গণপরিষদ ও সংসদ নির্বাচন একসঙ্গে চায় জাতীয় নাগরিক পার্টি
Published: 4th, March 2025 GMT
‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ প্রতিষ্ঠায় নতুন সংবিধান প্রণয়নের জন্য জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) যে গণপরিষদ নির্বাচনের দাবি করছে, সেটা সংসদ নির্বাচনসহ একসঙ্গেই হতে পারে বলে মনে করছে দলটি। দলের আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম আজ মঙ্গলবার বিষয়টি সামনে এনেছেন।
নাহিদ ইসলাম বলেছেন, গণপরিষদ নির্বাচন ও জাতীয় সংসদ নির্বাচন একসঙ্গে হতে পারে। এর মাধ্যমেই নতুন কাঠামো ও নতুন বাংলাদেশ গড়ে তোলা সম্ভব হবে। গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে একটি নতুন সংবিধান প্রকৃত গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় উত্তরণে সহায়তা করবে।
সকালে সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন জাতীয় নাগরিক পার্টির শীর্ষ নেতারা। এরপর নাহিদ ইসলাম দলের নেতাদের নিয়ে ঢাকার রায়েরবাজার কবরস্থানে জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে শহীদ ছাত্র–জনতার কবর জিয়ারত করেন।
উভয় স্থানেই নাহিদ ইসলাম গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেন। স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদনের পর এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, পুরোনো সংবিধান ও পুরোনো শাসনকাঠামো রেখে একটি নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণ সম্ভব নয়। কেবল সরকার পরিবর্তন করেই জনগণের কল্যাণ ও প্রকৃত গণতন্ত্র বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। তিনি বলেন, চব্বিশের যে গণ-অভ্যুত্থান হয়েছে, ছাত্র-জনতা রক্ত দিয়েছে, তাতে কেবল সরকার পরিবর্তন নয়; বরং শাসনকাঠামো ও সাংবিধানিক পরিবর্তন করে নতুন একটি বাংলাদেশের যাত্রা শুরু করতে চাই, যেখানে প্রকৃত গণতন্ত্র, ইনসাফ ও সাম্য নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
সেকেন্ড রিপাবলিকের (দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র) জন্য নতুন সংবিধান ও গণপরিষদ নির্বাচনের লক্ষ্যে নতুন দল কাজ করে যাচ্ছে উল্লেখ করে নাহিদ আরও বলেন, ‘১৯৪৭ থেকে ২০২৪-এর সব লড়াইয়ের আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করে আমরা নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণ করব এবং সেই লক্ষ্যে এনসিপি কাজ করে যাচ্ছে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা একটি স্বাধীন রাষ্ট্র পেলেও আমাদের সার্বভৌমত্ব বারবার হুমকির মুখে পড়েছে। আমাদের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো বারবার ভেঙে পড়েছে। আমরা একটি গণতান্ত্রিক সংবিধান গড়ে তুলতে পারিনি। একটি একদলীয় সংবিধানের মাধ্যমে ফ্যাসিজম এবং একদলীয় স্বৈরতন্ত্রের বীজ বপন করা হয়েছিল।’
পরে রায়েরবাজারে নাহিদ সাংবাদিকদের বলেন, গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে একটি নতুন সংবিধান প্রকৃত গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় উত্তরণে সহায়তা করবে। গণপরিষদ নির্বাচন ও জাতীয় সংসদ নির্বাচন একসঙ্গে হতে পারে। এর মাধ্যমেই নতুন কাঠামো ও নতুন বাংলাদেশ গড়ে তোলা সম্ভব হবে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে জুলাই অভ্যুত্থান এবং গত ১৫ বছরে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিচারের দাবি জানান নাহিদ ইসলাম। তিনি বলেন, ‘বিচারের পর সংস্কার কার্যক্রম করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে দ্রুত জাতীয় সংলাপে গিয়ে আমাদের জুলাই সনদ ও জুলাই ঘোষণাপত্র বাস্তবায়ন আমরা দেখতে চাই।’
গত শুক্রবার আত্মপ্রকাশের পর আজ শ্রদ্ধা নিবেদন ও কবর জিয়ারতের মধ্য দিয়ে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এ সময় দলীয় প্রধান নাহিদ বলেন, এ মুহূর্তে তাঁর দলের প্রথম লক্ষ্য হচ্ছে, সাংগঠনিকভাবে তার কার্যক্রম বিস্তৃত করা, তৃণমূলে সাংগঠনিক কার্যক্রম বিস্তৃত করা। এ ছাড়া দলের নিবন্ধন নিতে যে ধরনের শর্ত পূরণ করা প্রয়োজন, সে শর্তাবলি দ্রুততম সময়ের মধ্যে পূরণ করে নিবন্ধনের প্রক্রিয়া শুরু এবং এ মাসের মধ্যে দলের গঠনতন্ত্র প্রণয়নের কাজ শুরু করার কথা জানান তিনি।
‘খুনি হাসিনাকে ফাঁসির মঞ্চে নিতে হবে’রায়েরবাজারে শহীদদের কবর জিয়ারতের পর এনসিপির মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলম বলেন, ‘যত দিন না পর্যন্ত খুনি হাসিনাকে ফাঁসির মঞ্চে দেখছি, তত দিন যেন কেউ ভুলক্রমেও নির্বাচনের কথা না বলে।’
মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল) হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, সরকার ছাত্র-জনতার রক্তের ওপর এসেছে। তাদের মনে রাখতে হবে বিচার নিশ্চিত করতে না পারলে পুরো প্রক্রিয়া প্রশ্নবিদ্ধ হবে। দ্রুততম সময়ে বিচার নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজনে বিশেষভাবে ট্রাইব্যুনালের সংখ্যা বাড়িয়ে বিচার নিশ্চিত করতে হবে।
এনসিপির সদস্যসচিব আখতার হোসেন, মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী, জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আবদুল হান্নান মাসউদসহ কেন্দ্রীয় নেতারা শ্রদ্ধা নিবেদন ও কবর জিয়ারতের এ কর্মসূচিতে উপস্থিত ছিলেন।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ন হ দ ইসল ম গণত ন ত র ক ন শ চ ত কর একসঙ গ সরক র এনস প
এছাড়াও পড়ুন:
আইএসপি: স্কেলে টিকে থাকার লড়াই
বাংলাদেশের ইন্টারনেট ইন্ডাস্ট্রি এখন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। প্রযুক্তির ব্যবহার যেমন বাড়ছে, তেমনি বাড়ছে মানুষের চাহিদা, বিশেষ করে দ্রুত, নিরবচ্ছিন্ন ও মানসম্মত সংযোগের জন্য। কিন্তু এর পেছনের বাস্তবতা অনেক কঠিন। বিশেষ করে আইএসপি, অর্থাৎ ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডারদের জন্য এই বাজার খুব একটা প্রফিটের নয়, বরং একটানা লড়াইয়ের। কারণ, এই ব্যবসা আসলে ভলিউম গেম। এখানে লাভবান হতে হলে খেলতে হয় বড় স্কেলে।
যদি কোনো আইএসপি ২০ হাজারের কম গ্রাহক নিয়ে সার্ভিস চালায়, তাহলে টিকে থাকাই কঠিন হয়ে দাঁড়ায়, লাভ তো দূরের কথা। এখানে অনেক উদ্যোক্তা নিজের শ্রম, সময় ও ধৈর্যের বিনিয়োগকে আর্থিক হিসাবে বিবেচনায় আনেন না, ফলে ব্যবসার প্রকৃত লাভ-লোকসানের হিসাবও মেলে না। এই ভুল ধারণা থেকেই ব্যবসাটি অনেক সময় ক্ষতির দিকে চলে যায়। বাস্তবতা হচ্ছে, আইএসপি একটি ক্যাপিটাল ইনটেনসিভ ও কষ্টসাধ্য ইন্ডাস্ট্রি। এখানে প্রতিটা পয়সা বের করতে হয় খুব হিসাব করে।
আমার বিটিআরসিতে কাজ করার সাত বছরে শুধু দেশের বাস্তবতা দেখিনি, দেখার চেষ্টা করেছি আন্তর্জাতিক উদাহরণও। মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ভারত, এমনকি ইউরোপের দেশগুলো কীভাবে ব্রডব্যান্ডকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে, তা ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করেছি। একটি বিষয় স্পষ্ট—ব্রডব্যান্ড এখন আর শুধু একটি সুবিধা নয়, এটি মৌলিক অধিকারের মতোই গুরুত্বপূর্ণ। বিদ্যুৎ বা রেললাইন যেমন একটি অঞ্চলের আর্থিক সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়, তেমনি উচ্চ গতিসম্পন্ন ইন্টারনেট একটি এলাকার প্রোডাক্টিভিটি ও প্রবৃদ্ধি বাড়িয়ে দেয়। বিশ্বব্যাংকের গবেষণা বলছে, মাত্র ১০ শতাংশ ইন্টারনেট পেনিট্রেশন বৃদ্ধি পেলেই দেশের জিডিপি ১ শতাংশের বেশি বাড়ে। তাহলে এটার জন্য ভ্যাট প্রযোজ্য হবে?
বর্তমানে আমরা যেভাবে মোবাইলনির্ভর ‘স্মল স্ক্রিন’ ইউজারদের নিয়ে ভাবছি, তা কনজ্যুমার ইকোনমির একটি দিকমাত্র। ফেসবুক স্ক্রল করা, ভিডিও দেখা বা অনলাইন পেমেন্ট করার মতো কার্যক্রম মূলত ভোগকেন্দ্রিক। কিন্তু উৎপাদনমুখী অর্থনীতি তৈরি হয় ‘বিগ স্ক্রিন’, অর্থাৎ ডেস্কটপ বা ল্যাপটপ ব্যবহারকারীদের হাত ধরে। এরা ফ্রিল্যান্সিং করে, সফটওয়্যার বানায়, ভিডিও এডিট করে, সার্ভিস রপ্তানি করে। আর এসব কার্যক্রমের জন্য দরকার নিরবচ্ছিন্ন ফিক্সড হাইস্পিড ব্রডব্যান্ড কানেকশন।
আমাদের দেশে অনেকেই ব্যান্ডউইডথের খরচ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। বাস্তবতা হচ্ছে, একটা আইএসপি মোট ব্যান্ডউইডথের মধ্যে মাত্র ৬ থেকে ৭ শতাংশ ইন্টারন্যাশনাল ব্যান্ডউইডথ কেনে। বাকি ৯৩ শতাংশ কনটেন্ট আসে বিভিন্ন কনটেন্ট ডিস্ট্রিবিউশন নেটওয়ার্ক (সিডিএন) থেকে—যেমন গুগল, ফেসবুক, অ্যামাজন, ক্লাউডফেয়ার, নেটফ্লিক্স, টিকটক ইত্যাদি। এই কনটেন্টগুলো যদি দেশেই হোস্ট করা যায়, তাহলে ব্যান্ডউইডথ খরচ ৯৩ শতাংশের অনুপাতে অনেক কমে আসবে এবং ইউজারের অভিজ্ঞতাও হবে অনেক ভালো। সরকার ইতিমধ্যে এই এজ নেটওয়ার্কগুলো দেশে আনার উদ্যোগ নিয়েছে, যা নিঃসন্দেহে ইতিবাচক।
একটি আইএসপি পরিচালনার ব্যান্ডউইডথ খরচ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ৫৫ শতাংশ খরচই চলে যায় দেশের ভেতরের সংযোগব্যবস্থায়, যাকে আমরা বলি এনটিটিএন খরচ। বাকি ৪৫ শতাংশ যায় আন্তর্জাতিক ইন্টারনেট ব্যবহারে। পুরোটা দেখলে মানবসম্পদে খরচ হয় প্রায় ২০ শতাংশ, অফিস ও লজিস্টিকসে ১২ শতাংশ, ডেটা সেন্টার ও হোস্টিংয়ে ৩ শতাংশ, ব্যান্ডউইডথে ৪০ শতাংশ, এনটিটিএনে ২০ শতাংশ এবং ভ্যাট ৫ শতাংশ। সব মিলিয়ে দেখা যায়, খরচ এতটাই বেশি যে লাভের জন্য প্রয়োজন বিশাল স্কেল। এ ছাড়া ইন্টারনেট মৌলিক সার্ভিস হলে ভ্যাট মওকুফের ব্যাপারে কথা বলা যেতেই পারে।
আর স্কেলে গেলে ব্যয় কমে। যেমন যদি সাবমেরিন কেব্ল ব্যবহারে ২০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি আসে, তাহলে খরচ বাড়ে মাত্র ৫ শতাংশ। অর্থাৎ ইউনিট কস্ট কমে যায়। এর মানে, যত বেশি ব্যবহার, তত কম খরচ। এই স্কেলের সুবিধা পুরোপুরি পেতে হলে আইএসপিগুলোকে একে অপরের সঙ্গে রিসোর্স শেয়ার করতে হবে—একই রাউটার, একসঙ্গে ব্যান্ডউইডথ ম্যানেজমেন্ট, এরিয়া ধরে ফুল অটোমেশন, এসএএএস মডেলে গ্রাহক পরিচালনা ইত্যাদি।
এ ধরনের সহযোগিতার মাধ্যমে একটি নতুন প্রবণতা গড়ে উঠতে পারে—মার্জার ও অ্যাকুইজিশন। আইএসপিগুলো যদি নিজেদের স্বার্থে পার্টনারশিপ করে একসঙ্গে হতে পারে, তাহলে খুব সহজেই বড় স্কেলে পৌঁছানো সম্ভব। আর তখনই বিদেশি বিনিয়োগ আসবে। কারণ, তারা খোঁজে রেগুলেটরি স্থিতিশীলতা ও স্কেল। বিটিআরসির উচিত হবে এই মার্জারের প্রক্রিয়াকে উৎসাহিত করা—যেমন মার্জার ফি বন্ধ করা, লাইসেন্সিং সহজ করা কিংবা প্রণোদনা দেওয়া।
এভাবে যদি একটি কোম্পানি ১০ লাখ গ্রাহক অ্যাকোয়ার করতে পারে, তাহলে শুধু দেশের মধ্যেই নয়, আন্তর্জাতিক পরিসরেও তারা প্রতিযোগিতা করার সক্ষমতা অর্জন করবে। তখন আমাদের আইএসপি ইন্ডাস্ট্রি সত্যিকারের গ্লোবাল লেভেলে খেলতে পারবে।
এই পুরো ব্যবস্থার পেছনে আছে একটি সহজ সত্য—আইএসপি ব্যবসায় একা একা টেকা যায় না। এটা পার্টনারশিপ করে স্কেলে খেলার জায়গা। এখানে বিজয়ী হতে হলে দরকার একসঙ্গে এগোনোর মানসিকতা, টেকনোলজির স্মার্ট ব্যবহার এবং স্কেলের সঠিক পরিকল্পনা। আমাদের এখনই বুঝতে হবে, এই বিশাল স্কেলের কানেক্টিভিটি শুধু জিডিপি বাড়াবে না, এটি আমাদের অর্থনীতির মেরুদণ্ড।
রকিবুল হাসান টেলিকম, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাবিষয়ক লেখক