রমজানের আগে দাম বাড়াতে সেই পুরোনো কৌশল
Published: 19th, February 2025 GMT
‘দেখেন ভাই, বোতলে লেখা ৮৫২; কিনলাম ৮৮০ টাকায়। এই পাঁচ লিটারে যে আমার ২৮ টাকা বেশি দিতে হইল, তাইলে দ্যাশে পরিবর্তনটা হইছে কী?’ গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর কারওয়ান বাজার থেকে বেশি দরে তেল কেনার পর বারুদকণ্ঠে কথাগুলো বলেছিলেন শাহরিয়ার আলম। আঙুলের ইশারায় তাঁর দেখিয়ে দেওয়া সেই দোকানে দাম যাচাইয়ে যায় সমকাল। দাম বেশি নেওয়ার কারণ জানতে চাইলে সংশ্লিষ্ট দোকানি বলেন, ‘বোতলে লেখা দরেই ডিলার থেকে তেল কিনতে হইছে। সাড়ে আটশ টাকা পুঁজি খাটায়া ২৮ টাকা লাভ করতে না পারলে ব্যবসা করব কেমনে?’
ভোজ্যতেল নিয়ে এমন ক্ষোভের দহন এখন সবখানেই। ক্রেতারা যেমন ফুঁসছেন, ছোট ব্যবসায়ীরাও ত্যক্ত-বিরক্ত। গতকাল রাজধানীর কারওয়ান বাজার, মহাখালী, হাতিরপুলসহ বেশ কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, বোতলজাত সয়াবিন তেল পুরোপুরি উধাও। কয়েকটি দোকানে মিললেও গুনতে হচ্ছে বাড়তি টাকা। এ কারণে খোলা তেলের দামও আকাশ ছুঁয়েছে। প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেল কেনাবেচা হচ্ছে ১৮০ থেকে ১৮২ টাকায়। অথচ সরকারের নির্ধারিত দর ১৫৭ টাকা। সে হিসাবে প্রতি লিটারে ভোক্তাকে বাড়তি গুনতে হচ্ছে ২৩ থেকে ২৫ টাকা।
আমদানি সংকট দেখিয়ে কোম্পানিগুলো তেল সরবরাহ তলানিতে ঠেকিয়েছে। দৈনিক সাড়ে পাঁচ হাজার টন চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ হচ্ছে আড়াই হাজার টন। এতে বাজারে এক ধরনের কৃত্রিম সংকট দেখা দিয়েছে। এমন পরিস্থিতি চলছে তাও দুই-তিন মাস। খোদ বাণিজ্য মন্ত্রণালয়েরই দুটি সংস্থার পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে কৃত্রিম সংকটের ইঙ্গিত। তবু তাদের যেন কিছুই করার নেই। শুধু বাজার পরিদর্শনে গিয়ে ছোট ব্যবসায়ীকে জরিমানা করে দায় সারছে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, তদারকি আরও জোরদার করা হচ্ছে। অচিরেই সংকট কেটে যাবে।
ট্যারিফ কমিশন সূত্রে জানা গেছে, দেশে প্রতি মাসে তেলের চাহিদা সর্বোচ্চ ১ লাখ ৭০ হাজার টন। যেখানে ১২ পরিশোধনকারী প্রতিষ্ঠানের দৈনিক উৎপাদনক্ষমতা ২৫ হাজার ৫০০ টন। আমদানিও হচ্ছে পর্যাপ্ত। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, এত তেল যাচ্ছে কোথায়? ভোক্তাদের অভিযোগ, গণআন্দোলনের মাধ্যমে নতুন সরকার এলো। তবে বাজার ব্যবস্থাপনায় এক আনাও বদলায়নি। সিন্ডিকেট রয়ে গেছে আগের মতোই।
খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ীর অভিযোগের তীর আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের দিকে। তারা বলছেন, সরকারি সংস্থা শুধু ছোট দোকানিকে জরিমানা করে দায় এড়াচ্ছে। অথচ কোনো মিলে গিয়ে তদারকি কিংবা জরিমানা করছে না। গত দু’দিনে ঢাকার ছোট ও মাঝারি পর্যায়ের অন্তত ২০ ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলেছে সমকাল। তারা বলেন, কোম্পানিগুলো তাদের জানিয়েছে, আগামী শনিবার থেকে অপরিশোধিত তেলের জাহাজ বন্দরে নোঙর করবে। পরিশোধনের পর বোতলজাত করে তা ২৬ ফেব্রুয়ারি থেকে সরবরাহ করা হবে।
তবে অপরিশোধিত তেল পরিশোধন করে চার দিনের মধ্যে বাজারজাত করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। হয়তো আমদানিকারকরা কৃত্রিম সংকট তৈরির জন্য বোতলজাত তেল মজুত করেছেন। রমজান সামনে রেখে তারা সংকট দেখিয়ে সরকারকে চাপে ফেলে দাম বাড়ানোর কৌশলে হাঁটছেন। গত জানুয়ারিতেই আমদানিকারকরা ট্যারিফ কমিশনে দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দেন। তবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় রমজানে দাম বাড়বে না বলে সাফ জানিয়ে দেয়। এর পর থেকেই ভোজ্যতেল নিয়ে ভেলকি শুরু করে তারা।
খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ীর কথার সত্যতা মেলে দুই মাস আগের ভোজ্যতেল-কাণ্ডের ঘটনায়। গত ৯ ডিসেম্বর লিটারে ৮ টাকা বাড়ানোর ঘোষণা দেওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই বাজারে বোতলজাত তেলে ভরে যায় বাজার।
দুই সংস্থার পর্যবেক্ষণেও সংকট সৃষ্টির তথ্য
তেলের দাম বেশি রাখার প্রমাণ পেয়েছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরও। প্রতিষ্ঠানটির চারটি পরিদর্শক দল ৯ ও ১০ ফেব্রুয়ারি ঢাকার কেরানীগঞ্জের জিনজিরা, নয়াবাজার, মৌলভীবাজার ও কারওয়ান বাজার পরিদর্শন করে প্রতিবেদন তৈরি করে। এতে দেখা গেছে, জিনজিরা বাজারে জাকির জেনারেল স্টোর তীর ব্র্যান্ডের পাঁচ লিটারের বোতলের দর ৮৫২ টাকা মুছে বিক্রি করছে ৯০০ টাকায়, দুই লিটার বোতলের দর ৩৫০ টাকা মুছে ৪০০ টাকায় বেচা হচ্ছে। খোলা তেলের লিটারও কেনাবেচা হচ্ছে বেশি দরে। এ ছাড়া ব্যবসায়ীরা তেলের সঙ্গে অন্য পণ্য কেনার শর্ত জুড়ে দিচ্ছেন। চারটি বাজারেই এমন চিত্র পেয়েছে সংস্থাটি। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আসছে রমজানে বাজারে ভোজ্যতেলের বাড়তি চাহিদা ঘিরে পরিশোধনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো দাম বাড়ানোর জন্য সরবরাহে সংকট সৃষ্টি করতে পারে।
প্রায় একই ধরনের তথ্য মিলেছে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের ভোজ্যতেলের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে করা একটি পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনেও। এতে বলা হয়েছে, বোতলজাত সয়াবিন তেলের সরবরাহ কমে যাওয়া পুরোপুরি অস্বাভাবিক। কোথাও না কোথাও তেলের মজুতের ব্যাপারে তথ্যের ঘাটতি কিংবা অতি মুনাফার প্রবণতা রয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত সয়াবিন ও পাম অয়েলের আন্তর্জাতিক দর এখন নিম্নমুখী। আমদানি ও এলসি খোলার চাহিদাও আগের চেয়ে বেশি। স্থানীয় উৎপাদন ক্ষমতা চাহিদার তিন গুণ। দাম ও সরবরাহ স্থিতিশীল করতে শুল্ক ও করে রেয়াত দেওয়া হয়েছে। নিত্যপণ্য হিসেবে কমানো হয়েছে এলসি মার্জিন। ফলে সরবরাহ কমে যাওয়ার পেছনে অসাধুতা রয়েছে।
বাংলাদেশ পাইকারি ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশেম সমকালকে বলেন, তিন মাস ধরেই সংকট। আমদানিকারকদের দাবি অনুযায়ী, চার দিনের মধ্যে পরিশোধন করে বাজারে বোতলজাত তেল সরবরাহ করা সম্ভব বলে আমি মনে করি না।
কার কত উৎপাদন ক্ষমতা
ট্যারিফ কমিশনের তথ্য বলছে, সবচেয়ে বেশি ভোজ্যতেল উৎপাদন সক্ষমতা টিকে গ্রুপের। প্রতিষ্ঠানটি প্রতিদিন সাড়ে ৭ হাজার টন তেল পরিশোধন করতে পারে। এর পর রয়েছে সিটি গ্রুপ। তাদের দৈনিক পরিশোধন ক্ষমতা সাড়ে ৩ হাজার টন। মেঘনা গ্রুপ দিনে পরিশোধন করতে পারে ২ হাজার ৪০০ টন। এভাবে ১২ প্রতিষ্ঠানের দৈনিক পরিশোধন ক্ষমতা সাড়ে ২৫ হাজার টন। সব মিলিয়ে প্রতিষ্ঠানগুলোর বার্ষিক পরিশোধনক্ষমতা ৭৬ লাখ ৫০ হাজার টনের মতো।
বছরে চাহিদা কত
দেশে প্রতি মাসে ভোজ্যতেলের চাহিদা সর্বোচ্চ ১ লাখ ৭০ হাজার টন। সেই হিসাবে দৈনিক চাহিদা রয়েছে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার টন। তবে রমজানে এটি প্রায় দ্বিগুণ হয়। সব মিলিয়ে দেশে বছরে ভোজ্যতেলের চাহিদা রয়েছে ২৪ লাখ টনের মতো। এর মধ্যে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত সরিষা ও রাইসব্রান তেল পাওয়া যায় প্রায় ৩ লাখ টন। চাহিদার বাকি তেল বিশ্ববাজার থেকে অপরিশোধিত সয়াবিন, পাম ও সয়াবিন সিড আমদানি করে তা পরিশোধনের মাধ্যমে পূরণ করা হয়।
কী বলছেন আমদানিকারকরা
উৎস দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বন্দরে জাহাজ জট লেগে যাওয়ার কারণে তেল আসতে দেরি হচ্ছে বলে জানান আমদানিকারকরা। তবু তারা মজুত তেল নিয়মিত সরবরাহ করছেন। রোজায় সংকট হবে না। আগামী ২৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ৭ মার্চের মধ্যে তিন-চারটি কোম্পানির অন্তত দেড় লাখ টন তেল আসবে।
বসুন্ধরা মাল্টি ফুড অ্যান্ড বেভারেজের পরিচালক রেদোয়ানুর রহমান সমকালকে বলেন, নভেম্বরে ডলার পরিশোধ করা হয়েছে। জাহাজ আসতে সাধারণত ৪০ থেকে ৪৫ দিন লাগে। আমাদের জাহাজ আসার কথা ছিল জানুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে, অথচ এখনও আসেনি। ফেব্রুয়ারির শেষদিকে এসে পৌঁছাবে। এটা পরিশোধন হয়ে বাজারে যেতে লাগতে পারে এক সপ্তাহ ।
সরকার বদলেও মেলেনি মুক্তি
সরকার বদল হলেও সিন্ডিকেট ভাঙা সম্ভব হয়নি বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড.
বাণিজ্য সচিব (রুটিন দায়িত্ব) মো. আব্দুর রহিম বলেন, দৈনিক ২৫০০ টনের বেশি তেল সরবরাহ করা হচ্ছে বাজারে। তবে কোথাও সমস্যা থাকতে পারে। সে জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয় নিয়মিত বাজার তদারকি করছে। রমজান সামনে রেখে আরও নিবিড় তদারকি চলবে। যে পরিমাণ আমদানি হচ্ছে এক সপ্তাহের মধ্যে স্বাভাবিক হয়ে যাবে। তা ছাড়া আমদানি বাড়াতে সহজে অর্থায়ন করা হবে ব্যবসায়ীদের। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ভ জ যত ল র ব যবস য় র অপর শ ধ ত হ জ র টন ব তলজ ত সমক ল রমজ ন উৎপ দ ক ষমত সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
২০২৬ সালে বিশ্ববাজারে জিনিসপত্রের দাম আরও ৭% কমতে পারে, বাংলাদেশে কেন কমছে না
চলতি বছরের শুরু থেকেই বিশ্ববাজারে দাম কমার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুসারে, চলতি বছরে সামগ্রিকভাবে পণ্যমূল্য ৭ শতাংশ কমবে। আগামী বছর, অর্থাৎ ২০২৬ সালে পণ্যমূল্য আরও ৭ শতাংশ কমবে। এ দাম হবে ছয় বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম।
কিন্তু বাংলাদেশের বাজারে তার প্রভাব নেই। দেশে মূল্যস্ফীতির হার এখনো ৮ শতাংশের ঘরে। যদিও একসময় তা দুই অঙ্ক ছাড়িয়ে গিয়েছিল। গত সেপ্টেম্বর মাসে মূল্যস্ফীতি ৮ দশমিক ৩৬ শতাংশ হয়েছে। দেশের মানুষকে এখনো বাড়তি দামেই পণ্য ও সেবা কিনতে হচ্ছে। আগামী বছর নিত্যপণ্যের দাম কমবে কি না, সেই নিশ্চয়তাও নেই। বিশ্লেষকেরা বলছেন, ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম কমলেও দেশে এর প্রভাব কম।
বিশ্বব্যাংকের ‘কমোডিটি মার্কেটস আউটলুক অক্টোবর ২০২৫’ শীর্ষক প্রতিবেদনের তথ্যানুসারে, ২০২৫ সালের শুরু থেকেই বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম কমতে শুরু করেছে। যার মূল কারণ হিসেবে তারা চিহ্নিত করেছে জ্বালানির দাম কমে যাওয়া। সেই সঙ্গে আরও কিছু কারণ চিহ্নিত করেছে তারা। সেগুলো হলো চীনে তেলের চাহিদা বৃদ্ধির গতি কমে যাওয়া এবং বিশ্ববাজারে সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় তেলের দামে বড় ধরনের পতন ঘটা। খাদ্যপণ্যের দাম বছরের শুরু থেকে ধীরে ধীরে কমতে থাকে, কিন্তু বছরের প্রথমার্ধে প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে পানীয় পণ্যের দাম হঠাৎ অনেকটা বেড়ে যায়। এ ছাড়া বছরের দ্বিতীয়ার্ধে সোনার দাম রেকর্ড উচ্চতায় ওঠে। মূলত রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যে নিরাপদ বিনিয়োগ মাধ্যম হিসেবে মানুষ সোনার দিকে ছুটেছেন।
বিশ্ববাজারে পণ্যের মূল্য নির্ধারণে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখে জ্বালানি তেলের দাম। বিশ্বব্যাংক গ্রুপের পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০২৫ সালে জ্বালানির দাম আগের বছরের তুলনায় ১২ শতাংশ এবং ২০২৬ সালে আরও ১০ শতাংশ কমবে। ২০২৭ সালে তা আবার প্রায় ৬ শতাংশ বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস ২০২৬ সালে কৃষিপণ্য, খাদ্য ও কাঁচামালের দাম কমবে। চলতি বছরেও এসব পণ্যের দাম কমেছে।
জ্বালানি তেলবিশ্বব্যাংকের ২০২৬ সালের পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, প্রাকৃতিক গ্যাসের চাহিদা বাড়ায় গ্যাসের দাম কিছুটা বাড়লেও তেলের দাম কমে যাবে এবং সেই প্রভাবকে ছাপিয়ে যাবে। ২০২৫ সালে ব্রেন্ট ক্রুড তেলের দাম হতে পারে ব্যারেলপ্রতি গড়ে ৬৮ ডলার; ২০২৪ সালের ৮১ ডলারের তুলনায় যা বেশ কম। ২০২৬ সালে এই দাম আরও কমে ব্যারেলপ্রতি গড়ে ৬০ ডলারে নামতে পারে ধারণা করা হচ্ছে।
এই পূর্বাভাস অনুযায়ী, তেলের ব্যবহার বৃদ্ধির হার আরও কমবে—মূলত চীনের চাহিদা কমে যাওয়া, বৈদ্যুতিক ও হাইব্রিড গাড়ির দ্রুত প্রসার ও বৈশ্বিক তেল সরবরাহ বৃদ্ধির কারণে এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে।
২০২৫ সালে বৈশ্বিক তেলের বাজারে সরবরাহ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। ২০২৬ সালে তা আরও বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ২০২০ সালের সর্বোচ্চ মাত্রার তুলনায় প্রায় ৬৫ শতাংশ বেশি হবে এ সরবরাহ।
কৃষিপণ্যবিশ্বব্যাংক গ্রুপের পূর্বাভাস অনুযায়ী, কৃষিপণ্যের মূল্যসূচক ২০২৫ সালে স্থিতিশীল আছে। ২০২৬ সালে তা সামান্য ২ শতাংশ ও ২০২৭ সালে আরও ১ শতাংশ কমবে।
খাদ্যপণ্যের দাম, যেমন শস্য, তেল, প্রোটিনজাত খাবারসহ অন্যান্য খাদ্যের দাম সাম্প্রতিক সীমার কাছাকাছি থাকবে। তবে মাঝেমধ্যে সামান্য কিছুটা ওঠানামা থাকবে। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, প্রধান ফসলগুলোর উৎপাদন বৃদ্ধির হার আবার দীর্ঘমেয়াদি প্রবণতায় ফিরে আসছে।
২০২৫ সালের বাকি সময়ে সয়াবিনের দাম কমবে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের যে সয়াবিন সাধারণত চীনে রপ্তানি হয়, তা এবার কম দামে অন্য ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করতে হতে পারে। চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যযুদ্ধের অন্যতম প্রধান ক্ষেত্রে হচ্ছে এই সয়াবিন। চীন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে সয়াবিন কিনছে না। ফলে ২০২৬ ও ২০২৭ সালে এই পণ্যের দাম তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল থাকবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বিশ্ববাজারে দাম কমে গেলে যুক্তরাষ্ট্রে সয়াবিন চাষের পরিমাণ কিছুটা কমতে পারে, তবে ব্রাজিল তার সয়াবিন আবাদ আরও বাড়ানোর পথে রয়েছে। পানীয় পণ্যের দাম ২০২৬ সালে ৭ শতাংশ ও ২০২৭ সালে প্রায় ৫ শতাংশ কমবে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।
এদিকে চলতি বছর সারের দাম সামগ্রিকভাবে ২১ শতাংশ বাড়তি। চাহিদা বৃদ্ধি, বাণিজ্যিক প্রতিবন্ধকতা ও কিছু অঞ্চলে সরবরাহ–ঘাটতির কারণে এ দাম বেড়ে যাওয়া। ২০২৬ ও ২০২৭ সালে দাম প্রায় ৫ শতাংশ কমতে পারে। তবু ২০১৫-১৯ সালের গড় দামের তুলনায় তা অনেক বেশি থাকবে। এর কারণ হলো উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়া, রপ্তানি সীমাবদ্ধতা ও চলমান আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা।
চীন ইতিমধ্যে নাইট্রোজেন ও ফসফেট সার রপ্তানিতে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে। অন্যদিকে পটাশ সরবরাহকারী বড় দেশ বেলারুশ এখনো ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিষেধাজ্ঞার আওতায় আছে। রাশিয়া ও বেলারুশ—উভয় দেশই সারের ওপর ইউরোপীয় ইউনিয়নের আরোপিত নতুন শুল্কের সম্মুখীন।
দেশে কেন দাম বেশিবিশ্ববাজারে দাম কমলেও দেশের বাজার দাম না কমার অন্যতম প্রধান কারণ ডলারের দামের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন। গত তিন বছরে ডলার দাম অনেকটা বেড়েছে। সেই সঙ্গে দেশের অনেক আমদানি পণ্যে শুল্ক বেশি বলে মনে করেন গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান।
মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বাজার ব্যবস্থাপনার কারণে দাম কমছে না। বাজারে চাহিদা কত বা কখন কোন পণ্য আমদানি করতে হবে, সে বিষয়ে যথাযথ তথ্যের ঘাটতি আছে। ফলে সময়মতো পণ্য আমদানি হয় না।
আরেকটি বিষয় হলো দেশে যেসব পণ্য আমদানি করা হয়, তার অনেক কিছু উৎপাদিতও হয়। কিন্তু বিনিয়োগ কমে যাওয়ায় এসব পণ্যের সরবরাহে টান পড়েছে। বাজারের পণ্যমূল্যে তার প্রভাব পড়ছে বলে মনে করছেন মোস্তাফিজুর রহমান।
তিন বছর আগে দেশে ডলারের দাম ছিল ৮৬ টাকা। এখন তা বেড়ে ১২২ টাকা হয়েছে। এ ছাড়া কয়েক মাস ধরে আমদানির ঋণপত্র খোলাও কমেছে। এতে আমসদানিতে চাপ পড়ছে।
দেশের বাজার উচ্চ মূল্যের কারণ সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক সেলিম রায়হান বলেন, বিশ্ববাজারে জ্বালানি, কৃষি ও খাদ্যপণ্যের দাম কমলেও বাংলাদেশের বাজারে তার প্রভাব দেখা যাচ্ছে না। জ্বালানি ও পরিবহন ব্যয়, শুল্ক ও করের চাপ ও বাজার ব্যবস্থাপনায় অদক্ষতার কারণে দাম কমছে না। পাইকারি থেকে খুচরা পর্যন্ত অতি মুনাফা ও অস্বচ্ছ বাণিজ্যিক শৃঙ্খলের কারণেও বাজারে কৃত্রিমভাবে উচ্চমূল্য বিরাজ করছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে টাকার অবমূল্যায়ন। ফলে আমদানি ব্যয় বেড়ে গেছে এবং আন্তর্জাতিক মূল্যহ্রাসের সুফল ভোক্তাপর্যায়ে পড়ছে না।
সেলিম রায়হান আরও বলেন, এ ছাড়া রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তার কারণ ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা নেমে এসেছে। বিনিয়োগকারীরা নতুন ঝুঁকি নিতে চাচ্ছেন না। পণ্য পরিবহন ও আমদানি ব্যাহত হচ্ছে। ফলে সরবরাহ শৃঙ্খল দুর্বল হয়ে পড়ছে। এই পরিস্থিতিতে বাজারে পণ্যের ঘাটতি ও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়। এটি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
দেশে তিন বছর ধরেই উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে গড় মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১০ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ। সম্প্রতি তা কিছুটা কমলেও সেপ্টেম্বর মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৮ দশমিক ৩৬ শতাংশ। গত আগস্ট মাসে এই হার ছিল ৮ দশমিক ২৯ শতাংশ।