শুধু পিছিয়ে পড়া মানুষের জন্য নয়, দেশের ক্রান্তিলগ্নে অর্থনীতি বদলের যে আকাঙ্ক্ষা সবার মধ্যে তৈরি হয়েছিল, প্রস্তাবিত বাজেটে তা পূরণ হয়নি। যুব সমাজের জন্য কর্মসংস্থানমুখী যে বাজেট করা যেত, তা হয়নি। এ বাজেট জুলাই অভ্যুত্থানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। বাজেটটি সংস্কারের ধারণাকেও ধারণ করেনি। সরকার অর্থনীতি বিষয়ে সংস্কার কমিশনগুলোর প্রতি বিশ্বস্ত থাকেনি। এ বাজেট সংস্কারবিমুখ ও বৈষম্যমুখী বাজেট, যা হওয়ার কথা ছিল না। প্রত্যাশার বাজেট শেষ পর্যন্ত হতাশাজনক হয়েছে।

গতকাল বুধবার এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম আয়োজিত ‘জাতীয় বাজেট ২০২৫-২৬ : অবহেলিতরা কী পেয়েছে’ শীর্ষক আলোচনায় এসব কথা বলেন গবেষণা সংস্থা সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো এবং নাগরিক প্ল্যাটফর্মের আহ্বায়ক ড.

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। রাজধানীর গুলশানে লেকশোর হোটেলে এ আলোচনায় নাগরিক প্ল্যাটফর্মের অংশীজন, বেসরকারি সংস্থার প্রতিনিধি এবং ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ অংশ নেন।

ড. দেবপ্রিয় বলেন, কেউ কেউ হয়তো বলবেন– আমলারা বাজেট করেছে, পেশাজীবীরা সহযোগিতা করেনি। এখানে প্রশ্ন– নাগরিক সমাজ কী করেছে। নাগরিকদের দিক থেকে চাহিদার চাপ তৈরির ব্যর্থতা আছে। সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে নাগরিক সমাজ সরকারকে চাপ প্রয়োগ করতে পারত। এই ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে নির্বাচনের পর আগামী দিনের জন্য যে নেতৃত্ব আসবে, তাদের প্রতি চাপ অব্যাহত রাখতে হবে।

তিনি বলেন, বাজেটে কাঠামোগত সমস্যা আছে। আলোচনা ছাড়া করা হয়েছে। বাস্তবায়নে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতের বিষয়টিও পরিষ্কার নয়। এভাবে চললে দেশের ৮০ শতাংশ মানুষ যারা অবহেলিত, তারা উপেক্ষিত থাকে। ফলে আজকে যারা সচ্ছল, তারাও হুমকির মুখে পড়বে।

‘এক বছরে বিপ্লবী বাজেট দেওয়া সম্ভব নয়’– অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের এ মনোভাবের সমালোচনা করে অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আসা সরকারের কাছে প্রত্যাশা ছিল, তারা কিছু পরিবর্তনের সূচনা করবে। এ বাজেটে ছাঁচের কোনো পরিবর্তন করা হয়নি। পরোক্ষ করের আধিক্য কমেনি, যা অবহেলিত মানুষকে চাপে ফেলে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে বরাদ্দ বাড়ানোর দরকার ছিল, তা করা হয়নি। সামাজিক নিরাপত্তা খাতে অনেক কিছু ঢুকিয়ে আকার বড় করে দেখানো হয়েছে। 

তিনি বলেন, জাতীয় সক্ষমতা ও আত্মবিশ্বাস বাড়ানোর জন্য বাজেটে কোনো পদক্ষেপ নেই। জ্বালানি সক্ষমতা বাড়াতে উদ্যোগ নেই। উল্টো ট্রাম্প প্রশাসনকে ‘ম্যানেজ’ করতে গিয়ে আমদানি পণ্যে শুল্ক কমানো হয়েছে। কর বাড়ানো হয়েছে দেশে উৎপাদিত শিল্পপণ্যে।

সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এবার ভিন্নতর বাজেট করার সুযোগ হাতের মধ্যে পেয়েও সরকার ব্যর্থ হয়েছে। ঐতিহাসিক সুযোগটি ‘মিস’ নয়,  ‘লস’ হয়েছে।

গবেষণা সংস্থা সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, সরকারের কাছে হয়তো রাজনৈতিক সংস্কার বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে, অর্থনৈতিক সংস্কার নয়। ফলে সামষ্টিক অর্থনীতি এবং বিনিয়োগে অনিশ্চয়তা দূর করার পদক্ষেপ বাজেটে নেই। মানুষ অর্থনৈতিকভাবে চাপে আছে। তাদের জন্য কিছু নেই।  এবারের বাজেটে ভিন্ন কিছু করার সুযোগ ছিল। যুব শ্রেণিকে বিবেচনায় রেখে কর্মসংস্থান ও দারিদ্র্য বিমোচনমুখী করা যেত। পরোক্ষ কর নির্ভরতা কমানোর ব্যবস্থা থাকতে পারত।

অর্থনীতিবিদ জিয়া হাসান বলেন, আগের মতো ভুল তথ্যে ভর করে বাজেট করা হয়েছে। কিছুদিন আগেও বিবিএস বলেছে, এ বছরের প্রবৃদ্ধি হবে ৩ দশমিক ৩ শতাংশ। অথচ বাজেটে ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে ধরে নতুন লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে সাড়ে ৫ শতাংশ।

কর বিশেষজ্ঞ স্নেহাশীষ বড়ুয়া বলেন, চলতি বছরের বাজেটে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ছিল ৪ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা। অথচ এখন পর্যন্ত আদায় ৩ লাখ ২২ হাজার কোটি টাকা। এ টাকা দিয়ে সরকারের পরিচালন ব্যয় মেটানোর পর কী করে উন্নয়ন  হবে। এ ধারা থেকে বের হতে এ সরকারের উচিত ছিল পরিচালন ব্যয়ে লাগাম টানা।
আইসিএমএবির সভাপতি মাহতাব উদ্দিন আহমেদ বলেন, আগে স্বার্থান্বেষী মহলের চাপে রাজনৈতিক সরকার যে বাজেট করত, তা নিয়ে সমালোচনা হতো। এবার স্বার্থান্বেষী মহলের চাপ নেওয়ার কিছু ছিল না। কিন্তু বাজেট গতানুগতিক হয়েছে। 

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা ড. মাহদী আমিন বলেন, শিল্পে এখন স্থবিরতা। ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ নেই, পুঁজিবাজারেও নেই। কারও সঙ্গে আলোচনা না করেই বাজেট করা হয়েছে। জাতীয় নাগরিক পার্টির সামান্তা শারমিন বলেন, দেশের জনগোষ্ঠীর বড় অংশই অবহেলিত। তাদের জন্য এ বাজেট প্রত্যাশা পূরণ করে না। রূপান্তর ও জুলাই অভ্যুত্থানের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। সরকার আন্দোলনে যুক্তদের সঙ্গেও বাজেট প্রণয়নে আলোচনা করেনি।

জামায়াতের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য সাইফুল আলম খান বলেন, ‘আগে ঋণ করে ঘি খাওয়া হতো, এখন ঋণ করে ঋণ শোধ করার বাজেট হয়। বাসদ নেতা রাজেকুজ্জামান রতন বলেন, এ বাজেটের মাধ্যমে স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে, একটা সম্ভাবনা নষ্ট হয়েছে।

মূল প্রবন্ধে সিপিডির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, জাতীয় বাজেটে ‘কাউকে পেছনে না ফেলে’ উন্নয়নের যে অঙ্গীকার রয়েছে, বাস্তবে তা আংশিকভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ থাকলেও কাঠামোগত সংস্কার ও বাস্তবায়নে ঘাটতির কারণে প্রান্তিক মানুষের উন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব নিয়ে সংশয় রয়েছে।

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ব জ ট কর অবহ ল ত সরক র র ন বল ন র জন য

এছাড়াও পড়ুন:

চবির বিশেষ ভোজের টোকেনে অনাবাসিক শিক্ষার্থীরা ‘অতিথি’

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) বিভিন্ন আবাসিক হলে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি উদযাপন উপলক্ষ্যে আলোচনা সভা ও বিশেষ ভোজের আয়োজন করা হয়েছে। এতে আবাসিকদের শিক্ষার্থী বলা হচ্ছে এবং অনাবাসিকদের অতিথি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

এছাড়া, আবাসিকদের জন্য টাকার পরিমাণ কম ধরলেও অনাবাসিকদের জন্য বেশি ধরা হয়েছে। এ নিয়ে ক্ষোভ জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সচেতন শিক্ষার্থীরা।

জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শহিদ ফরহাদ হোসেন হলে উন্নত ভোজের টোকেন আবাসিকদের জন্য ১০০ টাকা ধরা হয়েছে। অপরদিকে, অতিথিদের জন্য ধরা হয়েছে ১৭০ টাকা; এই অতিথিরা হলেন হলের অনাবাসিক শিক্ষার্থী। শামসুন নাহার হলে আবাসিকদের জন্য ৮০ টাকা, অনাবাসিকদের জন্য ১৭০ টাকা। মিল পদ্ধতি চালু থাকা আমানত হলে আবাসিকদের জন্য ফ্রি হলেও অনাবাসিকদের জন্য ৭০ টাকা। তবে সোহরাওয়ার্দী হলে আবাসিক-অনাবাসিক সবার জন্যই ১৫৫ টাকা ধরা হয়েছে। 

আরো পড়ুন:

এসএসসিতে জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনা দিল শাবিপ্রবি প্রশাসন

চবিতে বিপ্লবী ছাত্র ঐক্যের আত্মপ্রকাশ

এদিকে, বিজয়-২৪ হলের প্রথম বিজ্ঞপ্তিতে আবাসিক-অনাবাসিক সবার জন্য ৮০ টাকা উল্লেখ করলেও দ্বিতীয় বিজ্ঞপ্তিতে অনাবাসিকদের জন্য ১৭০ টাকা ধরা হয়েছে। এভাবে অন্যান্য হলগুলোতেও একই অবস্থার কথা জানা গেছে। 

বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের শিক্ষার্থী জারিফ মাহমুদ বলেন, “৫ আগস্টের ফিস্ট নিয়ে হলে হলে বিশেষ খাবারের আয়োজন করছে, সেখানে আবাসিক-অনাবাসিক আলাদা করেছে। আমার প্রশ্ন হলো, প্রশাসনদের ছাত্র বা সন্তান কি শুধু আবাসিকরা? আমরা যারা অনাবাসিক, তারা কি বিশ্ববিদ্যালয়ে উড়ে এসেছি?”

তিনি প্রশাসনকে উদ্দেশ্য করে বলেন, “আপনারা আমাদের হলে সিট দিতে পারেননি, এটা আপনাদের ব্যর্থতা। এই আবাসিক-অনাবাসিক পরিচয় বন্ধ করুন। আয়োজন করলে সবার জন্য সমান করে আয়োজন করুন। আর সেটা না পারলে আয়োজন বন্ধ করুন।”

ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী নাঈম শাহ ফেসবুকে লেখেন, “কোনো একটা বিশেষ দিন এলেই দেখা যায়, হল প্রশাসনগুলোর আবাসিক শিক্ষার্থীদের বিশেষ করে দাঁড় করানোর ভণ্ডামি। ৫ তারিখে আয়োজনকে ঘিরে তারা আবার সেই অতিথি টার্ম সামনে নিয়ে আসছে। ফরহাদ হলে অনুষ্ঠান শেষে বিশেষ ভোজের আয়োজনের টোকেন আবাসিক শিক্ষার্থীদের জন্য ১০০ টাকা এবং অতিথিদের জন্য ১৭০ টাকা। বাকি হলগুলোতে বোধহয় তাই করেছে। কিন্তু এই অতিথিগুলোও তো বিশ্ববিদ্যালয়েরই শিক্ষার্থী।”

তিনি বলেন, “বাহির থেকে যে কয়েকজন শিক্ষার্থী আসবে, তাদের থেকে ৭০ টাকা করে বেশি না নিলে তো হল প্রশাসন দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছে না। আর আপনাদের যদি সামর্থ্য নাই থাকে, কাউকেই খাওয়ায়েন না। কিন্তু ৫ আগস্টের দিনকে কেন্দ্র করে করা অনুষ্ঠানে প্রিভিলেজড-আনপ্রিভিলেজড বিষয়টা জিইয়ে রাখাটা নিতান্ত নোংরামি লাগছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের এটা নিয়ে ভাবা উচিত।”

এ বিষয়ে শহিদ মো. ফরহাদ হোসেন হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. মো. আব্দুল মান্নান বলেন, “এ সিদ্ধান্তটি শুধু ফরহাদ হলের জন্য নয়, অন্যান্য হলেও এ সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়েছে। মূলত উন্নত ভোজের আয়োজনটি আবাসিক শিক্ষার্থীদের জন্য করা হয়েছে। তারপরেও কোনো অনাবাসিক শিক্ষার্থী বা কারো বন্ধুবান্ধব অংশ নিতে চাইলে পারবে। সেক্ষেত্রে তাদের জন্য টাকা বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। যেহেতু তাদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে কোনো বরাদ্দ দেওয়া হয়নি।”

বিশ্ববিদ্যালয়ে সব হল প্রাধ্যক্ষের উপস্থিতিতে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি।

ঢাকা/মিজান/মেহেদী

সম্পর্কিত নিবন্ধ