বিদ্যুতের দাম না বাড়িয়ে ব্যবহার কমানোয় জোর: বিদ্যুৎ উপদেষ্টা
Published: 24th, February 2025 GMT
দেশে প্রাথমিক জ্বালানির সরবরাহ–সংকট আছে বলে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। তিনি বলেন, জ্বালানি কেনার খরচ অনেক বেশি। বিদ্যুৎ উৎপাদনে বছরে ৪২ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। ভর্তুকি কমানোর উপায় হলো বিদ্যুতের দাম বাড়ানো বা ব্যবহার কমানো। বিদ্যুতের দাম না বাড়িয়ে ব্যবহার কমানোয় জোর দেওয়া হয়েছে।
আজ সোমবার রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টারে আয়োজিত এক সম্মেলনে অনলাইনে যুক্ত হয়ে এ কথাগুলো বলেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা। ‘রিকমেন্ডেশনস বাই দ্য টাস্কফোর্স অন রিস্ট্র্যাটেজাইজিং দ্য ইকোনমি’ শীর্ষক দুই দিনের এ সম্মেলনের আয়োজন করেছে বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। প্রথম দিনে ‘রিবিল্ডিং সাসটেইনেবল ফিউচারস: কানেকটিভিটি অ্যান্ড এনার্জি’ শীর্ষক তৃতীয় অধিবেশনে প্রধান অতিথি ছিলেন বিদ্যুৎ উপদেষ্টা।
ফাওজুল কবির খান বলেন, শীতের সময় বিদ্যুতের চাহিদা থাকে ৯ থেকে ১০ হাজার মেগাওয়াট। গরমের সময় এটি ১৭ থেকে ১৮ হাজার মেগাওয়াট হতে পারে। শীতাতপনিয়ন্ত্রিত যন্ত্র (এসি) ২৫ ডিগ্রির ওপরে রাখলে দুই হাজার মেগাওয়াট চাহিদা কমতে পারে। ইতিমধ্যে সবাইকে এটি মেনে চলার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কারও ঘরে গিয়ে এটি তদারকি করা হবে না। তবে ফিডার (একটি নির্দিষ্ট এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহের কেন্দ্রস্থল) থেকে চাহিদা ও সরবরাহ নজরদারি করা হবে।
দেশের কয়লা উত্তোলন নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে জ্বালানি উপদেষ্টা বলেন, ‘সরকার ইতিমধ্যে ১৭০টির বেশি আন্দোলন মোকাবিলা করেছে। কয়লা তোলার সিদ্ধান্ত নিয়ে নতুন আন্দোলনের সূত্রপাত করতে চাই না। এটি রাজনৈতিক সরকারের জন্য রেখে দেওয়া হচ্ছে।’
বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) চেয়ারম্যান জালাল আহমেদ বলেন, বিদ্যুৎ–সক্ষমতা অনেক, অথচ জ্বালানির অভাবে চাহিদামতো উৎপাদন করা যাচ্ছে না। মহাপরিকল্পনা করেই এসব করা হয়েছে। এতে জ্বালানি গুরুত্ব পায়নি। টাস্কফোর্সের সুপারিশেও জ্বালানি নিয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি, এটা বিপজ্জনক।
সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার জ্বালানিবিষয়ক বিশেষ সহকারী ম তামিম। সঞ্চালনাও করেন তিনি। শেষে তিনি বলেন, বর্তমানে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে দুই থেকে তিন হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনে সরবরাহ করা যাবে। এটি মাথায় রেখেই বিদ্যুৎকেন্দ্র বানাতে হবে। বাস্তব পরিকল্পনা করতে হবে।
বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক ইজাজ হোসেন বলেন, একসময় গ্যাস ছিল, বিদ্যুৎকেন্দ্র ছিল না। পরে গত ১৫ বছরে অনেক বিদ্যুৎকেন্দ্র করা হয়েছে, যা দরকার ছিল না। এখন সমস্যা হচ্ছে জ্বালানি কেনার সামর্থ্য নেই।
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) বাংলাদেশ আবাসিক মিশনের কান্ট্রি অপারেশনস হেড না উন কিম বলেন, জ্বালানি সাশ্রয়ে অতটা জোর দেওয়া হয় না। জ্বালানির সঠিক ব্যবহারে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। ধাপে ধাপে উন্নতির জন্য একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো–অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) বাংলাদেশ দপ্তরের প্রধান প্রতিনিধি ইচিগুচি তোমোহিদে বলেন, বাংলাদেশে ৪০টি মন্ত্রণালয় ও ৬০টি বিভাগ দিয়ে প্রশাসনিক কাঠামো পরিচালিত হয়। এটা অনেক বেশি। জাপানে মাত্র ৩০টি মন্ত্রণালয়। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ে দুটি বিভাগ, তাদের মধ্যে সমন্বয়ে সমস্যা আছে।
বিদ্যুৎ খাতে আমদানিনির্ভরতাকে মূল সমস্যা উল্লেখ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক মোশাহিদা সুলতানা বলেন, বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতের চলমান সংকট থেকে উত্তরণ সহজে সম্ভব নয়। আরও কয়েক বছর এমনই থাকবে। কয়লা, এলএনজি–নির্ভরতা থেকে বের হয়ে আসাটা কঠিন।
এতে আরও বক্তব্য দেন জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব নুরুন নাহার চৌধুরী। পরিবহন ব্যবস্থাপনা নিয়ে সম্মেলনে একটি নিবন্ধ উপস্থাপন করেন টাস্কফোর্স অন রিস্ট্র্যাটেজাইজিং দ্য ইকোনমির সদস্য মো.
বিল্ডিং সাসটেইনেবল ফিউচার কানেকটিভিটি অ্যান্ড এনার্জি শিরোনামে একটি লিখিত নিবন্ধ সরবরাহ করা হয় সম্মেলনে। টাস্কফোর্স অন রিস্ট্র্যাটেজাইজিং দ্য ইকোনমির সদস্য সেলিম রায়হানের এটি উপস্থাপন করার কথা থাকলেও তিনি উপস্থিত হতে পারেননি। এতে বিদ্যুৎ খাত উন্নয়নে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়নের সুপারিশ করা হয়।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ব যবহ র উপদ ষ ট সরবর হ র কম ন সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
ইরানের ভুলে আজারবাইজান যেভাবে ইসরায়েলের দিকে ঝুঁকে পড়ল
ইরানের প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও সাবেক প্রেসিডেন্ট আকবর হাশেমি রাফসানজানি তাঁর স্মৃতিকথায় ১৯৯৩ সালের নভেম্বরে প্রথম নাগোর্নো-কারাবাখ যুদ্ধের সময় আজারবাইজানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হেইদার আলিয়েভের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাতের কথা স্মরণ করেছেন। রাফসানজানির মতে, আর্মেনিয়ার সঙ্গে সংঘাতে ইরানের সামরিক সহায়তা চেয়েছিলেন আলিয়েভ।
রাফসানজানি লিখেছেন, ‘বারবার করে বলা তাঁর (আলিয়েভ) একটি মন্তব্য ছিল যে আর্মেনিয়ার সঙ্গে যুদ্ধের সুযোগ নিয়ে ইরানের উচিত আজারবাইজানে তার উপস্থিতি বাড়ানো। মাঝেমধ্যে তিনি এ–ও বলতেন, আজারবাইজান একসময় ইরানের অন্তর্ভুক্ত ছিল। আমাদের (ইরান) সেখানে এসে এটিকে (আজারবাইজান) রক্ষা করতে ও নিয়ন্ত্রণ নিতে অনুরোধ করতেন।’ তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন যে ইরান যদি আজারবাইজানকে তার প্রভাববলয়ে নিয়ে আসে, তবে তা পুরো ককেশাসে রাশিয়ার আধিপত্যকে নাড়িয়ে দেবে।
৩২ বছর পর পরিস্থিতি সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে। আজারবাইজানের কর্মকর্তারা এখন আর বাকুর বিষয়ে তেহরানের সম্পৃক্ততা চান না।
এখন ইরানের রাজনৈতিক নেতারাও এই ছোট প্রতিবেশী দেশটির সঙ্গে সম্পর্ক কীভাবে এগিয়ে নেবে তা নিয়ে অনিশ্চিত। আজারবাইজান ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে স্বাধীনতা লাভ করে, কিন্তু গোলস্তান (১৮১৩) এবং তুর্কমেনচায় (১৮২৮) চুক্তির মাধ্যমে রুশ সাম্রাজ্যের কাছে হস্তান্তরের আগে এটি একসময় ইরানের অংশ ছিল।
গত দশকে দুটি দেশের (ইরান ও আজারবাইজান) মধ্যে ক্ষমতার গতিশীলতা উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। আজারবাইজানের অনেকে ও দেশটির গণমাধ্যম এখন ইরানেরই কিছু অংশকে আজারবাইজানের সঙ্গে সংযুক্ত করার দাবি তুলছে।
এদিকে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইরানের সাম্প্রতিক ১২ দিনের যুদ্ধ তেহরান ও বাকুর রাজনৈতিক বিভেদকে আরও গভীরতার দিকে নিয়ে গেছে। তেহরানে আজারবাইজানের ইসরায়েলের সঙ্গে ক্রমবর্ধমান সামরিক ও গোয়েন্দা সম্পর্ক নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে।
ইসরায়েলি ড্রোন কোথা থেকে এল?ইসরায়েলের সঙ্গে ইরানের যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরপরই ইরানের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের কাছে বসবাসকারীরা আজারবাইজানের দিক থেকে ইসরায়েলি ড্রোন প্রবেশের খবর দেন। পরবর্তী সময়ে ইরানের রাষ্ট্রীয় সম্প্রচারমাধ্যমও এই খবর নিশ্চিত করে। প্রতিবেদনগুলোতে বলা হয়েছে যে তেহরান, তাবরিজ, উরমিয়াসহ বিভিন্ন শহরে ইসরায়েলের হামলায় ব্যবহৃত ড্রোনগুলো আজারবাইজান থেকে ইরানে প্রবেশ করেছিল।
বিষয়টি তখন এতটাই আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে যে ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক সংবাদ সম্মেলনে জানায় যে তারা বিষয়টি দেখছে। তবে কয়েক দিন পর ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান বলেন যে আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিয়েভ তাঁকে আশ্বস্ত করেছেন যে ইসরায়েল আজারবাইজানের ভূখণ্ড ব্যবহার করে হামলা চালায়নি।
যদিও এটি ইরানের অনেককে আশ্বস্ত করতে পারেনি। সংবাদমাধ্যম বা রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের কেউই আজারবাইজানের এ বক্তব্যকে গ্রহণ করেনি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তেহরানের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের একজন অধ্যাপক বলেন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও প্রেসিডেন্ট উভয়ই এ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছেন তার মানে ইরান এটি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে।
ওই বিশেষজ্ঞের মতে, ইরান যদি আজারবাইজান সীমান্ত থেকে ইসরায়েলের যুক্ত থাকার বিষয়ে নিশ্চিত না হতো, বিষয়টি এতটা উচ্চপর্যায়ে গুরুত্বসহকারে নেওয়া হতো না।
তিনি আরও যুক্তি দেন যে আলিয়েভের আশ্বাস সম্পর্কে পেজেশকিয়ানের মন্তব্য ককেশাস অঞ্চলে ইরানের পররাষ্ট্রনীতির ব্যর্থতা তুলে ধরে। অধ্যাপক বলেন, ‘পেজেশকিয়ান যা বলেছেন, তা কেবল কূটনৈতিক ভাষা। বাস্তবে শেষ কারাবাখ যুদ্ধের পর থেকে ইরান আজারবাইজানের সঙ্গে কীভাবে মোকাবিলা করবে তা জানে না। এর পর থেকে আজারবাইজান একটি বন্ধুত্বপূর্ণ বা অন্তত নিরপেক্ষ দেশ থেকে বরং একটি শান্ত কিন্তু গুরুতর হুমকির দেশে পরিণত হয়েছে।’
তিনি বাকু ও তেল আবিবের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার আরও প্রমাণ হিসেবে আজারবাইজানীয় ও ইসরায়েলি কর্মকর্তাদের মধ্যে উচ্চপর্যায়ের বৈঠকের কথা উল্লেখ করেন।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আজারবাইজান ইসরায়েলের অন্যতম প্রধান তেল ও গ্যাস সরবরাহকারী হয়ে উঠেছে এবং দেশটি উন্নত মানের ইসরায়েলি সামরিক ও গোয়েন্দা সরঞ্জাম আমদানি করছে। কিছু প্রতিবেদন অনুসারে, ২০১৬ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে ইসরায়েল আজারবাইজানের সামরিক অস্ত্রের প্রায় ৭০ শতাংশ সরবরাহ করেছে।ইরানের দোরগোড়ায় ইসরায়েলসোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর আজারবাইজান প্রথমে ইরানের আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী তুরস্কের কাছাকাছি আসে। পরবর্তী সময়ে দেশটি ইসরায়েলের সঙ্গেও তার সামরিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক গভীর করে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আজারবাইজান ইসরায়েলের অন্যতম প্রধান তেল ও গ্যাস সরবরাহকারী হয়ে উঠেছে এবং দেশটি উন্নত মানের ইসরায়েলি সামরিক ও গোয়েন্দা সরঞ্জাম আমদানি করছে। কিছু প্রতিবেদন অনুসারে, ২০১৬ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে ইসরায়েল আজারবাইজানের সামরিক অস্ত্রের প্রায় ৭০ শতাংশ সরবরাহ করেছে।
এখন আজারবাইজান নতুন সিরীয় সরকারের সঙ্গেও কাজ করছে। বাশার আল-আসাদের পতনের পর নতুন সিরীয় সরকার ইরান থেকে সরে এসেছে।
ওই বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘ককেশাস অঞ্চলে কোনো স্পষ্ট কৌশল না থাকায় ইরান এখন দেখছে যে তেল আবিব তার সীমান্তের দিকে আরও কাছাকাছি আসছে।’
তিনি জোর দিয়ে বলেন যে ইসরায়েল, সিরিয়া ও আজারবাইজানের মধ্যে একটি নতুন আঞ্চলিক জোট দ্রুতই তুরস্কের মাধ্যমে ইসরায়েলকে ইরানের দোরগোড়ায় নিয়ে আসতে পারে। একমাত্র বাধা হলো আর্মেনিয়া ও ইরানের মধ্যকার ৪৩ কিলোমিটার স্থলপথ, যার মাধ্যমে আজারবাইজান তার ছিটমহল এলাকা নাখচিভানের সঙ্গে যুক্ত।
যুক্তরাষ্ট্রের হামলার প্রতিবাদে ইরানে বিক্ষোভ। তেহরান, ইরান, ২২ জুন ২০২৫