ছয় বছর ধরে সাভারের একটি পোশাক কারখানায় শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন রেহানা আক্তার (২৮)। অপারেটর হিসেবে যোগ দেওয়ার পর একই পদে রয়েছেন, বেতন বেড়েছে বাৎসরিক, তবে যে দায়িত্বে ঢুকেছিলেন এখনও করছেন সেই একই কাজ। কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে পদোন্নতির কোনো নজির নেই, তিনি নিজেও সাহস পাননি বলার, পাছে চাকরি খোয়াতে হয়। তাই পদোন্নতির জন্য কারখানা বদলের কথা ভাবছেন তিনি।

শুধু রেহানা নয়, পোশাক কারখানাগুলোর নারী শ্রমিকদের বেশিরভাগেরই চিন্তা এমন। তারা বলছেন, একই কারখানায় পদোন্নতির নজির বিরল।

শিল্প পুলিশ জানায়, ঢাকা ইপিজেডে ৯০টিসহ সাভার, আশুলিয়া ও ধামরাই অঞ্চলে মোট ৫৫৯টি পোশাক কারখানা রয়েছে। ইপিজেডের বাইরে বিজিএমইএ অন্তর্ভুক্ত কারখানার সংখ্যা ৪০১টি এবং বিকেএমইএ অন্তর্ভুক্ত কারখানার সংখ্যা ৬৮টি।

কারখানা সংশ্লিষ্টরা জানান, একটি কারখানায় হেল্পার পদে যোগদান করে ক্যারিয়ার শুরু করেন শ্রমিকরা। এরপর ধাপে ধাপে অপারেটর পর্যন্ত হতে পারেন তারা। এর ওপরে সুপারভাইজার, লাইনম্যানের মতো নেতৃত্বস্থানীয় পদগুলোতে নারীদের অংশগ্রহণ নেই বললেই চলে। এজন্য কারখানার সদিচ্ছার যেমন অভাব রয়েছে, তেমনই নারীদের আগ্রহেরও ঘাটতি রয়েছে। সবমিলিয়ে কারখানাগুলোতে শ্রমিকদের বাইরের নেতৃত্বস্থানীয় পদে নারীদের সংখ্যা হাতেগোনা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সেটির সংখ্যা একেবারেই শূন্য।

শ্রমিকরা জানান, পোশাক কারখানায় একই লাইনে সাধারণত দুজন সুপারভাইজার ও একজন লাইনম্যান থাকেন। তারা শ্রমিকদের তদারকি করে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ আদায় করেন। শ্রমিক থেকে ধাপে ধাপে উঠে আসা এ পদগুলোতে প্রায় সবাই পুরুষ। অথচ, নারী কর্মীদের মধ্যে দীর্ঘ অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা থাকা সত্ত্বেও নেতৃত্বের দায়িত্বে খুব কমই দেখা যায়।

নারী শ্রমিকদের অভিযোগ, ১০-১২ বছর ধরে অপারেটর পদে কাজ করলেও তাদের পদোন্নতির সুযোগ সীমিত। অনেক পুরুষ সহকর্মী তুলনামূলক কম সময়ে সুপারভাইজার হয়ে যাচ্ছেন। উৎপাদন লাইনে নারীর সংখ্যা বেশি হলেও নেতৃত্বের জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ, পরামর্শ বা সহায়তা খুব কমই দেওয়া হয়। ফলে অনেক নারী নিজেদের অযোগ্য মনে করেন, যদিও তাদের ভেতরে নেতৃত্ব দেওয়ার সক্ষমতা রয়েছে।

তবে শুধু দক্ষতা নয়, মানসিক চাপও এক ধরনের বাধা। অনেক নারী শ্রমিক মনে করেন, নেতৃত্বের পদ মানেই বেশি ঝুঁকি। ভুল হলে চাকরি হারানোর আশঙ্কা থাকে। তাই নিরাপদ থেকে অপারেটরের কাজ করাকেই তারা সহজ মনে করেন। এর পেছনে পারিবারিক টানাপোড়েন ও কাঠামোগত প্রতিবন্ধকতাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

সাভারের বিভিন্ন কারখানায় ৫-১০ বছরের বেশি সময় ধরে কাজ করা অন্তত অর্ধশত নারী শ্রমিকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নেতৃত্ব থেকে পিছিয়ে থাকার পেছনে কয়েকটি কারণ বড় করে উঠে এসেছে।

তারা বলছেন- শিক্ষাগত যোগ্যতার ঘাটতি, মাতৃত্বকালীন সময়ের চ্যালেঞ্জ, সন্তানকে সময় দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা, সংসারের বাড়তি দায়িত্ব, নারী অধিকারকর্মীর অভাব ও ঝুঁকিমুক্ত থাকার মানসিকতা নেতৃত্ব থেকে পিছিয়ে থাকার জন্য ভূমিকা রাখছে।

তাদের অভিজ্ঞতা বলছে, পোশাক খাতে নারীর অংশগ্রহণ দৃশ্যমান হলেও নেতৃত্বে উন্নীত হওয়ার পথে রয়েছে নানা অদৃশ্য দেয়াল। আর এই দেয়াল ভাঙতে হলে শুধু কাঠামোগত পরিবর্তন নয়, নারী শ্রমিকদের জন্য সহায়ক পরিবেশও নিশ্চিত করতে হবে।

পোশাক শ্রমিক রেহানা আক্তার বলছিলেন, তিনি উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেছেন। উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন। তার প্রত্যাশা ম্যানেজমেন্ট লেভেলের কোনো চাকরিতে যোগ দেওয়া।

তিনি বলেন, ‘‘আমার ওপরের লেভেলে চাকরি করেন, তারা কেউ কেউ এসএসসি পাস। আমি এইচএসসি পাস। অভিজ্ঞতা আছে। কিন্তু পদোন্নতি নেই। আর যে কারখানায় আছি, সেখানে কাউকে সেভাবে পদোন্নতি দেওয়াও হয় না। আমি আরও পড়াশোনা করছি। অন্য কোনো কারখানায় আরেকটু বেশি বেতনে ভালো পদে যোগ দিব।’’

সাভারের একটি কারখানায় ১১ বছর ধরে কাজ করা নাছিমা আক্তার বলেন, ‘‘আমি সিনিয়র অপারেটর হিসেবে কাজ করছি। সুপারভাইজার বা লাইনম্যান হলে অনেক দায়িত্ব নিতে হয়, জবাবদিহিও বাড়ে। তাছাড়া অতিরিক্ত সময়ও দিতে হয়। আমার স্বামীও কাজ করেন। আমাকে বাসায়ও কাজ করতে হয়। তাই আমি আর কিছু চাই না। আর বেশি দিন চাকরিও করতে চাই না।’’

নাজমা বেগম নামে অপর একজন বলেন, ‘‘বড় পদগুলোতে চাপ বেশি। তাদের অনেক বাজে আচরণও করতে হয়। আমার দ্বারা তা সম্ভব নয়। আমি কাজ জানি। কিন্তু এইসব পদে গিয়ে আর চাপ নিতে চাই না। তাই যেভাবে আছি সেভাবেই থাকতে চাই।’’

বাংলাদেশ গার্মেন্ট ও সোয়েটার্স শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের কেন্দ্রীয় কমিটির নারী বিষয়ক সম্পাদক জাহান্নারা বেগম বলেন, ‘‘নারীরা যত ভালো কাজ করুক, তাদের ওপরের পর্যায়ে আসতে দেওয়া হয় না। ম্যানেজমেন্টে থাকা লোকজন মনে করে নারীরা এসব পোস্টে পারবে না। আমি দেখেছি, নারীরা সমানতালে, এমনকি কোথাও আরও ভালো কাজ করেন। আর সামাজিক বাধাও একটি বিষয়। যেমন সুপারভাইজারদের একটু দেরিতে ছুটি হয়। কাজ বুঝিয়ে দিতে হয়। বাড়িতে যেতে দেরি হয়। বাসায় সমস্যা হয়। এজন্য প্রথমত কারখানা কর্তৃপক্ষ, দ্বিতীয়ত সহকর্মীদের সমর্থন দরকার। আমি যেখানে কাজ করি, সেখানে নারীদের ওপরের দিকে দায়িত্ব দেওয়া হলে তারা ভালো কাজ করেছেন। ফলে তাদের ওপরের দিকে উঠিয়ে আনতে সবার সমর্থন প্রয়োজন।’’

অবশ্য কারখানাগুলোতে নারী নেতৃত্বের সঙ্কট নেই বলে মনে করেন চৈতি গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল কালাম। তিনি বলেন, ‘‘সব জায়গায় মেয়েরাই নেতৃত্ব দিচ্ছে। নারী নেতৃত্ব যারা আছেন তারাই নেতৃত্ব দিচ্ছেন। ২০টি সংগঠন থাকলে সেখানে বেশিরভাগই নারী নেতৃত্ব। কারখানার ভেতরেও একইভাবে নারীরা সমানতালে কাজ করছেন। এ ক্ষেত্রে কোনো ঘাটতির জায়গা দেখি না।”

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ডিস্টিংগুইশড ফেলো অধ্যাপক রওনক জাহান বলেন, ‘‘মেয়েরা যেই সেক্টরেই যাক, দেখা যায় তারা নিচের দিকে থাকে। নেতৃত্বের দিকে তারা উঠতে পারে না। অনেক সময় মেয়েরা যে ধরনের কাজ করে, গার্মেন্টসগুলোতেও নিচের দিকেই কাজ করে। ফলে তাদের নেতৃত্বে উঠে আসাও কঠিন। সেজন্য নেতৃত্বের দিকে উঠানোর জন্য একটা পরিকল্পনা প্রয়োজন। যেন ধীরে ধীরে মেয়েদের ওপরের দিকে উঠিয়ে আনা যায়। কিন্তু সেই ধরনের কোনো পরিকল্পনাও দেখা যাচ্ছে না।’’

ঢাকা/এস

.

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর দ র ওপর র র জন য ক জ কর

এছাড়াও পড়ুন:

সাংবাদিকদের কাজের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার আহ্বান জাতিসংঘ মহাসচিবের

সাংবাদিকদের কাজের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে বিশ্বের সব দেশের সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে অপরাধের বিচারহীনতা বন্ধের আন্তর্জাতিক দিবস উপলক্ষে তিনি এ আহ্বান জানান। বিশ্বব্যাপী ২ নভেম্বর দিবসটি পালিত হয়।

জাতিসংঘের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত মহাসচিবের বিবৃতিতে বলা হয়, সত্যের সন্ধানে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে কর্মরত গণমাধ্যমকর্মীরা ক্রমবর্ধমান বিপদের মুখে পড়ছেন। এর মধ্যে রয়েছে মৌখিক নিপীড়ন, আইনি হুমকি, শারীরিক আক্রমণ, কারাবাস ও নির্যাতন। এমনকি অনেককে জীবনও দিতে হচ্ছে।

আন্তোনিও গুতেরেস বলেন, ‘সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে অপরাধের বিচারহীনতা বন্ধের এই আন্তর্জাতিক দিবসে আমরা ন্যায়বিচারের দাবি জানাচ্ছি। বিশ্বজুড়ে সাংবাদিক হত্যার প্রায় ১০টি ঘটনার মধ্যে ৯টির বিচারই এখনো অমীমাংসিত রয়ে গেছে।’

জাতিসংঘ মহাসচিব বলেন, ‘বর্তমানে যেকোনো সংঘাতের মধ্যে (ফিলিস্তিনের) গাজা সাংবাদিকদের জন্য সবচেয়ে ভয়াবহ জায়গায় পরিণত হয়েছে। আমি আবারও এই ঘটনাগুলোর স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্তের আহ্বান জানাচ্ছি।’

আন্তোনিও গুতেরেস বলেন, ‘যেকোনো জায়গায় বিচারহীনতা শুধু ভুক্তভোগী এবং তাঁদের পরিবারের প্রতিই অন্যায় নয়, বরং এটি সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ওপর আক্রমণ, আরও সহিংসতাকে প্রশ্রয় দেওয়ার শামিল এবং গণতন্ত্রের প্রতি হুমকি।’ তিনি বলেন, সব সরকারের উচিত প্রতিটি ঘটনার তদন্ত করা, প্রত্যেক অপরাধীর বিচার করা এবং সাংবাদিকেরা যাতে সর্বত্র স্বাধীনভাবে তাঁদের কাজ করতে পারেন, তা নিশ্চিত করা।’

জাতিসংঘ মহাসচিব আরও বলেন, ‘নারী সাংবাদিকদের লক্ষ্য করে অনলাইনে উদ্বেগজনকভাবে বাড়তে থাকা হয়রানিমূলক আচরণ অবশ্যই আমাদের মোকাবিলা করতে হবে। এ ধরনের অপরাধের বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সাজা হয় না এবং এটি প্রায়শই বাস্তব জীবনে ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যাঁরা সাংবাদিকতার সঙ্গে জড়িত, তাঁদের জন্য ডিজিটাল দুনিয়াকে নিরাপদ রাখতে হবে।’

আন্তোনিও গুতেরেস বলেন, ‘যখন সাংবাদিকদের কণ্ঠ রুদ্ধ হয়, তখন আমরা সবাই আমাদের কণ্ঠস্বর হারাই। আসুন, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা রক্ষায়, জবাবদিহি নিশ্চিত করার দাবিতে এবং যাঁরা ক্ষমতার বিপরীতে সত্য তুলে ধরেন, তাঁরা যেন ভয় ছাড়াই তা করতে পারেন তা নিশ্চিত করতে আমরা সম্মিলিত অবস্থান নিই।’

সম্পর্কিত নিবন্ধ