অবৈধভাবে কিডনি বিক্রি, মিয়ানমারের দুই নাগরিক জানালেন তাঁদের অভিজ্ঞতা
Published: 28th, February 2025 GMT
‘আমি শুধু একটি বাড়ির মালিক হতে ও ঋণ শোধ করতে চেয়েছিলাম। আর সে কারণেই আমার কিডনি বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নিই।’ বিবিসিকে কথাগুলো বলছিলেন জেয়া (ছদ্মনাম)। তিনি মিয়ানমারের একটি খামারে কাজ করেন।
মিয়ানমারে ২০২১ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের জেরে নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠীর লড়াই শুরু হয়। এর পর থেকে দেশটিতে পণ্যের দাম বাড়তে থাকে। এতে নিজের ছোট্ট পরিবারের খরচ চালাতেও হিমশিম অবস্থায় পড়েন জেয়া। পরিবারের সদস্যদের জন্য আবশ্যকীয় খাবারটুকুও ঠিকমতো জোগাড় করতে পারছিলেন না। তখন গ্রামে তাঁরা তাঁর শ্বশুরবাড়িতে থাকতেন। ইয়াঙ্গুন শহর থেকে গ্রামটিতে যেতে কয়েক ঘণ্টা লাগে।
অভ্যুত্থানের পর থেকে মিয়ানমারে বেকারত্ব বেড়েছে। সংঘাতপূর্ণ পরিস্থিতিতে দেশটির অর্থনীতি ধ্বংস হয়ে গেছে এবং বিদেশি বিনিয়োগকারীরা সরে গেছেন। ইউএনডিপির তথ্য অনুসারে, ২০১৭ সালে মিয়ানমারে জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশ দারিদ্র্যের মধ্যে বাস করছিলেন। ২০২৩ সালের মধ্যে তা বেড়ে অর্ধেকে পৌঁছেছে।জেয়া (ছদ্মনাম) স্থানীয় এমন কয়েকজনকে চিনতেন, যাঁরা তাঁদের একটি করে কিডনি বিক্রি করেছিলেন। তাঁদের দেখে জেয়ার কাছে সুস্থই মনে হতো। আর সে কারণে তিনিও আগ্রহী হয়ে ওঠেন নিজের কিডনি বিক্রি করতে। পরে এ ব্যাপারে নেওয়া শুরু করেন খোঁজখবর।
বিবিসিকে জেয়া বলেন, তিনিসহ ওই গ্রামের আটজন ভারতে গিয়ে একটি করে কিডনি বিক্রি করেছেন।
অঙ্গপ্রত্যঙ্গের অবৈধ বাণিজ্য এশিয়াজুড়েই সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কীভাবে এ প্রক্রিয়া চলে, তা মিয়ানমারের নাগরিক জেয়া ও মিয়ো উয়িন নামের দুই ব্যক্তির গল্পে তুলে ধরেছে বিবিসি।
যেভাবে চুক্তিমিয়ানমার ও ভারত দুই দেশেই মানুষের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বেচাকেনা করা অবৈধ। তবে জেয়া বলেছেন, কিডনি বিক্রির জন্য ‘দালালের’ খোঁজ পেতে তাঁর বেশি বেগ পেতে হয়নি। কথিত দালাল প্রথমে জেয়ার স্বাস্থ্য পরীক্ষার ব্যবস্থা করেন। কয়েক সপ্তাহ পর দালাল জানান, একজন সম্ভাব্য কিডনিগ্রহীতার খোঁজ পাওয়া গেছেন। তিনিও মিয়ানমারের নারী। অস্ত্রোপচারের জন্য দাতা ও গ্রহীতা দুজনকেই ভারতে যেতে হবে বলে জেয়াকে জানানো হয়।
ভারতে কিডনি দাতা-গ্রহীতা যদি ঘনিষ্ঠ আত্মীয় না হন, তবে তাঁদের অবশ্যই ঘোষণা দিতে হয়, পরোপকারের অংশ হিসেবে এ দান করা হচ্ছে। তাঁদের মধ্যে কী ধরনের সম্পর্ক, তা-ও জানাতে হয়।
ডব্লিউএইচওর হিসাবে, ২০১০ সাল থেকে বিশ্বজুড়ে মানুষের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপনের হার ৫০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। বছরে প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার প্রতিস্থাপনের ঘটনা ঘটে। তবে প্রতিস্থাপনের জন্য বিশ্বব্যাপী অঙ্গপ্রত্যঙ্গের চাহিদার মাত্র ১০ শতাংশ পূরণ করা সম্ভব হয়।অন্যদিকে মিয়ানমারে অঙ্গ দান করার ক্ষেত্রে কোনো পরিবারকে তার সদস্যদের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য নথিভুক্ত করাতে হয়। জেয়া জানান, ওই দালাল একটি জাল নথি তৈরি করেছিলেন। তাতে জেয়ার নাম কিডনিগ্রহীতার পরিবারের সদস্যদের তালিকায় উল্লেখ করা হয়।
জেয়া বলেন, দালাল বিষয়টিকে এমনভাবে উপস্থাপন করেছিলেন, যেন তিনি (জেয়া) শ্বশুরবাড়ির কোনো আত্মীয়কে কিডনি দান করছেন। কিডনিগ্রহীতা তাঁর রক্তের কেউ না হলেও দূরসম্পর্কের আত্মীয়।
এরপর জেয়াকে ইয়াঙ্গুনে সংশ্লিষ্ট কিডনিগ্রহীতার কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে এক ব্যক্তি চিকিৎসক পরিচয় দিয়ে আরও কিছু কাগজপত্রের কাজ শেষ করেন। ওই ব্যক্তি জেয়াকে সতর্ক করে দেন যে তিনি যদি সিদ্ধান্ত পাল্টান, তবে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
পরবর্তী সময়ে বিবিসি চিকিৎসক পরিচয়দানকারী ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল। তিনি বলেছেন, কোনো রোগী এ প্রক্রিয়ার উপযোগী কি না, তা যাচাই করাই তাঁর কাজ। দাতা ও গ্রহীতার মধ্যকার সম্পর্ক যাচাই করা তাঁর কাজ নয়।
জেয়া বলেন, কিডনি দান করলে তাঁকে ৭৫ লাখ কিয়াত (মিয়ানমারের মুদ্রা) দেওয়া হবে বলা হয়েছিল। অস্ত্রোপচারের জন্য তিনি উত্তর ভারতে গিয়েছিলেন। বড় একটি হাসপাতালে অস্ত্রোপচার হয়।
ভারতে বিদেশি নাগরিকদের শরীরে কিডনি প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে অবশ্যই সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল বা স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠিত একটি অনুমোদন কমিটির কাছ থেকে অনুমতি নিতে হয়। জেয়া বলেন, একজন দোভাষীর সহায়তায় চারজন তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন।
‘তাঁরা আমার কাছে জানতে চেয়েছিলেন, আমি স্বেচ্ছায় তাঁকে কিডনি দান করছি, নাকি জোরজবরদস্তি করে নেওয়া হচ্ছে’, বলেন জেয়া। তিনি তাঁদের বোঝাতে সক্ষম হন, গ্রহীতা তাঁর আত্মীয়। পরে তাঁকে কিডনি দানের অনুমতি দেওয়া হয়।
অস্ত্রোপচারের জন্য অচেতন করার আগে চিকিৎসকদের কর্মকাণ্ডগুলো জেয়ার মনে আছে। তিনি বলেন, অস্ত্রোপচারের পর চলাফেরা করতে ব্যথা হচ্ছিল। এ ছাড়া বড় জটিলতা হয়নি। অস্ত্রোপচার শেষে এক সপ্তাহ হাসপাতালে থাকতে হয় তাঁকে।
আত্মীয় সেজে কিডনি দান করেছেন মিয়ো উয়িনওজেয়ার মতোই গ্রহীতার আত্মীয় সেজে কিডনি দান করেছেন মিয়ো উয়িন (ছদ্মনাম)। তিনি বলেন, ‘দালাল আমাকে এক টুকরা কাগজ দিয়েছিলেন। সেখানে যা লেখা ছিল, সেগুলো আমাকে মুখস্থ করতে হয়েছে।’
উয়িন বলেন, তাঁকে বলতে বলা হয়েছিল যে তাঁর এক আত্মীয়ের সঙ্গে গ্রহীতার বৈবাহিক সম্পর্ক আছে। তা ছাড়া একজনকে তাঁর মা সাজানো হয়েছিল। তথ্য যাচাইকারী ব্যক্তি তাঁর মা ভেবে ওই অন্য নারীকেই ফোন করেছিলেন। জানতে চেয়েছিলেন, তাঁর সন্তান যে কিডনি দিচ্ছেন, তা তিনি জানেন কি না।
উয়িন জানান, কিডনি দেওয়ার জন্য জেয়ার সমপরিমাণ অর্থই তাঁকে দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। ওই অর্থের ১০ শতাংশ দালালকে দিতে হয়েছে। জেয়া ও উয়িন দুজনই বলেছেন, তাঁদের এক-তৃতীয়াংশ অর্থ অগ্রিম দেওয়া হয়েছিল।
উয়িন বলেন, ‘আমি মনঃস্থির করেছিলাম, এটা আমাকে করতেই হবে। কারণ, আগেই আমি তাঁদের কাছ থেকে অর্থ নিয়েছি।’
কিডনি বিক্রি করার সিদ্ধান্তের কারণ সম্পর্কেও জানিয়েছেন এই ব্যক্তি। বলেছেন, ঋণ পরিশোধ ও স্ত্রীর চিকিৎসার খরচ মেটাতে না পেরে তিনি এমনটা করেছেন।
অভ্যুত্থানের পর থেকে মিয়ানমারে বেকারত্ব বেড়েছে। সংঘাতপূর্ণ পরিস্থিতিতে দেশটির অর্থনীতি ধ্বংস হয়ে গেছে এবং বিদেশি বিনিয়োগকারীরা সেখান থেকে সরে গেছেন। জাতিসংঘের উন্নয়ন সংস্থা ইউএনডিপির তথ্য অনুসারে, ২০১৭ সালে মিয়ানমারে জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশ দারিদ্র্যের মধ্যে বাস করছিলেন। তবে ২০২৩ সালের মধ্যে তা বেড়ে অর্ধেকে পৌঁছেছে।
উইন বলেন, কিডনি বিক্রি যে অবৈধ, তা দালাল তাঁকে বলেননি। জানলে তিনি তা করতেন না। এ জন্য জেলে যেতে হয় কি না, সেই ভয়ে আছেন তিনি।
সাক্ষাৎকার ও অন্যান্য তথ্য প্রদানকারীর নাম গোপন রাখা এবং তাঁদের নিরাপত্তা রক্ষার স্বার্থে এসব ঘটনায় সংশ্লিষ্ট সংস্থা বা ব্যক্তির নাম প্রকাশ করেনি বিবিসি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মিয়ানমারের আরেকজন বিবিসিকে বলেন, তিনি ভারতে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে প্রায় ১০ জনকে কিডনি বেচাকেনায় সাহায্য করেছেন। তিনি আরও বলেন, মিয়ানমারের মধ্যাঞ্চলীয় মান্দালয়ের একটি সংস্থা এ বেচাকেনার ব্যবস্থা করেছে।
ভারতে গ্রেপ্তারবিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) হিসাবে, ২০১০ সাল থেকে বিশ্বজুড়ে মানুষের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপনের হার ৫০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। বছরে প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার প্রতিস্থাপনের ঘটনা ঘটে। তবে প্রতিস্থাপনের জন্য বিশ্বব্যাপী অঙ্গপ্রত্যঙ্গের চাহিদার মাত্র ১০ শতাংশ পূরণ করা সম্ভব হয়।
মানব অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ব্যবসা প্রায় সব দেশেই অবৈধ। ডব্লিউএইচওর এক হিসাব অনুযায়ী, প্রতিস্থাপনকৃত অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ৫ থেকে ১০ শতাংশই আসে কালোবাজারে। তবে প্রকৃত সংখ্যা অনেক বেশি হতে পারে।
দারিদ্র্যের কারণে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নেপাল, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, আফগানিস্তান, ভারত, বাংলাদেশসহ এশিয়ায় অবৈধভাবে কিডনি বিক্রি বেড়েছে।
চিকিৎসার জন্য বিদেশি পর্যটকদের কাছে ভারত একটি পছন্দের জায়গা। বিভিন্ন সংবাদ প্রতিবেদন ও পুলিশের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, দেশটিতে কিডনি বিক্রির হার বেড়েছে। আর এ খবরে তৈরি হয়েছে উদ্বেগ।
গত জুলাইয়ে ভারতের পুলিশ বলেছিল, তারা কিডনি বেচাকেনা চক্রের সাত সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে। যার মধ্যে একজন ভারতীয় চিকিৎসক ও তাঁর সহকারীও আছেন।
দিল্লির ইন্দ্রপ্রস্থ অ্যাপোলো হাসপাতালের চিকিৎসক বিজয়া রাজাকুমারীর বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, (চক্রের সদস্য হিসেবে) তিনি কয়েক কিলোমিটার দূরে ইয়াথার্থ নামের একটি হাসপাতালে ভিজিটিং কনসালট্যান্ট হিসেবে অস্ত্রোপচার করেছিলেন।
বিজয়ার আইনজীবী বিবিসিকে বলেছেন, অভিযোগগুলো ‘সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন’। এগুলোর পক্ষে কোনো প্রমাণ নেই। তিনি শুধু অনুমোদন কমিটির কাছ থেকে অনুমতি পাওয়ার পর অস্ত্রোপচার করেছেন ও সব সময় আইনের সঙ্গে সংগতি রেখে কাজ করেছেন। জামিন আদেশ অনুসারে, তাঁর বিরুদ্ধে জাল নথি তৈরির অভিযোগ নেই।
ইয়াথার্থ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বিবিসিকে বলেছে, ভিজিটিং কনসালট্যান্টদের বিরুদ্ধে হওয়া মামলাসহ তাঁদের সব মামলা যেন আইনি ও নৈতিক মানদণ্ড মোতাবেক পরিচালিত হয়, তা তারা নিশ্চিত করবে। ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা প্রতিরোধে পদক্ষেপ নেওয়ার কথাও জানিয়েছে তারা।
চিকিৎসক রাজাকুমারী গ্রেপ্তার হওয়ার পর স্থানীয় অ্যাপোলো হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলেছে, তিনি একজন ফ্রিল্যান্স কনসালট্যান্ট ছিলেন, যিনি ফি-ফর-সার্ভিস (কাজ অনুযায়ী পারিশ্রমিক) ভিত্তিতে নিযুক্ত ছিলেন। অভিযোগ ওঠার পর তাঁর সঙ্গে চিকিৎসাবিষয়ক যোগাযোগ ছিন্ন করা হয়েছে।
তবে চিকিৎসক রাজাকুমারীর বিরুদ্ধে আদালতে কোনো অভিযোগ আনা হয়নি।
অনুশোচনা নেইগত এপ্রিলে ভারতের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা রাজ্যগুলোকে চিঠি লিখে বিদেশিদের অঙ্গ প্রতিস্থাপনের হার বেড়ে যাওয়া সম্পর্কে সতর্ক করেছিলেন।
এ ব্যাপারে বক্তব্য জানতে ভারতের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, জাতীয় অঙ্গ ও টিস্যু প্রতিস্থাপন সংস্থা এবং মিয়ানমারের সামরিক সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল বিবিসি। তবে সাড়া পাওয়া যায়নি।
জেয়ার অস্ত্রোপচারের কয়েক মাস পর বিবিসি তাঁর বক্তব্য শুনেছিল। সে সময় তিনি বলেন, ‘আমি আমার ঋণ পরিশোধ করতে পেরেছি এবং একটি জমি কিনেছি।’ তবে তিনি বাড়ি তৈরি করতে পারেননি।’ জেয়া বলেছিলেন, তিনি পিঠের ব্যথায় ভুগছেন। তবে তাঁর অনুশোচনা নেই।
জেয়া বলেন, ‘আমাকে শিগগির কাজ শুরু করতে হবে। যদি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আবার দেখা দেয়, তবে আমাকে তা মোকাবিলা করতে হবে। এ নিয়ে আমার কোনো অনুশোচনা নেই।’
অস্ত্রোপচারের ছয় মাস পর মিয়ো উয়িন বিবিসিকে বলেছেন, তিনি তাঁর ঋণের একটা বড় অংশ শোধ করতে পেরেছেন। তবে পুরোটা পারেননি। অস্ত্রোপচারের পর পেটের কিছু সমস্যায় ভুগছেন বলেও জানালেন। বললেন, ‘আমার চাকরি নেই, একটা পয়সাও হাতে নেই।’
কিডনি বিক্রি করা নিয়ে তাঁর মধ্যেও নেই অনুশোচনা। তবে অন্যদের এটা না করার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। বলেছেন, ‘এটা ভালো নয়।’
আরও পড়ুনবাংলাদেশ-ভারত অবৈধ কিডনি প্রতিস্থাপন চক্র: দিল্লিতে অ্যাপোলোর চিকিৎসক গ্রেপ্তার০৯ জুলাই ২০২৪.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: কর ছ ল ন র র জন য র সদস য চ ক ৎসক পর ব র কর ছ ন র কর ছ হয় ছ ল বল ছ ন দ ন কর ন কর ছ র একট
এছাড়াও পড়ুন:
৫০ শয্যার থানচি হাসপাতাল চলছে একজন চিকিৎসকে
বান্দরবানের থানচি উপজেলার প্রায় ৩০ হাজার মানুষের একমাত্র ভরসার জায়গা ৫০ শয্যার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসক, নার্স ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির সংকটে এই হাসপাতাল কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। বর্তমানে পুরো হাসপাতাল চালাচ্ছেন মাত্র একজন চিকিৎসক। গত পাঁচবছরে চিকিৎসাধীন ও রেফার্ড করা ২৪ জন রোগী মারা গেছেন।
হাসপাতাল সূত্র জানায়, ১৯৯৫ সালে ৩১ শয্যার থানচি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স যাত্রা শুরু করে। পরে এটি ৫০ শয্যায় উন্নীত হয়। এই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১২ জন চিকিৎসক থাকার কথা থাকলেও কর্মরত আছেন মাত্র দুইজন। তাদের মধ্যে একজন ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন। এ কারণে রোগীদের সেবা দিতে পারছেন না। ১৮ জন নার্স পদে রয়েছেন মাত্র চারজন। চারজন মিডওয়াইফ থাকার কথা, নেই একজনও।
আরো পড়ুন:
ফরিদপুরে পাগলা ঘোড়ার কামড়ে আহত ২০
বক্তব্য দেওয়ার সময় অসুস্থ হয়ে পড়লেন কাদের সিদ্দিকী
প্রাথমিক থেকে শুরু করে জরুরি চিকিৎসার জন্য এই হাসপাতালে ছুটে যান পাহাড়ি ও বাঙালিরা। তাদের অভিযোগ, হাসপাতালটি ৫০ শয্যায় উন্নীত হলেও আধুনিক চিকিৎসা সুবিধা যোগ হয়নি। প্রয়োজনীয় সংখ্যক চিকিৎসক না থাকায় গর্ভবতী নারী, শিশু ও বৃদ্ধ রোগীরা সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়ছেন।
দুর্গম এলাকার রোগীরা অনেক সময় নদীপথ কিংবা পাহাড়ি রাস্তা পাড়ি দিয়ে হাসপাতালে এলেও কাঙ্ক্ষিত চিকিৎসা সেবা পান না। বরং তাদের বান্দরবান সদর হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। অনেক সময় বান্দরবানে যাওয়ার পথে রোগীরা মারা যান। এ কারণে জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসক, নার্স ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সরবরাহের দাবি জানিয়েছেন তারা।
হাসপাতালের পরিসংখ্যানবীদ পঙ্কজ বড়ুয়া জানান, ২০২০ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত এখানে ভর্তি হয়েছেন ৫ হাজার ১৯৮ জন রোগী। এর মধ্যে ৪৫৬ জনকে রেফার্ড করা হয় বান্দরবান সদর হাসপাতালে। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন ১৭ জন রোগী।
থানচি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অ্যাম্বুলেন্স চালক মংক্যসিং মারমা বলেন, “২০১৯ সালে চাকরিতে যোগদান করার পর থেকে অন্তত সাতজন রেফার্ড করা রোগী মাঝপথে আমার গাড়িতেই মারা গেছেন।”
শৈসাই মং মারমা তিন বছর আগে বিনা চিকিৎসায় তার মাকে মারা যেতে দেখেছেন। তিনি জানান, তার মা শৈমেপ্রু মারমা (৩৪) অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। ২০২২ সালের ১৪ নভেম্বর হঠাৎ তিনি অচেতন হয়ে পড়েন। রেমাক্রী বাজার থেকে নদীপথে থানচি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান মাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাকে জেলা সদর হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। ভাড়া গাড়িতে জেলা হাসপাতালে যাওয়ার সময় চিম্বুক বারো মাইল এলাকায় তার মা মারা যান।
লেংরু ম্রো নামে চার সন্তানের মা হারিয়েছেন স্বামীকে। তিনি জানান, তার স্বামী রেং য়ুং ম্রো (৪৫) কিডনি জটিলতা নিয়ে থানচি হাসপাতালে যান। সঙ্গে সঙ্গে সেখান থেকে তাকে বান্দরবান সদর হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। থানচি থেকে বান্দরবান যাওয়ার মাঝপথে মারা যান তার স্বামী।
স্থানীয় বাসিন্দা মংমে মারমা বলেন, “হাসপাতালে চিকিৎসক, ওষুধ ও যন্ত্রপাতির সংকট দীর্ঘদিন ধরেই চলছে। বিশেষজ্ঞ ডাক্তার বদলি হলেও অনেকেই থানচিতে যোগ দেন না, ডিপুটেশনে থেকে যান সদর হাসপাতালে। ফলে এ অঞ্চলের পাহাড়ি ও বাঙালি প্রায় ৩০ হাজার মানুষ স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।”
রিয়েং ম্রো নামে অপর বাসিন্দা বলেন, “পাহাড়ে বসবাসকারীদের অধিকাংশ গরিব। জেলা সদর হাসপাতালে রোগী নিয়ে যাওয়া ব্যয়বহুল ও কষ্টকর। রেমাক্রি, বড় মোদক, তিন্দু থেকে থানচি সদরে রোগী আনতেই অনেক টাকা খরচ হয়ে যায়। এরপর আবার বান্দরবান সদর হাসপাতালে রেফার্ড করলে সাধারণ মানুষ কীভাবে চিকিৎসা করাবে?”
থানচি উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা (ইউএইচএফপিও) ডা. মো. ওয়াহিদুজ্জামান মুরাদ বলেন, “বর্তমানে হাসপাতালে আমিসহ দুইজন চিকিৎসক রয়েছেন। একজন ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসাধীন। তিন রোগীদের সেবা দিতে পারছেন না। ফলে পুরো হাসপাতাল পরিচালনার দায়িত্ব আমাকে একাই সামলাতে হচ্ছে।”
তিনি আরো বলেন, “জনবল ও সরঞ্জাম সংকটের কারণে গুরুতর রোগীদের রেফার্ড করা ছাড়া উপায় থাকে না। দীর্ঘ পথের কারণে অনেকেই জীবিত অবস্থায় সদর হাসপাতালে পৌঁছাতে পারেন না।”
বান্দরবান জেলা সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ শাহীন হোসাইন চৌধুরী বলেন, “শুধু বান্দরবান নয়, পুরো তিন পার্বত্য জেলাতেই চিকিৎসক সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। নতুন করে ৪৮তম বিসিএসের ডাক্তার পদায়ন না হওয়া পর্যন্ত এই সংকট পুরোপুরি সমাধান করা সম্ভব হচ্ছে না। তারপরও বিভাগীয় প্রধানকে বিষয়টি চিঠির মাধ্যমে জানানো হয়েছে। ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের আট-দশজন চিকিৎসককে বান্দরবানে বদলি করার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।”
ঢাকা/মাসুদ