বিদেশি কোম্পানিকে বন্দর ব্যবস্থাপনার ইজারা দেওয়ার ঝুঁকিগুলো কী
Published: 14th, June 2025 GMT
বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক সম্পদগুলোর একটি হলো চট্টগ্রাম বন্দর। দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যিক কার্যক্রমের বেশির ভাগ পরিচালিত হয় এই বন্দরের মাধ্যমে। চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) দুবাইভিত্তিক বহুজাতিক কোম্পানি ডিপি ওয়ার্ল্ডের কাছে ইজারা দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে দেশজুড়ে বিতর্ক ও উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে।
সরকারের ভাষ্য, ডিপি ওয়ার্ল্ড পৃথিবীর অনেক দেশের বন্দর পরিচালনার কাজ করছে; তারা আন্তর্জাতিক মানের বন্দর পরিচালনায় দক্ষ। ডিপি ওয়ার্ল্ডের মতো অভিজ্ঞ কোম্পানির মাধ্যমে বন্দরের আধুনিকায়ন ও প্রযুক্তি হস্তান্তর সম্ভব হবে এবং এর মাধ্যমে বিদেশি বিনিয়োগ আসবে এবং বন্দরের কার্যকারিতা বাড়বে।
সরকারের ভাষ্যের সঙ্গে ভিন্নমত প্রকাশ করে কেউ কেউ বলছেন, সমুদ্রবন্দর ইজারা কেবল অর্থনীতির বিষয় নয়; এটি একটি কৌশলগত বিষয়। এর ফলে জাতীয় সম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রণ বিদেশি কোনো কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে কি না, এমন প্রশ্ন উঠেছে।
এই চুক্তির আওতায় বিদেশি কোম্পানিগুলো পরিচালনা, বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত এবং প্রবেশাধিকারসহ সার্বিক ব্যবস্থাপনার ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারবে। এর ফলে জাতীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় বিদেশি কর্তৃত্বের অনুপ্রবেশ ঘটতে পারে; ভবিষ্যতে এ সম্পদ ঘিরে জটিলতা ও বিরোধের আশঙ্কা বাড়তে পারে, এমনকি জাতীয় নিরাপত্তাও হুমকির মুখে পড়তে পারে। ফলে অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, চট্টগ্রাম বন্দরের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার পরিচালনা বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়া আদৌ কতটা যৌক্তিক?
চট্টগ্রাম বন্দর শুধু একটি সমুদ্রবন্দর নয়, এটি বাংলাদেশের অর্থনীতির চালিকা শক্তি। দেশের মোট আমদানি-রপ্তানির প্রায় ৯২ শতাংশই এই বন্দরের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। খাদ্যপণ্য, জ্বালানি তেলসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পণ্যের নির্বিঘ্ন প্রবাহ নিশ্চিত করতে এই বন্দর অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে। এই বন্দর প্রতিবছর প্রায় তিন মিলিয়ন টিইইউ (২০ ফুট দীর্ঘ কনটেইনারের একক হিসাব) কনটেইনার হ্যান্ডল (পরিচালনা) করে।
■ বন্দরের কর্মদক্ষতা কেবল অপারেশন ও ব্যবস্থাপনার ওপর নির্ভর করে না; ভৌগোলিক অবস্থান ও কাঠামোগত সুযোগ-সুবিধার ওপরও নির্ভর করে। ■ বিদেশি অপারেটর নিয়োগ–সংক্রান্ত চুক্তির শর্তাবলি, সম্ভাব্য লাভ-ক্ষতি ও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে মূল্যায়ন করা আবশ্যক।বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহম্মদ ইউনূস যথার্থই চট্টগ্রাম বন্দরের গুরুত্ব ব্যাখ্যা করে একে বাংলাদেশের ‘হৃৎপিণ্ড’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। হৃৎপিণ্ড সবল না হলে যেমন শরীরের রক্ত সঞ্চালন ব্যাহত হয়, তেমনি এই বন্দর দুর্বল হলে দেশের অর্থনীতির কর্মকাণ্ডে ব্যাঘাত ঘটবে।
এখন প্রশ্ন আসে, এই ‘হৃৎপিণ্ড’ কে সবল রাখতে আমরা কোন পথ বেছে নেব? সঠিক জীবনযাপন ও স্বাস্থ৵বিধি মেনে শরীরচর্চা করে হৃৎপিণ্ডের সক্ষমতা বাড়াব, নাকি সহজ সমাধানের খোঁজে ‘বিদেশি দাওয়াইয়ের’ ওপর নির্ভর করব? আগেই বলা হয়েছে, সিদ্ধান্তটি কেবল অর্থনৈতিক নয়, কৌশলগত এবং এর সঙ্গে জাতীয় স্বার্থ ও নিরাপত্তা জড়িত।
২.নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) ২০০৭ সালে নির্মিত হয়, যার প্রাথমিক সক্ষমতা ছিল ১.১ মিলিয়ন টিইইউ। সাম্প্রতিক সময়ে আধুনিক যন্ত্রপাতি ও অবকাঠামো সংযোজনের মাধ্যমে এটি আরও উন্নত করা হয়েছে। বর্তমানে দেশীয় ব্যবস্থাপনায় টার্মিনালটি বছরে ১.৩ মিলিয়ন টিইইউর বেশি কনটেইনার হ্যান্ডল করছে, যা তার নির্ধারিত সক্ষমতার চেয়েও বেশি।
এনসিটি প্রতিবছর এক হাজার কোটি টাকার বেশি রাজস্ব আয় করছে। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, যে টার্মিনাল দেশীয় ব্যবস্থাপনায় সফলভাবে পরিচালিত হচ্ছে এবং লাভজনকভাবে কাজ করছে, সেটি বিদেশি পরিচালনায় হস্তান্তরের প্রয়োজনীয়তা আসলে কতটুকু বাস্তবসম্মত?
চট্টগ্রাম বন্দরের দক্ষতা বৃদ্ধি ও আধুনিকায়নের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কোনো দ্বিমত নেই। এটি দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম ব্যস্ত বন্দর হলেও এর দক্ষতা আন্তর্জাতিক মানের তুলনায় অনেক কম।
বর্তমানে একটি জাহাজ বার্থিংয়ের (জাহাজের অপেক্ষার সময়) জন্য চট্টগ্রামে তিন–চার দিন অপেক্ষা করে, সেখানে সিঙ্গাপুরে এটি মাত্র ১২ থেকে ২৪ ঘণ্টা এবং কলম্বোয় ২৪ থেকে ৩৬ ঘণ্টার মধ্যেই সম্পন্ন হয়। একইভাবে কনটেইনার খালাসে চট্টগ্রাম বন্দরে ৭ থেকে ১০ দিন সময় লাগে, যা বিশ্বের শীর্ষ বন্দরে সাধারণত ২–৩ দিনের মধ্যে শেষ হয়; এর ফলে রপ্তানি ও আমদানির খরচ বেড়ে যায়।
বন্দরের কর্মদক্ষতা কেবল অপারেশন ও ব্যবস্থাপনার ওপর নির্ভর করে না; ভৌগোলিক অবস্থান ও কাঠামোগত সুযোগ-সুবিধার ওপরও নির্ভর করে। চট্টগ্রাম বন্দর কর্ণফুলী নদীর তীরে একটি সরু চ্যানেলে অবস্থিত, যেখানে পানির গভীরতা (ড্রাফট) প্রায় ৯ দশমিক ৫ মিটার যা আবার জোয়ার-ভাটার কারণে অনেক সময় কম-বেশি হয়।
পানির অগভীরতার পাশাপাশি কর্ণফুলী নদীর সরু চ্যানেল, তীক্ষ্ণ বাঁক ও জোয়ার-ভাটার পরিবর্তন জাহাজ চলাচলে বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। ফলে জাহাজের ‘টার্ন-অ্যারাউন্ড টাইম’ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যায়। অবস্থানগত সীমাবদ্ধতার ফলে চট্টগ্রাম বন্দরের দক্ষতাকে সিঙ্গাপুর বা কলম্বো বন্দরের মানদণ্ডে সরাসরি মূল্যায়ন করা যৌক্তিক নয়।
প্রাকৃতিক সীমাবদ্ধতা ছাড়াও আধুনিক স্ক্যানিং প্রযুক্তি ও ডিজিটাল সিস্টেমের অভাবে চট্টগ্রাম বন্দরে কাস্টমস ক্লিয়ারেন্সে ৭ থেকে ১০ দিন সময় লাগে। অবকাঠামো ও গুদাম ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা পণ্য হস্তান্তরে বিলম্ব ঘটায় আর শ্রমিকদের প্রযুক্তিগত দক্ষতার ঘাটতি অপারেশনাল কার্যকারিতাকে বাধাগ্রস্ত করছে। তাই চট্টগ্রাম বন্দরের চ্যালেঞ্জ কেবল কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়েই সীমাবদ্ধ নয়, এর কার্যকর সমাধানে প্রয়োজন কাস্টমস–প্রক্রিয়ার দ্রুততর ডিজিটালাইজেশন, শ্রমিকদের দক্ষতা উন্নয়ন এবং গুদামজাতকরণ ও পরিবহনব্যবস্থার আধুনিকীকরণ।
৩.চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) ডিপি ওয়ার্ল্ডকে ইজারা দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয় শেখ হাসিনা সরকারের আমলে ২০২৩ সালে; সরকারের সঙ্গে সরকার (জিটুজি) আলোচনার মাধ্যমে। তাহলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বন্দর নিয়ে কেন একই নীতি অনুসরণ করছে?
বিষয়টি শুধু একটি সরকারের সিদ্ধান্ত নয়; বরং এটি এক বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মতবাদ—‘নব উদারনৈতিক (নিউ লিবারেল) দর্শনের প্রতিফলন।’ এই দর্শনের লক্ষ্য হলো বাজারব্যবস্থার সম্প্রসারণ, সরকারি সম্পদের বেসরকারীকরণ, নিয়ন্ত্রণ কমিয়ে মূলধনের অবাধ প্রবাহ নিশ্চিত করা এবং বহুজাতিক করপোরেশনগুলোর জন্য প্রবেশাধিকারের পথ উন্মুক্ত করা।
বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, আইএফসি, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকসহ আন্তর্জাতিক আর্থিক সংস্থাগুলো এই দর্শন বাস্তবায়নে দীর্ঘদিন ধরে ভূমিকা রেখে চলেছে। তারা উন্নয়নশীল দেশগুলোকে বৈদেশিক বিনিয়োগের নামে কৌশলগত খাতগুলোতে বেসরকারীকরণে উৎসাহ দিচ্ছে, যা অনেক সময় জাতীয় স্বার্থ ও সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়।
একাধিক উদাহরণ থেকেই বোঝা যায়, এ ধরনের চুক্তির পরিণতি ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে; যেমন আফ্রিকার ছোট্ট দেশ জিবুতি ২০০৬ সালে দুবাইভিত্তিক ডিপি ওয়ার্ল্ডকে ‘ডোরালে কনটেইনার টার্মিনাল’ পরিচালনার জন্য ৫০ বছরের জন্য ইজারা দিয়েছিল। শুরুতে বিনিয়োগ ও উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি থাকলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব নিয়ে উদ্বেগ দেখা দেয়। ফলে ২০১৮ সালে জিবুতি সরকার একতরফাভাবে চুক্তি বাতিল করে। জবাবে ডিপি ওয়ার্ল্ড আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ বিরোধ নিষ্পত্তি সংস্থায় মামলা করে এবং পরে ক্ষতিপূরণ দাবি করে জয়লাভও করে।
এ ধরনের উদাহরণ শুধু আফ্রিকায় নয়, দক্ষিণ এশিয়া ও পূর্ব আফ্রিকার দেশগুলোতেও দেখা গেছে। যেমন ২০১৪ সালে কেনিয়ার মোম্বাসা বন্দরের একটি টার্মিনাল চীনা কোম্পানি সিআরবিসিকে দিয়েছিল। শুরুতে রাজস্ব বাড়লেও পরে স্থানীয় শ্রমিক ও ব্যবসায়ীদের অংশগ্রহণ কমে যায়। কারণ, চীনা কোম্পানিগুলো নিজস্ব শ্রমিক ও সরবরাহব্যবস্থা ব্যবহার করেছিল।
বিশ্বব্যাংকের ২০২০ সালের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, যেসব অবকাঠামো প্রকল্পে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) বা বেসরকারীকরণ বাস্তবায়িত হয়েছে, সেগুলোর ৪২ শতাংশ ক্ষেত্রে আর্থিক ঝুঁকি ও দায় শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রকেই বহন করতে হয়েছে। শ্রীলঙ্কা, ফিলিপাইন ও কেনিয়ার মতো দেশের অভিজ্ঞতা বলছে, বিদেশি কোম্পানিকে কৌশলগত খাতের নিয়ন্ত্রণ দিলে স্থানীয়দের ক্ষমতা দুর্বল হয় এবং স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতা কমে যায়।
এ ছাড়া একাধিক গবেষণা দেখিয়েছে, কৌশলগত খাতে বেসরকারীকরণ টেকসই উন্নয়নের নিশ্চয়তা দিতে পারেনি; বরং আয়বৈষম্য, শ্রমবাজার সংকোচন এবং সামাজিক অসন্তোষ বেড়েছে। ওইসিডির ২০২২ সালের এক পর্যালোচনায় বলা হয়েছে, যথাযথ নিয়ন্ত্রণক্ষমতা ছাড়া কৌশলগত সম্পদের বেসরকারীকরণ দীর্ঘমেয়াদে জাতীয় স্বার্থ ক্ষুণ্ন ও দর–কষাকষির ক্ষমতা দুর্বল করে।
৪.স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, দক্ষতা বাড়ানোর একমাত্র উপায় কি বিদেশি কোম্পানির হাতে বন্দর ব্যবস্থাপনা তুলে দেওয়া? ২০২৩ সালে চট্টগ্রাম বন্দরের পাশেই নবনির্মিত পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল একটি সৌদি কোম্পানির অধীন পরিচালনার জন্য দেওয়া হয়। চুক্তি অনুযায়ী বার্ষিক পাঁচ লাখ টিইইউ হ্যান্ডল করার কথা থাকলেও এক বছর পর গড় হ্যান্ডলিং লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ১৩ শতাংশ। সেখানে এখনো পর্যাপ্ত গ্যান্ট্রি ক্রেন বসানো হয়নি এবং প্রয়োজনীয় দক্ষ জনবল ও টার্মিনাল অটোমেশন গড়ে তোলা হয়নি। অনেকের মতে, ২০২৩ সালে সৌদি অপারেটরের সঙ্গে করা চুক্তিটি জাতীয় স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
এ দৃষ্টান্ত প্রমাণ করে, শুধু বিদেশি অপারেটর আনলেই দক্ষতা ও উন্নয়ন নিশ্চিত হয় না। অবকাঠামো, জনবল ও সুশাসনের ঘাটতি থাকলে তারাও ব্যর্থ হয়। একই অভিজ্ঞতা আফ্রিকার মোমবাসা ও লাতিন আমেরিকার গুয়ায়াকিল বন্দরে দেখা গেছে; যেখানে বিদেশি পরিচালনা সেবার মান বাড়াতে পারেনি, বরং দুর্বল চুক্তি, শ্রমিক অসন্তোষ ও অতিরিক্ত খরচের মতো সমস্যা তৈরি করেছে।
চট্টগ্রাম বন্দরের দক্ষতা বাড়াতে সবচেয়ে দ্রুত, সহজ এবং স্বল্প ব্যয়ে বাস্তবায়নযোগ্য পদক্ষেপ হলো কাস্টমস সংস্কার। বর্তমানে একটি কনটেইনার ক্লিয়ারেন্সে গড়ে সাত দিন লাগে, অথচ আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী এটি এক–দুই দিনে সম্ভব। বিশ্বব্যাংকের লজিস্টিকস পারফরম্যান্স সূচক অনুযায়ী, কাস্টমস দক্ষতায় বাংলাদেশের অবস্থান ১৩২ দেশের মধ্যে ১০০তম; যা আমাদের বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমিয়ে দেয়। আধুনিক স্ক্যানার, স্বয়ংক্রিয় রিস্ক ম্যানেজমেন্ট, ২৪/৭ অপারেশন ও দক্ষ জনবল নিশ্চিত করা গেলে বিদেশিদের কাছে ইজারা দেওয়া ছাড়াই বন্দরের সামগ্রিক স্থবিরতা অনেকাংশে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।
৫.এনসিটি পরিচালনা বিষয়ে দুবাইভিত্তিক কোম্পানি ডিপি ওয়ার্ল্ডের সঙ্গে ইজারার শর্তাবলি এখনো জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়নি। এর ফলে চুক্তির দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব, অর্থনৈতিক লাভ-ক্ষতি কিংবা কৌশলগত ঝুঁকি সম্পর্কে স্বচ্ছ ও বাস্তবসম্মত মূল্যায়ন করা দুরূহ। বৈশ্বিক অভিজ্ঞতা বলছে, বিদেশি অপারেটর নিয়োগে বন্দরের দক্ষতা বাড়লেও কনটেইনার চার্জ বৃদ্ধি, শ্রমিক অধিকার সংকোচন, কৌশলগত তথ্যঝুঁকি এবং আন্তর্জাতিক বিরোধের আশঙ্কা বাড়ে।
বিশ্বব্যাংকের একটি গবেষণা অনুযায়ী, বেসরকারীকরণে বন্দর পরিচালনার ব্যয় ২০–৪০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের অভিজ্ঞতায়ও দেখা গেছে, বিদেশি অপারেটরের নিয়ন্ত্রণে বন্দরের পরিচালনা সরাসরি স্থানীয় অর্থনীতিকে চাপের মুখে ফেলে। ভারতের মুন্দ্রা ও শ্রীলঙ্কার হামবানটোটা বন্দরে বিদেশি অপারেশনের অধীন কনটেইনার চার্জ ২০–৩০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে, যা ব্যবসায়িক ব্যয় ও প্রতিযোগিতায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
বাংলাদেশের অর্থনীতি ও বৈদেশিক বাণিজ্য দ্রুত সম্প্রসারিত হচ্ছে আর এই প্রবৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধি অপরিহার্য। তবে এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার সমাধান শুধু বিদেশি অপারেটরের ওপর নির্ভর করে সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন একটি সুসমন্বিত বহুমাত্রিক রোডম্যাপ; যেখানে অবকাঠামো উন্নয়ন, প্রযুক্তির আধুনিকায়ন, দক্ষ মানবসম্পদ গঠন এবং নীতিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার একসঙ্গে পরিকল্পিতভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। কাস্টমস প্রক্রিয়া, অপারেশনাল ব্যবস্থাপনা, শ্রমিক ব্যবস্থাপনা এবং পণ্য পরিবহন ও গুদামজাতকরণসহ সমগ্র লজিস্টিকস শৃঙ্খলকে আধুনিক ও কার্যকর করতে হবে একটি সমন্বিত পদ্ধতির মাধ্যমে।
চট্টগ্রাম বন্দরের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় সম্পদ নিয়ে তড়িঘড়ি করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ কোনোভাবেই কাম্য নয়। বিদেশি অপারেটর নিয়োগ–সংক্রান্ত চুক্তির শর্তাবলি, সম্ভাব্য লাভ-ক্ষতি ও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে মূল্যায়ন করা আবশ্যক। এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া হতে হবে খোলামেলা, অংশগ্রহণমূলক এবং
প্রতিযোগিতামূলক দরপত্রের ভিত্তিতে; যাতে দেশি ও বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো সমভাবে অংশগ্রহণ করতে পারে। একই সঙ্গে এ রকম একটি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সব অংশীজনের সঙ্গে পরামর্শ ও আলোচনার ভিত্তিতেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।
● গোলাম রসুল অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস, অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড টেকনোলজি, ঢাকা
* মতামত লেখকের নিজস্ব
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ব সরক র করণ ব শ বব য প রক র য় ক স টমস সরক র র র ওপর ন অবস থ ন অবক ঠ ম ক শলগত দ র বল র জন য অন য য় গ রহণ ক ষমত এনস ট
এছাড়াও পড়ুন:
চীনের উত্থান ও ভারতের সীমান্তবর্তী অঞ্চলের বাস্তবতা
মিয়ানমার ও বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের যুদ্ধ সম্ভাবনা ক্ষীণ; কিন্তু দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং পূর্ব এশিয়ার ত্রিসংযোগস্থলে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ভারতের সীমান্ত নিরাপত্তা জটিল করে তুলছে, ঠিক সেই সময়ে যখন চীন কৌশলগতভাবে ধীরে ধীরে এগোচ্ছে।
চলতি বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য মিজোরামের রাজধানী আইজলে একটি চমকপ্রদ রাজনৈতিক ঘটনা ঘটে। বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সীমানা ঘেঁষা এই রাজ্যে মিয়ানমারভিত্তিক দুটি জাতিগত বিদ্রোহী গোষ্ঠী একীভূত হওয়ার চুক্তি স্বাক্ষর করে। এ সময় উপস্থিত ছিলেন মিজোরামের মুখ্যমন্ত্রী লালদুহোমা।
চিনল্যান্ড কাউন্সিল (সিসি) কয়েক বছর ধরে মিয়ানমারের পশ্চিমাঞ্চলের চিন রাজ্যে সক্রিয় ছিল। ২০২১ সালে ইন্টেরিম চিন ন্যাশনাল কনসালটেটিভ কাউন্সিল (আইসিএনসিসি) গঠিত হয়। এটি গঠিত হয় মূলত সিসি-এর কিছু ভিন্নমতাবলম্বী অংশের উদ্যোগে। উভয় গোষ্ঠীই ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে– গণতান্ত্রিক সরকারকে সরিয়ে সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলকারী মিয়ানমারের জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে– লড়াই করেছে। মিজোরামের মুখ্যমন্ত্রী লালদুহোমা গণমাধ্যমকে জানান, চিনের জনগণের সংগ্রামে সহায়তা করাই ছিল তার উদ্দেশ্য। সেই উদ্দেশ্য থেকেই তিনি এই একত্রীকরণে ভূমিকা রাখেন। একীভূত সংগঠনের নাম রাখা হয়– চিন ন্যাশনাল কাউন্সিল (সিএনসি)।
ভারতের মিজোরামে মিজো, পার্শ্ববর্তী মণিপুরের কুকি, মিয়ানমারের চিন ও তার আশপাশের রাজ্যের চিন জনগণ এবং বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের বম সম্প্রদায় একই জাতিগোষ্ঠীর অংশ, যাদের সম্মিলিতভাবে ‘জো জনগোষ্ঠী’ (মিজো-কুকি-চিন সম্প্রদায়ের সমষ্টিগত নাম) বলা হয়। আন্তর্জাতিক ও প্রাদেশিক সীমারেখা দ্বারা বিভক্ত হলেও তাদের মধ্যে একটি গভীর জাতিগত বন্ধন বজায় আছে। তবে একটি ভারতীয় রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর পক্ষে মিয়ানমারের জাতিগত বিদ্রোহীদের ঐক্য গড়ার পদক্ষেপ নেওয়া নিঃসন্দেহে তাৎপর্যপূর্ণ। ২০২১ সালের অভ্যুত্থানের পর থেকে ভারত মিয়ানমার নিয়ে দ্বৈত নীতি অনুসরণ করে এসেছে। ভারত জান্তা সরকারকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি না দিলেও, কৌশলগত ও অর্থনৈতিক স্বার্থ বজায় রাখতে সম্পর্ক অব্যাহত রেখেছে। এ ক্ষেত্রে দিল্লিতে গণতান্ত্রিক বিরোধী পক্ষের সদস্যদের একটি সেমিনারে আমন্ত্রণ জানানোর ঘটনাও উল্লেখযোগ্য।
এই ঘটনার প্রেক্ষাপটে মণিপুর ও নাগাল্যান্ডের মেইতেই ও নাগা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর পক্ষ থেকে অভিযোগ ওঠে, ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর একটি অংশ মণিপুর ও মিয়ানমারভিত্তিক কুকি-চিন বিদ্রোহীদের সহায়তা করছে। এই কুকি-চিন বিদ্রোহীরা আক্রমণ চালাচ্ছে মিয়ানমারভিত্তিক মেইতেই ও নাগা বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলোর ওপর। মেইতেই ও নাগা বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলো আবার জান্তা সরকারের সঙ্গে সমন্বয় করে চলছে।
লালদুহোমার দলের পক্ষ থেকে মিয়ানমারের জো জনগণের প্রতি সমর্থন প্রকাশের ঘটনায় প্রশ্ন উঠেছে– ভারত কি জো জাতিগোষ্ঠীভুক্ত চিন বিদ্রোহীদের সঙ্গে সম্পর্ক আরও গভীর করছে, যে বিদ্রোহীরা বর্তমানে মিয়ানমার-ভারত সীমান্তবর্তী বিস্তীর্ণ অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ ধরে রেখেছে?
এপ্রিল মাসে থাইল্যান্ডের ব্যাংককে বিমসটেক সম্মেলনের ফাঁকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি মিয়ানমারের সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাইংয়ের সঙ্গে দেখা করেন। অভ্যুত্থানের পর তাদের প্রথম সাক্ষাৎ। এ সাক্ষাৎ জান্তা সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা অব্যাহত রাখার বার্তা দেয়। মিয়ানমারে চলমান অস্থিরতা ভারত ও চীনের মতো দেশগুলোর জন্য এক কূটনৈতিক সংকটে পরিণত। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশের পরিস্থিতি : ২০২৪ সালের আগস্টে ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে ভারতপন্থি শেখ হাসিনা সরকার উৎখাত হওয়া এবং তাতে ভারতের কৌশলগত পরিবেশ আরও জটিল হয়ে ওঠা।
বাংলাদেশ প্রসঙ্গে ভারত স্পষ্টভাবে হাসিনাপন্থি অবস্থান নিয়েছে। তিনি ও তাঁর দলের শীর্ষ নেতারা এখন ভারতের আশ্রয়ে রয়েছেন। এদিকে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান মুহাম্মদ ইউনূস এখন চীনঘেঁষা নীতি নিয়েছেন। চলতি বছরের মার্চ মাসে তাঁর চার দিনের চীন সফরসহ বিভিন্ন পদক্ষেপের মাধ্যমে তা স্পষ্ট। ঢাকা থেকে বিশ্লেষকরা বলছেন, ইউনূস সরকারের ওপর মার্কিন প্রভাবও বাড়ছে।
ভারতের ‘অ্যাক্ট ইস্ট’ নীতি সফল করতে মিয়ানমার ও বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক জরুরি। কারণ এই নীতি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে ভারতের সংযোগ জোরদারে ভূমিকা রাখবে। পাশাপাশি এটি সীমান্তবর্তী মিয়ানমার ও বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলোকে নিয়ন্ত্রণেও সহায়ক হতে পারে। তবে বাংলাদেশের ভেতরে ইসলামপন্থি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর পুনঃসংগঠনের ইঙ্গিত আসামে ও পশ্চিমবঙ্গে উদ্বেগ তৈরি করছে।
সতর্ক কৌশলের প্রয়োজন
ভারতের উত্তর-পূর্ব সীমান্ত এক জটিল ভূকৌশলগত এলাকা। যেখানে অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বিষয়াবলির সীমানা প্রায়ই একে অপরের সঙ্গে মিশে যায়। দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও পূর্ব এশিয়ার মিলনস্থলে অবস্থিত এই অঞ্চল। অঞ্চলটি জাতিগতভাবে বৈচিত্র্যময়, পরিবেশ ও ভূপ্রকৃতিগতভাবে সংবেদনশীল। রাজনৈতিকভাবেও জটিল। ফলে এখানে নিরাপত্তা, কৌশলগত ও মানবিক সমস্যা সব ঘনীভূত।
ভারতের পশ্চিম সীমান্তে মূল উদ্বেগ পাকিস্তান ও পাকিস্তান-সমর্থিত সন্ত্রাসবাদ। উত্তর-পূর্ব সীমান্তে খেলোয়াড় অনেক। তাদের স্বার্থও পরস্পরবিরোধী। বহু জাতিগোষ্ঠী ও রাষ্ট্রের স্বার্থ-সংঘাতে এই অঞ্চল প্রায় স্থায়ীভাবে উত্তেজনাপূর্ণ। ভারতে সম্ভবত আর কোনো অঞ্চলেই অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা জাতীয় নিরাপত্তার জন্য এতটা গুরুত্বপূর্ণ নয়।
সীমান্তবর্তী জাতিগোষ্ঠীর উপস্থিতি, তাদের জাতিগত আকাঙ্ক্ষা ও জাতীয় স্বার্থের মিশ্রণ এখানে জটিল আন্তঃসীমান্ত গতিশীলতা তৈরি করেছে। এই অঞ্চল সংঘাতপ্রবণ হয়ে উঠেছে, যার প্রভাব পুরো অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়তে পারে। ভূরাজনৈতিক দিক থেকে এখানে একটিও ভুল সিদ্ধান্ত বড় ক্ষতি ডেকে আনতে পারে।
২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থান হয়। পরে দমন-পীড়নের মধ্য দিয়ে শুরু হয় এই অনিশ্চয়তার নতুন অধ্যায়। গণতন্ত্রপন্থিরা ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট (এনইউজি) গঠন করে। এর সশস্ত্র শাখা পিপলস ডিফেন্স ফোর্স (পিডিএফ)। এটি জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করে। দেশটি জড়িয়ে পড়ে গৃহযুদ্ধে। মিয়ানমার সেনাবাহিনী ধীরে ধীরে ভারতের সীমান্তবর্তী অনেক অংশের নিয়ন্ত্রণ হারায়। মণিপুর ও মিজোরামের সীমানায় অবস্থিত চিন রাজ্যে সিএনএ, সিডিএফ ও কেএনএর মতো জো জনগোষ্ঠীর সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর ঘাঁটি লক্ষ্য করে বিমান হামলা শুরু করে জান্তা বাহিনী। এসব গোষ্ঠী পিডিএফের মিত্র হিসেবে নিজেদের জো জনগণের প্রতিনিধি বলে দাবি করে থাকে।
চিন রাজ্যে সংঘাত ছড়িয়ে পড়ার পর এর প্রভাব পড়ে ভারতে। মিজোরাম ও মণিপুরে শরণার্থী প্রবাহ শুরু হয়। মিজোরামে, যেখানে জো-জনগণ সংখ্যাগরিষ্ঠ, তাদের উষ্ণভাবে গ্রহণ করা হয়। কিন্তু মণিপুরে জো ও নাগা দুটি সংখ্যালঘু গোষ্ঠী। সংখ্যাগরিষ্ঠ মেইতেই জনগোষ্ঠী উদ্বেগ প্রকাশ করে বলে, শরণার্থী আগমনের ফলে রাজ্য জনসংখ্যার ভারসাম্য হারাচ্ছে। মেইতেই সম্প্রদায় অনুপ্রবেশকারী বহিষ্কারের দাবি তোলায় জো জনগোষ্ঠীর সঙ্গে তাদের উত্তেজনা বাড়ে।
২০২৩ সালের মে মাসে মেইতেই ও জো সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে ভয়াবহ জাতিগত সংঘাত শুরু হয়। পরবর্তী দুই বছরে প্রায় ৩০০ জনের প্রাণহানি ঘটে। এতে মেইতেই বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলোর পুনরুত্থানের আশঙ্কা তৈরি হয়। এই গোষ্ঠীকে এক সময় ভারত দমন করেছিল।
ভারতের মিয়ানমার সীমান্তে নেওয়া পদক্ষেপগুলোর বহুমুখী প্রভাব রয়েছে। অনুপ্রবেশ, মাদক ও অস্ত্র চোরাচালান এবং বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর চলাচল ঠেকাতে ভারত ‘ফ্রি মুভমেন্ট রেজিম’-এর পরিসর সীমিত করেছে। ‘প্রটেকটেড এরিয়া রেজিম’ পুনর্বহাল করেছে। সীমান্তে কাঁটাতার নির্মাণ শুরু করেছে। তবে এই পদক্ষেপগুলো জো ও নাগা জনগণের ঐতিহ্যবাহী আন্তঃসীমান্ত সম্পর্ক ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি করেছে।
ইম্ফলভিত্তিক এক সাংবাদিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এসব সিদ্ধান্তে মেইতেইদের মধ্যে সীমান্ত নিরাপত্তা ও জনসংখ্যাগত পরিবর্তন ঠেকানো নিয়ে আশ্বাস তৈরি হলেও, জো ও নাগা জনগণের অনুভূতিতে আঘাত লেগেছে। তা ছাড়া সীমান্ত অঞ্চলের বহু মানুষ অনানুষ্ঠানিক সীমান্ত বাণিজ্যের ওপর নির্ভরশীল।
বিদ্রোহীদের মোকাবিলা
২০২৫ সালের মে মাস নাগাদ পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে। নাগা বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট কাউন্সিল অব নাগালিমের (এনএসসিএন-আইএম) অন্যতম নেতা ইকাটো চিশি সিউ মিয়ানমারে চলে যান। যেখানে তিনি এইচ এস রামসান ও অ্যাবসালম রামান নেতৃত্বাধীন কট্টরপন্থি একটি বিদ্রোহী গোষ্ঠীতে যোগ দেন বলে জানা যায়। এই পদক্ষেপ নাগা শান্তি আলোচনাকে বিপদের মুখে ফেলে। একই সঙ্গে নাগা সশস্ত্র সংগ্রামের পুনরুত্থান নিয়েও উদ্বেগ তৈরি হয়।
এনএসসিএন-আইএম ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অন্যতম শক্তিশালী বিদ্রোহী গোষ্ঠী– যা নাগাল্যান্ডকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। এরা ঐতিহাসিকভাবে মিয়ানমারের নাগাল্যান্ড সীমান্তবর্তী এলাকায় সক্রিয়। ভারত থেকে স্বাধীনতার দাবিতে গঠিত হলেও, তারা ১৯৯৭ সাল থেকে ভারতের সঙ্গে যুদ্ধবিরতিতে রয়েছে। বর্তমানে তারা বৃহত্তর নাগাল্যান্ড দাবি করছে, যেখানে আসাম, মণিপুর ও অরুণাচল প্রদেশের কিছু অংশ অন্তর্ভুক্ত। তবে ওই তিন রাজ্যই এ দাবি প্রত্যাখ্যান করে আসছে।
২০২৪ সালে ভারতের জাতীয় তদন্ত সংস্থা (এনআইএ) এক আদালতে দাবি করে, এনএসসিএন-আইএমের মিয়ানমারভিত্তিক চীন-মিয়ানমার মডিউল নিষিদ্ধ মেইতেই বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন কাংলেই ইয়াউল কানবা লুপ (কেওয়াইকেএল) এবং পিপলস লিবারেশন আর্মিকে (পিএলএ) সহায়তা করে ভারতে অনুপ্রবেশ করাতে। যেন তারা জো জনগণের ওপর সন্ত্রাসী হামলা চালাতে পারে। কেওয়াইকেএল এবং পিএলএ মণিপুরের ইম্ফল উপত্যকাভিত্তিক সাতটি বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর মধ্যে অন্যতম। গোষ্ঠীগুলো ভারত থেকে আলাদা হতে চায়। মিয়ানমার ও বাংলাদেশে তাদের ঘাঁটি রয়েছে।
এনআইএর এই অভিযোগে নাগা ও মেইতেই উভয় গোষ্ঠীর মধ্যে ক্ষোভ দেখা দেয়। এনএসসিএন-আইএমের দাবি, ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী কুকিদের পক্ষ নিচ্ছে। এরপর ভারত সরকারের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক কিছুটা উন্নত হয়। তবে সিউর পদক্ষেপ আবারও অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে। অন্যদিকে যুদ্ধবিরতির বিরোধিতাকারী এনএসসিএন-কে (ইয়ুং অং) এখনও মিয়ানমারের নাগা স্বশাসিত অঞ্চলে সক্রিয় রয়েছে। এই অঞ্চল ভারতের নাগাল্যান্ড ও চীনের ইউনান প্রদেশের সীমান্তঘেঁষা।
মিয়ানমারের সাগাইং, চিন ও রাখাইন রাজ্যে ভারতের একাধিক বিচ্ছিন্নতাবাদী ও সশস্ত্র গোষ্ঠী সক্রিয় রয়েছে, যারা প্রায়ই মিয়ানমারের জাতিগত বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে কাজ করে। জো জনগোষ্ঠীর মধ্যে কুকি ন্যাশনাল আর্মি (কেএনএ) চিন ও সাগাইংয়ে সক্রিয়। এরা জান্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে কাচিন ইন্ডিপেনডেন্স আর্মিকে (কেআইএ) সহযোগিতা করে। কেআইএর সঙ্গে এনএসসিএনের ঐতিহাসিক সম্পর্ক রয়েছে। কেএনএ ও কেআইএ উভয়েরই রাখাইনভিত্তিক আরাকান আর্মির (এএ) সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে।
জোমি রেভলিউশনারি আর্মি (জেডআরএ) চিন ও সাগাইং অঞ্চল থেকে পরিচালিত হয় এবং মিয়ানমারের চিন ন্যাশনাল আর্মির (সিএনএ) সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে। সিএনএর সঙ্গে ভারতের মিজোরাম রাজ্যের মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্টের (এমএনএফ) ঐতিহাসিক সম্পর্ক রয়েছে। ২০২৩ সালে লালদুহোমার জোরাম পিপলস মুভমেন্টের (জেডপিএম) কাছে ক্ষমতা হারায় এমএনএফ। এমএনএফেরও আরাকান আর্মির সঙ্গে পুরোনো সম্পর্ক রয়েছে।
অন্যদিকে জোমি রেভলিউশনারি অর্গানাইজেশন (জেডআরও), যা চিন রাজ্যে সক্রিয়, তারা মিয়ানমারের সামরিক জান্তাকে সহযোগিতা করে। মণিপুরি বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন পিএলএ সাগাইংয়ে সক্রিয় এবং জান্তার সঙ্গে সম্পর্ক রাখে। আসামের বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী উলফা-ইন্ডিপেন্ডেন্টেরও (উলফা-আই) মিয়ানমারে ঘাঁটি রয়েছে। তারা বিদ্রোহবিরোধী কর্মকাণ্ডে জান্তা সরকারকে সহযোগিতা করে বলে জানা যায়।
ইম্ফলভিত্তিক সাংবাদিক প্রদীপ ফানজৌবমের মতে, মিয়ানমারে চলমান রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ভারতীয় বিদ্রোহী সংগঠনগুলোর পুনর্গঠনের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করেছে। অথচ সরকারের অবস্থান এখনও দ্বিধাগ্রস্ত। ‘আমরা নতুন নতুন সমীকরণ ও পুনর্গঠনের খবর পাচ্ছি,’ বলেন তিনি। ‘সরকার কী অনুমোদন করবে আর কী করবে না– তা এখনই ঠিক করতে হবে। অথচ এখনও আমরা সেই পুরোনো কৌশলই দেখছি। এক গোষ্ঠীকে ব্যবহার করে আরেক গোষ্ঠীকে দমন করার খেলা।’
একসময় ভারত ও মিয়ানমার যৌথ সামরিক অভিযান চালিয়ে এনএসসিএন-কে, উলফা-আই, পিএলএ, জেডআরএ এবং কেএনএর ঘাঁটি ধ্বংস করেছিল। বর্তমানে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ হ্রাস পাওয়ায় এ ধরনের যৌথ অভিযানের সুযোগ কম। পাশাপাশি ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের শীতলতাও সীমান্তবর্তী বিদ্রোহীদের দমন করতে বাংলাদেশের সহযোগিতার সম্ভাবনাকে ক্ষীণ করে তুলেছে।
চীনা চ্যালেঞ্জ
ভারত-চীন কূটনৈতিক সম্পর্কে কিছুটা উষ্ণতা এলেও সীমান্ত পরিস্থিতি এখনও উত্তেজনাপূর্ণ। উভয় দেশই প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখার (এলএসি) পাশে সামরিক ও নাগরিক অবকাঠামো নির্মাণ করছে। চীন সম্প্রতি অরুণাচল প্রদেশের সীমান্তসংলগ্ন অঞ্চলে ইয়ারলুং সাংপো নদীর ওপর ‘বিশ্বের বৃহত্তম বাঁধ’ নির্মাণের অনুমোদন দিয়েছে। ভারত আশঙ্কা করছে, এই বাঁধ ব্রহ্মপুত্র নদের পানিপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণে ব্যবহৃত হতে পারে।
মিয়ানমার ও বাংলাদেশে কৌশলগত প্রভাব বিস্তারে চীনের পদক্ষেপগুলোও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। চীন বাংলাদেশে তিস্তা নদীর পানি ব্যবহারসহ নানা কৌশলগত অবকাঠামো প্রকল্পে জড়িত হতে চাইছে। সেই সঙ্গে বঙ্গোপসাগর হয়ে ভারত মহাসাগরে প্রবেশাধিকার চাইছে। মিয়ানমারে চীনের উপস্থিতি এতটাই বেড়েছে যে গণতন্ত্রপন্থিরা জান্তা সরকারকে ‘চীনা ক্রীড়নক’ বলেও আখ্যায়িত করছে। কিছুটা পশ্চিমা সমর্থনও পাচ্ছে তারা।
চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) অংশ হিসেবে চীন-মিয়ানমার অর্থনৈতিক করিডোর (সিএমইসি) এখনও একটি মূল অগ্রাধিকার। কিয়াওকফিউ গভীর সমুদ্রবন্দরসহ অবকাঠামো প্রকল্পগুলোর মাধ্যমে চীনের ভারত মহাসাগরে প্রবেশাধিকার আরও সহজ হচ্ছে।
মিয়ানমার সরকার একটি আইন পাস করেছে– পাবলিক সিকিউরিটি সার্ভিসেস ল। এর মাধ্যমে মিয়ানমারে চীনা ব্যবসায়িক স্বার্থ রক্ষায় চীনের নিরাপত্তা বাহিনী সক্রিয় হতে পারবে। এমনকি দেশটি চীনা নববর্ষকে জাতীয় ছুটি হিসেবেও স্বীকৃতি দিয়েছে।
সম্ভবত এরই প্রতিদানস্বরূপ চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ৯ মে রাশিয়ার রাজধানী মস্কোতে মিয়ানমারের জান্তা নেতা সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাইংয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এই সাক্ষাৎ বোঝায়, চীন ও রাশিয়া তাদের পাশে রয়েছে। ভারতের এক গোয়েন্দা কর্মকর্তার মতে, এই সাক্ষাৎ রাশিয়ারও চীনের সঙ্গে মিয়ানমার ইস্যুতে অবস্থান সাযুজ্যের ইঙ্গিত দেয়। চীন ও রাশিয়া দুটোই মিয়ানমার জান্তার অস্ত্র সরবরাহকারী দেশ।
এর আগে চীন মিয়ানমারের বিদ্রোহী গোষ্ঠী মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্রেসি অ্যালায়েন্স আর্মিকে (এমএনসিএএ) শান রাজ্যের উত্তরাঞ্চলের লাশিও শহরটি জান্তার কাছে হস্তান্তরের জন্য রাজি করায়। এই শহর চীনের অর্থনৈতিক স্বার্থের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। চীন বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর কাছে অনুরোধ করেছে, তারা যেন সিএমইসির রুটের গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলো থেকে দূরে থাকে। তবে জান্তা সরকারের প্রতি চীনের স্পষ্ট সমর্থন বিদ্রোহী ও গণতন্ত্রপন্থি গোষ্ঠীগুলোর কাছে চীনের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতে পারে। অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলছেন, মিয়ানমারের কিছু অংশে চীনবিরোধী মনোভাব বাড়ছে ক্রমশ। v
সৌজন্যে: আউটলুক ম্যাগাজিন, ১ জুন ইস্যু