্লথ হয়ে যায়, তখনো তিনি নিছক গান শুনলেই উঠে দাঁলেড়িয়ে নাচতে শুরু করতেন। ছন্দ তাঁর পায়ে যেভাবে খেলত, শব্দও তেমনি হাতে খেলত, আর তা কাগজে লিখে চলত। নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গোকে আমি মনে রাখব একজন নাচের মানুষ হিসেবে। গত ২৮ মে ৮৭ বছর বয়সে তিনি চলে গেলেন অনন্তলোকে।

নগুগি আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন তাঁর মহান সাহিত্য–ঐতিহ্য দিয়ে। তাঁর সাহিত্য ছিল উদ্ভাবনী শৈলীতে অভিনব আর মৌলিক সমালোচনায় ঋদ্ধ। তাঁর এই সাহিত্য–ঐতিহ্য আমাদের আনন্দের সঙ্গে উৎসাহিত করে আরও ভালো কিছু করার জন্য, আরও সাহস নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার জন্য। আমাদের সমাজগুলোর ভিত গড়ে দেওয়া ঔপনিবেশিক কাঠামোর বিরুদ্ধে আমরা যাঁরা লেখক, কর্মী, শিক্ষক ও মানুষেরা লড়ছি, তাদের জন্য নগুগি অফুরান অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবেন।

২০০৫ সালে নগুগির সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয়। এর বহু আগে থেকেই আফ্রিকান সাহিত্যধারার একজন প্রতিষ্ঠিত লেখক ও নোবেল পুরস্কারের দীর্ঘদিনের দাবিদার ছিলেন তিনি। তাঁর সঙ্গে পরিচয়ের পর দ্রুতই আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে যায়, তাঁর লেখালেখির সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে রয়েছে শিক্ষাদানের ব্যাপারটি। এর সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে ছিল তাঁর রাজনৈতিক অঙ্গীকার।

নগুগি প্রাঞ্জল হাসিমুখ, ক্লান্তিহীন হাসি আর উচ্ছ্বাসের আড়ালে ছিল এক গভীর ক্ষোভ, যা তাঁর শরীর ও মনের ক্ষতচিহ্নগুলোরই প্রতিচ্ছবি। শৈশব, কৈশোর ও যৌবনে চরম অপরাধমূলক শাসনব্যবস্থার নির্মমতা ও সহিংসতার চিহ্ন তিনি বয়ে চলেছিলেন।

নগুগির বধির ভাইকে ব্রিটিশরা গুলি করে হত্যা করেছিল। তার কারণ হলো চেক পয়েন্টে তিনি ব্রিটিশ সেনার থামার নির্দেশনা শুনতে পাননি। ব্রিটিশ শাসনের শেষ দিকে মাউ মাউ বিদ্রোহ (কেনিয়ার সশস্ত্র বিপ্লবীদের সঙ্গে ব্রিটিশ প্রশাসনের লড়াই) তাঁর অন্য ভাইদের বিপরীত দুই পক্ষে ভাগ করে দিয়েছিল।

এ দুটি ঘটনা তাঁর মধ্যে গভীরভাবে এই বোধকে প্রোথিত করে দিয়েছিল যে সহিংসতা ও বিভাজন হলো ঔপনিবেশিকতাকে স্থায়ী রূপ দেওয়ার দুটি প্রধান চালিকা শক্তি। এমনকি স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে মেট্রোপোলের (ঔপনিবেশিক কেন্দ্রের) সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার পরও সেটা সত্য।

অর্ধশতাব্দীর বেশি সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরও একটি বিষয়ে আলোচনা উঠলে নগুগি সবচেয়ে বেশি উত্তেজিত হয়ে উঠতেন। সেটি হলো ব্রিটিশ শাসন থেকে কেনিয়ান শাসনে রূপান্তরকাল। বাস্তবতা হচ্ছে, কেনিয়া থেকে ব্রিটিশদের বিদায়ের মধ্য দিয়ে ঔপনিবেশিক শাসন বিদায় নেয়নি; বরং নতুন কেনিয়ান শাসকদের হাত ধরে সেটি আরও গভীরভাবে গেড়ে বসেছিল। আরও শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল।

একজন লেখক ও নাট্যকার হিসেবে নগুগি একজন যোদ্ধা হয়ে উঠেছিলেন। তিনি তাঁর ভাষাকে জটিল হয়ে ওঠা আফ্রিকান পরিচয়গুলোর (স্থানীয়, গোষ্ঠীগত, জাতীয় ও বিশ্বজনীন) সঙ্গে পুনরায় সংযোগ তৈরির কাজে নিবেদিত করেছিলেন। ব্রিটিশ শাসনের এই ‘সাংস্কৃতিক বোমা’ সাত দশক ধরে ‘নিশ্চিহ্ন’ হয়ে গিয়েছিল।

১৯৬২ সালে কাসপালায় তাঁর প্রথম নাটক দ্য ব্ল্যাক হারমিট প্রকাশিত হয়। খুব দ্রুতই তাঁকে ‘মহাদেশের কণ্ঠস্বর’ বলে ডাকা শুরু হয়। এর দুই বছর পর তাঁর প্রথম উপন্যাস উইপ নট চাইল্ড প্রকাশিত হয়। পূর্ব আফ্রিকান লেখকের লেখা ইংরেজি ভাষার প্রথম উপন্যাস।

নগুগি যখন খ্যাতির চূড়ায় পৌঁছালেন, তখন সিদ্ধান্ত নিলেন, তিনি ইংরেজি ভাষায় লেখা বন্ধ করবেন। তাঁর মাতৃভাষা গিকুয়ুতে লেখালেখি শুরু করলেন।

নিজের মাতৃভাষায় তাঁর প্রত্যাবর্তন শুধু নিজের ক্যারিয়ার নয়, জীবনের গতিপথকেই মৌলিকভাবে বদলে দিল। উপনিবেশ–উত্তর কেনিয়ান শাসনব্যবস্থার প্রতি নগুগির স্বচ্ছদৃষ্টির সমালোচনা ইংরেজি বা জাতীয় ভাষা সোয়ালির পরিবর্তে তাঁর মাতৃভাষায় মানুষের কাছে পৌঁছাতে লাগল। কেনিয়ার নতুন শাসকদের জন্য সেটা সহ্য করা অসম্ভব হয়ে পড়ল। ফলে তাঁকে ১৯৭৭ সালে কোনো বিচার ছাড়াই এক বছরের জন্য কারাবন্দী করা হলো।

নগুগি যখন গিকুয়ু ভাষায় লেখা শুরু করেন এবং যখন তিনি কারাগারে ছিলেন, তখন তাঁর মধ্যে এই উপলব্ধি এল যে উপনিবেশ-পরবর্তী শাসনের মূলমন্ত্রটা হলো ‘নয়া ঔপনিবেশিকতা’। এটি সেই প্রচলিত ‘নয়া ঔপনিবেশিকতা’ নয়, যেটি উপনিবেশবিরোধী ও উপনিবেশ-পরবর্তীকালের আন্দোলনকারীরা আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতার পরও সাবেক উপনিবেশের ওপর ঔপনিবেশিক শাসকদের নিয়ন্ত্রণ বোঝাতে ব্যবহার করতেন।

বরং এটি হলো নতুন স্বাধীন হওয়া নেতাদের নিজ ইচ্ছায় ঔপনিবেশিক শাসনের কলাকৌশল ও ভাষা আত্মস্থ করে নেওয়ার বিষয়টি। তাঁদের অনেকেই (যেমন জোমো কেনিয়াত্তা, যাঁর উদাহরণ নগুগি প্রায়ই দিতেন) ব্রিটিশ শাসনের সময় কারাবরণ ও নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন।

সুতরাং প্রকৃতভাবে উপনিবেশ থেকে মুক্তি তখনই সম্ভব, যখন মানুষের মন বিদেশি নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত হবে। আর এর জন্য প্রথম, সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো নিজের মাতৃভাষায় লেখার স্বাধীনতা।

মার্ক লেভাইন ইউসি আরভাইনের গ্লোবাল মিডল ইস্ট স্টাডিজ প্রোগ্রামের পরিচালক

আল-জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের পর গ্রামগঞ্জের কর্মী-সমর্থকেরা কী ভাবছেন
  • পর্যটক এক্সপ্রেসের ধাক্কায় দুমড়ে-মুচড়ে গেল অটোরিকশা-মোটরসাইকেল, নিহত ১
  • করোনায় ঢাকায় একজনের মৃত্যু
  • সর্বনাশ! এ তো শয়তানের নিশ্বাস!
  • দেশে আবারো করোনায় ১ জনের মৃত্যু, শনাক্ত ৩
  • ঈদযাত্রায় সায়েদাবাদে যাত্রীর চাপ, বাড়তি ভাড়া নেওয়ার অভিযোগ
  • এই রাতে আলো ছিল, জয় ছিল, আর ছিল একজন হামজা চৌধুরী
  • শেরপুরে ট্রাকের ধাক্কায় অটোরিকশার ৩ যাত্রী নিহত, আহত ২
  • নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গো শুধু লেখকই নন, একজন যোদ্ধাও