পাল্টা শুল্ক কমিয়ে আনা আশাব্যঞ্জক, তবে আত্মতুষ্টির কোনো সুযোগ নেই
Published: 1st, August 2025 GMT
বাংলাদেশি পণ্য রপ্তানিতে যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের আরোপ করা পাল্টা শুল্কের হার ৩৫ থেকে কমিয়ে ২০ শতাংশে আনা রপ্তানি খাতের জন্য একটি ইতিবাচক ও স্বাগতযোগ্য পদক্ষেপ।
নতুন এ হারের সংশোধন যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্কের কাঠামোর একটি বৃহত্তর পুনর্বিন্যাসের অংশ হিসেবে এসেছে, যা দেশটির অনেক বাণিজ্যিক অংশীদারের ওপর প্রযোজ্য বলে মনে হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, শ্রীলঙ্কার জন্য হার কমিয়ে ২০ শতাংশ করা হয়েছে (আগে ছিল ৩০ শতাংশ), পাকিস্তানের হার কমে হয়েছে ১৯ শতাংশ (আগে ছিল ২৯ শতাংশ)। বাংলাদেশের অন্যান্য প্রতিযোগী, যেমন ভিয়েতনাম ও ভারতের ক্ষেত্রে ট্যারিফ হার বর্তমানে যথাক্রমে ২০ শতাংশ ও ২৫ শতাংশ।
এ প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশি পণ্যে ওপর পাল্টা শুল্কের নতুন হার এখন প্রতিযোগী দেশগুলোর সঙ্গে তুলনামূলকভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ, যা বাণিজ্যবিচ্যুতির ঝুঁকি হ্রাসের ইঙ্গিত দেয়। বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাতে রপ্তানিতে বড় ধরনের বিঘ্নের ঝুঁকি কমে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি করে।
অবশ্য বৈশ্বিক বাণিজ্য প্রেক্ষাপটে একটি গুরুত্বপূর্ণ অনিশ্চয়তা এখনো রয়ে গেছে, যেহেতু চীনের ওপর পাল্টা শুল্কের হার এখনো চূড়ান্ত হয়নি। বৈশ্বিক উৎপাদনব্যবস্থায় চীনের গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান এবং বাংলাদেশের সঙ্গে বিভিন্ন রপ্তানি খাতের প্রতিযোগিতামূলক মিল থাকায় যুক্তরাষ্ট্র চীনের জন্য কী হার নির্ধারণ করে, সেটি ভবিষ্যতের বৈশ্বিক বাণিজ্যপ্রবাহ গঠনে মুখ্য ভূমিকা পালন করবে। যদি চীনের ওপর উচ্চ শুল্ক আরোপ করা হয়, তাহলে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রপ্তানিকারক দেশগুলোর অনুকূলে চাহিদার সঞ্চালন ঘটতে পারে। অন্যদিকে যদি চীন অপেক্ষাকৃত অনুকূল হারে সুবিধা পায়, তাহলে প্রতিযোগিতা আরও তীব্র হতে পারে। সুতরাং চীনের জন্য চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত বৈশ্বিক বাণিজ্য গতি–প্রকৃতি পুনঃসংগঠনে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।
পাল্টা শুল্ক কমে ২০ শতাংশ হওয়ায় স্বল্প মেয়াদে স্বস্তি এনে দিয়েছে। তবু এটি এ প্রশ্নও উত্থাপন করে যে বাংলাদেশ এর বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্রকে কী দিয়েছে। কিছু প্রতিশ্রুতি, যেমন গম, তুলা ও বিমান আমদানির চুক্তি ইতিমধ্যেই প্রকাশ পেয়েছে। তবে যুক্তিসংগতভাবে বলা যায় যে আরও কিছু সংবেদনশীল প্রতিশ্রুতি হয়তো গোপনীয়তা চুক্তির আওতায় দেওয়া হয়েছে, যা নিকট ভবিষ্যতে জনসমক্ষে আসার সম্ভাবনা নেই। এ পরিস্থিতি বাংলাদেশের বাণিজ্য কূটনীতিতে অধিক স্বচ্ছতা, নজরদারি ও দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত পরিকল্পনার প্রয়োজনীয়তা স্পষ্টভাবে তুলে ধরে।
এ অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হিসেবে কাজ করে। এটি স্পষ্ট করে দেয় যে দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যকাঠামোতে আরও বেশি স্থিতিশীলতা ও সহনশীলতা তৈরি করা এখন সময়ের দাবি। এ অভিজ্ঞতা থেকে তিনটি কৌশলগত অগ্রাধিকার স্পষ্টভাবে উঠে আসে। প্রথমত, বাংলাদেশকে রপ্তানি পণ্যের বৈচিত্র্য ও নতুন বাজারে প্রবেশের প্রচেষ্টা আরও জোরদার করতে হবে। একটি সংকীর্ণ পণ্যভিত্তিক ও কিছু নির্দিষ্ট গন্তব্যনির্ভর রপ্তানিকাঠামো, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর অতিনির্ভরতা, বাংলাদেশের অর্থনীতিকে অপ্রয়োজনীয় ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেয়।
দ্বিতীয়ত, বাণিজ্য, কর ও বিনিয়োগ নীতিতে কার্যকর সংস্কার প্রয়োজন, যাতে প্রতিযোগিতা বাড়ে এবং দীর্ঘমেয়াদি বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট হয়। নিয়ন্ত্রক ও ব্যবসাবান্ধব পরিবেশের উন্নয়ন বাংলাদেশকে আরও স্থিতিশীল ও আকর্ষণীয় বাণিজ্য অংশীদার হিসেবে গড়ে তুলবে। তৃতীয়ত, বাংলাদেশকে এখন এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার উদীয়মান অর্থনীতিগুলোর সঙ্গে লক্ষ্যভিত্তিক মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি অনুসন্ধান করা উচিত। এ ধরনের চুক্তি ভবিষ্যতের সংরক্ষণবাদী চাপ থেকে সুরক্ষা প্রদান করতে পারে এবং বিকল্প রপ্তানিপ্রবাহ তৈরি করতে সহায়ক হতে পারে।
সুতরাং যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্কের হারের এ হ্রাস আশাব্যঞ্জক হলেও আত্মতুষ্টির কোনো সুযোগ নেই বা জায়গা তৈরি করে না; বরং এটি একটি সুযোগ এবং একই সঙ্গে একটি সতর্কবার্তা। বাংলাদেশকে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে, যাতে একটি বৈচিত্র্যময়, প্রতিযোগিতামূলক ও সহনশীল বাণিজ্য কৌশল প্রতিষ্ঠা করা যায়।
সেলিম রায়হান, নির্বাহী পরিচালক, সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: য ক তর ষ ট র র র জন য র ওপর
এছাড়াও পড়ুন:
ইরান যে তিন কারণে পারমাণবিক অস্ত্র বানাবে না
বিশ্বরাজনীতিতে ইরানের পরমাণু কর্মসূচি একটি বহুল আলোচিত ও বিতর্কিত ইস্যু। পশ্চিমা শক্তিগুলো, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল, বহু বছর ধরে অভিযোগ করে আসছে, ইরান নাকি গোপনে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে চাইছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা (আইএইএ) বা যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব গোয়েন্দা সংস্থাগুলো আজ পর্যন্ত এমন কোনো প্রমাণ দেখাতে পারেনি, যা এ দাবিকে প্রতিষ্ঠিত করে। অন্যদিকে ইরান শুরু থেকেই বলে আসছে যে তাদের পরমাণু কর্মসূচি সম্পূর্ণরূপে শান্তিপূর্ণ ও বেসামরিক উদ্দেশ্যে পরিচালিত।
প্রশ্ন হলো, যদি ইরান সত্যিই পারমাণবিক অস্ত্র বানাতে চাইত, তাহলে গত দুই দশকে তা তৈরি করেনি কেন? আর যদি তা না-ই চায়, তাহলে উচ্চমাত্রায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ চালিয়ে যাচ্ছে কেন? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর পেতে হলে ইরানের ধর্মীয় অবস্থান, কৌশলগত চিন্তা, রাজনৈতিক বাস্তবতা এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতির দ্বিচারিতা একত্রে বিশ্লেষণ করতে হবে।
আরও পড়ুনইরান এবার বড় যুদ্ধের জন্য যেভাবে প্রস্তুত হবে০৬ জুলাই ২০২৫ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞা ও নৈতিক অবস্থান২০০৩ সালে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি একটি ঐতিহাসিক ফতোয়া জারি করেন। সেখানে স্পষ্টভাবে বলা হয়, ‘পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি, মজুত কিংবা ব্যবহার ইসলামের দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ হারাম।’ এ সিদ্ধান্ত শুধুই ধর্মীয় নয়, বরং একটি নৈতিক অবস্থানও, যেখানে নিরীহ মানুষ হত্যাকে ইসলাম কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করেছে। পারমাণবিক বোমা শুধু সামরিক লক্ষ্যবস্তু ধ্বংস করে না, বরং শহর, জনপদ ও লাখ লাখ নিরীহ মানুষের প্রাণ হরণ করে। ইসলামের যুদ্ধনীতিতে বেসামরিক নাগরিকদের হত্যা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।
ইরান মনে করে, পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার শুধু মানবতার বিরুদ্ধে নয়, পরিবেশ ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের বিরুদ্ধে চরম অন্যায়। হিরোশিমা-নাগাসাকির দৃষ্টান্ত এ বিষয়ে যথেষ্ট প্রমাণ দেয়।
কৌশলগত ও সামরিক বাস্তবতাঅনেকের ধারণা, পারমাণবিক অস্ত্র থাকলেই একটি দেশ নিরাপদ থাকে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। পাকিস্তান ১৯৯৮ সালে পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করলেও ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের চাপের মুখে আফগানিস্তানে মার্কিন অভিযানে অংশ নিতে বাধ্য হয়। উত্তর কোরিয়া পারমাণবিক অস্ত্রধারী হওয়া সত্ত্বেও আন্তর্জাতিকভাবে একঘরে। এমনকি রাশিয়া, যাদের বিশ্বের সর্বোচ্চ পারমাণবিক অস্ত্র মজুত রয়েছে, ইউক্রেন যুদ্ধে ন্যাটোর সঙ্গে কৌশলগতভাবে চাপে পড়েছে। ইসরায়েলও অঘোষিত পারমাণবিক অস্ত্রধারী হওয়া সত্ত্বেও ইরানের ‘অপারেশন ট্রু প্রমিজ’-এ বড় ধরনের সামরিক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছে।
এ বাস্তবতা ইরানকে বুঝিয়ে দিয়েছে, পারমাণবিক অস্ত্র নয়, কার্যকর প্রতিরোধক্ষমতা ও প্রযুক্তিগত অগ্রগতিই নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে। তাই তারা শক্তিশালী ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র, চালকবিহীন বিমান বা ড্রোন এবং কৌশলগত অস্ত্র নির্মাণে জোর দিয়েছে।
সামরিক মহড়া চলাকালে ইরানের দক্ষিণাঞ্চলের অজ্ঞাত স্থান থেকে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করা হয়েছে। ২০২৪ সালের ১৯ জানুয়ারি ছবিটি প্রকাশ করে ইরান