আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে ব্যাপক দুর্বৃত্তায়নের শিকার হওয়া কয়েকটি ব্যাংকে এখনও তারল্য সংকট চলছে। এই সংকটের তীব্রতা কমাতে নিয়মিত বিরতিতে নতুন টাকা ছাপিয়ে ব্যাংকগুলোকে সরবরাহ করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা এভাবে টাকা ছাপানোর সমালোচনা করছেন। আগের সরকারের সময়েও তারা টাকা ছাপানোর বিরোধিতা করেছেন। হিসাব ছাড়া টাকা ছাপানো হলে অর্থনীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এতে বাজারে টাকার সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় একদিকে মূল্যস্ফীতি ঘটে, অন্যদিকে ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে যায়।

পরিহাসজনক হলো, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড.

আহসান এইচ মনসুরও এই দায়িত্ব নেওয়ার আগে বিভিন্ন সময়ে টাকা ছাপানোর সমালোচনা করেছেন। উপরন্তু, আগামীতেও যে এ ধারা বজায় থাকবে তার বিভিন্ন বক্তব্যে তেমন ইঙ্গিতও রয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদও টাকা ছাপিয়ে কয়েকটি ব্যাংককে সহায়তা দেওয়ার পক্ষে যুক্তি দিয়েছেন। 
তবে প্রশ্ন হলো, শুধু টাকার জোগান দিয়ে কি ব্যাংকগুলোকে বাঁচানো যাবে? 

গত সরকারের আমলে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণের নামে হাতিয়ে নেওয়া হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে। ফলে ২০২২ সালের পর তীব্র তারল্য সংকট তথা নগদ টাকার অভাব শুরু হয় এস আলম গ্রুপ-সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোতে। আমানতকারীদের টাকা ফেরত দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের নির্দেশে উদার সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। নিয়মিত টাকা ছাপিয়ে ব্যাংকগুলোকে সরবরাহ করা হতে থাকে। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে লুটেরা চক্র ঋণের নামে আরও টাকা বের করে নেওয়ার মচ্ছবে মেতে ওঠে। 
গত বছরের সেপ্টেম্বরে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ সাংবাদিকদের বলেছিলেন, আগের সরকার (আওয়ামী লীগ সরকার) ৬০ হাজার কোটি টাকা ছাপিয়েছিল, যা মূল্যস্ফীতির আগুনে ঘি ঢেলেছে। এই টাকার একটি অংশ সরকার ঋণ হিসেবে নিয়েছে, বাকিটা বিভিন্ন ব্যাংককে তারল্য সহায়তা হিসেবে ধার দেওয়া হয়। 

৫ আগস্টের পট পরিবর্তনের পর আলোচিত ব্যাংকগুলোকে দেওয়া বাংলাদেশ ব্যাংকের উদার সহায়তা বন্ধ হয়ে গেলে পরিস্থিতি আরও নাজুক হয়। ব্যাংকিং খাতে ব্যাপক অস্থিরতা ও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। সম্ভাব্য বিপর্যয় এড়াতে আগের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে বাংলাদেশ ব্যাংক। টাকা ছাপিয়ে গোপনে সমস্যাগ্রস্ত কয়েকটি ব্যাংককে সরবরাহ করা হয়। গত বছরের ২৮ নভেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে গভর্নর নিজেই জানান, সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংকগুলোকে ২২ হাজার কোটি টাকা সরবরাহ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
গত সপ্তাহে জানা যায়, টাকা ছাপিয়ে নতুন করে আরও দুই ব্যাংককে আড়াই হাজার কোটি দেওয়া হবে। এ নিয়ে বিভিন্ন ব্যাংককে দেওয়া তারল্য সহায়তার পরিমাণ ২৯ হাজার ৪১০ কোটি টাকা। এর মধ্যে চারটি ব্যাংককে ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি জোগান দেওয়া হয়েছে। 

সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংকগুলোকে বাংলাদেশ ব্যাংক যে টাকা দিচ্ছে, তা মুফতে নয়; ঋণ হিসেবে দেওয়া হচ্ছে। এর সুদের হার ১০ শতাংশের কাছাকাছি। শর্ত অনুসারে, এ টাকা কেবল ছোট গ্রাহকদের আমানত ফেরতের প্রয়োজনে ব্যবহার করতে হবে। তাতে সাময়িকভাবে ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের টাকা ফেরত দিতে না পারার মতো ব্যর্থতা থেকে যাচ্ছে। কারণ আমানতকারীকে প্রদত্ত সুদ ও ঋণগ্রহীতার কাছ থেকে প্রাপ্ত সুদহারের ব্যবধানই মূলত ব্যাংকের আয়। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রাপ্ত টাকা যেহেতু ঋণ হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না, তাই তা থেকে সুদজনিত কোনো আয়ও হবে না। 

যে ব্যাংকটি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে তাকে এক বছরে কমপক্ষে ৫০০ কোটি টাকা সুদ পরিশোধ করতে হবে। আলোচিত বছরে যদি ব্যাংকটি ৫০০ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা না করতে পারে, তাহলে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রাপ্য সুদই শোধ করতে পারবে না। তাতে ব্যাংকটির দায় আরও বাড়বে। 
দুর্ভাগ্যজনকভাবে আলোচিত ব্যাংকগুলোর প্রতিটিরই খেলাপি ঋণের হার ভয়ানক রকম বেশি। এই হার ৩০ থেকে ৮০ শতাংশ পর্যন্ত। ধরে নিই, একটি ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৫ হাজার কোটি টাকা, আর ব্যাংকটি বছরে ২৫০ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা করে। তাহলে খেলাপি ঋণের জন্য পর্যাপ্ত সঞ্চিতি রাখতেই ব্যাংকটির ২০ বছর সময় লাগবে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণের জন্য যদি বছর শেষে ৫০০ কোটি টাকা সুদ গুনতে হয়, তাহলে ব্যাংকটির আয় দিয়ে ঋণের সুদ পরিশোধ করা যাবে না, খেলাপি ঋণের জন্য সঞ্চিতি রাখা তো দূরের কথা, এ ক্ষেত্রে বছর শেষে ব্যাংকটির দায় কমপক্ষে আরও ২৫০ কোটি টাকা বাড়বে। 

তাহলে এই গ্যাঁড়াকল থেকে ব্যাংকগুলোকে উদ্ধারের উপায় কী? উপায় হচ্ছে, ব্যাংকগুলোর দক্ষতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বাড়ানো এবং খেলাপি ঋণের বিশাল বোঝা কমিয়ে আনা। এটি সবার জানা, আলোচিত ব্যাংকগুলোর ঋণের বড় অংশ বেনামি। অন্যদিকে ঋণের বিপরীতে আছে নামমাত্র জামানত। যে সম্পদের মূল্য ১০০ কোটি টাকা দেখিয়ে ৮০ কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হয়েছে, তার প্রকৃত মূল্য হয়তো ৩০ কোটি টাকা। এই সম্পদের মূল্য অদূরভবিষ্যতে ১০০ কোটি টাকা তো দূরের কথা, ৫০ কোটি টাকায়ও ওঠে কিনা তা অনিশ্চিত। অন্যদিকে ঋণগ্রহীতার বড় অংশই দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছে। তাই গ্রাহক ঋণ পরিশোধ করবে বা সম্পদের মূল্য বাড়লে তা বিক্রি করে ঋণ সমন্বয় করা হবে– এমন আশায় না থেকে জামানত রাখা সম্পদ দ্রুত বিক্রি করে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। তাতে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য কিছুটা রসদ ব্যাংকগুলোর হাতে আসবে। এর পাশাপাশি ঋণগ্রহীতাদের অন্যান্য সম্পদ বিক্রি করে তা দিয়ে ঋণ সমন্বয় করতে হবে। এর জন্য দরকার সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সিদ্ধান্ত, পরিকল্পনা ও ক্র্যাশ প্রোগ্রাম। অর্থঋণ আদালতে মামলা করার মতো প্রচলিত পথে এগোলে ৩০ বছরেও এসব খেলাপি ঋণ  আদায় হবে না। 
ব্যাংকগুলোকে বাঁচাতে টাকা সরবরাহের পাশাপাশি প্রয়োজন কার্যকর অ্যাকশন প্ল্যান ও তার বাস্তবায়ন। সবচেয়ে ভালো হতো, ব্যাংকগুলোর অবসায়ন করা গেলে। সে ক্ষেত্রে আমানতকারীদের স্বার্থ সুরক্ষার বিষয় হবে একটি বড় চ্যালেঞ্জ।

জিয়াউর রহমান: সাংবাদিক ও বিশ্লেষক;
সম্পাদক, অর্থসূচক।

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: আল চ ত ব সরক র র শ ধ কর র জন য

এছাড়াও পড়ুন:

বিদ্যুৎ না থাকায় ডিইপিজেডে উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ

ঢাকার সাভার উপজেলার আশুলিয়ায় ঢাকা রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে (ডিইপিজেড) আজ সোমবার দুপুর থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। এ কারণে দুপুরের পর ডিইপিজেডের সব কারখানায় শ্রমিকদের ছুটি দেওয়া হয়েছে। ডিইপিজেডের জন্য নিরবচ্ছিন্নভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ইউনাইটেড পাওয়ারের বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাস–সংযোগ বিচ্ছিন্ন করায় এ সংকট তৈরি হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

ডিইপিজেডের নির্বাহী পরিচালক মো. শরীফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ ইউনাইটেড পাওয়ারের ডিইপিজেডে বিদ্যুৎ সরবরাহের প্রকল্পটিতে গ্যাস–সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। এতে তারা উৎপাদন করতে না পারায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারছে না। ফলে ডিইপিজেডে প্রায় ৯০টি কারখানার এক লাখের মতো শ্রমিককে ছুটি দেওয়া হয়।

বিদ্যুতের সংযোগ না থাকায় বড় ধরনের বিপর্যয়ের মুখে পড়তে হয়েছে উল্লেখ করে মো. শরীফুল ইসলাম বলেন, মঙ্গলবার যদি এটি অব্যাহত থাকে, তবে সংকট আরও বাড়বে। শ্রমিকেরা কাজ না করতে পেরে বিক্ষুব্ধ হলে বিষয়টি আরও জটিল হয়ে উঠবে। কোনো ধরনের নোটিশ ছাড়া এ ধরনের ঘটনায় বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

ডিইপিজেডের নির্বাহী পরিচালক বলেন, ‘তিতাস বলছে, ইউনাইটেড পাওয়ারের কাছে বিল বকেয়া রয়েছে। তারা বকেয়া পরিশোধ করেনি। এ ব্যাপারে আদালতে দীর্ঘদিন ধরে মামলা চলছে। কিন্তু আমাদের কথা হচ্ছে, বেপজাকে কোনো ধরনের পূর্ব নোটিশ না দিয়ে হঠাৎ করে এ ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছেন। এ ধরনের পদক্ষেপের আগে ডিইপিজেডের গুরুত্ব বিবেচনা করে আলোচনার মধ্য দিয়ে বিষয়টির সমাধান করা উচিত ছিল।’

এ বিষয়ে ইউনাইটেড পাওয়ার প্ল্যান্টের ব্যবস্থাপক মো. মমতাজ হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘গ্যাসের কোনো প্রেশার নেই। প্রেশার শূন্য। কিন্তু কেন তিতাস কর্তৃপক্ষ এমনটি করল, সে ব্যাপারে এখানকার (আশুলিয়া অঞ্চলের) তিতাসের লোকজন কিছু বলতে পারেননি। আমরা নিজেরাও বিষয়টি নিয়ে জানি না। এ ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘আমার জানামতে, বকেয়া নিয়ে কোনো ধরনের মামলা নেই। তিতাস কেন গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দিল, সেটি জানা নেই।’

জানতে চাইলে তিতাসের আশুলিয়া আঞ্চলিক কার্যালয়ের ব্যবস্থাপক প্রকৌশলী আবু ছালেহ মুহাম্মদ খাদেমুদ্দীন প্রথম আলোকে বলেন, গ্যাসের বিল বকেয়া থাকায় গ্যাস–সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। এটি সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলের সিদ্ধান্ত। দুপুরের দিকে গ্যাস–সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • আদানির সঙ্গে চুক্তি ক‌রে শুল্ক ফাঁকি
  • শিল্প খাতের উৎপাদন যেন ব্যাহত না হয়
  • কারাগারে গাঁজা সরবরাহ করতে গিয়ে নিজেই কারাগারে
  • ‘মানবিক করিডোর’ নিয়ে বৈশ্বিক অভিজ্ঞতা কী
  • ডিইপিজেডে বিদ্যুৎ নেই, ৯০ কারখানায় ছুটি
  • মঙ্গলবার ৭ ঘণ্টা গ্যাস থাকবে না যেসব জায়গায়
  • পাকিস্তানের সঙ্গে উত্তেজনার মধ্যে আরও ২৬টি রাফাল যুদ্ধবিমান কিনছে ভারত
  • পর্তুগাল ও স্পেনে নজিরবিহীন বিদ্যুৎ বিপর্যয়, পর্যুদস্তু জনজীবন
  • হাসপাতালে ডায়রিয়ার প্রকোপ শয্যা ও স্যালাইন সংকট
  • বিদ্যুৎ না থাকায় ডিইপিজেডে উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ