নির্বাচন বনাম সংস্কার বিতর্কের লাভ-ক্ষতি
Published: 23rd, January 2025 GMT
জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থান ছাত্র-জনতাকে যেভাবে ঐক্যবদ্ধ করেছিল, সেটি বাংলাদেশ বিনির্মাণে আশাবাদী করেছিল। বিশেষত শেখ হাসিনার দুঃশাসনের বিরুদ্ধে এবং ছাত্র-জনতার খুনের প্রতিবাদে জুলাইয়ের শেষদিক থেকে সারাদেশে এক দফার দাবি ঘিরে সবাই যেভাবে এক ছাতার নিচে দাঁড়িয়েছিল, তা অভূতপূর্ব। তৎকালীন ক্ষমতাসীনদের রক্তচক্ষু, হামলা, বিভিন্ন বাহিনীর নির্বিচার গুলির মুখে দাঁড়িয়েও যে ইস্পাতদৃঢ় অবস্থান ছাত্র-জনতা দেখিয়েছে, তা যে কোনো গণতান্ত্রিক লড়াইয়ে চিরকালের উদাহরণ হয়ে থাকবে। কিন্তু ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতি ও দেশত্যাগের পর রাজনীতির পুরোনো ধারা নতুন করে ফিরে আসতে দেখা গেল। বিভক্তি ও স্বার্থের রাজনীতি আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। এ কথা সত্য, দীর্ঘদিনের অভ্যাস থেকে বেরিয়ে আসতে সময় লাগবে। কিন্তু জুলাই-আগস্টে অগণিত জীবন অকালে হারানোর পরও সেই একই ধারায় বাংলাদেশ চলতে দেখা যাতনার।
দেশ যাবে কোন পথে– এমন প্রশ্নের দিশা আমরা জুলাই-আগস্টেই পেয়েছি। দেশকে দ্রুত গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার দিকে এগিয়ে নিতে তাই সব পক্ষকেই বিচক্ষণতা ও দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যে দ্রুত নির্বাচন দিয়ে গণতান্ত্রিক ধারায় দেশকে নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে আশাবাদ ব্যক্ত হতে দেখা গেছে। এই প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করতে সরকার কয়েকটি ‘সংস্কার কমিশন’ গঠন করেছে। এরই মধ্যে চারটি কমিশন সংস্কার প্রস্তাব জমা দিয়েছে। বাকি সংস্কার প্রস্তাব চলতি জানুয়ারিতেই পাওয়া যাবে বলে জানতে পেরেছি। একটা বিষয় পরিষ্কার, রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতেই সংস্কার বাস্তবায়ন ও নির্বাচন আয়োজন করতে হবে সরকারকে। সে ক্ষেত্রে ঐকমত্য তৈরি না হলে সংস্কার বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠবে।
আরেকটি বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা থাকা দরকার যে, সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। এটা সময়ের সঙ্গে পরিবর্তনশীল। নিত্যনতুন চিন্তা-পদ্ধতি বেরিয়ে আসবে, সেই সঙ্গে পুরোনো ধারণাও বদলে যাবে। আওয়ামী শাসনামলে ভেঙে পড়া গণতান্ত্রিক সেতুটি পুনরায় নির্মাণ করতে হলে সংস্কার অবশ্যই করতে হবে। যেমন নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন বলছে, গত দেড় দশকে বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থা অনেকটাই ভেঙে পড়েছে। যে কারণে তারা যে প্রস্তাব দিচ্ছে, সেখানে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নতুন করে যুক্ত করা হয়েছে। তারা বলেছে, রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতে সরকার সেগুলো বাস্তবায়ন করবে।
কথা হচ্ছে, দেশে এখন মোটাদাগে রাজনৈতিক শক্তি কারা? এই শক্তিগুলো ঐকমত্যে পৌঁছুতে পারবে কি? নব্বইয়ের দশক থেকে বাংলাদেশের রাজনীতি দুটি বড় ধারায় বিভক্ত ছিল– বিএনপি ও আওয়ামী লীগ। এখন চব্বিশের আগস্টের পরে আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক দল হিসেবে বড় ধরনের অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। কেউ কেউ বলছেন, আওয়ামী লীগের অবস্থা একসময়ে মুসলিম লীগের মতো হয়ে যাবে। ভবিষ্যতের কথা আপাতত তোলা রইল। বর্তমানে আগামী নির্বাচনে দলটির অংশ নেওয়া বিষয়ে যে বিতর্ক তৈরি হয়েছে, তাতে বলা যায়, আওয়ামী লীগের আগামী নির্বাচনে দলীয় পরিচয়ে অংশ নেওয়া অনিশ্চিত। প্রত্যাশিত সংস্কারের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর যে ঐকমত্য দরকার, সেখানে আওয়ামী লীগের মতামত প্রয়োগের সুযোগ থাকছে না। তাহলে রাজনৈতিক ঐকমত্যের জন্য অবশিষ্ট রাজনৈতিক দলগুলো দুটি মোটাদাগে বিভক্ত– বিএনপি ও জামায়াত। জাতীয় পার্টি রাজনৈতিক দল হিসেবে কতটা পারফর্ম করতে পারবে, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। এর বাইরে নতুন রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে জাতীয় নাগরিক কমিটি, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে চাইছে। কিন্তু এখনও আনুষ্ঠানিক রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ না করায় রাজনৈতিক শক্তি বলতে যা বোঝায়, সেভাবে এখনও দানা বাঁধতে পারেনি। এ ছাড়া আরও কিছু রাজনৈতিক দল ও জোট থাকলেও, তারা মোটাদাগে উল্লিখিত দুই ভাগে বিভক্ত।
সংস্কার আগে, নাকি নির্বাচন– এ নিয়ে রাজনৈতিক দল ও দেশবাসী এখনও ধোঁয়াশার মধ্যে। এখন পর্যন্ত সরকারের পক্ষ থেকে নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করা হয়নি। আবার সংস্কার বলতে ঠিক কতটুকু সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে, সেটিও পরিষ্কার নয়। বিএনপিসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দল আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রূপরেখা চাইছে। তারা বলছে, একমাত্র রাজনৈতিক সরকারের পক্ষেই দেশের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক সমস্যা সমাধান করা সম্ভব। নির্বাচন না হলে দেশের সংকট-অনিশ্চয়তা কাটবে না। সংস্কারের ব্যাপারে কারও কোনো আপত্তি নেই। তবে প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে সরকারের উচিত দ্রুত নির্বাচনের দিকে যাওয়া।
এ অবস্থায় প্রশ্ন উঠছে– আগে সংস্কার, নাকি নির্বাচন? নির্বাচিত সরকার ছাড়া জনগণের প্রত্যাশা আর কেউ পূরণ করতে পারবে না। সে জন্য প্রথমত প্রয়োজনীয় সংস্কার করতে হবে। পরে সেই সংস্কার অনুমোদন করা হবে। নির্বাচন যত তাড়াতাড়ি হবে ততই দেশের জন্য মঙ্গল। দেশের মানুষ বিগত তিনটি সংসদ নির্বাচনে ভোটের অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিল। নির্বাচন সংস্কার কমিশন বলছে, দেশের নির্বাচন ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে বেশ কিছু প্রস্তাব তারা চূড়ান্ত করেছে। একটি ভালো নির্বাচন দেশের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রার মাপকাঠি। এ ছাড়া অন্যান্য কমিশনও যে প্রস্তাবনা চূড়ান্ত করেছে, তাতে রাজনৈতিক দলগুলো কতটা ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারবে?
বাস্তবতা হচ্ছে, চাইলেই বিএনপি কিংবা বড় রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত উপেক্ষা করে সংস্কার বাস্তবায়ন করা এই মুহূর্তে সম্ভব না। যদি সরকার মনে করে, সব দলকে আলোচনার টেবিলে বসিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছুবে, সেটা যেমন অতীতে হয়নি, ভবিষ্যতেও হবে না। পরিস্থিতি এমন হলে নির্বাচনের রোডম্যাপ বাস্তবায়নেও জটিলতা তৈরি হতে পারে। সে ক্ষেত্রে যে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা তৈরি হবে তা অনির্বাচিত সরকারের পক্ষে সামাল দেওয়া কঠিন হবে বৈ কি। আবার বাংলাদেশে দ্রুত নির্বাচিত সরকার দেখতে চায় বলে বিদেশি বন্ধু ও উন্নয়ন সহযোগী থেকেও প্রকাশ্যে তাগিদ পাওয়া যাচ্ছে। খাদ্য-বস্ত্রসহ অন্য অধিকারগুলোর মতো ভোট দেওয়ার অধিকারও এক ধরনের নাগরিক অধিকার। সবার ওপরের দিকের নাগরিক অধিকারগুলোর একটি ভোট দেওয়ার অধিকার।
নাগরিকরা চায় দেশ কার দ্বারা পরিচালিত হবে, আমি কার দ্বারা পরিচালিত হবো– এই প্রশ্নগুলোর সদুত্তর। ভোটের অধিকার তাই অনেক বড় বিষয়। নির্বাচন বনাম সংস্কারের বিতর্ক এই মুহূর্তে শুভবুদ্ধির লক্ষণ নয়। নির্বাচন আয়োজনের জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার সম্পন্ন করে নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণাই পারে দেশকে স্থিতিশীল রাখতে। এটাই কাম্য।
এহ্সান মাহমুদ: সহকারী সম্পাদক,
সমকাল; কথাসাহিত্যিক
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: গণত ন ত র ক সরক র র প র র জন ত ত সরক র ঐকমত য র জন য ব এনপ আওয় ম আগস ট
এছাড়াও পড়ুন:
লন্ডন বৈঠকে বিচার ও সংস্কারের বিষয়টি নির্বাচনের মতো গুরুত্ব না পাওয়া অত্যন্ত হতাশাজনক: এনসিপি
লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠকে নির্বাচনের তারিখ সংক্রান্ত আলোচনা যতটুকু গুরুত্ব পেয়েছে, বিচার ও সংস্কার ততটুকু গুরুত্ব পায়নি বলে মনে করে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। বিষয়টিকে ‘অত্যন্ত হতাশাজনক’ বলেছে দলটি।
আজ শুক্রবার রাতে এনসিপির এক বিবৃতিতে এই প্রতিক্রিয়া জানানো হয়েছে। এনসিপির যুগ্ম সদস্যসচিব (দপ্তর) সালেহউদ্দিন সিফাত বিবৃতিটি পাঠিয়েছেন।
এনসিপির বিবৃতিতে বলা হয়, রাষ্ট্রকাঠামো সংস্কার প্রশ্নে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা হিসেবে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের আলোচনাকে ইতিবাচকভাবে দেখছে এনসিপি। এই প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে লন্ডনে অনুষ্ঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মধ্যকার বৈঠকটি ‘সংসদ নির্বাচন’ বিষয়ে দলটিকে আস্থায় আনতে সফল হয়েছে সরকার। জাতীয় ঐক্য, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব এবং রাষ্ট্র সংস্কারের প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা জরুরি। কিন্তু বৈঠকে নির্বাচনের তারিখ সংক্রান্ত আলোচনা যতটুকু গুরুত্ব পেয়েছে, অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশে নাগরিকদের প্রধান দাবি তথা বিচার ও সংস্কার ততটুকু গুরুত্ব পায়নি। এটা অত্যন্ত হতাশাজনক বলে মনে করে এনসিপি।
নির্বাচন প্রশ্নে সরকার কেবল একটি রাজনৈতিক দলের অবস্থান ও দাবিকেই বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে বলে বারবার প্রতীয়মান হচ্ছে—এ কথা উল্লেখ করে এনসিপি আরও বলেছে, জুলাই ঘোষণাপত্র প্রণয়ন, জুলাই সনদ কার্যকর করা এবং বিচারের সুস্পষ্ট রোডম্যাপ ছাড়া জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন গণ-অভ্যুত্থানকে স্রেফ একটি ক্ষমতা হস্তান্তরের মাধ্যমে পরিণত করবে এবং রাষ্ট্র বিনির্মাণের জন–আকাঙ্ক্ষাকে অবদমিত করবে।
জনগণের দাবি তথা জুলাই সনদ রচনা ও কার্যকর করার আগে নির্বাচনের কোনো তারিখ ঘোষিত হলে তা জনগণ মেনে নেবে না বলে উল্লেখ করেছে এনসিপি। তাদের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘কাজেই রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সংস্কারের বিষয়গুলোর ব্যাপারে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা ও জুলাই সনদ রচনা এবং কার্যকর করেই আসন্ন জুলাইকে যথাযথ মর্যাদায় স্মরণ করার উদ্যোগ নিতে সরকারকে জোর দাবি জানাচ্ছে এনসিপি।’
জুলাই ঘোষণাপত্র প্রণয়ন, মৌলিক সংস্কার বাস্তবায়নে জুলাই সনদ কার্যকর করা ও বিচারের রোডম্যাপ ঘোষণার পরই নির্বাচন সংক্রান্ত আলোচনা চূড়ান্ত হওয়া উচিত বলেও বিবৃতিতে উল্লেখ করেছে এনসিপি।