সম্প্রতি স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন তাদের সুপারিশমালা পেশ করেছে। এতে স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করে তুলতে বেশ কিছু চমৎকার প্রস্তাবনা উঠে এসেছে। সমাজ, রাষ্ট্র ও রাজনীতি সচেতন মানুষ মাত্রই স্বীকার করবেন সুশাসনের জন্য শক্তিশালী স্থানীয় সরকারব্যবস্থার বিকল্প নেই। তবে সংস্কার কমিশনের দুটি প্রস্তাব নিয়ে আমার বড় আকারে আপত্তি আছে। তার একটি শিক্ষাগত যোগ্যতা সংক্রান্ত; অপরটি পরোক্ষ ভোট প্রসঙ্গে।

স্থানীয় সরকার সংক্রান্ত সংস্কার কমিশন সিটি করপোরেশন, পৌরসভার মেয়র, উপজেলা পরিষদ এবং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পদের নির্বাচন অপ্রত্যক্ষ ভোটে করার সুপারিশ করেছে। তারা প্রস্তাবনায় বলেছে, এসব ক্ষেত্রে মেম্বার বা কাউন্সিলর জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হবেন। এরপর তাঁরা নিজেদের মধ্য থেকে একজনকে ভোট দিয়ে মেয়র বা চেয়ারম্যান নির্বাচিত করবেন।

এই নির্বাচনপদ্ধতির সবচেয়ে বড় অসুবিধা হচ্ছে, এতে চেয়ারম্যান বা মেয়র নির্বাচনে নির্বাচক সংখ্যা কম হওয়ায় টাকার বিপুল ব্যবহারের সম্ভাবনা। এতে ভোট কেনাবেচার অসুস্থ প্রতিযোগিতা শুরু হবে। একজন শ্রমিক, মজুর, কৃষক, মালি, মুচি, দলিত সবাইকেই নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ দিতে হবে। পৃথিবীতে নির্বাচনমাত্রই অর্থের ব্যাপার জড়িত থাকে। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে তা আরও ব্যাপক।

জামানত ফি ও অন্যান্য ব্যয়ের কারণে গরিব মানুষ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ারই সুযোগ পান না। নতুন করে প্রাতিষ্ঠানিক পদ্ধতিতে সেখানে কোনো সিস্টেমিক বৈষম্য তৈরি করার মানে হয় না। এই পদ্ধতি অভিজাততন্ত্রকেই আরও শক্তিশালী করবে। ব্যবসায়ী ও ধনিক শ্রেণির হাতে ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে ফেলবে।

তা ছাড়া নির্বাচকমণ্ডলী নির্দিষ্ট হওয়ায় যে সরকার ক্ষমতায়, সে সরকারের মনোনীত প্রার্থীই নির্বাচিত হয়ে আসবে। ইতিমধ্যে পরোক্ষ ভোটের মাধ্যমে জেলা পরিষদ নির্বাচনের অভিজ্ঞতা তাই বলে। স্কুলগুলোতে ম্যানেজিং কমিটির নির্বাচনে সভাপতি নির্বাচনে যেমন স্থানীয় সংসদ সদস্যের একচেটিয়া প্রভাব পরিলক্ষিত হয়, সেই একই রকম প্রভাব দেখা যাবে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এবং পৌরসভার মেয়র নির্বাচনে।

সরকার ও সরকারি দলের আকাঙ্ক্ষাই চূড়ান্ত হয়ে যাবে। সরকারদলীয় প্রার্থীর নির্বাচিত হয়ে আসাটা অনিবার্য হয়ে পড়বে। নির্বাচিত ব্যক্তিরা তাঁদের নির্বাচকমণ্ডলীর প্রতিই বেশি মনোযোগী হন। এতে চেয়ারম্যান, মেয়ররা তাঁদের নির্বাচক মেম্বার, কমিশনারদের মনঃতুষ্টির দিকেই মনোযোগী হবেন বেশি। তাঁরা নিজেরাও যেহেতু মেম্বার বা কমিশনারদের মধ্য থেকেই নির্বাচিত হবেন, তাতে নিজের নির্বাচনী এলাকার প্রতিও পক্ষপাতমূলক হয়ে ওঠার সমূহ আশঙ্কা আছে।

বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হওয়া শিক্ষিতদের হাতে সব তুলে দেওয়ার বন্দোবস্ত আমরা চাই না। প্রতিটি ক্ষেত্রে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচন হওয়া উচিত। দণ্ডপ্রাপ্ত অপরাধী, স্বীকৃত ঋণখেলাপি, অপ্রকৃতিস্থ ছাড়া নাগরিক মাত্রই নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার সুযোগ থাকতে হবে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা, বর্ণ, ধর্ম, গোত্র, লিঙ্গ বিচারে কোনো বৈষম্য থাকা চলবে না। জনগণের ভোটের অধিকার হবে অবাধ, তাঁরাই নিজেদের প্রতিনিধি নির্বাচিত করবেন। পরোক্ষ নির্বাচনের নামে ভোটের অধিকার কেড়ে নেওয়া চলবে না।

২.

স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের সুপারিশে শিক্ষাগত যোগ্যতা হিসেবে চেয়ারম্যান ও মেয়রের ক্ষেত্রে স্নাতক এবং নির্বাহী সদস্যদের ক্ষেত্রে মাধ্যমিক পাস অগ্রাধিকার পাবে বলে বলা হয়েছে। কেবল প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাই কারোর দক্ষতা, যোগ্যতার একমাত্র মাপকাঠি হতে পারে না। সুশিক্ষিত ব্যক্তিমাত্রই স্বশিক্ষিত। যত দিন পর্যন্ত সর্বস্তরে শিক্ষাকে বিনা মূল্যে নিশ্চিত করা না যাচ্ছে, তত দিন পর্যন্ত জনপ্রতিনিধি নির্বাচনে শিক্ষাগত যোগ্যতা স্থির করে দেওয়া বৈষম্যমূলক প্রস্তাবনা।

বহু শিক্ষার্থী এখনো অর্থের অভাবে ঝরে যায়। মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশোনাই যেখানে কঠিন, সেখানে স্নাতক পর্যন্ত টাকা দিয়ে পড়ার সামর্থ্য কি সবার আছে? দেশের সব উচ্চমাধ্যমিক পাস ছাত্রের জন্য কি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে, কলেজে পর্যাপ্ত সিট আছে? যদি না থাকে, সে ক্ষেত্রে নাগরিককে গণপ্রতিনিধিত্ব থেকে বিরত রাখার অধিকার রাষ্ট্রের নেই।

এ দেশে বহু নারীর বিয়ের পর উচ্চশিক্ষা চালিয়ে নেওয়ার সুযোগ থাকে না। তাঁর জনপ্রতিনিধি হওয়ার অধিকার কেন দেওয়া হবে না? সব স্নাতক পাস ব্যক্তিই কি সমান যোগ্যতাসম্পন্ন হন! পৃথিবীতে বহু রাষ্ট্রনায়কই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় উচ্চশিক্ষিত না হয়েও রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন সফলভাবেই।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটন, জেমস মনরো, এন্ড্রু জ্যাকসন, উইলিয়াম হ্যানরি হ্যারিসন, জ্যাকারি টেইলর, মিলার্ড ফিলমোর, এন্ড্রু জনসন, গ্রুভার ক্লিভল্যান্ড, উইলিয়াম ম্যাকেনলি, হ্যারি এস ট্রুম্যান—এঁদের কেউই কলেজ শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন না। কেবল মাধ্যমিক পাস করা স্যার জন মেজর, উইনস্টন চার্চিলসহ কমপক্ষে আটজন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের বারান্দাতেও পা রাখেননি। প্রতিবেশী দেশ ভারতের জনপ্রিয় নেত্রী জয়ললিতাও ছিলেন কেবল মাধ্যমিক পাস। তামিলনাড়ুর আরেক মুখ্যমন্ত্রী করুণা নিধিও ছিলেন দশম শ্রেণি পাস।

জীবনে স্কুলে না যাওয়া জ্যাকব জুমা দক্ষিণ আফ্রিকার দীর্ঘকাল ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং পরে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেন। উচ্চমাধ্যমিক পাস করা ওমর আল বশির সুদানের সেনাবাহিনীতে ব্রিগেডিয়ার এবং সেখান থেকে দীর্ঘকাল ছিলেন সুদানের প্রেসিডেন্ট। আফ্রিকান আমেরিকানদের অবিসংবাদিত নেতা হয়ে ওঠা ফ্রেডরিক ডাগলাসেরও ছিল না কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। পৃথিবীর নানা দেশে এ রকম অসংখ্য উদাহরণ আছে। যাঁরা কোনো রূপ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই সফল রাষ্ট্রপ্রধান হয়েছেন। কারও কারও শাসনকালের ক্ষেত্রে সমালোচনা থাকতে পারে, কিন্তু সেই সমালোচনা কারণ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ঘাটতি নয়, বরং স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাব।

আমাদের সংস্কার কমিশন যে প্রস্তাবনা রেখেছে, আমাদের বাঙালি সত্তার প্রবাদপুরুষ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কিংবা জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম কেউই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হওয়ার যোগ্যতা রাখেন না। নজরুলের নির্বাচনের প্রতি ঝোঁক ছিল। তিনি নির্বাচনে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি বেঁচে থাকলে আমাদের সংস্কার কমিশন তাঁকেও উপযুক্ত শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকায় অযোগ্য ঘোষণা করত! সফল ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল থেকে আমাদের তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া, সংস্কার কমিশনের সুপারিশ মতে তাঁরা কেউই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান অথবা পৌরসভার মেয়র হওয়ার যোগ্যতা রাখেন না।

৩.

এখন পর্যন্ত উচ্চশিক্ষার সুযোগ ধনিক শ্রেণির হাতে অনেকটাই সীমাবদ্ধ। সাধারণ গরিব মানুষের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হওয়াটা এমনিই কঠিন। সেখানে নির্বাচিত হওয়ার সুযোগকেই নাই করে দিলে তা দেশে চূড়ান্তভাবে একটা অভিজাততন্ত্রের সৃষ্টি করবে। এই জুলাই আন্দোলনেও শত শত শ্রমিক, দোকানদার, মজুর, রিকশাচালক প্রাণ দিয়েছেন, আহত হয়েছেন, অংশ নিয়েছেন। তাঁদের প্রতিনিধিত্ব পরিবর্তিত রাষ্ট্রে থাকতে হবে। এই আন্দোলন কেবল বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের একার ছিল না।

বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হওয়া শিক্ষিতদের হাতে সব তুলে দেওয়ার বন্দোবস্ত আমরা চাই না। প্রতিটি ক্ষেত্রে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচন হওয়া উচিত। দণ্ডপ্রাপ্ত অপরাধী, স্বীকৃত ঋণখেলাপি, অপ্রকৃতিস্থ ছাড়া নাগরিক মাত্রই নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার সুযোগ থাকতে হবে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা, বর্ণ, ধর্ম, গোত্র, লিঙ্গ বিচারে কোনো বৈষম্য থাকা চলবে না। জনগণের ভোটের অধিকার হবে অবাধ, তাঁরাই নিজেদের প্রতিনিধি নির্বাচিত করবেন। পরোক্ষ নির্বাচনের নামে ভোটের অধিকার কেড়ে নেওয়া চলবে না।

আরজু আহমাদ লেখক ও অ্যাকটিভিস্ট। কেন্দ্রীয় সদস্য, জাতীয় নাগরিক কমিটি

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: স থ ন য় সরক র জনগণ র আম দ র চ ত কর পর ক ষ করব ন হওয় র ন হওয়

এছাড়াও পড়ুন:

‘হাসিনার আমলই ভালো ছিল’—এটা কোন ঘরানার গান

ইদানীং কিছু ভদ্রলোক ইনিয়ে-বিনিয়ে, এমনকি সুযোগ বুঝে সরাসরিও বলে ফেলছেন, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ের চেয়ে শেখ হাসিনার শাসনেই দেশ ভালো চলছিল। দু–একজন এ-ও বলছেন, গত ৪০ বছরে এখনকার মতো খারাপ অবস্থা নাকি তাঁরা দেখেননি।

এই ‘মহামানবদের’ কথা মান্য করলে প্রশ্ন এসেই যায়, কী লাভ হলো গণ–অভ্যুত্থান করে, এত জীবন বিসর্জন দিয়ে, এত রক্ত ঝরিয়ে?

আওয়ামী লীগের শত্রুরা উত্তর দিক: সরকারি চাকরিতে কোটাবিরোধী আন্দোলনকে হাসিনা পতনের এক দফা দাবিতে রূপান্তরের কী প্রয়োজন ছিল? গণবিস্ফোরণ ঘটিয়ে দেড় দশকে গড়ে ওঠা এক শক্তিশালী ব্যবস্থাকে ভেঙে খান খান করে ফেলার কী এমন প্রয়োজন ছিল?

হাসিনা-পরবর্তী এই ‘ভগ্ন হৃদয়ের’ যুগে ভারতীয় শিল্পী কবির সুমনের সে গানটি ‘প্রথমত আমি তোমাকে চাই...শেষ পর্যন্ত তোমাকে চাই’ শুনি আর ভাবি, ২০২৪-এর ‘ডামি’ নির্বাচনের আগে শেখ হাসিনাকে আজীবন ক্ষমতায় দেখতে চাওয়া অলিগার্কদের কী যে আকুতি ছিল!

মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে নেত্রীর পতন দেখে হয়তো সেদিন তাঁরা শুনেছেন কিংবা গেয়েছেন অন্য কোনো গান। হতে পারে আরেক ভারতীয় শিল্পী হৈমন্তী শুক্লার গাওয়া সেই গান তাঁরা গেয়েছিলেন, ‘চেয়ে চেয়ে দেখলাম তুমি চলে গেলে...আমার বলার কিছু ছিল না।’

আক্ষেপ কেন, কমরেড, জীবন নিয়ে পালিয়ে তো তিনি নিরাপদেই আছেন দিল্লিতে!

তবু ‘সে কি ভোলা যায়, তুমি আমারই ছিলে’ হে বাংলাদেশ সাম্রাজ্য! সত্যিই তো তাঁর এবং তাঁদের একচেটিয়া অধিকার ছিল যেভাবে খুশি যত বেশি ক্ষমতা, অর্থ, প্রতিপত্তি ভোগের।

একটি অভিজাত গোষ্ঠীকে (অলিগার্কি) হাসিনা-প্রদত্ত সেই লাভজনক স্থিতাবস্থা হারিয়ে কীভাবে চুপ করে বসে থাকবে এর ‘ভাগ্যবান’ সদস্যরা! নতুন রাজনৈতিক বিনিয়োগও কিছু দরকার হবে যদি ভবিষ্যৎ মুনাফার আশা করতে হয়।

টাকাওয়ালাদের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়, বিনা ভোটে বা জালিয়াতির মাধ্যমে সংসদ সদস্য পদ বা মন্ত্রিত্ব উপহার, তাঁর চামচাদের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ ও পদোন্নতি এবং দলীয় অনুগতদের মিডিয়ার লাইসেন্স প্রদানসহ কত ধরনের দান-দক্ষিণার ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন ‘ষোলো কোটি মানুষকে খাওয়ানোর’ দাবিদার বর্তমানে নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগপ্রধান হাসিনার সরকার।

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে কর্ণফুলী টানেল, পদ্মা সেতু থেকে গভীর সমুদ্রবন্দর, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে থেকে টোল রোড, ডজন ডজন নতুন ব্যাংক থেকে শত বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমতি—এ রকম বড় বড় ব্যয়বহুল প্রকল্প গ্রহণে তাঁর কোনো তুলনাই হয় না।

একটু–আধটু দুর্নীতি হলেও অন্তত মধ্য আয়ের দেশ হওয়ার স্বপ্ন তো দেখাচ্ছিলেন তাঁর সভাসদরা। এই ধরুন, লাখো কোটি টাকার ব্যাংকঋণ জালিয়াতি, খেলাপি, দলীয় নেতা মাস্তানদের হাজার হাজার কোটি টাকার চাঁদাবাজি ও সম্পদ লুণ্ঠন, বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার পাচার ইত্যাদি বিষয় দেড় দশকের স্থিতিশীলতার তুলনায় এমনকি বাড়াবাড়ি!

যাদের ‘এতিম’ করে রেখে উনি চলে গেলেন, তাদের কারও কারও বক্রোক্তি এ রকম: এক অনাকাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনের পর বহুত শখ করে তো ক্ষমতায় বসিয়েছিলেন নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে; তাঁর সরকার এখন পর্যন্ত কী করতে পেরেছে? নির্বাচন, সংস্কার, হত্যা ও দুর্নীতির বিচার, আইনশৃঙ্খলার উন্নতি, অর্থনীতি জোরদার—কোনটি পেরেছে?

জনগণকে কষ্ট করে ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার বিকল্প ব্যবস্থাও করে দিয়েছিলেন জনদরদি হাসিনা সরকার। ২০১৪ সালের ১৫৪ সংসদ সদস্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত, ২০১৮ সালে নৈশকালীন ভোট এবং ২০২৪ সালে ডামি নির্বাচন করে হাসিনা তাঁর বাবা শেখ মুজিবের তৈরি একদলীয় বাকশাল ব্যবস্থার নতুন মডেল দাঁড় করান পৃথিবীর সামনে।

যাঁরা এই আওয়ামী শাসনের ‘স্থিতিশীলতা’ নস্যাৎ করতে চেয়েছে তাদের ‘ঠ্যাং ভেঙে’ দিতে একটুও দ্বিধা করেনি হাসিনা সরকার। সরকারের ধারাবাহিকতা নষ্টের চেষ্টাকারীদের ‘উচিত শিক্ষা’ দেওয়া হয়েছে গুম, খুন, সহিংসতা, জঙ্গিনাটক, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, প্রতিবাদ দমন ও বাক্‌স্বাধীনতা হরণের মাধ্যমে। সে জন্য আপনারা তাঁকে ফ্যাসিবাদী বলার সাহসও পাননি তখন।

জুলাই-আগস্ট বিপ্লবে হাজারো তরুণ ও সাধারণ মানুষ নিহত (শহীদ) হওয়ার দায় নিতে চাননি হাসিনা। উল্টো তাঁর দাবি, ৫ আগস্ট তাঁকে মারতেই লক্ষ জনতা গণভবন অভিমুখে যাত্রা করেছিল।

আরও পড়ুন‘আমি কী অপরাধ করেছি’— সবাই জানেন শিরোনামটা...৩০ জুলাই ২০২৫

আরও রক্তপাত এড়াতেই নাকি তাঁর নিজের লোকদের মায়া ছেড়ে ‘একলা চলো’ নীতি অবলম্বন করে ভারতে পাড়ি জমান শেখ হাসিনা।

তাই আজ তাঁর ফেরার অপার ইচ্ছা যেন স্বৈরশাসক জেনারেল এরশাদের পৃষ্ঠপোষকতায় তৈরি গানের মতোই, ‘তোমাদের পাশে এসে বিপদের সাথি হতে আজকের চেষ্টা আমার।’

যাদের ‘এতিম’ করে রেখে উনি চলে গেলেন, তাদের কারও কারও বক্রোক্তি এ রকম: এক অনাকাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনের পর বহুত শখ করে তো ক্ষমতায় বসিয়েছিলেন নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে; তাঁর সরকার এখন পর্যন্ত কী করতে পেরেছে? নির্বাচন, সংস্কার, হত্যা ও দুর্নীতির বিচার, আইনশৃঙ্খলার উন্নতি, অর্থনীতি জোরদার—কোনটি পেরেছে?

যেন এত সব বিষয় নিয়ে জনমনে কোনো ক্ষোভই ছিল না হাসিনার আমলে। এটি সেই বিস্মৃত অতীত, যেটি নিয়ে কল্পিত সংগীত রচিত হয়: ‘আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম’।

আরও পড়ুনশেখ হাসিনা স্বৈরশাসকদের টিকে থাকার দুটি মূলমন্ত্রেই ব্যর্থ২২ আগস্ট ২০২৪

তার মানে, তাঁর শাসনকালই জাতির জন্য ছিল আদর্শ। এটা প্রমাণ করার এক অদৃশ্য প্রচেষ্টা রয়েছে আজ এখানে, আমাদের চারপাশে, আশপাশে।

সত্য, মিথ্যা মিশিয়ে এমন দাবি করেন কারা এবং কেন—সেটা আমাদের একটু বোঝা দরকার।

হাসিনার চামচা ও সুবিধাভোগী, তাঁর ঘরানার অসৎ বুদ্ধিজীবী, তাঁর হত্যাকাণ্ড ও দুর্নীতি নিয়ে নির্বিকার নেতা-কর্মী-সমর্থক, বর্তমান আমলে বিশেষ কিছু না পেয়ে প্রবলভাবে হতাশ কতিপয় সুশীল অথবা পরিস্থিতি সম্পর্কে নির্বোধ ব্যক্তির পক্ষেই ফ্যাসিবাদী শাসনামলকে উত্তম বলা সম্ভব।

এতে হাসিনার লোকদের বড় লাভ হতে পারে দায় স্বীকার না করে বা ক্ষমা না চেয়েই তাঁদের হাত ও নামসমূহকে দুর্নীতি, হত্যাকাণ্ড ও নির্যাতনের রক্তের দাগ থেকে মুক্ত করা।

এ প্রচেষ্টা ঘটে যাওয়া সত্যকে অস্বীকার, শহীদদের আত্মত্যাগ অগ্রাহ্য, আহত ব্যক্তিদের প্রতি অশ্রদ্ধা এবং মজলুমদের অনুভূতির সঙ্গে মশকরা ছাড়া আর কিছুই না।

এগুলোই আবার জুলাই বিপ্লবের পক্ষের শক্তির বয়ান তৈরিতে ব্যর্থতা প্রমাণ করে।

আরও পড়ুনহাসিনা শাসনের উন্নয়নের বানোয়াট গল্প০৩ অক্টোবর ২০২৪

পরিবর্তনের পক্ষে জনগণের প্রবল আকাঙ্ক্ষার কোনো কমতি ছিল না এবং হত্যা-দুর্নীতিসহ ফ্যাসিবাদী কর্মকাণ্ডের বিচার এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান নির্মাণের লক্ষ্যে কমবেশি সংস্কারের উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে। কিন্তু বুদ্ধিবৃত্তিক ও রাজনৈতিক চিন্তা, গণতান্ত্রিক ভাবনা, কিংবা আমলাতান্ত্রিক কর্মসূচিকে জনমত তৈরির জন্য সেভাবে উপস্থাপন করা সম্ভব হয়নি। একটা একটা করে ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার উত্তম বিকল্প জনগণের সামনে আনলে গণমানুষকে নতুন ধারণা ও আশাবাদ উপহার দেওয়া যেত।

কয়েকটি মডেল নির্বাচন দিয়ে, তরুণদের পরিবেশ রক্ষার মতো সামাজিক আন্দোলনে সম্পৃক্ত করে, রাজনৈতিক দলসমূহকে দুর্নীতি ও চাঁদাবাজি প্রতিরোধে অংশীদার বানিয়ে এবং গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান ঠিকঠাক করে, সাংবাদিকদের স্বাধীনতা, সুরক্ষা ও কল্যাণ নিশ্চিত করে হাসিনার কুশাসনকে যথাযথভাবে চিত্রিত করা যেত।

ধারণা করি, জনগণের সঙ্গে যোগাযোগে ঘাটতি এবং অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্যোগগুলো সম্পর্কে জনসম্পৃক্ততার অভাব হাসিনার উপকারভোগীদের নিজস্ব গান গাওয়ার পরিসর দিয়েছে।

ফ্যাসিবাদী শাসনের জাঁতাকলে পিষ্ট রাজনৈতিক দল এবং ২০২৪-এর আন্দোলনে পুরোভাগে থাকা ছাত্র ও অন্য শক্তিগুলো পরস্পরের মধ্যে লজ্জাজনক কুতর্কে জড়িয়ে পড়ায় গণ–অভ্যুত্থান ও পরিবর্তনের এজেন্ডা এবং উপযোগী বয়ান যথেষ্ট মার খেয়েছে। দেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ নিয়ে জনগণও কিছুটা বিভ্রান্ত ও হতাশ হয়েছে।

বাংলাদেশিদের বর্তমান হতাশা ও ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা তৈরি হওয়াটাই কাম্য ছিল পরাজিত শক্তির। হাসিনা বিহনে আওয়ামী উপকারভোগী বা অন্ধ সমর্থকেরা গোপালগঞ্জ বা অন্য কোনো অঞ্চলে নিরালায় বসে যেন গুনগুন করে গাইছে গগন হরকরার গান, ‘আমি কোথায় পাব তারে আমার মনের মানুষ যে রে...।’ তারা বুঝতে পারছে না জাতির জীবনে শেখ হাসিনা এমন এক জুলুমশাহি শাসকের নাম ও ফ্যাসিবাদের প্রতিমূর্তি; যার শাসন পুরো দেশকে বানিয়ে ফেলেছিল ‘জল্লাদের উল্লাসমঞ্চ’।

নিজেদের বাইরে জনগণের অন্য যেকোনো গোষ্ঠীকে ক্ষমতার ভাগ দিতে না চাওয়া সেই ফ্যাসিবাদী ধারায় ছেদ টেনেছে জুলাই বিপ্লবের মধ্য দিয়ে অধ্যাপক ইউনূসের সরকার গঠন, যেটিও আশা করি বাংলাদেশের শেষ সরকার নয়।

বিদায় নেওয়া ফ্যাসিবাদ রাজনৈতিক মতাদর্শ হিসেবে যেকোনো দেশেই অনেকটা পুরোনো দিনের গান। এই গান অবশ্যই স্মৃতিজাগানিয়া কিন্তু চলমান বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন। ভবিষ্যতে আবারও ফ্যাসিবাদকে সহ্য করবে, এমন প্রজন্ম এ দেশে সেকেলে এবং অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে। তরুণেরা এবং অভিজ্ঞ বিবেকবানেরা এখন অজানা এক নতুন বাংলাদেশের অপেক্ষায়।

ফলে ‘হাসিনার আমলই ভালো ছিল’ গান বাদ দিয়ে হাসিনার মানসপুত্রদের এখন নিরালা নিঝুম ও যথাযথ ভাবগম্ভীর পরিবেশে বসে মুদ্রিতনেত্রে মন্দ্রসপ্তক কণ্ঠে ভক্তিভরে গাওয়া উচিত, ‘মা, আমার সাধ না মিটিল, আশা না পুরিল, সকলি ফুরায়ে যায় মা... ।’

খাজা মাঈন উদ্দিন সাংবাদিক

*মতামত লেখকের নিজস্ব

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • জুলাই সনদে আমাদের যে সম্মতি সেটি আইনের ঊর্ধ্বে: সালাহউদ্দিন
  • সন্ত্রাস, চাঁদাবাজ ও মাদকমুক্ত বন্দর গড়তে চাই : সাখাওয়াত
  • বিএনপির ৩১ দফা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে রূপগঞ্জে লিফলেট বিতরণ 
  • জুলাই আন্দোলনকে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে জড়াবেন না: টুকু
  • সবাই অপেক্ষা করছে একটা নির্বাচনের জন্য
  • ‘হাসিনার আমলই ভালো ছিল’—এটা কোন ঘরানার গান
  • সরকারের ভুল সিদ্ধান্তে দেশে ফ্যাসিবাদ, উগ্রবাদ মাথাচাড়া দিতে পারে: তারেক রহমান
  • সরকারের একটি অংশ অপকৌশলের আশ্রয় নিচ্ছে: তারেক রহমান
  • ট্রাম্পের প্রতি মার্কিন জনগণের সমর্থন ৪০ শতাংশে ঠেকেছে
  • জাতিসংঘে সম্মেলনের ফাঁকে বাংলাদেশ-পাকিস্তান বৈঠক, ফিলিস্তিন ইস্যুতে উদ্বেগ