‘জুলাই সনদ’ বাস্তবায়নের ওপর নির্ভর করবে নির্বাচনের সময়: প্রেস সচিব
Published: 5th, February 2025 GMT
সংস্কার কমিশনগুলোর প্রতিবেদন নিয়ে রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজের আলোচনায় ঐকমত্যের ভিত্তিতে যে ‘জুলাই সনদ’ তৈরি হবে, তা বাস্তবায়নের ওপর আগামী জাতীয় নির্বাচনের সময় নির্ভর করবে বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। তিনি বলেছেন, ‘জুলাই চার্টারের বাস্তবায়নের আলোকে নির্ভর করবে ইলেকশনটা কি এ বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে হবে, নাকি আগামী বছর জুলাইয়ের মধ্যে হবে।’
বুধবার অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূসের কাছে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন ও জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন তাদের প্রতিবেদন জমা দেন। এ উপলক্ষে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনার সামনে আয়োজিত সংক্ষিপ্ত ব্রিফিংয়ে এ কথা বলেন তিনি।
এর আগে যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন হস্তান্তর করেন সংস্কার কমিশন প্রধান আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মোমিনুর রহমান ও জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরী।
শফিকুল আলম বলেন, ‘ছয়টি কমিশনের পুরো প্রতিবেদন নিয়ে দেশের রাজনৈতিক দল ও সিভিল সোসাইটির সাথে কথা বলবে ঐকমত্য কমিশন। কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর কথার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত হবে কতটুকু সংস্কার আসলে দ্রুত করতে হবে, কতটুকু পরে করা যাবে।’
উল্লেখ্য, ঐকমত্য কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। আর ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে আছেন সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক আলী রিয়াজ। অন্য কমিশনগুলোর প্রধানরাও ঐকমত্য কমিশনের সদস্য।
শফিকুল আলম বলেন, ‘পুরো সংস্কারগুলো নিয়ে সবাই ঐকমত্যে আসবেন। ধরেন ৫ হাজার সংস্কারের মধ্যে ২ হাজারের ব্যাপারে ঐকমত্যে এলেন, এই কনসেনসাসে যেটা রিচ হবে, সবাই একমত হবে, সেটা রাজনৈতিক দলগুলো স্বাক্ষর করবে। স্বাক্ষর করার পর যেটা দাঁড়াবে সেটা হবে ‘জুলাই চার্টার’। এ জুলাই চার্টারের বাস্তবায়ন এ সরকার কিছু করবে, পরবর্তী সরকারগুলো এসে করবে। এ বাস্তবায়নের আলোকে নির্ভর করবে ইলেকশনটা কি এ বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে হবে নাকি আগামী বছর জুলাইয়ের মধ্যে হবে।’
.উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
জুলাই সনদ নিয়ে রাজনৈতিক সংকট তৈরি হলো কেন
ঐকমত্য কমিশন দেশ ও জাতির সঙ্গে প্রতারণা ও বিশ্বাসঘাতকতা করেছে বলে অভিযোগ করেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি অভিযোগ করেছেন, তাঁরা স্বাক্ষর করেছেন জুলাই সনদে।
কিন্তু ঐকমত্য কমিশন যে সুপারিশ জমা দিয়েছে, সেখানে অনেক কিছুই বদলে গেছে। যেমন বিএনপিসহ অন্যান্য দলের বিভিন্ন বিষয়ের ওপর দেওয়া নোট অব ডিসেন্ট নেই।
এর চেয়েও ভয়াবহ বিষয় হচ্ছে, সব দল মিলে একমত হয়েছিল—এমন বিষয়ও নাকি কমিশনের সুপারিশে বদলে দেওয়া হয়েছে।
বিষয়টি উল্লেখ করে বিএনপির মহাসচিব সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন, অফিস-আদালতে শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি রাখার বিধানটি বিলুপ্ত করার বিষয়ে সব দল একমত হয়েছিল।
আরও পড়ুনজুলাই সনদ নিয়ে জট খুলুন, সময় কিন্তু চলে যাচ্ছে০১ নভেম্বর ২০২৫কিন্তু পরবর্তী সময়ে কমিশনের সুপারিশে শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি টাঙানোর বিধানটি বিলুপ্ত করার বিষয় সনদে রাখা হয়নি।
শুধু তা-ই নয়, এমন আরও অনেক বিষয় কমিশনের সুপারিশে যুক্ত করা হয়েছে, যা নিয়ে দলগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করা হয়নি।
এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, কমিশনের সুপারিশগুলো নিয়ে পরবর্তী সংসদ ২৭০ দিনের মধ্যে সিদ্ধান্ত নিতে না পারলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে যুক্ত হয়ে যাবে।ঐকমত্য স্থাপন করতে গিয়ে এখন কঠোর সমালোচনার মুখে পড়েছে কমিশন।
অভিযোগ উঠেছে, তারাই অনৈক্য স্থাপনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। কমিশন মূলত কালক্ষেপণ করেছে সংস্কারের নামে।
আদতে তাদের সংস্কারের উদ্দেশ্য ছিল কি না সেই প্রশ্ন উঠেছে। প্রকৃতপক্ষে তারা নতুন কোনো সংস্কার প্রস্তাব উত্থাপন করতে পারেননি, যা আসলেই কার্যকর করা যেতে পারে।
আরও পড়ুনজুলাই সনদ যেন ব্যর্থ না হয়৩০ অক্টোবর ২০২৫কমিশনে যেসব বিষয় নিয়ে আলাপ-আলোচনা করেছে তার বেশির ভাগই বিএনপির ৩১ দফার মধ্যে আছে।
যেমন বিভিন্ন বিষয়ে সংস্কারের জন্য একাধিক কমিশন করার প্রস্তাবনা বিএনপির ৩১ দফাতেই ছিল।
রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার মধ্যে ভারসাম্য আনার পরিকল্পনা বিএনপি আগেই প্রচার করেছে।
নির্বাহী বিভাগের সঙ্গে বিচার বিভাগের ক্ষমতার সম্পর্ক পুরোপুরি আলাদা করা ও ভারসাম্য আনার বিষয়ে বিএনপি একাধিকবার আলাপ করেছে।
ফলে বোঝাই যাচ্ছে, কমিশন তেমন নতুন কোনো আলাপ সামনে আনতে পারেনি। ভবিষ্যতে যে নির্বাচিত সরকার আসবে, তাদের দুর্বল করতে নানা কৌশল বাস্তবায়নই যেন ছিল এই কমিশনের লক্ষ্য।
এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে সাংবিধানিক কাউন্সিল গঠনের প্রস্তাব করা। আর কাউকে ফ্যাসিবাদী হতে দেওয়া যাবে না—এ যুক্তি দিয়ে কমিশন মূলত বিদ্যমান রাজনৈতিক কাঠামোর মধ্যে ক্ষমতার নতুন অংশীদার সৃষ্টি করতে চেয়েছিল সাংবিধানিক কাউন্সিল গঠনের মধ্য দিয়ে।
আরও পড়ুনজুলাই সনদ নিয়ে লুকোচুরি হলে ভালো হবে না২৭ অক্টোবর ২০২৫বিএনপিসহ কয়েকটি দলের বিরোধিতার মুখে কমিশনে প্রস্তাবটি আর আলোচনায় রাখতে পারেনি। কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে যথেষ্ট অসংগতি রয়েছে বলে মনে হচ্ছে, যা দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে নতুন অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিতে পারে।
সংবাদমাধ্যম থেকে পাওয়া খবরে জানা যায়, জুলাই সনদ অনুযায়ীই সংবিধান সংস্কার পরিষদকে সংবিধানে পরিবর্তন আনতে হবে।
চাইলেও আগামী জাতীয় সংসদ তাদের ইচ্ছেমতো সংবিধানে পরিবর্তন, পরিবর্ধন, পরিমার্জন, সংযোজন, বিয়োজন করতে পারবে না। এ থেকে পরিষ্কার, গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী প্রথম সংসদের কোনো ভূমিকা রাখার সুযোগ নেই সংবিধান পরিবর্তন বা সংস্কারে।
এর ফলে ভিন্নমতের অংশগ্রহণ, সংসদে আলোচনার গণতান্ত্রিক পরিবেশ থেকে বঞ্চিত হতে হবে দেশকে। প্রকৃতপক্ষে সংবিধান বিষয়ে আগামীর নির্বাচিত সংসদকে ঠুঁটো জগন্নাথ-এ পরিণত করতে চাইছে কমিশন।
ঐকমত্য কমিশন সুপারিশ করেছে, পরবর্তী সংসদ নির্বাচনে নির্বাচিত ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত সংবিধান সংস্কার পরিষদ প্রথম অধিবেশনের শুরু থেকে ২৭০ দিনের মধ্যে জুলাই সনদ অনুসারে সংবিধান সংস্কারের কাজ শেষ করবে।
এই ‘সংবিধান সংস্কার পরিষদ’ বিষয়টিও পরিষ্কার নয়। ঐকমত্য কমিশনের আলোচনার সময় এটি নিয়ে যথেষ্ট আলোচনা হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই।
যত দূর জানি, কমিশনে এ নিয়ে আলাপই করা হয়নি। তবে এই ‘সংবিধান সংস্কার পরিষদ’ও বাধ্য থাকবে হুবহু কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে। তাদের নিজস্ব কোনো মত, পরিবর্তন-পরিমার্জনের সুযোগ থাকছে না।
অর্থাৎ ঐকমত্য কমিশনই জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের পরিবর্তে একটি অনির্বাচিত প্রতিনিধিদল হিসেবে কার্যত ক্ষমতা ধারণ করবে।
কমিশন গণভোটের বিষয়টিও উল্লেখ করেছে তাদের সুপারিশে। তারা এমনকি জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোট আয়োজন করা যায় বলে মত দিয়েছে, যা সম্পূর্ণ অগ্রাহ্যযোগ্য এবং বাংলাদেশের বাস্তবতায় অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে ক্ষতির কারণ হতে পারে।
দেশের মানুষের ভোটের অধিকার নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে গিয়ে আওয়ামী লীগ পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছে। গণধিক্কৃত দলে পরিণত হয়েছে। রাজনীতিতে এখন নিষিদ্ধ। ইতিহাসের ট্র্যাজেডি হচ্ছে, ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না। ফেব্রুয়ারির নির্বাচন অনুষ্ঠানকে যারা বাধাগ্রস্ত করতে চাইছে ইতিহাসের শিক্ষার কথা তাদের বিবেচনায় নেওয়া উচিত।গণভোট আয়োজনে যেমন খরচের বিষয়টি আছে। তেমনি ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারসহ তার মিত্রদের ষড়যন্ত্রও থেমে নেই।
এ অবস্থায় গণভোট ব্যর্থ হওয়ার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। তা ছাড়া জুলাই অভ্যুত্থানের বড় একটি দলকে নাখোশ রেখে গণভোট আয়োজন নতুন রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টিরই নামান্তর বলে মনে হচ্ছে।
কমিশনের আচরণে এমন মনে হওয়া স্বাভাবিক যে কাউকে খুশি করতে এবং কাউকে রুষ্ট করতে এসব সুপারিশ আনা হয়েছে।
গণ-অভ্যুত্থানের পর একটি গ্রহণযোগ্য, কার্যকর, বিভিন্ন মতের আলাপ-আলোচনার মধ্যে দিয়ে গণতান্ত্রিক সংসদ জুলাই সনদ বাস্তবায়নে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে।
শুধু কাগজে-কলমে কিছু সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়ন করলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির উন্নতি ঘটবে না। জনগণের মতামতের ভিত্তিতে গঠিত সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য ভোট এবং কার্যকর সংসদ পারে জুলাই অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন ঘটাতে।
কিন্তু সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশ নিয়ে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তা জাতীয় নির্বাচনকে নতুন করে অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলেছে। সরকার মুখে মুখে বলছে বটে ফেব্রুয়ারিতেই নির্বাচন হবে; কিন্তু বাধাগুলো দূর করার প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিচ্ছে না।
দেশের মানুষের ভোটের অধিকার নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে গিয়ে আওয়ামী লীগ পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছে। গণধিক্কৃত দলে পরিণত হয়েছে। রাজনীতিতে এখন নিষিদ্ধ।
ইতিহাসের ট্র্যাজেডি হচ্ছে, ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না। ফেব্রুয়ারির নির্বাচন অনুষ্ঠানকে যারা বাধাগ্রস্ত করতে চাইছে ইতিহাসের শিক্ষার কথা তাদের বিবেচনায় নেওয়া উচিত।
ড. মারুফ মল্লিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক
*মতামত লেখকের নিজস্ব