আমি কী পরব, কীভাবে বাঁচব তা বলার অধিকার কারো নেই: বাঁধন
Published: 24th, July 2025 GMT
পোশাক নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা ঘিরে দেশে শুরু হয়েছে তীব্র সমালোচনা। সামাজিক মাধ্যমে এই আদেশের বিরুদ্ধে উঠেছে অসংখ্য কণ্ঠ। এবার সেই কণ্ঠে যুক্ত হলেন অভিনেত্রী আজমেরী হক বাঁধন। বৃহস্পতিবার (২৪ জুলাই) সকালে ফেসবুকে দেওয়া এক আবেগঘন পোস্টে এ অভিনেতা ব্যক্তিগত লড়াই, সমাজের চাপ, পোশাক নিয়ে জাজমেন্ট এবং আত্মমুক্তির সাহসী অভিজ্ঞতা জানিয়েছেন।
‘আমি, আমার পোশাক ও সামাজিক বিচারের মাপকাঠি’ শিরোনামের সেই পোস্টে বাঁধন বলেন, “একসময় আমি ভারী মিষ্টি বাচ্চা একটা মেয়ে ছিলাম-মেধাবী, দয়ালু, এবং সবসময় সমাজের প্রত্যাশানুযায়ী পোশাক পরতাম। আমার বাবা-মা আমাকে যা পরতে বলতেন, সমাজ যা ‘শালীন’ বলে মনে করত-আমি তাই পরতাম। কিশোর বয়সে আমি কখনো জিন্স পরিনি, কারণ সমাজের চোখে এটা কেবল ‘বাজে মেয়েরা’ পরে।”
বাঁধন বলেন, “একটা পারফেক্ট মেয়ে হওয়ার জন্য মনস্থির করেছিলাম-সমাজ আমার কাছে যা চায়, তার সেরা ভার্সন। কিন্তু তারপর, আমার পৃথিবী ভেঙে পড়ল।”
আরো পড়ুন:
সঞ্জয় দত্তর সঙ্গে অন্তরঙ্গ দৃশ্য, মুখ খুললেন বিদ্যা
‘ভিউয়ের পেছনে ছুটতে ছুটতে আমরা যদি একটু থামতাম, একটু ভাবতাম’
ব্যক্তিগত ও ক্যারিয়ারের তিক্ত সময়ের স্মৃতিচারণ করে বাঁধন বলেন, “আমি ডিভোর্স চেয়েছিলাম-একটা অত্যাচারিত, বেদনাদায়ক বিবাহ থেকে যা দিনশেষে আমাকে পুনর্বাসন কেন্দ্রে ঠেলে দিয়েছিল। সেসময়ে অর্থাৎ ২০০৬ সালে লাক্স চ্যানেল আই সুপারস্টার প্রতিযোগিতায় অংশ নিই। সেই প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে নিজেকে আবিষ্কার করি-কেবল একজন নারী হিসেবে নয়, বরং একজন মানুষ হিসেবে। আমি তখনো লাজুক, তখনো সত্যবাদী ছিলাম-আমি আত্মবিশ্বাস অর্জন করতে শুরু করি এবং পুনরায় জীবনকে ভালোবাসতে শুরু করি। এ জন্য আমি সবসময় সেই সৌন্দর্য প্রতিযোগিতার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকব।”
পরের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বাঁধন বলেন, “তারপরও আমার মনে ‘শ্রেষ্ঠ নারী’ হওয়ার অভিলাষ ছিল, যা সমাজে প্রশংসা কুড়াতে পারে। তবে সেই সময়ে আমি জিন্স পরেছি। এমন পোশাক পরেছিলাম, যা আমার গায়ের রংকে ফুটিয়ে তোলে। এমন পোশাক, যা ‘ভদ্র মেয়েদের’ পরা উচিত ছিল না!”
দ্বিতীয় বিবাহবিচ্ছেদের সময়ের কথা উল্লেখ করে বাঁধন বলেন, “দ্বিতীয় বিবাহবিচ্ছেদের পর আমি কেবল ব্যর্থতার অনুভূতিই অনুভব করিনি, আমার মনে হয়েছিল যে সমাজ আমাকে সবচেয়ে ‘খারাপ নারী’ বলে চিহ্নিত করেছে। সেই তকমা আমার হৃদয় ভেঙে দিয়েছিল। আমি আমার পুরো জীবন ‘সেরা’ হওয়ার চেষ্টা করে কাটিয়েছি। কিন্তু বিস্ময়করভাবে সেই ব্যর্থতার মধ্যে দিয়ে সমাজ আমাকে যে ভূমিকা পালন করাতে চেয়েছিল, তার পরিবর্তে আমি একজন মানুষ হওয়ার সাহস পেয়েছি। আমি আমার অধিকারের দাবি তুলতে শুরু করি। আমি আমার স্বাধীনতার জন্য লড়াই শুরু করি।”
এক বন্ধুর কথা উল্লেখ করে বাঁধন বলেন, “একদিন এক বন্ধু ফোন করে বলল, ‘তুমি খুব বাস্তবসম্মত কথা বলো। তুমি খুব ভালো করছো, তবে তোমার আরো শালীন পোশাক পরা উচিত।’ কথা শুনে আমি হেসে ফেললাম।”
অন্য একটি ঘটনার কথা জানিয়ে ‘রেহানা মরিয়ম নূর’খ্যাত অভিনেত্রী বলেন, “একবার আমি এক টিভি সাক্ষাৎকারে স্লিভলেস ব্লাউজ পরে গিয়েছিলাম। চ্যানেল টিম আমাকে চুল দিয়ে কাঁধ ঢাকতে বলেছিল। তারা আমাকে বিরাট লেকচার দিয়েছিল। বছরের পর বছর, আমি কীভাবে পোশাক পরব সে সম্পর্কে অসংখ্য পরামর্শ পেয়েছিলাম, একজন মা হিসেবে, একজন ‘বিচক্ষণ নারী’ হিসেবে, একটি রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে হিসেবে।”
নিজেক স্বাধীন দাবি করে বাঁধন বলেন, “কিন্তু জানেন কি? আমার আর কিছু যায় আসে না। আমি স্বাধীন। আমাকে কী পরতে হবে, কী বলতে হবে, কী ভাবতে হবে বা কীভাবে বাঁচতে হবে—তা বলার অধিকার কারো নেই। এটা আমার সিদ্ধান্ত, একান্তই আমার।”
সমাজের বাস্তচিত্রের কথা স্মরণ করে বাঁধন বলেন, “এই ধরনের জাজমেন্ট আমাকে খুব হতাশ করে, বিরক্ত করে তোলে। কিন্তু এই ধরনের বাস্তবতার মুখোমুখি আমরা নারীরা প্রতিদিন হই। এই সমাজে মানুষের একটাই লক্ষ্য বলে মনে হয়: নারীদের সংশোধন করা। যেন এটাই স্বর্গের সবচেয়ে বিশুদ্ধ পথ!”
সবশেষে এই অভিনেত্রী বলেন, “কিন্তু আমার কথা শোনো, আমার বন্ধুরা-তোমরা যদি এসব বিশ্বাস করো, তাহলে তুমি একজন বোকা। বেহেশতের রাস্তা তোমার নিজের কর্মকাণ্ডের দ্বারাই প্রশস্ত হয়, অন্যের ওপর নজরদারি করে নয়; বিশেষ করে নারীদের কবজা করে নয়।”
প্রসঙ্গত, ইতিমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পোশাক সংক্রান্ত নির্দেশনা গভর্নরের নির্দেশে প্রত্যাহার করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার (২৪ জুলাই) গণমাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে এ সংক্রান্ত একটি বিবৃতি পাঠানো হয়েছে।
ঢাকা/রাহাত/শান্ত
.উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর চলচ চ ত র প শ ক পর
এছাড়াও পড়ুন:
৫০ শয্যার থানচি হাসপাতাল চলছে একজন চিকিৎসকে
বান্দরবানের থানচি উপজেলার প্রায় ৩০ হাজার মানুষের একমাত্র ভরসার জায়গা ৫০ শয্যার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসক, নার্স ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির সংকটে এই হাসপাতাল কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। বর্তমানে পুরো হাসপাতাল চালাচ্ছেন মাত্র একজন চিকিৎসক। গত পাঁচবছরে চিকিৎসাধীন ও রেফার্ড করা ২৪ জন রোগী মারা গেছেন।
হাসপাতাল সূত্র জানায়, ১৯৯৫ সালে ৩১ শয্যার থানচি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স যাত্রা শুরু করে। পরে এটি ৫০ শয্যায় উন্নীত হয়। এই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১২ জন চিকিৎসক থাকার কথা থাকলেও কর্মরত আছেন মাত্র দুইজন। তাদের মধ্যে একজন ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন। এ কারণে রোগীদের সেবা দিতে পারছেন না। ১৮ জন নার্স পদে রয়েছেন মাত্র চারজন। চারজন মিডওয়াইফ থাকার কথা, নেই একজনও।
আরো পড়ুন:
ফরিদপুরে পাগলা ঘোড়ার কামড়ে আহত ২০
বক্তব্য দেওয়ার সময় অসুস্থ হয়ে পড়লেন কাদের সিদ্দিকী
প্রাথমিক থেকে শুরু করে জরুরি চিকিৎসার জন্য এই হাসপাতালে ছুটে যান পাহাড়ি ও বাঙালিরা। তাদের অভিযোগ, হাসপাতালটি ৫০ শয্যায় উন্নীত হলেও আধুনিক চিকিৎসা সুবিধা যোগ হয়নি। প্রয়োজনীয় সংখ্যক চিকিৎসক না থাকায় গর্ভবতী নারী, শিশু ও বৃদ্ধ রোগীরা সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়ছেন।
দুর্গম এলাকার রোগীরা অনেক সময় নদীপথ কিংবা পাহাড়ি রাস্তা পাড়ি দিয়ে হাসপাতালে এলেও কাঙ্ক্ষিত চিকিৎসা সেবা পান না। বরং তাদের বান্দরবান সদর হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। অনেক সময় বান্দরবানে যাওয়ার পথে রোগীরা মারা যান। এ কারণে জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসক, নার্স ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সরবরাহের দাবি জানিয়েছেন তারা।
হাসপাতালের পরিসংখ্যানবীদ পঙ্কজ বড়ুয়া জানান, ২০২০ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত এখানে ভর্তি হয়েছেন ৫ হাজার ১৯৮ জন রোগী। এর মধ্যে ৪৫৬ জনকে রেফার্ড করা হয় বান্দরবান সদর হাসপাতালে। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন ১৭ জন রোগী।
থানচি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অ্যাম্বুলেন্স চালক মংক্যসিং মারমা বলেন, “২০১৯ সালে চাকরিতে যোগদান করার পর থেকে অন্তত সাতজন রেফার্ড করা রোগী মাঝপথে আমার গাড়িতেই মারা গেছেন।”
শৈসাই মং মারমা তিন বছর আগে বিনা চিকিৎসায় তার মাকে মারা যেতে দেখেছেন। তিনি জানান, তার মা শৈমেপ্রু মারমা (৩৪) অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। ২০২২ সালের ১৪ নভেম্বর হঠাৎ তিনি অচেতন হয়ে পড়েন। রেমাক্রী বাজার থেকে নদীপথে থানচি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান মাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাকে জেলা সদর হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। ভাড়া গাড়িতে জেলা হাসপাতালে যাওয়ার সময় চিম্বুক বারো মাইল এলাকায় তার মা মারা যান।
লেংরু ম্রো নামে চার সন্তানের মা হারিয়েছেন স্বামীকে। তিনি জানান, তার স্বামী রেং য়ুং ম্রো (৪৫) কিডনি জটিলতা নিয়ে থানচি হাসপাতালে যান। সঙ্গে সঙ্গে সেখান থেকে তাকে বান্দরবান সদর হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। থানচি থেকে বান্দরবান যাওয়ার মাঝপথে মারা যান তার স্বামী।
স্থানীয় বাসিন্দা মংমে মারমা বলেন, “হাসপাতালে চিকিৎসক, ওষুধ ও যন্ত্রপাতির সংকট দীর্ঘদিন ধরেই চলছে। বিশেষজ্ঞ ডাক্তার বদলি হলেও অনেকেই থানচিতে যোগ দেন না, ডিপুটেশনে থেকে যান সদর হাসপাতালে। ফলে এ অঞ্চলের পাহাড়ি ও বাঙালি প্রায় ৩০ হাজার মানুষ স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।”
রিয়েং ম্রো নামে অপর বাসিন্দা বলেন, “পাহাড়ে বসবাসকারীদের অধিকাংশ গরিব। জেলা সদর হাসপাতালে রোগী নিয়ে যাওয়া ব্যয়বহুল ও কষ্টকর। রেমাক্রি, বড় মোদক, তিন্দু থেকে থানচি সদরে রোগী আনতেই অনেক টাকা খরচ হয়ে যায়। এরপর আবার বান্দরবান সদর হাসপাতালে রেফার্ড করলে সাধারণ মানুষ কীভাবে চিকিৎসা করাবে?”
থানচি উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা (ইউএইচএফপিও) ডা. মো. ওয়াহিদুজ্জামান মুরাদ বলেন, “বর্তমানে হাসপাতালে আমিসহ দুইজন চিকিৎসক রয়েছেন। একজন ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসাধীন। তিন রোগীদের সেবা দিতে পারছেন না। ফলে পুরো হাসপাতাল পরিচালনার দায়িত্ব আমাকে একাই সামলাতে হচ্ছে।”
তিনি আরো বলেন, “জনবল ও সরঞ্জাম সংকটের কারণে গুরুতর রোগীদের রেফার্ড করা ছাড়া উপায় থাকে না। দীর্ঘ পথের কারণে অনেকেই জীবিত অবস্থায় সদর হাসপাতালে পৌঁছাতে পারেন না।”
বান্দরবান জেলা সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ শাহীন হোসাইন চৌধুরী বলেন, “শুধু বান্দরবান নয়, পুরো তিন পার্বত্য জেলাতেই চিকিৎসক সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। নতুন করে ৪৮তম বিসিএসের ডাক্তার পদায়ন না হওয়া পর্যন্ত এই সংকট পুরোপুরি সমাধান করা সম্ভব হচ্ছে না। তারপরও বিভাগীয় প্রধানকে বিষয়টি চিঠির মাধ্যমে জানানো হয়েছে। ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের আট-দশজন চিকিৎসককে বান্দরবানে বদলি করার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।”
ঢাকা/মাসুদ