পোশাক কারখানায় নারী শ্রমিক: কাজে এগিয়ে থাকলেও নেতৃত্বে পিছিয়ে
Published: 17th, September 2025 GMT
ছয় বছর ধরে সাভারের একটি পোশাক কারখানায় শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন রেহানা আক্তার (২৮)। অপারেটর হিসেবে যোগ দেওয়ার পর একই পদে রয়েছেন, বেতন বেড়েছে বাৎসরিক, তবে যে দায়িত্বে ঢুকেছিলেন এখনও করছেন সেই একই কাজ। কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে পদোন্নতির কোনো নজির নেই, তিনি নিজেও সাহস পাননি বলার, পাছে চাকরি খোয়াতে হয়। তাই পদোন্নতির জন্য কারখানা বদলের কথা ভাবছেন তিনি।
শুধু রেহানা নয়, পোশাক কারখানাগুলোর নারী শ্রমিকদের বেশিরভাগেরই চিন্তা এমন। তারা বলছেন, একই কারখানায় পদোন্নতির নজির বিরল।
শিল্প পুলিশ জানায়, ঢাকা ইপিজেডে ৯০টিসহ সাভার, আশুলিয়া ও ধামরাই অঞ্চলে মোট ৫৫৯টি পোশাক কারখানা রয়েছে। ইপিজেডের বাইরে বিজিএমইএ অন্তর্ভুক্ত কারখানার সংখ্যা ৪০১টি এবং বিকেএমইএ অন্তর্ভুক্ত কারখানার সংখ্যা ৬৮টি।
কারখানা সংশ্লিষ্টরা জানান, একটি কারখানায় হেল্পার পদে যোগদান করে ক্যারিয়ার শুরু করেন শ্রমিকরা। এরপর ধাপে ধাপে অপারেটর পর্যন্ত হতে পারেন তারা। এর ওপরে সুপারভাইজার, লাইনম্যানের মতো নেতৃত্বস্থানীয় পদগুলোতে নারীদের অংশগ্রহণ নেই বললেই চলে। এজন্য কারখানার সদিচ্ছার যেমন অভাব রয়েছে, তেমনই নারীদের আগ্রহেরও ঘাটতি রয়েছে। সবমিলিয়ে কারখানাগুলোতে শ্রমিকদের বাইরের নেতৃত্বস্থানীয় পদে নারীদের সংখ্যা হাতেগোনা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সেটির সংখ্যা একেবারেই শূন্য।
শ্রমিকরা জানান, পোশাক কারখানায় একই লাইনে সাধারণত দুজন সুপারভাইজার ও একজন লাইনম্যান থাকেন। তারা শ্রমিকদের তদারকি করে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ আদায় করেন। শ্রমিক থেকে ধাপে ধাপে উঠে আসা এ পদগুলোতে প্রায় সবাই পুরুষ। অথচ, নারী কর্মীদের মধ্যে দীর্ঘ অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা থাকা সত্ত্বেও নেতৃত্বের দায়িত্বে খুব কমই দেখা যায়।
নারী শ্রমিকদের অভিযোগ, ১০-১২ বছর ধরে অপারেটর পদে কাজ করলেও তাদের পদোন্নতির সুযোগ সীমিত। অনেক পুরুষ সহকর্মী তুলনামূলক কম সময়ে সুপারভাইজার হয়ে যাচ্ছেন। উৎপাদন লাইনে নারীর সংখ্যা বেশি হলেও নেতৃত্বের জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ, পরামর্শ বা সহায়তা খুব কমই দেওয়া হয়। ফলে অনেক নারী নিজেদের অযোগ্য মনে করেন, যদিও তাদের ভেতরে নেতৃত্ব দেওয়ার সক্ষমতা রয়েছে।
তবে শুধু দক্ষতা নয়, মানসিক চাপও এক ধরনের বাধা। অনেক নারী শ্রমিক মনে করেন, নেতৃত্বের পদ মানেই বেশি ঝুঁকি। ভুল হলে চাকরি হারানোর আশঙ্কা থাকে। তাই নিরাপদ থেকে অপারেটরের কাজ করাকেই তারা সহজ মনে করেন। এর পেছনে পারিবারিক টানাপোড়েন ও কাঠামোগত প্রতিবন্ধকতাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
সাভারের বিভিন্ন কারখানায় ৫-১০ বছরের বেশি সময় ধরে কাজ করা অন্তত অর্ধশত নারী শ্রমিকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নেতৃত্ব থেকে পিছিয়ে থাকার পেছনে কয়েকটি কারণ বড় করে উঠে এসেছে।
তারা বলছেন- শিক্ষাগত যোগ্যতার ঘাটতি, মাতৃত্বকালীন সময়ের চ্যালেঞ্জ, সন্তানকে সময় দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা, সংসারের বাড়তি দায়িত্ব, নারী অধিকারকর্মীর অভাব ও ঝুঁকিমুক্ত থাকার মানসিকতা নেতৃত্ব থেকে পিছিয়ে থাকার জন্য ভূমিকা রাখছে।
তাদের অভিজ্ঞতা বলছে, পোশাক খাতে নারীর অংশগ্রহণ দৃশ্যমান হলেও নেতৃত্বে উন্নীত হওয়ার পথে রয়েছে নানা অদৃশ্য দেয়াল। আর এই দেয়াল ভাঙতে হলে শুধু কাঠামোগত পরিবর্তন নয়, নারী শ্রমিকদের জন্য সহায়ক পরিবেশও নিশ্চিত করতে হবে।
পোশাক শ্রমিক রেহানা আক্তার বলছিলেন, তিনি উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেছেন। উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন। তার প্রত্যাশা ম্যানেজমেন্ট লেভেলের কোনো চাকরিতে যোগ দেওয়া।
তিনি বলেন, ‘‘আমার ওপরের লেভেলে চাকরি করেন, তারা কেউ কেউ এসএসসি পাস। আমি এইচএসসি পাস। অভিজ্ঞতা আছে। কিন্তু পদোন্নতি নেই। আর যে কারখানায় আছি, সেখানে কাউকে সেভাবে পদোন্নতি দেওয়াও হয় না। আমি আরও পড়াশোনা করছি। অন্য কোনো কারখানায় আরেকটু বেশি বেতনে ভালো পদে যোগ দিব।’’
সাভারের একটি কারখানায় ১১ বছর ধরে কাজ করা নাছিমা আক্তার বলেন, ‘‘আমি সিনিয়র অপারেটর হিসেবে কাজ করছি। সুপারভাইজার বা লাইনম্যান হলে অনেক দায়িত্ব নিতে হয়, জবাবদিহিও বাড়ে। তাছাড়া অতিরিক্ত সময়ও দিতে হয়। আমার স্বামীও কাজ করেন। আমাকে বাসায়ও কাজ করতে হয়। তাই আমি আর কিছু চাই না। আর বেশি দিন চাকরিও করতে চাই না।’’
নাজমা বেগম নামে অপর একজন বলেন, ‘‘বড় পদগুলোতে চাপ বেশি। তাদের অনেক বাজে আচরণও করতে হয়। আমার দ্বারা তা সম্ভব নয়। আমি কাজ জানি। কিন্তু এইসব পদে গিয়ে আর চাপ নিতে চাই না। তাই যেভাবে আছি সেভাবেই থাকতে চাই।’’
বাংলাদেশ গার্মেন্ট ও সোয়েটার্স শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের কেন্দ্রীয় কমিটির নারী বিষয়ক সম্পাদক জাহান্নারা বেগম বলেন, ‘‘নারীরা যত ভালো কাজ করুক, তাদের ওপরের পর্যায়ে আসতে দেওয়া হয় না। ম্যানেজমেন্টে থাকা লোকজন মনে করে নারীরা এসব পোস্টে পারবে না। আমি দেখেছি, নারীরা সমানতালে, এমনকি কোথাও আরও ভালো কাজ করেন। আর সামাজিক বাধাও একটি বিষয়। যেমন সুপারভাইজারদের একটু দেরিতে ছুটি হয়। কাজ বুঝিয়ে দিতে হয়। বাড়িতে যেতে দেরি হয়। বাসায় সমস্যা হয়। এজন্য প্রথমত কারখানা কর্তৃপক্ষ, দ্বিতীয়ত সহকর্মীদের সমর্থন দরকার। আমি যেখানে কাজ করি, সেখানে নারীদের ওপরের দিকে দায়িত্ব দেওয়া হলে তারা ভালো কাজ করেছেন। ফলে তাদের ওপরের দিকে উঠিয়ে আনতে সবার সমর্থন প্রয়োজন।’’
অবশ্য কারখানাগুলোতে নারী নেতৃত্বের সঙ্কট নেই বলে মনে করেন চৈতি গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল কালাম। তিনি বলেন, ‘‘সব জায়গায় মেয়েরাই নেতৃত্ব দিচ্ছে। নারী নেতৃত্ব যারা আছেন তারাই নেতৃত্ব দিচ্ছেন। ২০টি সংগঠন থাকলে সেখানে বেশিরভাগই নারী নেতৃত্ব। কারখানার ভেতরেও একইভাবে নারীরা সমানতালে কাজ করছেন। এ ক্ষেত্রে কোনো ঘাটতির জায়গা দেখি না।”
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ডিস্টিংগুইশড ফেলো অধ্যাপক রওনক জাহান বলেন, ‘‘মেয়েরা যেই সেক্টরেই যাক, দেখা যায় তারা নিচের দিকে থাকে। নেতৃত্বের দিকে তারা উঠতে পারে না। অনেক সময় মেয়েরা যে ধরনের কাজ করে, গার্মেন্টসগুলোতেও নিচের দিকেই কাজ করে। ফলে তাদের নেতৃত্বে উঠে আসাও কঠিন। সেজন্য নেতৃত্বের দিকে উঠানোর জন্য একটা পরিকল্পনা প্রয়োজন। যেন ধীরে ধীরে মেয়েদের ওপরের দিকে উঠিয়ে আনা যায়। কিন্তু সেই ধরনের কোনো পরিকল্পনাও দেখা যাচ্ছে না।’’
ঢাকা/এস
.উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর দ র ওপর র র জন য ক জ কর
এছাড়াও পড়ুন:
বিশ্ব ইজতেমা মার্চে
প্রতিবছর জানুয়ারিতে বিশ্ব ইজতেমার আয়োজন করা হলেও এবার জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কারণে তা পিছিয়ে মার্চ মাসে করা হবে।
সোমবার (৩ নভেম্বর) জাতীয় প্রেস ক্লাবে সংবাদ এ তথ্য জানিয়েছেন তাবলিগ জামাত বাংলাদেশ বা শুরায়ী নেজামের শীর্ষ নেতা মুফতি কেফায়েতুল্লাহ আজহারি।
আরো পড়ুন:
শেষ হলো দাওয়াতে ইসলামীর ইজতেমা
দ্বিতীয় পর্বের ইজতেমা শুরু
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, বিগত বছরগুলোতে দুই পর্বে বিশ্ব ইজতেমা হলেও আগামী বছর এক পর্বে হবে। মাওলানা সাদ কান্ধলভীর অনুসারী বা সাদপন্থিদের ইজতেমা আয়োজনের সুযোগ থাকবে না।
মুফতি কেফায়েতুল্লাহ বলেছেন, “তাবলিগ জামাত বাংলাদেশ তাবলিগি এ মেহনতকে দ্বীনি মেহনত হিসেবে বিশ্বাস করে। দ্বীনি কাজের অংশ হিসেবে বর্তমান সরকারের অনুরোধ শ্রদ্ধার সঙ্গে গ্রহণ করে আমরা আগামী বিশ্ব ইজতেমা মার্চে আয়োজনের বিষয়ে একমত হয়েছি। আমরা বিশ্বাস করি, এ সিদ্ধান্ত রাষ্ট্রীয় কার্যক্রমে সরকারের প্রতি সহযোগিতার শামিল।”
বিশ্ব ইজতেমা সাদপন্থিরা আয়োজন করতে পারবেন কি না, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, “সরকারের কাছে তারা লিখিত দিয়ে গতবার শেষবারের মতো ইজতেমার আয়োজন করেছিল। সেক্ষেত্রে তাদের আর ইজতেমা করার সুযোগ নেই।”
বিশ্ব ইজতেমা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে সংবাদ সম্মেলনে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে তিনটি অনুরোধ তুলে ধরা হয়।
১. আগামী ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহের আগেই ইজতেমার দিন-তারিখ ঘোষণা এবং সংশ্লিষ্ট কার্যক্রম শুরু করার জন্য সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থাগুলোকে অবহিত করা।
২. ইজতেমা যথাযথভাবে সম্পন্ন করতে টঙ্গী বিশ্ব ইজতেমা ময়দানকে অস্থায়ীভাবে কেপিআই (কি পয়েন্ট ইন্সটলেশন) ঘোষণা।
৩. ইজতেমায় আসা বিদেশি অতিথিদের সময়মতো উপস্থিতি নিশ্চিত করতে নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে ভিসা সহজীকরণ-সংক্রান্ত পরিপত্র জারি করা।
ঢাকা/রায়হান/রফিক