কানাডার হবু প্রধানমন্ত্রী কে এই মার্ক কার্নি, ট্রাম্পকে কি সামলাতে পারবেন তিনি
Published: 10th, March 2025 GMT
নতুন প্রধানমন্ত্রী পাচ্ছে কানাডা। দেশটির ক্ষমতাসীন লিবারেল পার্টির প্রধান নির্বাচিত হয়েছেন মার্ক কার্নি। নিয়ম অনুযায়ী ক্ষমতাসীন দলের প্রধানই কানাডায় সরকারপ্রধান হয়ে থাকেন। সেই হিসাবে, মার্ক কার্নি বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর স্থলাভিষিক্ত হচ্ছেন, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
মার্ক কার্নি অর্থনীতিবিদ, কানাডার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক প্রধান। তিনি ব্যাংক অব ইংল্যান্ডেরও নেতৃত্ব দিয়েছেন। আগামী কয়েক দিনের মধ্যে তিনি প্রধানমন্ত্রী পদে শপথ নিতে পারেন।
পেশায় অর্থনীতিবিদ–ব্যাংকার কার্নি এমন এক সময় সরকারপ্রধানের দায়িত্ব নিচ্ছেন, যখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে কানাডার বাণিজ্যযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার শঙ্কা বাড়ছে।
সামনেই কানাডার জাতীয় নির্বাচন হওয়ার কথা। তাঁর আগে সর্বোচ্চ স্তরের জাতীয় রাজনীতিতে যুক্ত হলেন ক্ষমতাসীন দলের নতুন প্রধান কার্নি।
দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক নানাবিধ সমস্যা মোকাবিলা করতে হবে হবু প্রধানমন্ত্রীকে। পাশাপাশি সমালোচনা দূর করে, লিবারেল পার্টির বছরের পর বছর ধরে সমর্থন কমে আসার লাগাম টেনে ধরার চ্যালেঞ্জও তাঁর সামনে।
দলীয় ফোরামে ৮৫ দশমিক ৯ শতাংশ ভোট পেয়ে দলের নেতা ও হবু প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর গতকাল রোববার সন্ধ্যায় প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে মার্ক কার্নি বলেন, ‘আমি দিন–রাত একটি লক্ষ্য সামনে রেখেই কাজ করব, তা হলো সবার জন্য আরও শক্তিশালী কানাডা গড়ে তোলা।’দলীয় ফোরামে ৮৫ দশমিক ৯ শতাংশ ভোট পেয়ে দলের নেতা ও হবু প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর গতকাল রোববার সন্ধ্যায় প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে মার্ক কার্নি বলেন, ‘আমি দিন–রাত একটি লক্ষ্য সামনে রেখেই কাজ করব, তা হলো সবার জন্য আরও শক্তিশালী কানাডা গড়ে তোলা।’
কানাডায় নতুন নেতৃত্ব নির্বাচনের পর বেশ কয়েকটি প্রশ্ন সামনে এসেছে। কে এই মার্ক কার্নি? কানাডার ভবিষ্যৎ নিয়ে তিনি কোন ধরনের নীতি অনুসরণ করার পরিকল্পনা করছেন? তিনি কী আসন্ন সাধারণ নির্বাচনে তুলনামূলক শক্তিশালী কনজারভেটিভ পার্টির বিরুদ্ধে লিবারেলদের সৌভাগ্য ছিনিয়ে আনতে পারবেন?
অক্সফোর্ডের স্নাতক, কেন্দ্রীয় ব্যাংকারকানাডার উত্তর–পশ্চিমাঞ্চলে মার্ক কার্নির জন্ম। বেড়ে ওঠা দেশটির পশ্চিমাঞ্চলের আলবার্টা প্রদেশে। তিনি নিজেকে রাজনৈতিক অঙ্গনে ‘একজন বহিরাগত’ হিসেবে তুলে ধরেছেন, যিনি কানাডাকে অর্থনৈতিক অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তার সময়ে নেতৃত্ব দিতে পারবেন।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কানাডার পণ্যের ওপর উচ্চ শুল্ক আরোপ করেছেন। গত ৪ মার্চ থেকে এটা কার্যকর হয়েছে। ফলে কানাডা বিপর্যয়ের আশঙ্কায় পড়েছে। সামনের দিনগুলোয় অর্থনৈতিক মন্দার আশঙ্কা জাতীয়তাবাদের অনুভূতি এবং অটোয়াতে স্থিতিশীল নেতৃত্বের আকাঙ্ক্ষাকে সামনে নিয়ে এসেছে।
৫৯ বছর বয়সী মার্ক কার্নি ২০০৮ সালের বিশ্বব্যাপী আর্থিক সংকটের সময়ে ব্যাংক অব কানাডার গভর্নর হিসেবে তাঁর কাজ শুরু করেছিলেন। কানাডাকে আরও গুরুতর মন্দা থেকে রক্ষা করতে দ্রুত ও সিদ্ধান্তমূলক উদ্যোগ নেওয়ার জন্য তাঁকে কৃতিত্ব দেওয়া হয়।মার্ক কার্নি ঐতিহ্যবাহী হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি ও অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের বহুজাতিক বিনিয়োগ ব্যাংক ও আর্থিক সেবাদাতা কোম্পানি গোল্ডম্যান স্যাকসে এক দশকেরও বেশি সময় কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে তাঁর।
অতিসম্প্রতি মার্ক কার্নি ব্রুকফিল্ড অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেছেন। প্রতিষ্ঠানটিতে তিনি বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবতৃন মোকাবিলার লক্ষ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ বিনিয়োগ সম্প্রসারণ প্রচেষ্টায় নেতৃত্ব দিয়েছেন।
সংকটের সময় মার্ক কার্নি নিজের ব্যাংকিং অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে ‘ট্রাম্প ঝড়’ সফলভাবে মোকাবিলা করতে পারবেন, এমনটাই মনে করছেন তাঁর রাজনৈতিক সমর্থকেরা।
৫৯ বছর বয়সী মার্ক কার্নি ২০০৮ সালে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সংকটের সময়ে ব্যাংক অব কানাডার গভর্নর হিসেবে তাঁর কাজ শুরু করেছিলেন। ওই সময় কানাডাকে আরও গুরুতর মন্দা থেকে রক্ষা করতে দ্রুত ও সিদ্ধান্তমূলক উদ্যোগ নেওয়ার জন্য তাঁকে কৃতিত্ব দেওয়া হয়।
মার্ক কার্নি ২০১৩ সালে ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের নেতৃত্বে আসেন। ২০২০ সাল পর্যন্ত তিনি সেখানে ছিলেন। ওই বছর যুক্তরাজ্য আনুষ্ঠানিকভাবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে বেরিয়ে আসে, যা ব্রেক্সিট নামে পরিচিত।
যুক্তরাজ্যের অর্থনীতিতে ব্রেক্সিটের প্রভাব কমিয়ে আনার জন্য স্বীকৃত ছিলেন মার্ক কার্নি। তবে ইইউর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করা যুক্তরাজ্যের অর্থনীতির জন্য ঝুঁকি তৈরি করেছে বলেও মূল্যায়ন করেছিলেন তিনি। এটা ব্রেক্সিটের পক্ষে থাকা যুক্তরাজ্যের রক্ষণশীলদের ক্ষুব্ধ করেছিল।
মার্ক কার্নির বিষয়ে লেখক, কলাম লেখক ও যুক্তরাজ্যের একাডেমি অব সোশ্যাল সায়েন্সের প্রেসিডেন্ট উইল হাটন বলেন, ‘তিনি (মার্ক কার্নি) একজন সৃজনশীল ও উদ্ভাবনী গুণসম্পন্ন কেন্দ্রীয় ব্যাংকার ছিলেন।’
আরও পড়ুনকানাডার নতুন প্রধানমন্ত্রী মার্ক কার্নি ৪ ঘণ্টা আগেরাজনীতিতে স্বল্প অভিজ্ঞতাঅর্থনৈতিক বিষয়ে মার্ক কার্নির যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা নিয়ে বিতর্ক খুব কমই রয়েছে। তবে নির্বাচনী রাজনীতিতে তাঁর স্বল্প অভিজ্ঞতা নিয়ে এরই মধ্যে প্রশ্ন উঠেছে।
এক সময় বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর অর্থনৈতিক উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেছেন কার্নি। আবাসন সংকট ও জীবনযাত্রার ক্রমবর্ধমান ব্যয় মোকাবিলায় ট্রুডো সরকারের ব্যর্থতার জেরে ব্যাপক ক্ষোভ নিয়েই পদ ছাড়েন তিনি।
তবে মার্ক কার্নি এর আগে কখনোই এতবড় রাজনৈতিক পদের (সরকারপ্রধান) জন্য লড়াই করেননি। লিবারেল পার্টির নেতৃত্বের প্রচারে বেশির ভাগ সময় তিনি কানাডার মানুষের কাছে নিজেকে পরিচয় করিয়ে দিতে ব্যয় করেছেন।
কানাডার ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড্যানিয়েল বেলান্ড বলেন, ‘তিনি (মার্ক কার্নি) এমন একজন মানুষ, যিনি বরাবরই পর্দার আড়ালে ছিলেন।’
প্রচার শুরুর পর বেশকিছু প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন মার্ক কার্নি। এর মধ্যে রয়েছে—সরকারি ব্যয়ে লাগাম টানা, আবাসন খাতে বিনিয়োগ বাড়ানো, কানাডার ব্যবসায়িক অংশীদারদের মধ্যে বৈচিত্র্য আনা, অভিবাসনে সাময়িক রাশ টানা।
জলবায়ু উদ্যোগ ও অর্থায়নবিষয়ক জাতিসংঘের সাবেক একজন বিশেষ দূত বলেন, কার্নি জলবায়ুসংকট মোকাবিলা এবং শুন্য নির্গমনে পৌঁছানোর পথে বেসরকারি খাতকে নেতৃত্বের ভূমিকায় আনাটাকে সমর্থন করেন।
গত মাসে লিবারেল পার্টির নেতৃত্বের লড়াইয়ে প্রতিদ্বন্দ্বীদের সঙ্গে বিতর্কের সময় মার্ক কার্নি বলেছিলেন, ‘কীভাবে সংকট মোকাবিলা করতে হয়, সেটা আমি জানি। আমি জানি কীভাবে শক্তিশালী অর্থনীতি গড়ে তুলতে হয়।’
কানাডার বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: কর ছ ন র জন য প রব ন কর ছ ল র জন ত র সময় সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
নারীবাদের ছদ্মবেশে ভারত যখন যুদ্ধ চালায়
ভারতের সেনাবাহিনীর যে দুই নারী অফিসার ‘অপারেশন সিঁদুর’ ঘোষণা করেছিলেন, তাঁদের একজন হিন্দু ও একজন মুসলমান। তাঁদের দিয়ে অভিযানের ঘোষণা দেওয়ানোর ঘটনাকে ভারত জাতীয় কর্মযজ্ঞে নারীর অন্তর্ভুক্তি হিসেবে তুলে ধরতে চেয়েছে।
খাকি পোশাক পরা এই দুই নারী যখন যুদ্ধের ফ্রন্টলাইন থেকে সংবাদমাধ্যমের সামনে কথা বলছিলেন; যখন তাঁরা ভারতের ২৬ জন সাধারণ পুরুষ মানুষকে হত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার কথা বলছিলেন এবং যখন তাঁরা প্রতীকীভাবে বিধবাদের সিঁদুরের সম্মান রক্ষার বার্তা দিচ্ছিলেন, তখন অনেকেই এই দৃশ্যকে দেশের সেবায় নিয়োজিত একটি নারীবাদী চিত্র বলে প্রশংসা করেছিলেন।
দুই নারী অফিসারের ঘোষণাপর্ব শেষ হওয়ার পর ভারত সরকার এটিকে নারী ক্ষমতায়নের এক বিরাট উদাহরণ হিসেবে আখ্যায়িত করল। তাঁদের ছবি সবখানে ছড়িয়ে পড়ল। সবাই বলল, ‘দেখো, নারীরাও আজ সম্মুখসমরে লড়াই করছে!’
এই ঘটনা ইতিহাসের আরেকটি ঘটনার কথা মনে করিয়ে দেয়। সেটি হলো, ১৯৭১ সালের যুদ্ধে যখন ভারত-পাকিস্তান মুখোমুখি হয়েছিল, তখন ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে অনেকেই হিন্দুদের যুদ্ধদেবী দুর্গার সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। দুর্গা দেবীকে নারী শক্তি ও দেশপ্রেমের প্রতীক হিসেবে দেখা হয়। দুর্গার সঙ্গে ইন্দিরার তুলনা দেওয়া হয়েছিল কারণ, ইন্দিরা সে সময় বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে বড় ভূমিকা রেখেছিলেন। দুর্গার সঙ্গে ইন্দিরার এই তুলনা থেকে বোঝা যায়, ভারতে রাজনীতি অনেক সময়ই নারীর পরিচয় ও ধর্মীয় কল্পনার সঙ্গে মিশিয়ে ব্যাখ্যা করা হয় এবং রাষ্ট্র পরিচালনার বিষয়টি ধর্মীয় প্রতীকের সঙ্গে জড়িয়ে যায়।
কিন্তু কোনো নারী যুদ্ধের নেতৃত্ব দিলেই কি সেটিকে নারীবাদের অগ্রগতি বলা যায়?
অনেক দিন ধরেই নারীবাদী গবেষকেরা বলে আসছেন, ‘নেশন বিল্ডিং’ বা ‘দেশ গড়ার’ মতো বড় কাজ আসলে পুরুষদের দৃষ্টিভঙ্গিতেই চলে। সেখানে নারী-পুরুষকে সমানভাবে দেখা হয় না। বরং, নারীদের এমন সব ভূমিকা দেওয়া হয়, যেখানে তারা দেশের জন্য কিছু ত্যাগ করে। যেমন নারী মা হিসেবে সন্তান উৎসর্গ করে, বিধবা হিসেবে শোক করে—ইত্যাদি।
নীরা ইউভাল-ডেভিস নামের একজন গবেষক বলছেন, নারীদের অনেক সময় দেশের সম্মান আর সংস্কৃতির প্রতীক হিসেবে দেখানো হয়। কিন্তু রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা তাঁদের হাতে খুব কমই থাকে।
সামিতা সেন ও মৈত্রেয়ী চৌধুরীর মতো কয়েকজন ভারতীয় গবেষক বলছেন, ‘আমাদের দেশে নারীরা জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজে অংশ নিলেও তাঁদের সেই অংশগ্রহণ সর্বার্থে স্বাধীন থাকে না। বরং সমাজের নিয়মকানুন, মানে পুরুষদের বানানো নিয়ম মেনে তাঁদের দায়িত্ব পালন করতে হয়।’
তাই শুধু নারীরা সামনে এসেছে মানেই সব ঠিক হয়ে গেছে, এমন ভাবাটা ঠিক হবে না। আমাদের দেখতে হবে নারীদের সত্যিকার অর্থে সুযোগ দেওয়া হচ্ছে, নাকি শুধু লোকদেখানোর জন্য দেখানো হচ্ছে যে তাঁরাও অংশ নিচ্ছেন।
আজকের যেসব নারী যুদ্ধক্ষেত্রে কাজ করছেন বা সামরিক বাহিনীতে সামনে আসছেন, সেটিকে অনেক সময় একধরনের নারীবাদ হিসেবে দেখানো হয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এর মধ্য দিয়ে নারীদের এমনভাবে তুলে ধরা হয় যেন তাঁরা ‘পুরুষদের মতো’ হতে পারছেন। অথচ সামরিক বাহিনীর যে পুরুষতান্ত্রিক মূল কাঠামো, সেটিকে কিন্তু আগের মতোই রেখে দেওয়া হয়।
এই বিষয়টি আমরা পরিষ্কারভাবে অপারেশন সিঁদুরের মধ্যে দেখতে পেয়েছি। এখানে ইউনিফর্ম পরা দুই নারী অফিসারকে সামনে এনে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, যেন এটি নারীদের অগ্রগতির একটি ছবি। কিন্তু তাঁরা যে ভূমিকা পালন করেছেন, তার পুরোটাই পুরুষতান্ত্রিক চিন্তার ওপর তৈরি। এই পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোয় নারীদের দেশের জন্য লড়াই করে এবং পুরুষদের মতো জাতীয়তাবাদ দেখিয়ে নিজেদের ‘বীরত্ব’ প্রমাণ করতে হয়।
এই ধরনের নারীবাদের ছবিগুলো ভারতের এক বিশেষ আদর্শের সঙ্গে মিলে যায়। সেটি হলো আরএসএসের (রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ) চিন্তাধারা। ১৯২৫ সালে গঠিত এই সংগঠন হিন্দু জাতীয়তাবাদের পক্ষে কাজ করে। সংগঠনটি ভারতের শাসক দল বিজেপির আদর্শগত ভিত্তি হিসেবে কাজ করে।
আরএসএস মনে করে, ভারতের একটি হিন্দুরাষ্ট্র হওয়া উচিত, যেখানে হিন্দুধর্মের রীতিনীতিই থাকবে সবার ওপরে। গবেষক ক্রিস্টোফ জ্যাফরেলো বলছেন, এই সংগঠন সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের প্রাধান্য দেয় এবং ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রকে দুর্বল করে।
আরএসএসের যে কাঠামো, সেখানে নিয়মশৃঙ্খলা আর জাতীয়তাবাদের ওপর অনেক গুরুত্ব দেওয়া হয়। সেখানে পুরুষদের নেতৃত্বকেই বেশি জায়গা দেওয়া হয়। তাই এটা আসলে সমাজের ভেতরে পুরুষের আধিপত্য আর স্তরভিত্তিক বৈষম্যকে আরও পোক্ত করে।
আরএসএসের নারী শাখা (যেমন ‘রাষ্ট্রীয় সেবিকা সমিতি’ ও ‘দুর্গা বাহিনী’) আসলে পুরুষতান্ত্রিক ভাবনারই প্রতিফলন। এই সংগঠনগুলো অনেক বছর ধরে নারীদের মার্শাল আর্ট শেখাচ্ছে আর আদর্শগত প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। কিন্তু এসব নারীর মুক্তির জন্য করা হচ্ছে না, করা হচ্ছে ‘হিন্দুরাষ্ট্রকে রক্ষা করার’ জন্য।
অপারেশন সিঁদুরের চেহারাও এই ভাবনার সঙ্গে মিলে যায়। গেরুয়া রঙের ছাপ, যুদ্ধজয়ী নারীর চেহারা আর সাজানো-গোছানো সাহসিকতার প্রদর্শন—এর সবই এই পুরোনো চিন্তার ধারাবাহিকতা।
দক্ষিণ এশিয়ায় যুদ্ধ ও লিঙ্গবিষয়ক প্রখ্যাত গবেষক বিনা ডি’কস্টা দেখিয়েছেন, কীভাবে নারীর দেহকে অনেক সময় জাতীয় গৌরবের প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
এই অপারেশন সিঁদুরের মধ্যে এক মুসলমান নারী অফিসারকে রাখা হয়েছে। এটি দেখে মনে হতে পারে, এটি ধর্মনিরপেক্ষতার ইঙ্গিত। কিন্তু ডি’কস্টা বলছেন, এটি আসলে একধরনের ওপর-চালাকি। কারণ, এই একজন মুসলমান নারীকে দেখিয়ে বলা হয়, ‘দেখো, আমরা সবাইকে সুযোগ দিচ্ছি।’ অথচ বাস্তবে ভারতে অনেক মুসলমানের প্রতি বৈষম্য দেখানো হচ্ছে, অনেককে অপমান করা হচ্ছে বা ভয় দেখানো হচ্ছে।
এই একজন মুসলমান নারীকে সামনে আনা হচ্ছে যেন এটা প্রমাণ করতে যে সবাইকেই সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু এর মধ্য দিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের চিন্তাভাবনাকেই আরও পোক্ত করা হচ্ছে আর মুসলমানদের বঞ্চনাকে ঢেকে রাখা হচ্ছে।
সিঁদুর হিন্দু বিবাহিত নারীরা মাথার মাঝখানে সিঁথিতে লাগান। এটি সাধারণভাবে বিবাহিত অবস্থার চিহ্ন, স্বামীর প্রতি ভক্তি এবং ‘ভালো স্ত্রী’ হওয়ার প্রতীক। সিঁদুরের সঙ্গে দেবী দুর্গার ভাবনাও জড়িয়ে থাকে।
ইতিহাসবিদ তনিকা সরকার তাঁর ‘হিন্দু ওয়াইফ, হিন্দু নেশন’ বইয়ে দেখিয়েছেন কীভাবে জাতীয়তাবাদী কথা বা ভাবনা স্ত্রীর পবিত্রতা আর মাতৃভূমির পবিত্রতাকে একসঙ্গে গুলিয়ে ফেলে।
অপারেশন সিঁদুর নামটাই সিঁদুরের প্রতীককে একধরনের অস্ত্র বানিয়ে ফেলেছে। এই নামের মধ্য দিয়ে বলা হয়েছে পাকিস্তানের ওপর সামরিক হামলার মাধ্যমে বিধবাদের ভেঙে যাওয়া বৈবাহিক সম্পর্কের প্রতিশোধ নেওয়া হবে, তার মধ্য দিয়ে হিন্দু বিধবাদের সম্মান ফিরিয়ে দেওয়া হবে।
এই পুরো অপারেশন একধরনের ছবি তৈরি করেছে, যেখানে দেখানো হয়েছে কিছু নারী বিধবা হয়ে গেছেন (মানে তাঁরা সিঁথির সিঁদুর হারিয়েছেন) আর তাঁদের কষ্টকে প্রতিশোধের জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
নারীবাদী ইতিহাসবিদ উর্বশী বুতালিয়া বলেছেন, যুদ্ধের সময় নারীর দেহ, অনুভূতি আর প্রতীকগুলোকে (যেমন সিঁদুর, শোক, মাতৃত্ব ইত্যাদি) ‘যুদ্ধের চিহ্ন’ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। যুদ্ধ যখন হয়, তখন তা কেবল গোলাবারুদ দিয়ে হয় না। তার জন্য একটি ‘গল্প’ বা ‘ব্যাখ্যা’ দাঁড় করানো হয়, যাতে মানুষ বুঝতে পারে কেন যুদ্ধটা জরুরি। সেই গল্প বানাতে নারীদের দুঃখ, কষ্ট, চোখের জল—এসব ব্যবহার করা হয়।
যখন কোনো নারীর স্বামী মারা যান, তাঁকে বলা হয় বিধবা। তখন তাঁর মাথা থেকে সিঁদুর মুছে যায়। এই বিধবার কান্না, তাঁর হারানো সিঁদুর, তাঁর দুঃখ এসব অনুষঙ্গ ব্যবহার করে বলা হয়, ‘দেখো, কত কষ্ট। এর প্রতিশোধ নেওয়া দরকার।’
অর্থাৎ, নারীর কষ্টকে একটা জাতীয়তাবাদী অনুভূতির জ্বালানি বানিয়ে ফেলা হয় যেন দেশের জন্য যুদ্ধ করাটা ন্যায্য প্রমাণিত হয়।
উর্বশী বুতালিয়া বলছেন, অপারেশন সিঁদুরের সিঁদুর আসলে নারীদের কাছে এখন আর কোনো ভালো কিছুর প্রতীক নয়; এটি সেই কষ্টের স্মৃতি, যা তাঁরা হারিয়েছেন। সিঁদুর বলতে এখানে সম্মান হারানো, সামাজিক মর্যাদা হারানো ও নিরাপত্তা হারানোকে বোঝানো হয়েছে। বুতালিয়া মনে করেন, নারীর দুঃখকে সম্মান দিতেই তাঁর পাশে দাঁড়াতে হবে, তাঁর দুঃখকে ব্যবহার করতে নয়।
এই দুই নারী অফিসারকে এখানে স্বাধীন ব্যক্তি হিসেবে দেখানো হয়নি; বরং এক কল্পনার ‘মাতৃভূমির’ সৈনিক হিসেবে দেখানো হয়েছে। তাঁদের দেখানো হয়েছে সেই পুরোনো চিন্তার ধারাবাহিকতায়, যেখানে নারীদের মূলত ঘর আর পূজার আসনের মধ্যেই আটকে রাখা হতো।
এখানে আসলে যেটা উদ্যাপন করা হচ্ছে, সেটা নারীদের মুক্তি নয়। বরং তাদের এমন একটি ভূমিকার মধ্যে নিয়ে আসার বিষয়কে উদ্যাপন করা হচ্ছে, যা কিনা পুরুষদের মতো যুদ্ধকেন্দ্রিক এবং আক্রমণাত্মক।
নারীদের এমনভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে যেন তারা যুদ্ধ করতে পারে, অস্ত্র ধরতে পারে এবং সেটাকেই নারীর অগ্রগতি বলে দেখানো হচ্ছে। কিন্তু এর মাধ্যমে মূলত রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে যুদ্ধ ও সহিংসতাকে বৈধতা দেওয়া হচ্ছে, নারীবাদকে নয়।
এই প্রতীকগুলো (যেমন নারী অফিসার, সিঁদুর, যুদ্ধ) আসলে পুরোনো ক্ষমতার কাঠামোকে টিকিয়ে রাখে। তাই আমাদের দরকার এই প্রতীকগুলোর মানে নিয়ে প্রশ্ন তোলা। এসবের মাধ্যমে সরকার কী বোঝাতে চায়, কাকে সুবিধা দিতে চায়, সেই প্রশ্ন তোলা দরকার।
প্রশ্ন হচ্ছে যখন নারী অফিসাররা যুদ্ধের নেতৃত্ব দেন, তখন মানুষ কী উদ্যাপন করে? যুদ্ধকে? নাকি মানুষ কেবল এই কারণে খুশি হয় যে নারীরাও এতে অংশ নিচ্ছে?
এই দৃশ্যপটের ভেতরে যে বার্তাটি সূক্ষ্মভাবে দেওয়া হচ্ছে, সেটি হলো নারীরা ‘পুরুষদের মতো’ না হলে তাঁদের যোগ্যতা প্রমাণিত হয় না। তাঁরা পুরুষের মতো শক্তিশালী না হলে তাঁদের নেতৃত্বকেও গুরুত্ব দেওয়া হয় না।
এই দুই নারী অফিসারকে সম্মান জানিয়ে রাষ্ট্র আসলে নারী নেতৃত্বকে ব্যবহার করছে, যেন যুদ্ধ ও সহিংসতাকে আরও জোরালোভাবে বৈধতা দেওয়া যায়। কিন্তু যে কাঠামো নারীদের প্রতি সহিংসতা চালায়, সেটাকে ভাঙার কোনো চেষ্টাই এখানে নেই।
প্রকৃত নারীবাদ চায় নারীরা নিজেরা ঠিক করুক তাঁরা কোথায়, কীভাবে অংশ নেবেন। কিন্তু এখানে সেই সিদ্ধান্তও নারীদের নয়। বরং এখানে আরএসএসের মতো পুরুষতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদ ঠিক করে দিচ্ছে তাঁদের ভূমিকা কী হবে।
এই দুই অফিসার আসলে পুরোনো সেই চিত্রনাট্যে অভিনয় করেছেন, যেখানে নারী মানেই দেশের জন্য স্ত্রীর মতো দায়িত্বশীল হওয়া।
এখানে একজন মুসলমান নারী অফিসারকেও রাখা হয়েছে। এটা ইচ্ছাকৃত; যেন বলা যায়, ‘আমরা সবাইকে সমান সুযোগ দিচ্ছি।’ কিন্তু এর মধ্য দিয়ে দুর্গা বাহিনীর চিন্তাধারা ফুটে উঠেছে। সেই চিন্তাধারা হলো হিন্দু পরিবারকে রক্ষা করতে চাইলে ‘অহিন্দু’ নারীদেরও ব্যবহার করা যায়।
শুধু এই কারণেই একজন মুসলমান নারীকে সামনে আনা হয়েছে। এটি লোকদেখানো বহুত্ববাদ। বাস্তবে মুসলমানদের প্রতি বৈষম্য ও অবহেলা সমাজে ঠিকই চলছে।
নারীবাদী আন্দোলন শুধু দেখে না যে কারা যুদ্ধ করছে, বরং যুদ্ধের প্রয়োজনীয়তা, কারণ এবং পদ্ধতি নিয়েই প্রশ্ন তোলে। যদি আমরা মেনে নিই দেশ গড়ার পুরো কাজটাই পুরুষদের নিয়ন্ত্রণে চলে, তাহলে শুধু নারীদের সেই পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোর ভেতর ঢুকিয়ে দিলেই সমাধান হয় না। বরং আমাদের সেই চিন্তাকেই বদলাতে হবে, যেখানে নারীর সম্মান শুধু স্ত্রীসুলভ আচরণ বা যুদ্ধক্ষেত্রে আত্মোৎসর্গের সঙ্গে জড়িয়ে দেওয়া হয়।
নারীর সত্যিকারের নেতৃত্ব হওয়া উচিত শান্তি প্রতিষ্ঠা, সাধারণ মানুষের সুরক্ষা, পুনর্বাসন এবং নীতিনির্ধারণের জায়গায়—যেখানে সিঁদুর বা বাহাদুরি দিয়ে নারীর মূল্য যাচাই করা হয় না। নারী যুদ্ধ করছেন কি না তার ওপর তাঁর মর্যাদা নির্ভর করে না; বরং তিনি নিজের শর্তে সমাজে কীভাবে অবদান রাখছেন, তার ওপর তাঁর মর্যাদা নির্ভর করে।
সত্যিকারের লিঙ্গসমতা মানে হলো সেই নারীদের মূল্য দেওয়া, যাঁরা পুরুষতান্ত্রিক প্রতীকের ভেতরে ঢুকতে চান না। সত্যিকারের লিঙ্গসমতা মানে হলো সেই নারীদের মূল্য দেওয়া, যাঁরা যুদ্ধের বদলে শান্তির পক্ষে কথা বলেন, যাঁরা বিধবাদের পাশে থাকেন এবং যাঁরা মনে করেন, ‘স্ত্রী’ বা ‘সিঁদুর’ দিয়ে নারীর সম্মান মাপা উচিত নয়।
অমৃতা দত্ত বিলফেল্ড ইউনিভার্সিটির বিলফেল্ড গ্র্যাজুয়েট স্কুল ইন হিস্ট্রি অ্যান্ড সোশিওলজির প্রভাষক
অরণি বসু হাইডেলবার্গ ইউনিভার্সিটির হাইডেলবার্গ সেন্টার ফর ট্রান্সকালচারাল স্টাডিজের সহকারী অধ্যাপক
আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ