থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়া—দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এই দুই প্রতিবেশী দেশের সীমান্ত বরাবর সংঘাতের এক দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। দীর্ঘ বনভূমিবেষ্টিত এই সীমান্তের কিছু অংশ নিয়ে উভয় দেশেরই দাবি রয়েছে। অতীতেও, বিশেষত ২০০৮ ও ২০১১ সালে, গুরুতর গোলাগুলিতে ৪০ জনের প্রাণহানি হয়েছিল। তবে সেই সংঘাতগুলো তুলনামূলকভাবে দ্রুত শান্ত হয়েছিল। এমনকি চলতি বছরের মে মাসেও, কম্বোডিয়ার এক সৈনিক নিহত হওয়ার পর উভয় পক্ষকে সহিংসতা প্রতিরোধে আগ্রহী দেখা গেছে এবং উত্তেজনা কমাতে উভয় দেশের সেনা কমান্ডারদের মধ্যে বৈঠকও হয়েছে।

কিন্তু গত বৃহস্পতিবার সেই শান্ত অবস্থা বিস্ফোরিত হয়েছে। থাই কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, শুক্রবারও লড়াই চলতে থাকায় অন্তত ১৫ জন নিহত হয়েছেন, যার মধ্যে একজন ছাড়া সবাই বেসামরিক নাগরিক। কম্বোডিয়ায়ও একজন বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন বলে জানা গেছে। গত বুধবার একটি ল্যান্ডমাইন বিস্ফোরণে পাঁচ থাই সেনা আহত হওয়ার পর এবারের উত্তেজনা বড় আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। প্রশ্ন উঠছে, দুই দেশের মধ্যে এই সীমান্ত সংঘাতের নেপথ্যে আসলে কী?

উত্তেজনা বৃদ্ধির পেছনের মূল কারণ হিসেবে দেখা হচ্ছে গত মাসে দুই দেশের সম্পর্কের অবনতিকে। কম্বোডিয়ার জ্যেষ্ঠ নেতা হুন সেন থাই প্রধানমন্ত্রী পেতোংতার্ন সিনাওয়াত্রাকে চরমভাবে বিব্রত করেছেন বিতর্কিত সীমান্ত নিয়ে তাদের মধ্যে একটি ফোনালাপ ফাঁস করে। এই ফোনালাপে পেতোংতার্ন হুন সেনকে ‘চাচা’ বলে সম্বোধন করেন এবং তাঁর নিজের একজন সামরিক কমান্ডারের সমালোচনা করেন, যা থাইল্যান্ডে ব্যাপক জনরোষ সৃষ্টি করে। ফলে পেতোংতার্নকে প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে বরখাস্ত করা হয়।

কেন হুন সেন এমন একটি স্পর্শকাতর ফোনালাপ ফাঁস করার সিদ্ধান্ত নিলেন তা এখনো স্পষ্ট নয়। অথচ দুই পরিবারের মধ্যে কয়েক দশক ধরে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান। তাহলে কেন সেই দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক নষ্ট করলেন তিনি?

অনেক বিশ্লেষক পেতোংতার্নকে এই কথোপকথনের জন্য দোষারোপ করছেন। হয়তো তিনি বিশ্বাস করেছিলেন যে, তাঁর বাবা, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী থাকসিন সিনাওয়াত্রার সঙ্গে হুন সেনের বন্ধুত্বের সূত্র ধরে তিনি দুই দেশের মতবিরোধগুলো সমাধান করতে পারবেন। উল্লেখ্য, অতীতে থাকসিনের বিরোধীরা এই বন্ধুত্বকে ব্যবহার করে তাঁর বিরুদ্ধে কম্বোডিয়ার স্বার্থকে থাইল্যান্ডের স্বার্থের উপরে স্থান দেওয়ার অভিযোগ এনেছিল।

এই মুহুর্তে যা রহস্য রয়ে গেছে তা হলো, কেন হুন সেন এই বন্ধুত্ব নষ্ট করার এবং এই সংঘাতকে উসকে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। হয়তো এর পেছনে ছিল এই বছর স্ক্যাম সেন্টারগুলোতে চাপ সৃষ্টির জন্য থাইল্যান্ডের সিদ্ধান্ত, অথবা জুয়াকে বৈধ করার থাকসিনের উচ্চাকাঙ্ক্ষা, যা কম্বোডিয়ার লাভজনক ক্যাসিনো শিল্পকে হুমকির মুখে ফেলেছিল। অথবা হয়তো এখানে আরও সরল কোনো ব্যাপার ঘটেছে।

এই ফোনালাপ ফাঁস সিনাওয়াত্রা পরিবারকে সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিতভাবে হতবাক করে দিয়েছে। থাকসিন ও পেতোংতার্ন উভয়ের প্রতিক্রিয়া থেকে মনে হচ্ছে তারা বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয়েছেন। এর মধ্য দিয়ে দুই দেশের মধ্যে ক্রমবর্ধমান তিক্ত বাকযুদ্ধ শুরু হয়েছে। তবে এটি কেবল কথার চেয়েও বেশি কিছু। থাই পুলিশ থাইল্যান্ডে প্রভাবশালী কম্বোডিয়ান ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে, যাদের বিরুদ্ধে জুয়া ও প্রতারণার সাম্রাজ্য গড়ে তোলার অভিযোগ রয়েছে।

পিছু হটার পরিবর্তে, কম্বোডিয়ার হুন সেন থাইল্যান্ড এবং বিশেষ করে সিনাওয়াত্রা পরিবারের বিরুদ্ধে বাগাড়ম্বর বাড়ানোর সুযোগটি লুফে নিয়েছেন বলে মনে হচ্ছে। তিনি দাবি করেছেন যে তার কাছে গোপন নথি রয়েছে, যা প্রকাশ পেলে থাকসিন ফেঁসে যেতে পারেন এবং প্রমাণ হতে পারে যে তিনি রাজতন্ত্রের অপমান করেছেন। থাইল্যান্ডে এটি একটি বড় অপরাধ, যার জন্য কারাদণ্ডও হতে পারে। এর প্রতিক্রিয়ায় থাই সরকার বুধবার কম্বোডিয়ান রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কার করেছে এবং নিজেদের দূতকে প্রত্যাহার করে নিয়েছে, যা সর্বশেষ সংঘাতের ক্ষেত্র তৈরি করেছে।

বর্তমানে কোনো পক্ষই পিছু হটতে রাজি বলে মনে হচ্ছে না। উভয় দেশের নেতৃত্বেই আপস করার মতো প্রয়োজনীয় শক্তি ও আত্মবিশ্বাসের অভাব দেখা যাচ্ছে।

কম্বোডিয়ায় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এসেছেন সাবেক শক্তিশালী নেতা হুন সেনের অনভিজ্ঞ পুত্র হুন মানেট, যার মধ্যে পিতার মতো কর্তৃত্ব দেখানোর শক্তি নেই। ফলে মনে হচ্ছে হুন সেনই এই সংঘাতকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে ইচ্ছুক। অন্যদিকে, থাইল্যান্ডে থাকসিনের দলকে কেন্দ্র করে গঠিত দুর্বল জোট সরকার স্থবির অর্থনীতি এবং মার্কিন নিষেধাজ্ঞার হুমকির কারণে বিপর্যস্ত। এই অবস্থায় তারা কম্বোডিয়ার মোকাবিলায় কোনো দুর্বলতা দেখাতে পারছে না।

কম্বোডিয়ার অর্থনীতিও বর্তমানে খারাপ সময় পার করছে। কোভিড-১৯ মহামারির ধাক্কা তারা এখনো পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারেনি। অপহরণ ও প্রতারণার শিকার হওয়ার আশঙ্কায় চীনা পর্যটকদের অনুপস্থিতির কারণে কম্বোডিয়ার অর্থনীতির অন্যতম স্তম্ভ পর্যটন খাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। উপরন্তু, থাইল্যান্ডের মতো কম্বোডিয়ার অর্থনীতিও এখন সম্ভাব্য মার্কিন নিষেধাজ্ঞার হুমকির মুখে।

তবে উভয় দেশেই হুন সেন এবং থাকসিনের মতো অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ রয়েছেন, যারা যখন প্রস্তুত থাকবেন, তখন এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার একটি উপায় খুঁজে বের করতে পারবেন। একই সাথে, আসিয়ানের অন্যান্য সদস্য রাষ্ট্রগুলো এই সংঘাতে হস্তক্ষেপ করে উভয় দেশকে উত্তেজনা কমাতে রাজি করাতে চেষ্টা করে কিনা, তাও দেখার বিষয়। সদস্য দেশগুলোর মধ্যে সংঘাত এড়ানোই আসিয়ান গঠনের প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল। ফলে এ মুহূর্তে আসিয়ানের কিছু দেশের জন্য এই দুটি দেশকে সংঘাত নিরসনে সহায়তা করা একটি অগ্রাধিকার হওয়া উচিত।

তবে এই মুহুর্তে যা রহস্য রয়ে গেছে তা হলো, কেন হুন সেন এই বন্ধুত্ব নষ্ট করার এবং এই সংঘাতকে উসকে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। হয়তো এর পেছনে ছিল এই বছর স্ক্যাম সেন্টারগুলোতে চাপ সৃষ্টির জন্য থাইল্যান্ডের সিদ্ধান্ত, অথবা জুয়াকে বৈধ করার থাকসিনের উচ্চাকাঙ্ক্ষা, যা কম্বোডিয়ার লাভজনক ক্যাসিনো শিল্পকে হুমকির মুখে ফেলেছিল।

অথবা হয়তো এখানে আরও সরল কোনো ব্যাপার ঘটেছে: এশিয়ার সবচেয়ে ধূর্ত রাজনৈতিক জীবিতদের একজন (হুন সেন) একটি ম্যাকিয়াভেলিয়ান পদক্ষেপ নিয়েছেন। তিনি থাইল্যান্ডে নিজের বেশিরভাগ প্রভাব হারানো এক মিত্রকে (থাকসিন) ত্যাগ করেছেন, একই সাথে নিজের জনগণের চোখে নিজের জাতীয়তাবাদী পরিচয়কে উজ্জ্বল করেছেন।

জোনাথন হেড বিবিসি নিউজের দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার সংবাদদাতা

বিবিসি নিউজ থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনুবাদ

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: কম ব ড য এই স ঘ ত বন ধ ত ব কর ছ ন র জন য

এছাড়াও পড়ুন:

নিউ ইয়র্কে নিহত বাংলাদেশি পুলিশ কর্মকর্তা সম্পর্কে যা জানা গেলো

যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কের সেন্ট্রাল ম্যানহাটনে একটি বহুতল অফিসে বন্দুক হামলায় নিহত হয়েছেন নিউ ইয়র্ক পুলিশের কর্মকর্তা দিদারুল ইসলাম (৩৬)। জানা গেছে, তিনি বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত অভিবাসী ছিলেন। খবর রয়টার্সের।

নিহত কর্মকর্তা দিদরুল ইসলামকে একজন ‘বীর বাংলাদেশি অভিবাসী’ হিসেবে উল্লেখ বর্ণনা করেছেন নিউ ইয়র্কের মেয়র এবং নিউ ইয়র্কের পুলিশ কমিশনার। তারা বলেছেন, ওই কর্মকর্তা নিজের জীবন ঝুঁকিতে ফেলে অন্যদের জীবন রক্ষা করেছিলেন।

সোমবার ম্যানহাটনের মিডটাউন অফিস টাওয়ারের ভেতরে এক বন্দুকধারী হামলা চালিয়ে পুলিশ কর্মকর্তা দিদারুল ইসলাম (৩৬) সহ চারজনকে হত্যা করে। হামলাকারী পরবর্তীতে আত্মহত্যা করেছে বলে পুলিশ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

আরো পড়ুন:

পুতিনকে এবার ১২ দিনের আল্টিমেটাম দিলেন ট্রাম্প

নিউ ইয়র্কে বন্দুকধারীর গুলিতে নিহত ৪

নিউ ইয়র্কের মেয়র এরিক অ্যাডামস এক প্রেস ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের বলেন, “ভয়াবহ একটি বন্দুক সহিংসতার ঘটনায় আমরা চারটি প্রাণ হারিয়েছি, যার মধ্যে নিউ ইয়র্ক সিটি পুলিশ বিভাগের একজন সদস্য ‘অফিসার ইসলাম’ রয়েছেন। 

অ্যাডামস জানান, নিহত অফিসার তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে নিউ ইয়র্ক পুলিশে কর্মরত ছিলেন এবং তিনি বাংলাদেশ থেকে আসা একজন অভিবাসী।

মেয়র বলেন, “হামলার সময় অফিসার ইসলাম অন্যদের জীবন রক্ষা করছিলেন, তিনি নিউ ইয়র্কবাসীদের রক্ষা করছিলেন। তিনি এই শহরকে ভালোবাসতেন এবং আমরা যাদের সাথে কথা বলেছি তারা সবাই বলেছেন যে, তিনি একজন সৎ মানুষ ও ঈশ্বরে বিশ্বাসী ব্যক্তি ছিলেন।”

মেয়র আরো জানিয়েছেন, সোমবার রাতে তিনি অফিসর ইসলামের পরিবারের সঙ্গে দেখা করেছেন। 

মেয়র আরো বলেন, “আমি তাদেরকে বলেছি, অফিসার ইসলাম একজন একজন বীর এবং আমরা তার ত্যাগের প্রশংসা করি।”

নিউ ইয়র্কের পুলিশ কমিশনার জেসিকা টিশ সংবাদ সম্মেলনে জানান, অফিসার ইসলাম বিবাহিত ছিলেন এবং তার দুটি সন্তান ছিল। তার স্ত্রী তৃতীয় সন্তানের মা হতে চলেছেন।

পুলিশ কমিশনার বলেন, “অফিসার ইসলাম নিজেকে ঝুঁকির মুখে ফেলেছিলেন। তিনি চূড়ান্ত ত্যাগ স্বীকার করেছিলেন, তাকে ঠান্ডা মাথায় গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল।”

ঢাকা/ফিরোজ

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • সব্যসাচী কাজী মোতাহার হোসেন বিজ্ঞান ও শিল্পের মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন
  • স্কিন ব্যাংকে পর্যাপ্ত ত্বক থাকলে ৪০ শতাংশের বেশি দগ্ধ রোগীকেও বাঁচানো যায়
  • রাগ নিয়ন্ত্রণে হাদিসের ৭ উপদেশ
  • চুলে গুঁজে দিলেন ৭১১ গলফ ‘টি’
  • বাবা হারালেন চিত্রনায়িকা মিষ্টি জান্নাত
  • ‘নতুন একটি দলের কয়েকজন মহারথী’ বলার পর বক্তব্য বদলালেন উপদেষ্টা মাহফুজ আলম
  • ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ট্রেনে কাটা পড়ে একজনের মৃত্যু
  • ভাসানীরা না থাকলে শেখ মুজিব কখনো তৈরি হতেন না: নাহিদ
  • কাভার্ড ভ্যানের পেছনে ধাক্কা দিয়ে দুমড়েমুচড়ে গেল যাত্রীবাহী বাস
  • নিউ ইয়র্কে নিহত বাংলাদেশি পুলিশ কর্মকর্তা সম্পর্কে যা জানা গেলো