সরকারের অবস্থান যাচাই করতে চায় বিএনপি
Published: 14th, January 2025 GMT
জরুরি কিছু সংস্কার করে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে দ্রুত নির্বাচন চাইলেও প্রথমবার বিএনপি সুনির্দিষ্ট সময় উল্লেখ করেছে। গতকাল মঙ্গলবার সংবাদ সম্মেলনে দলটি জুলাই-আগস্টের মধ্যে নির্বাচন সম্ভব বলে জানিয়েছে। আগের দিন সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটির বৈঠকে চলতি বছরের মাঝামাঝি সময়ে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পক্ষে মত দেন বিএনপি নেতারা।
সরকার চলতি বছরের ডিসেম্বর অথবা আগামী বছরের জুনের মধ্যে নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় জানিয়েছে। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতনের পর পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সংস্কারকে গুরুত্ব দিয়ে অন্তত ১১টি কমিশন করা হয়েছে। চলতি মাসেই কমিশনগুলো থেকে সংস্কারের প্রস্তাবনা আসবে। এমন সময়ে বিএনপি কেন জুলাই-আগস্টকে নির্বাচনের জন্য বেছে নিচ্ছে– এমন প্রশ্নে দলটির নেতারা বলছেন, স্থানীয় নির্বাচন করার মাধ্যমে সরকার জাতীয় নির্বাচন পিছিয়ে দিতে চাইছে। নির্বাচন যত বিলম্বিত হবে, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট তত বাড়বে। গণতন্ত্রে উত্তরণের জনআকাঙ্ক্ষাও ব্যাহত হবে। মাঠ নির্বাচনের জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত।
ফলে দেরি করার যৌক্তিক কারণ নেই।
এ বিষয়ে গতকাল মঙ্গলবার গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘নির্বাচন বিষয়ে সরকারের অবস্থান নিয়ে স্থায়ী কমিটিতে দীর্ঘ আলোচনা হয়েছে। আমরা মনে করি, ডিসেম্বর কিংবা আগামী বছরের জুন পর্যন্ত নির্বাচন বিলম্বিত করার কোনো কারণ নেই। নির্বাচন কমিশন হয়েছে; সরকারেও মোটামুটি স্থিতিশীলতা এসেছে। এখন মনে হয় না নির্বাচন এত বিলম্বে করার কোনো কারণ আছে। যত বিলম্ব হচ্ছে, তত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট বৃদ্ধি পাচ্ছে।’
জুলাই-আগস্ট বর্ষাকাল। প্রচার ছাড়াও অঝোর ধারার বৃষ্টি কিংবা ঝড়ে ব্যাহত হতে পারে ভোটদান। বিষয়টি জেনেও বিএনপির দাবির বিষয়ে দলটির কয়েক নেতা জানান, সরকারের কাছে তারা দাবি করেছেন। এখন আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে তারিখ নির্ধারণ হতে পারে। তবে তা কোনোভাবেই চলতি বছর অতিক্রম করা ঠিক হবে না।
বিএনপি সূত্র জানায়, জাতীয় নির্বাচনকে ফোকাস করতে দরকষাকষির অংশ হিসেবে হাইকমান্ড জুলাই-আগস্টে নির্বাচনের দাবি তুলেছে। স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনে সরকারের আগ্রহে জাতীয় নির্বাচন নিয়ে সংশয়ে দলটির নেতারা। আলাপ সামনে আনার মাধ্যমে চাপ তৈরির পাশাপাশি সরকারের অবস্থানও পরখ করতে পারবে বলে মনে করছেন তারা।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ সমকালকে বলেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক কিংবা অন্তর্বর্তী– সরকারের ধরন যেমনই হোক, তাদের প্রধান কাজ সংস্কার শেষে সংসদ নির্বাচন করা। কিন্তু বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার আগে স্থানীয় নির্বাচন করতে চায়, এ জন্য নিশ্চয় হালনাগাদ ভোটার তালিকা লাগবে। তালিকা যখন করতেই হবে, তখন সংসদ নির্বাচনে বাধা কোথায়? আমরা আমাদের অবস্থান স্পষ্ট করেছি। এখন অংশীজন ও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কথা বলে সিদ্ধান্ত সরকারকেই নিতে হবে।’
সবই তো প্রস্তুত
স্থায়ী কমিটির সিদ্ধান্ত জানাতে গতকাল গুলশানে সংবাদ সম্মেলন করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল। এ সময় উপস্থিত ছিলেন স্থায়ী কমিটির সদস্য ড.
প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, “ক্রান্তিকালে জাতীয় সংসদ নির্বাচন ছাড়া অন্য নির্বাচন করার চিন্তা আসে কোত্থেকে? নির্বাচন পেছানোর চিন্তাই বা আসে কোত্থেকে? কারণ এটাই তো আপনার (সরকার) প্রথম কাজ। আপনি দেশকে একটি লাইনের ওপর তুলতে চাইলে নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। সংস্কার চলমান প্রক্রিয়া। আমরাই তো সংস্কার আগে তৈরি করেছি, জাতির সামনে তা উপস্থাপনও করেছি। ২০১৬ সালে আমরা ‘ভিশন-২০৩০’ এবং ২০২৩ সালে ৩১ দফা দিয়েছি। আমরাই তো সবচেয়ে বেশি সংস্কার করেছি।”
এক প্রশ্নের জবাবে বিএনপি মহাসচিব বলেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের কোনো প্রশ্নই আসে না। কারণ গত তিনটি নির্বাচন হতে পারেনি। ফলে মানুষ নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্রে উত্তরণের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে চাইছে। লোকাল গভর্নমেন্ট দেশ চালায় না। দেশ চালায় জাতীয় সংসদ, আইন প্রণয়ন করে জাতীয় সংসদ, গণতন্ত্রের মূল হলো জাতীয় সংসদ। এটা কার্যকর ছাড়া গণতন্ত্র ফাংশনাল হয় না।
তিনি আরও বলেন, ‘নির্বাচনের জন্য ভোটার তালিকা হালনাগাদ, সেটি করতে বেশি দিন লাগার কথা নয়। প্রিসাইডিং অফিসার নিয়োগসহ অন্যান্য কাজেও এক-দুই মাসের বেশি লাগবে না। সবই তো তৈরি। নির্বাচন কমিশনও সংসদ নির্বাচন আয়োজনে প্রস্তুত বলেছে। ইসি তো বলেছে, দুটি নির্বাচন একসঙ্গে সম্ভব নয়। তাই আমরা মনে করি, জাতির স্বার্থেই সংসদ নির্বাচন দ্রুত হওয়া দরকার।’
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ব এনপ জ ল ই আগস ট র অবস থ ন গণতন ত র ন র জন য র জন ত ক সরক র র বছর র ব এনপ
এছাড়াও পড়ুন:
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যেভাবে সুষ্ঠু ভোটে বাধা হতে পারে
বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশে, যেখানে নির্বাচনপ্রক্রিয়া নিয়ে ইতিমধ্যে প্রশ্ন ও চ্যালেঞ্জ রয়েছে, সেখানে এআইয়ের (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) ব্যবহার এক নতুন ধরনের হুমকি নিয়ে এসেছে। এটি শুধু প্রচলিত কারচুপির পদ্ধতিগুলোকেই আরও সফিসটিকেটেড বা কৌশলী করে তুলবে না; বরং আমাদের গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি যে জনগণের বিশ্বাস, সেটিই নষ্ট করে দিতে পারে।
নির্বাচনে এআইয়ের প্রভাব কোনো কাল্পনিক গল্প নয়, এটি একটি বাস্তব ঝুঁকি। এআই-চালিত টুলগুলো ব্যবহার করে রাজনৈতিক নেতা বা কর্মকর্তাদের অত্যন্ত বিশ্বাসযোগ্য ‘ডিপফেক’ (ভুয়া অডিও, ভিডিও এবং ছবি) তৈরি করা সম্ভব।
এই ডিপফেকগুলো সহজেই মিথ্যা কেলেঙ্কারি ছড়াতে পারে, যা ভোটারদের বিভ্রান্ত করে তাঁদের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করতে সক্ষম। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এআই-চালিত বটগুলো সেকেন্ডের মধ্যে এমন সব মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে দিতে পারে, যা একটি রাজনৈতিক দলের জন্য ব্যাপক জনসমর্থনে বা বিরোধিতায় ভূমিকা রাখতে পারে।
যখন জনগণ দেখতে পাবে, তারা যা দেখছে বা শুনছে, তার মধ্যে কোনটা আসল আর কোনটা নকল, তা বোঝা কঠিন, তখন স্বাভাবিকভাবেই তাদের মধ্যে সংবাদমাধ্যম, নির্বাচন কর্তৃপক্ষ এবং পুরো গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার বিষয়ে সন্দেহ ঢুকে যাবে। এটি একটি দেশের স্থিতিশীলতার জন্য দীর্ঘমেয়াদি হুমকি।
এআই অ্যালগরিদমগুলো বিশাল পরিমাণ ডেটা বিশ্লেষণ করে নির্দিষ্ট ভোটারদের লক্ষ করে তাদের ব্যক্তিগত আগ্রহ ও দুর্বলতা অনুযায়ী রাজনৈতিক বার্তা পাঠাতে পারে। এই ‘মাইক্রো টার্গেটিং’-এর মাধ্যমে ভোটারদের মনোভাবকে প্রভাবিত করা বা নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে ভোটদানের সময় বা স্থান সম্পর্কে ভুল তথ্য ছড়িয়ে দিয়ে তাদের ভোটদান থেকে বিরত রাখাও সম্ভব।
আমাদের গণতন্ত্রকে সুরক্ষিত রাখতে হলে এই নতুন প্রযুক্তির ঝুঁকিগুলো সম্পর্কে সচেতন হতে হবে এবং সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিতে হবেএআই শুধু মিথ্যা তথ্য ছড়ানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না, এটি নির্বাচনী পরিকাঠামোর ওপর সাইবার হামলাও জোরদার করতে পারে। এআই-চালিত টুলগুলো আরও সফিসটিকেটেড ফিশিং আক্রমণ তৈরি করে নির্বাচনী কর্মকর্তাদের অ্যাকাউন্ট হ্যাক করতে বা এমন ম্যালওয়্যার তৈরি করতে পারে, যা প্রচলিত নিরাপত্তাব্যবস্থা এড়িয়ে যেতে সক্ষম। এ ধরনের আক্রমণ ভোটার ডেটাবেজ বা ভোটিং মেশিনকে লক্ষ্য করে করা যেতে পারে। সেটি নির্বাচনের ফলাফল পরিবর্তন বা পুরো প্রক্রিয়াকে বিঘ্নিত করতে পারে।
প্রশ্ন হচ্ছে, এই বিপত্তির সমাধান কী? এ প্রশ্নের জবাব হিসেবে প্রথমেই মনে রাখা দরকার, এই গুরুতর চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় একটি সমন্বিত ও কার্যকর পদক্ষেপ প্রয়োজন। এখানে এক্সপ্লেইনেবল এআই (এক্সএআই) একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এআই মডেলের সিদ্ধান্তগুলো মানুষের কাছে বোধগম্য করে তোলে এক্সএআই। এটি এআইয়ের স্বচ্ছতা বাড়ায়।
ডিপফেক শনাক্তকরণ: এক্সএআই ব্যবহার করে এমন টুল তৈরি করা সম্ভব, যা কেবল ডিপফেক শনাক্ত করে না; বরং কেন একটি বিষয়বস্তু জাল বলে চিহ্নিত হয়েছে, তার বিস্তারিত ব্যাখ্যাও দেয়। এর ফলে মানব ফ্যাক্ট-চেকাররা বিশ্লেষণ যাচাই করতে পারেন এবং জনগণের আস্থা তৈরি হয়।
প্রচারণার নিরীক্ষা: এক্সএআই রাজনৈতিক প্রচারণায় এআই ব্যবহারের নিরীক্ষা করতে পারে। এটি বিশ্লেষণ করে দেখাতে পারে, কীভাবে একটি অ্যালগরিদম তার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা পক্ষপাতদুষ্ট বা কারসাজিমূলক টার্গেটিং কৌশলগুলো প্রকাশ করতে সাহায্য করে।
নিরাপত্তা বৃদ্ধি: সাইবার নিরাপত্তার ক্ষেত্রে এক্সএআই হুমকির শনাক্তকরণ সিস্টেমকে উন্নত করতে পারে। এটি ব্যাখ্যা করতে পারে, কেন একটি নির্দিষ্ট কার্যকলাপকে ক্ষতিকর বলে মনে করা হয়েছে। এই প্রক্রিয়া নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের দ্রুত এবং কার্যকরভাবে প্রতিক্রিয়া জানাতে সাহায্য করে।
অংশগ্রহণকারীদের করণীয়: এআইয়ের হুমকি মোকাবিলায় সব গুরুত্বপূর্ণ অংশগ্রহণকারীকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। প্রথমত, রাজনৈতিক দলগুলো এবং নেতাদের প্রকাশ্যে প্রতিশ্রুতি দিতে হবে, তাঁরা প্রতারণামূলক এআই জেনারেটেড কনটেন্ট বা ভুল তথ্য ছড়ানোর প্রচারে জড়িত হবেন না। তাঁদের উচিত এআইয়ের যেকোনো বৈধ ব্যবহার সম্পর্কে স্বচ্ছ থাকা এবং এআই জেনারেটেড কনটেন্টে সুস্পষ্ট লেবেল ব্যবহার করা। দ্বিতীয়ত, নির্বাচন কমিশনকে রাজনৈতিক প্রচারে এআই ব্যবহারের বিষয়ে সুস্পষ্ট নিয়ম ও প্রবিধান তৈরি এবং প্রয়োগ করতে হবে। তাদের উচিত এআই-চালিত টুলগুলোতে বিনিয়োগ করা এবং ভোটারদের সচেতন করার জন্য বড় আকারের প্রচার চালানো।
এ ছাড়া একটি যৌথ গবেষণা ও উন্নয়ন দল গঠন করা প্রয়োজন, যারা নির্বাচনের আগপর্যন্ত কমিশনকে এআই এবং সাইবার নিরাপত্তা বিষয়ে নিরবচ্ছিন্ন সহায়তা দেবে। তৃতীয়ত, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, সংবাদমাধ্যম এবং সুশীল সমাজকে এআইয়ের হুমকি সম্পর্কে তথ্য আদান-প্রদান করতে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে পড়লে তা দ্রুত মোকাবিলা করার জন্য একটি সুস্পষ্ট প্রটোকল স্থাপন করা জরুরি। সংবাদমাধ্যম এবং সুশীল সমাজের উচিত ফ্যাক্ট-চেকিং এবং জনগণের মধ্যে মিডিয়া লিটারেসি বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা।
আমাদের গণতন্ত্রকে সুরক্ষিত রাখতে হলে এই নতুন প্রযুক্তির ঝুঁকিগুলো সম্পর্কে সচেতন হতে হবে এবং সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিতে হবে। এআইয়ের ক্ষমতা যেমন বিশাল, তেমনি এর অপব্যবহারের বিপদও কম নয়।
জনগণের বিশ্বাস এবং একটি ন্যায্য নির্বাচনের অধিকার নিশ্চিত করতে এখনই আমাদের সবাইকে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হলো, বাংলাদেশ সরকারের একটি সম্মিলিত গবেষণা ও উন্নয়ন (আরএনডি) দল গঠন করা। এই বিশেষজ্ঞ দল এআই-সম্পর্কিত ঝুঁকিগুলো ক্রমাগত বিশ্লেষণ ও অনুমান করবে এবং দৃঢ় সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ করবে।
অধ্যাপক ড. আলমগীর হোসেন এআইয়ের সাবেক অধ্যাপক, যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজে অবস্থিত এআরআইটিআইয়ের সাবেক পরিচালক