গণহত্যাকারীদের বিচার ও রাজনীতিতে নিষিদ্ধের দাবি জানাল জুলাই মঞ্চ
Published: 6th, March 2025 GMT
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে গণহত্যাকারীদের গ্রেপ্তার করে বিচারের মুখোমুখি করার পাশাপাশি রাজনীতিতে তাঁদের নিষিদ্ধের দাবিতে আজ বৃহস্পতিবার বিকেলে রাজধানীর শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের সামনে সংবাদ সম্মেলন করেছে জুলাই মঞ্চ। তিনটি দাবিতে ১৭ দিন ধরে তাঁরা অবস্থান কর্মসূচি পালন করে আসছে।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন জুলাই মঞ্চের প্রতিনিধি সাকিব হোসাইন। তিনি বলেন, গণহত্যাকারীদের গ্রেপ্তারে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না অভ্যুত্থান–পরবর্তী সরকার। সরকারের এমন অনীহার ব্যাপারে ক্ষোভ ও অসন্তোষ প্রকাশ করছে জুলাই মঞ্চ। তিনি বলেন, গণহত্যার স্পষ্ট প্রমাণ থাকার পরও গ্রেপ্তারকৃতদের বিচারে ধীরগতি জনমনে সংশয়ের জন্ম দিয়েছে। পাশাপাশি দেখা যাচ্ছে চিহ্নিত গণহত্যাকারীদের গ্রেপ্তারে বিশেষ কোনো উদ্যোগও নেওয়া হচ্ছে না।
এই সরকারকে সাত মাস সময় দেওয়া হয়েছে উল্লেখ করে জুলাই মঞ্চের এই প্রতিনিধি বলেন, ‘আমরা আশা করেছিলাম এই ৭ মাসে আমাদের শহীদদের আত্মাকে শান্ত করতে পারব গণহত্যাকারীদের বিচার করার মাধ্যমে। কিন্তু এত দিন পার হওয়ার পরও সেটা সম্ভব হয়নি। আমরা শহীদদের প্রতি দায়বদ্ধ। গণহত্যার বিচার আগে হতে হবে, তারপর সংস্কার বা নির্বাচন যা ইচ্ছা করুন।’
বাংলাদেশে গণহত্যা হবে আর বিচার হবে না—এটা মেনে নেওয়া যায় না উল্লেখ করে লিখিত বক্তব্যে সাকিব হোসাইন বলেন, ‘আমরা নাগরিক দায়িত্ববোধ ও নিরাপদ বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে শাহবাগে অবস্থান করছি। বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর থেকে সুস্থ ধারার রাজনীতি কোনো রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। জুলাই বিপ্লবের পর লাশের রাজনীতি বন্ধ করে আধুনিক ও নিরাপদ বাংলাদেশ বিনির্মাণ করার একটি বড় সুযোগ এসেছে।’ এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে স্বপ্নের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় সব রাজনৈতিক দলকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।
সাকিব হোসাইন বলেন, জুলাই-আগস্ট ২০২৪ এর যুদ্ধ ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব সুরক্ষার যুদ্ধ। এ যুদ্ধে বাংলাদেশ বিজয়ী হয়েছে। বিজয়ীদের সমস্বরে সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে বাংলাদেশবিরোধী এই গণহত্যাকারী চক্রের শাস্তি কীভাবে নিশ্চিত করবে এবং তারা বাংলাদেশে রাজনীতি করতে পারবে কি না।
এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন জুলাই মঞ্চের প্রতিনিধি মোহাম্মদ শাকিল মিয়া, আরিফুল ইসলাম তালুকদার, অর্ণব হোসেন প্রমুখ।
জুলাই মঞ্চের দাবিগুলো হলো জুলাই গণহত্যার বিচার; গণহত্যাকারী দল হিসেবে আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনগুলোকে নিষিদ্ধ ঘোষণা এবং প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যেসব সদস্য সরাসরি গণহত্যায় জড়িত তাঁদের চিহ্নিত করে গ্রেপ্তার ও বিচারের আওতায় আনা।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: গণহত য ক র দ র র জন ত
এছাড়াও পড়ুন:
যে ‘ধর্মীয় অনুপ্রেরণায়’ ইরানে এই হামলা চালাল ইসরায়েল
ইসরায়েল আবারও ইরানে বড় রকমের হামলা করেছে। হামলায় ইরানের বেশ কয়েকজন উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তা ও পরমাণুবিজ্ঞানী নিহত হয়েছেন। হামলা হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ঘাঁটি ও আবাসিক এলাকায়। একদিন পর পাল্টা হামলা চালায় ইরান। এতে কয়েকজন ইসরায়েলি নিহত হয়। ধ্বংস হয় তেলআবিবের কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা।
ইসরায়েল তার ইরানবিরোধী এ হামলার নাম দিয়েছে ‘রাইজিং লায়ন’। এ নাম রাখা হয়েছে হিব্রু বাইবেলের একটি চরণ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে। যে নাম ইসরায়েলের একটি শক্তিশালী ও বিজয়দীপ্ত ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি দেয়।
ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বৃহস্পতিবার ইহুদিদের সবচেয়ে পবিত্র উপাসনাস্থল জেরুজালেমের ওয়েস্টার্ন ওয়ালের একটি ফাটলে হাতে লেখা একটি চিরকুট রেখে আসার সময় ছবি তোলেন। এটি ছিল মূলত ইরানে ইসরায়েলের হামলার ইঙ্গিত।
শুক্রবার তার অফিস থেকে সেই চিরকুটে একটি ছবি প্রকাশ করা হয়। সেখানে লেখা ছিল: ‘জনগণ সিংহের মতো উঠে দাঁড়াবে।’
এই বাক্যাংশটি হিব্রু বাইবেলের গ্রন্থ বুক অব নাম্বারস (গণনা পুস্তক) ২৩:২৪ পদ থেকে এসেছে। যেখানে বলা হয়েছে: ‘দেখো, এই জাতি একটি মহান সিংহের মতো উঠে দাঁড়াবে এবং একটি তরুণ সিংহের মতো নিজেকে উদ্দীপ্ত করবে; সে শিকার না খাওয়া পর্যন্ত বিশ্রাম নেবে না এবং নিহতদের রক্ত না পান করা পর্যন্ত থামবে না।’
এই চরণটি হিব্রু বাইবেলের অ-ইসরায়েলীয় একজন নবী ও ভবিষ্যদ্বক্তা বালামের প্রথম ভবিষ্যদ্বাণীর অংশ। সেখানে তিনি ইসরায়েলের শক্তি ও ক্ষমতার কথা বলেন। তাদের এমন এক সিংহের সঙ্গে তুলনা করেন যে নিজের ক্ষুধা না মেটানো পর্যন্ত বিশ্রামে যায় না।
অনেকেই মনে করেন, এই অভিযানের নাম ইরানের শেষ শাহ-এর পুত্রের প্রতি ইঙ্গিত হতে পারে। কারণ পারস্য রাজপরিবারের প্রতীক হিসেবেও সিংহ ব্যবহৃত হতো।
ইসরায়েলের ঐশ্বরিক অধিকারের দাবিইসরায়েল প্রায়শই তার সামরিক অভিযানের নাম হিব্রু বাইবেল বা ওল্ড টেস্টেমেন্ট থেকে নেয় বা ধর্মীয় অনুপ্রেরণা থেকে গ্রহণ করে। ফিলিস্তিনি ভূমির উপর ইহুদিদের তথাকথিত ঐশ্বরিক অধিকারের দাবি এবং মধ্যপ্রাচ্যে তাদের যুদ্ধকে ন্যায্যতা দিতে ইসরায়েল এসব ধর্মীয় বিষয় ব্যবহৃত করে বলে অনেকে মনে করে থাকেন।
উদাহরণস্বরূপ, ইসরায়েলি সেনাবাহিনী সিরিয়ার সামরিক স্থাপনা লক্ষ্য করে চালানো এক অভিযানের নাম দিয়েছিল, ‘অ্যারো অব বাশান।’ ‘বাশান’ শব্দটি ইসরায়েলিদের ধর্মগ্রন্থ ওল্ড টেস্টামেন্টে ব্যবহৃত হয়েছে। এটি দিয়ে মূলত সিরিয়ার দক্ষিণ ও জর্ডান নদীর পূর্বে অবস্থিত একটি অঞ্চলকে নির্দেশ করা হয়। বাশানের রাজাকে পরাজিত করে ইসরায়েলিরা সেই অঞ্চলকে দখল করেছিল।
গাজা উপত্যকার ওপর হামলা চালাতেও অস্ত্র ও অভিযানের জন্য হিব্রু বাইবেলীয় প্রতীক বা অনুষঙ্গ ব্যবহার করছে ইসরায়েল। নেতানিয়াহু অন্তত তিনবার গাজায় আক্রমণের জন্য হিব্রু বাইবেলীয় আমালেক কাহিনি ব্যবহার করেছেন।
২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর এক বিবৃতিতে নেতানিয়াহু হিব্রু বাইবেল ও ওল্ড টেস্টামেন্টের গ্রন্থ ‘বুক অব ডিউটেরনমি’(২৫:১৭) এর থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন:
‘আমালেক তোমার সঙ্গে যা করেছিল তা মনে রেখো, আমরা মনে রাখি এবং আমরা যুদ্ধ করি।’
এর মধ্য দিয়ে গাজাবাসীদের উপর পূর্ণাঙ্গ হামলা করা উচিত বলে নেতানিয়াহু ইঙ্গিত করেন। কারণ ডিউটেরনমির এই উদ্ধৃতি বাইবেলের স্যামুয়েল গ্রন্থে বর্ণিত আমালেকীয়দের বিরুদ্ধে সম্পূর্ণ ধ্বংসের আহ্বান হিসেবে বিবেচিত হয়।
বাইবেলের এ কাহিনিতে ইসরায়েলিদের ওপর আক্রমণকারীদের সম্পূর্ণরূপে নির্মূল করার আহ্বান জানানো হয়েছে। গাজার গোটা জনসংখ্যাকে সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিহ্ন করে দিতে বাইবেলের এ কাহিনিকে হাজির করেছেন নেতানিয়াহু।
গণহত্যার মামলায় নেতানিয়াহুর বক্তব্যইসরায়েলের বিরুদ্ধে দক্ষিণ আফ্রিকার দায়ের করা গণহত্যার মামলায় আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের (আইসিজে) প্রথম শুনানিতে দক্ষিণ আফ্রিকার পক্ষের আইনজীবী হিব্রু বাইবেলের উদ্ধৃতির মাধ্যমে নেতানিয়াহুর এই বক্তব্যকে গাজার জনগণের বিরুদ্ধে গণহত্যায় প্ররোচনা হিসেবে তুলে ধরেন।
আইনজীবী আরও জানান, নেতানিয়াহু ৩ নভেম্বর সেনাদের উদ্দেশ্যে লেখা আরেকটি চিঠিতে একই আমালেকীয় গল্প পুনরাবৃত্তি করেন।
ধর্মীয় নাম ব্যবহার করে সামরিক প্রযুক্তিইসরায়েলি সেনাবাহিনীর যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি গাজায় বোমাবর্ষণে সহায়তা করছে, তাদের নাম ‘ল্যাভেন্ডার’ এবং ‘দ্য গসপেল’, যা উভয়ই হিব্রু বাইবেলীয় ধর্মগ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে।
টিআরটি ওয়ার্ল্ডের বিশ্লেষক রাভালে মহিদিনের মতে, প্রায়ই ধর্মীয় ধর্মগ্রন্থ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ইসরায়েলের অস্ত্রের নামকরণ করা হয়। যেমন, স্যামসন রিমোট কন্ট্রোলড ওয়েপন স্টেশন।
জেরিকো ব্যালিস্টিক মিসাইল-এর নাম রাখা হয়েছে জেরিকো শহরের নামে। হিব্রু বাইবেল ও ওল্ড টেস্টামেন্টের একটি গ্রন্থ ‘বুক অব যশুয়া’ অনুসারে ইসরায়েলিরা এই শহর ফিলিস্তিনিদের কাছ দখল করেছিল।
ডেভিড’স স্লিং নামক আরেকটি ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থার নাম রাখা হয়েছে বাইবেলের মেষপালক ডেভিড ও বিশাল যোদ্ধা গোলিয়াথের মধ্যকার বিখ্যাত সেই লড়াইয়ের স্মরণে, যেখানে ডেভিডের বিজয় হয়েছিল। এই কাহিনী আছে হিব্রু বাইবেল ও ওল্ট টেস্টামেন্টের একটি গ্রন্থ ‘বুক অব স্যামুয়েল’-এ।
*দ্য নিউ আরব, মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা বিষয়ক লন্ডনভিত্তিক সংবাদমাধ্যম। টিআরটি ওয়ার্ল্ডের বিশ্লেষক ও হার্ভার্ডের গবেষক রাভালে মহিদিনের একটি লেখার অবলম্বনে দ্য নিউ আরব এ বিশ্লেষণটি প্রকাশ করেছে। অনুবাদ করেছেন: রাফসান গালিব