Prothomalo:
2025-11-03@03:35:06 GMT

হাঙরের ঘাই, হাওয়াই মিঠাই

Published: 4th, August 2025 GMT

থাকা, না থাকা

ধরো, আমিও তো আছি।

কাল শুনবে, নাই।

তোমাদের প্রতিদিনের সংবাদের নিচে

চাপা পড়ব, ধুলায় মিশে

বড়জোর ছাইটাই হব।

হুট করে কারও যদি

মনে পড়ে খুব, সেটাও জানব না—

হেঁচকি পাবে না আর, থাকবে না তৃষ্ণা,

নিদ্রার কোনো দরকার, ডুব দেবার জন্য

প্রয়োজন হবে না কোনো নদী,

কিংবা কুমারীর প্রতিবাদী অবয়ব, অন্ধকার।

দেখো, তুমিও তো আছ,

কাল শুনব, নাই।

তোমার দিকে যাওয়া

একজন আমার জন্য অপেক্ষা করছে,

তার কাছে আমায় যেতে হবে সমস্ত পৃথিবী, সমস্ত মানুষ পার হয়ে। — বুদ্ধদেব বসু

কত যে আঁধার সাঁতার পারায়ে তোমার দিকে যাই

হাঙরের ঘাই, শিরদাঁড়া ভাঙে যেন হাওয়াই মিঠাই—

দিকহারা ঢেউ পাহাড় হয়ে আসে, ভাসায় সব ঠাঁই

বন্ধুর পথ ঠিকানা তোমার—নাই নাই নাই

কত যে আঁধার সাঁতার পারায়ে তোমার দিকে যাই

বাস্তবের চেয়ে ভারী জল—আমরণ সাঁতরাই

ধরে আসে গলা, মোচড়ায় সরল তলপেট

সমস্ত জগৎ যেন বাঁধ; বাঁধা—সামনে দাঁড়ায়

হড়কে যায় পা, পর্বতারোহীর, পপাত ধরণিতল

পিছলাই, উপত্যকায় পড়ি—ধপ্পাস্, যারপরনাই

কত যে আঁধার সাঁতার পারায়ে তোমার দিকে যাই

আশরীর যায় কেটে কেটে, বাতাসে বর্শার ফলা

গল গল করে গলা থেকে বেরোয় রক্তের ফুল

অনিচ্ছার কুম্ভ দাঁড় করায় তোমাকে দৃশ্যের আড়ালে

মাংসের খোঁড়ল ডেকে তোলে আত্মার অমিত চড়াই

কত যে আঁধার সাঁতার পারায়ে তোমার দিকে যাই!

বিপন্ন শব্দাবলিতে ভরে যায় সমস্ত পৃথিবী, এ দুনিয়া

নরক যেন, মনে হয় এ ভ্রমণ এক অশেষ বিশেষ

মানুষের সবুজ সম্ভ্রম খসে খসে পড়ে শূন্য হাওয়া

ধূসর জিব বুলিয়ে যায় সমস্ত রন্ধ্রে, মুষল বৃষ্টির—

যানহীন পথ, নিভু ল্যাম্পপোস্ট, আকাশ ফাটা বজ্র—বাজখাঁই

কত যে আঁধার সাঁতার পারায়ে তোমার দিকে যাই!

মরণ ছাড়া এ যাওয়া আসার কী নাম দেব রাই!

কত যে আঁধার সাঁতার পারায়ে তোমার দিকে যাই!

ক্রমাগত

এই শহরেই ঘুরবে তুমি

এই শহরে আমার মতো

আমার শ্বাসের বিষণ্নতা

তোমার ত্বকে রচবে ক্ষত

 ক্রমাগত

 ক্রমাগত

ক্ষতের ফোঁড়ে নখ চালাবে

বাড়বে ক্ষত তোমার মতো

এমন ব্যথার ব্যথাভ্যাসে

অনারোগ্য তোমার ক্ষত

এই শহরে আমার মতো

কে আর এমন অবিরত!

মিটিয়ে নিজের সকল আশ

খুঁজবে তুমি কাহার শ্বাস!

ইতস্তত

ইতস্তত

এই শহরেই ঘুরবে তুমি

এই শহরে আমার মতো

আমার শ্বাসের বিষণ্নতা

 তোমার ত্বকে করবে ক্ষত

ক্রমাগত

ক্রমাগত

দিন বাড়বে বছর যাবে

অমন তোমার রূপ নিটোলে

ক্ষত বাড়বে, কীটেরা খাবে

মিটিয়ে নিজের সকল আশ

পাচ্ছ না যে কাহার শ্বাস!

ক্রমাগত

ক্রমাগত.

..

আহত হরিণ

ফ্রিদা কাহলোকে

আহত হরিণ

আমার এ বুক

ঋণে বিক্ষত

হৃদয় তোমার

হয়রান জানি

সেথা অবিরত

যে রক্ত ঝরে

রাঙা মাটি আরও

লাল হয়ে যায়

টকটকে লাল

ফসল ফলায়

জীবনকে দেয়

দম বাঁচবার

সেই রক্তের

শপথ আমার

আহত বিধুর

ক্ষুর তুলে বুকে

চুমু আর লালা

মলমের ওমে

পতঝড় এই

নিবিড় শালায়

শিশিরেরা ঝরে

ভোরের বেলায়

যা মাড়াতে এলে

আহত হরিণ

পাহাড়ের গায়

রক্তফলায়

আহত হরিণ

ক্ষুরের হরফ

দাগ থেকে যায়

ক্ষত অবিরত

আহত হরিণ

আমার এ বুক

দগদগে ঘায়

কোথায় কোথায়!

বিদায়

‘যা লিখতে নেই, লেখকের একমাত্র কাজ কেবল সেটাই লেখা’ — একরাম আলি

গলির মোড়ে অপস্রিয়মাণ

এই যে তোমার একলা চলে যাওয়া

এই যে আমায় একলা করে যাওয়া

এই যে এসব মুহূর্ত প্রমাণ করছে,

বিষেই নীল হয়েছে নীল

মিলের সাথে আদতে নাই মিল

জগৎজোড়া যত্ত বেরং আছে

রঙিন তারা সকল ভালোর কাছে—

তবুও তুমি অপস্রিয়মাণ

এই আমারে একলা করে যাও

একলা তুমি রাতের ভাত খাও

একাই শোনো ভোরবেলার আজান

গলিগুলো শেষ হয় না তবু

শেষ হয় না গলির মোড়ের গান

শেষ হয় না তোমার চলে যাওয়া

গলির মুখে অপস্রিয়মাণ।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: এই শহর ম র মত ইকত য সমস ত

এছাড়াও পড়ুন:

পরাবাস্তবতার আবেদন কি ফুরিয়েছে

অবচেতনের মানচিত্র ধরে এক অন্তহীন অভিযাত্রা কবি–সাহিত্যিকেরা যুগ যুগ ধরে করে আসছেন। সাহিত্যের দীর্ঘ যাত্রাপথে এমন কিছু বাঁক আসে, যা তার গতিপথকে চিরতরে বদলে দেয়। পরাবাস্তবতা বা সুররিয়ালিজম ছিল এমনই এক যুগান্তকারী আন্দোলন, যা কেবল শিল্পের আঙ্গিক নয়; বরং শিল্পীর বিশ্ববীক্ষা এবং আত্মবীক্ষণকে সম্পূর্ণ নতুন এক দর্শন দান করেছিল। এটি ছিল বিংশ শতাব্দীর ইউরোপের এক ক্ষতবিক্ষত সময়ের সন্তান। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞ, ভিক্টোরীয় যুগের শুষ্ক নৈতিকতা এবং বুদ্ধিবৃত্তিক জগতের অতিনিয়ন্ত্রিত যুক্তিবাদ—এই সবকিছুর বিরুদ্ধে পরাবাস্তবতা ছিল এক শৈল্পিক ও দার্শনিক বিদ্রোহ। এর মূল লক্ষ্য ছিল মানব মনের সেই গভীরে প্রবেশ করা, যেখানে যুক্তির আলো পৌঁছায় না; সেই অবচেতনের অন্ধকার মহাসাগর থেকে তুলে আনা বিস্মৃত স্বপ্ন, অবদমিত ইচ্ছা আর আদিম প্রবৃত্তির মণি–মুক্তা। পরাবাস্তবতা তাই কেবল একটি শিল্পরীতি নয়, এটি চেতনার শৃঙ্খলমুক্তির এক দুঃসাহসী ইশতেহার।

১৯২৪ সালে ফরাসি কবি ও লেখক আঁদ্রে ব্রেটন তাঁর ‘পরাবাস্তবতার প্রথম ইশতেহার’ (ম্যানিফেস্টো অব সুররিয়ালিজম) প্রকাশের মাধ্যমে এই আন্দোলনের আনুষ্ঠানিক সূচনা করেন। ব্রেটনের সংজ্ঞায়, পরাবাস্তবতা হলো, ‘বিশুদ্ধ মানসিক স্বয়ংক্রিয়তা, যার মাধ্যমে মুখ বা লেখনী দিয়ে অথবা অন্য যেকোনো উপায়ে চিন্তার আসল কার্যকারিতাকে প্রকাশ করার ইচ্ছা পোষণ করা হয়। এটি যুক্তির সমস্ত নিয়ন্ত্রণ থেকে এবং সকল প্রকার নান্দনিক ও নৈতিক উদ্দেশ্য থেকে বিযুক্ত চিন্তার এক শ্রুতলিখন।’

এই দর্শনের প্রধান পাথেয় ছিল ভিয়েনার মনোবিজ্ঞানী সিগমুন্ড ফ্রয়েডের যুগান্তকারী মনঃসমীক্ষণ তত্ত্ব। ফ্রয়েড দেখিয়েছিলেন যে মানুষের সচেতন মনের আড়ালে লুকিয়ে আছে এক বিশাল অবচেতন জগৎ, যা তার আচরণ, স্বপ্ন ও ব্যক্তিত্বকে নিয়ন্ত্রণ করে। পরাবাস্তববাদীরা ফ্রয়েডের এই তত্ত্বকে লুফে নিয়েছিলেন। তাঁদের কাছে শিল্পসৃষ্টির উদ্দেশ্যই ছিল যুক্তির সেন্সরশিপকে ফাঁকি দিয়ে অবচেতন মনের এই লুকানো জগৎকে উন্মোচিত করা। তাঁরা চেয়েছিলেন, স্বপ্ন ও বাস্তবতাকে একীভূত করে এক ‘পরম বাস্তবতা’ বা ‘সুররিয়ালিটি’ তৈরি করতে।

পরাবাস্তবতা ছিল বিংশ শতাব্দীর ইউরোপের এক ক্ষতবিক্ষত সময়ের সন্তান। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞ, ভিক্টোরীয় যুগের শুষ্ক নৈতিকতা এবং বুদ্ধিবৃত্তিক জগতের অতিনিয়ন্ত্রিত যুক্তিবাদ—এই সবকিছুর বিরুদ্ধে পরাবাস্তবতা ছিল এক শৈল্পিক ও দার্শনিক বিদ্রোহ।

পরাবাস্তবতার পদযাত্রা প্যারিসের শৈল্পিক পরিমণ্ডল থেকে শুরু হলেও এর ঢেউ খুব দ্রুতই বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। আঁদ্রে ব্রেটন ছিলেন এই আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা, কিন্তু তাঁর ছত্রচ্ছায়ায় সমবেত হয়েছিলেন বহু প্রতিভাবান স্রষ্টা, যাঁরা নিজ নিজ ভাষায় ও সংস্কৃতিতে পরাবাস্তবতার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছেন।

আঁদ্রে ব্রেটন (জন্ম: ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৬—মৃত্যু: ২৮ সেপ্টেম্বর ১৯৬৬)

সম্পর্কিত নিবন্ধ