বাংলাদেশের জন্ম হওয়ার পর ইতিহাসের চর্চা ক্রমাগত কমে আসছে উল্লেখ করে ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন, ‘ইতিহাস যেন বিশেষ দিনে জন্মগ্রহণ করেছে, একটা জাতি যেন বিশেষ মুহূর্তে চলে এল। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক যে আমরা ইতিহাস জানতে চাইছি না। অথচ ইতিহাস না জানলে ভবিষ্যতে কোন দিকে যাব, সেই পথের দিশা খুঁজে পাব না। ইতিহাস না জানলে আমরা আমাদের পরিচয় জানতে পারব না। বর্তমানকে বুঝতে পারব না।’

শনিবার বিকেলে রাজধানীর দ্য ডেইলি স্টার সেন্টারে ‘বাংলাদেশের কালচার ও আমাদের রাজনীতি’ শিরোনামে বুক রিভিউ প্রতিযোগিতা-২০২৫–এর পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এ কথাগুলো বলেন।

আবুল মনসুর আহমদের ৪৬তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে আবুল মনসুর আহমদ স্মৃতি পরিষদ। অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম এ সংগঠনের সভাপতি। অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তব্যে তিনি বলেন, মানুষের বাঁচার আকাঙ্ক্ষা রাজনীতি ও লেখার মধ্যে প্রকাশ করেছেন আবুল মনসুর আহমদ। তিনি এমন আধুনিকতার কথা বলেছেন, যে আধুনিকতা ঐতিহ্য ও জনজীবনকে অস্বীকার করবে না। যে আধুনিকতা অল্প কয়েকজন মানুষের হবে না।

অপর আলোচকেরা বলেন, বর্তমান সময়ের সংকট মোকাবিলায় দিকনির্দেশনা হতে পারে আবুল মনসুর আহমদের বই।

প্রসঙ্গত, ১৯৬৬ সালে পাক-বাংলার কালচার শিরোনামে বইটি লেখেন আবুল মনসুর আহমদ। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বইটির নাম পাল্টে বাংলাদেশের কালচার করেন তিনি। বাংলার সামাজিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসের ওপর লেখা বইটির ১০টি অধ্যায়ের দুটো অধ্যায় তিনি স্বাধীন দেশে লেখেন।

আবুল মনসুর আহমদ ১৮৯৮ সালের ৩ সেপ্টেম্বর ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার ধানীখোলা গ্রামে জন্ম নেন। ১৯৭৯ সালের ১৮ মার্চ ঢাকায় মারা যান তিনি। আবুল মনসুর আহমদ ছিলেন সাহিত্যিক, রাজনীতিবিদ, আইনজ্ঞ ও সাংবাদিক। তিনি ১৯৪৬ সালে অবিভক্ত বাংলার কলকাতা থেকে প্রকাশিত দৈনিক কৃষক, নবযুগ ও ইত্তেহাদ–এর সম্পাদক ছিলেন। তিনি শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের যুক্তফ্রন্ট সরকারে প্রাদেশিক শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন। ১৯৫৭ সালে তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সরকারে ছিলেন কেন্দ্রীয় বাণিজ্য ও শিল্পমন্ত্রী। বাংলাদেশের কালচার ছাড়াও তাঁর রচনার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে আয়না, আসমানী পর্দা, গালিভারের সফরনামা ও ফুড কনফারেন্স, আত্মকথা, আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর।

অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘ইতিহাস না জানলে আমরা আমাদের পরিচয় জানতে পারব না। বর্তমানকে বুঝতে পারব না। ভবিষ্যতে কোন দিকে যাব, সেই পথের দিশা খুঁজে পাব না। সংস্কৃতিও তেমন গুরুত্বপূর্ণ। সংস্কৃতির যে মূল কথা ‘স্বাতন্ত্র্য’—তা আবুল মনসুর আহমদ তাঁর লেখায় তুলে এনেছেন। সংস্কৃতি দিয়েই আমাদের লড়তে হবে। আমরা আরও দেখছি, যত আমাদের উন্নতি হচ্ছে, তত আমরা দেশপ্রেম হারাচ্ছি।’

অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘রাজনীতি ও সংস্কৃতির মধ্যে পার্থক্য করা হচ্ছে। যেটাকে আমরা আধুনিকতা বলি। রাজনীতি ও সংস্কৃতি—দুটো যে অবিভাজ্য এবং দুটোই যে সংস্কৃতির অংশ, সেটা আবুল মনসুর আহমদ জানতেন এবং সেই চর্চা করতেন। তাঁর রচনার মধ্যে তিনি দেখিয়েছেন, জীবনের ক্ষুধা, সেটাই প্রধান ক্ষুধা। মানুষ বাঁচতে চায়। মানুষের বাঁচার আকাঙ্ক্ষা তাঁকে রাজনীতিমুখী ও সাহিত্যমুখী করেছে, তাঁর সংস্কৃতি গড়ে তুলেছে। মানুষের বাঁচার আকাঙ্ক্ষা তিনি রাজনীতি ও লেখার মধ্যে প্রকাশ করেছেন। তিনি গণতন্ত্রে বিশ্বাস করতেন। ধর্মজীবী মানুষদের আচরণ তিনি এত বছর আগে যেভাবে দেখিয়েছেন, আজ আমরা তা দেখাতে পারি না।’

আলোচনায় অংশ নিয়ে অধ্যাপক মো.

আবুল ফজল বলেন, আবুল মনসুর আহমদ মনে করতেন, ব্যক্তির জীবনে যেমন ব্যক্তিত্ব থাকে, তেমনি একটি জাতির ব্যক্তিত্ব হচ্ছে তার সংস্কৃতি। তাঁর লেখায় আরও একটা দাবি উঠে আসে, বাংলাদেশ যে আলাদা হলো, এটা ইতিহাসে যে বঙ্গ ছিল, সেটার বিভাজন নয়। এটা ইংরেজ আমলের বঙ্গের বিভাজন। বাংলা অঞ্চলের কোনো মুসলাম ও হিন্দুর সঙ্গে অন্য কোনো অঞ্চলের মুসলমান ও হিন্দুর মিল নেই। বর্তমান সময়ের সংকট মোকাবিলায় দিকনির্দেশনা হতে পারে তাঁর বই।

আবুল মনসুর আহমদ বাঙালি মুসলমানের মনকে অসাধারণভাবে বুঝতে পেরেছিলেন উল্লেখ করে সাংবাদিক শুভ কিবরিয়া বলেন, মানুষের ভাবাবেগ বোঝার জন্য এই বই (বাংলাদেশের কালচার) দিক নির্দেশনামূলক হতে পারে।

প্রাবন্ধিক সহুল আহমদ বলেন, আবুল মনসুর আহমদের কাছে সংস্কৃতি ছিল নিজেদের স্বাতন্ত্র্যবোধকে ফুটিয়ে তোলার বড় উপাদান। তিনি মনে করতেন, সংস্কৃতি পরিবর্তনশীল। সংস্কৃতিতে যা ক্ষতিকর, তা বর্জনীয়।

কবি তুহিন খান বলেন, এই অঞ্চলের সাংস্কৃতিক ভাবনা ও স্বাতন্ত্র্যবোধ তাঁর লেখায় উঠে এসেছে। তিনি বলেছেন, এ দেশের মানুষকে ইসলামি মোল্লা ও প্রগতি মোল্লার বিরুদ্ধে লড়তে হয়।

আবুল মনসুর আহমদের চিন্তার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার লক্ষ্যে আয়োজিত ‘আবুল মনসুর আহমদ বুক রিভিউ প্রতিযোগিতা ২০২৫’–এ এবারের বই ছিল বাংলাদেশের কালচার। বই পর্যালোচনা প্রতিযোগিতায় বিজয়ী চারজনের নাম ঘোষণা করেন প্রতিযোগিতার বিচারক কাজল রশীদ শাহীন। প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছেন আসিফ মাহমুদ। দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ হয়েছেন যথাক্রমে এস এ এইচ ওয়ালীউল্লাহ, জুবায়ের দুখু ও শরাবন তহুরা। পুরস্কার হিসেবে তাঁদের হাতে সনদ ও বই তুলে দেওয়া হয়।

অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন আবুল মনসুর আহমদের ছেলে দ্য ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহ্‌ফুজ আনাম। অনুষ্ঠানের শুরুতে গাজায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত ফিলিস্তিনি ও জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে শহীদদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন দ্য ডেইলি স্টার–এর সহসম্পাদক ইমরান মাহফুজ।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: অন ষ ঠ ন র জন ত প রব ন আম দ র করত ন

এছাড়াও পড়ুন:

২ বছরের ভেতরে জুলাই সনদ বাস্তবায়নে আপত্তি নেই বিএনপির

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে জুলাই সনদের খসড়া পাঠানো হয়েছে। সেই খসড়ায় বলা হয়েছে, দুই বছরের মধ্যে ঐকমত্য হওয়া বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করতে হবে। এ বিষয়ে বিএনপির কোনো আপত্তি নেই বলে জানিয়েছেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ।

আজ মঙ্গলবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় ধাপের ২১তম দিনের আলোচনার বিরতিতে সালাহউদ্দিন আহমদ এ কথা বলেন।

সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘আমরা যেটা পেয়েছি, এটা জুলাই জাতীয় সনদ নামে একটা খসড়া পেয়েছি। সেটা ভূমিকা, বিস্তারিত বিষয়গুলো নেই। এই খসড়ার সঙ্গে আমরা মোটামুটি একমত। কিন্তু খসড়ার কিছু বাক্য, শব্দ ও গঠনপ্রণালি নিয়ে কারও কোনো মতামত আছে কি না, তা জানতে রাজনৈতিক দলগুলোকে খসড়াটি দিয়েছে কমিশন। আমাদের যে সংশোধনী থাকবে, আমরা তা কাল জমা দেব।’

খসড়ায় যে অঙ্গীকারের কথা বলা হয়েছে, সে বিষয়ে বিএনপি একমত বলে জানান বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য। তিনি বলেন, ‘খসড়ায় দুই বছরের ভেতরে প্রতিশ্রুতিগুলো বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে যে অঙ্গীকার চাওয়া হয়েছে, সে বিষয়ে আমরা একমত।’

সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘আমরা সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়োগ আইনের মাধ্যমে করতে চাই। এতে আইনি ত্রুটি থাকলে সংশোধন সহজ হবে।’ তিনি বলেন, ‘কার্যকর রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য একটি সক্রিয় নির্বাহী বিভাগ প্রয়োজন। তবে সেই নির্বাহী বিভাগকে চেক অ্যান্ড ব্যালান্সের মধ্যে রাখতে হবে।’

বিএনপির এই নেতা বলেন, ‘সংবিধানে যত বেশি যুক্ত করা হবে, সংশোধন তত বেশি জটিল হয়ে পড়বে। তাই আমরা চাই, আইনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী করা হোক এবং সেই আইনে প্রয়োজন অনুযায়ী সংশোধন আনা সহজ হবে।’

নারী প্রতিনিধিত্ব বিষয়ে বিএনপির অবস্থান প্রসঙ্গে সালাহউদ্দিন বলেন, ‘আমরা প্রথম ধাপে প্রস্তাব করেছি, আগামী নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে ৫ শতাংশ অর্থাৎ ১৫টি আসনে নারীদের মনোনয়ন দেওয়া হবে। পরবর্তী নির্বাচনে তা ১০ শতাংশ অর্থাৎ ৩০টি হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা চাই, নারীরা সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত হোক। কিন্তু সমাজের বাস্তবতা বিবেচনায় আমরা ধাপে ধাপে অগ্রসর হতে চাই।’

সংস্কার কমিশনের ৭০০–এর বেশি সুপারিশ সম্পর্কে সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, এর মধ্যে প্রায় ৬৫০টির মতো প্রস্তাবে বিএনপি একমত হয়েছে। বাকিগুলোর বিষয়ে পরামর্শ বা সংশোধিত প্রস্তাব দিয়েছে। তিনি বলেন, ‘সব প্রস্তাব সনদে আসবে না। তবে যেগুলো মৌলিক, যেমন সংবিধান সংশোধনসংক্রান্ত, সেগুলো অবশ্যই গুরুত্ব পাবে।’

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • জুলাই সনদে আমাদের যে সম্মতি সেটি আইনের ঊর্ধ্বে: সালাহউদ্দিন
  • ওসমানী বিমানবন্দরে বোর্ডিং ব্রিজের চাকা ফেটে তরুণের মৃত্যু
  • সংসদের উচ্চকক্ষে পিআর চালুর প্রস্তাব কমিশনের, আলোচনায় উত্তেজনা
  • টেলিযোগাযোগ বিভাগের প্রতিবাদ ও প্রতিবেদকের বক্তব্য
  • মানিব্যাগ তুলতে সেপটিক ট্যাংকে নেমে বড় ভাইয়ের মৃত্যু, ছোট ভাই হাসপাতালে
  • সিলেটে সহপাঠীর সঙ্গে বেড়াতে যাওয়া স্কুলছাত্রীকে দলবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগ
  • ৪ কলেজ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ২১টি স্থাপনার নাম বদল
  • ২ বছরের ভেতরে জুলাই সনদ বাস্তবায়নে আপত্তি নেই বিএনপির
  • জুলাই সনদের খসড়ায় ফ্যাসিবাদের দুঃশাসনের চিত্র নেই: ইসলামী আন্দোলন
  • কক্সবাজারের সোনাদিয়া উপকূলে ভেসে এল অজ্ঞাতনামার লাশ, এখনো নিখোঁজ অরিত্র