সদ্য শেষ হওয়া ঈদের ছুটিতে ঢাকা থেকে ঠাকুরগাঁওয়ে নিজ বাড়ি গিয়েছিলেন ইমন আহমেদ। রাজধানীতে বাসে উঠেছিলেন রাত ১২টার দিকে। পরদিন প্রায় সন্ধ্যায় গিয়ে পৌঁছান বাড়িতে। ঈদের আগে যেদিন রাজধানী ছেড়েছিলেন, সেদিনও ঢাকায় তাপপ্রবাহ ছিল। ঠাকুরগাঁওয়ে গিয়ে কিন্তু পেলেন ভিন্ন পরিস্থিতি। রাত যত বাড়ে, তাপমাত্রা কমতে থাকে ধীরে ধীরে।

ইমন আহমেদ বলছিলেন, ‘রাতে একপর্যায়ে গায়ে কাঁথা জড়াতে হলো। এ ছাড়া উপায় ছিল না।’

বেশ সকালেই ঘুম ভাঙে ইমনের। তখন জানালা খুলে দেখেন, চারদিকে যেন শীতকালের কুয়াশার মতো। রাজধানীর চৈত্রের খরতাপ ছেড়ে যাওয়া ইমনের ধন্দ লাগে। অবশ্য একটু পর রোদ উঠলে ‘কুয়াশা’র সেই পর্দাও উধাও হলো। যথারীতি তাপও বাড়তে লাগল।

দিনে গরম আর রাতে তাপের এ পরিস্থিতি নিয়ে অনেকেই সামাজিক যোগাযোগের নানা মাধ্যমে ছবি দিয়ে পোস্ট দিচ্ছেন। আবহাওয়া কিংবা জলবায়ুর পরিবর্তন ভেবে শঙ্কাও প্রকাশ করছেন কেউ কেউ। আবহাওয়াবিদদের কাছে অবশ্য প্রকৃতির এ অবস্থার ব্যাখ্যা আছে।

মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে বয়ে গেছে মৃদু থেকে মাঝারি তাপপ্রবাহ। তাপপ্রবাহ এখনো চলছে। এরই মধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে কালবৈশাখী হয়েছে। আবহাওয়ার পূর্বাভাস অনুযায়ী, এ মাসে স্বাভাবিকের চেয়ে তাপমাত্রা বেশি থাকতে পারে। দেশজুড়ে প্রচণ্ড তাপপ্রবাহেরও আশঙ্কা আছে।

কিন্তু এরই মধ্যে এখন দিনে তাপ আর রাতে ঠান্ডা, ভোরে কুয়াশার মতো। কেন?

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এখন সূর্যোদয় হয় মোটামুটি পৌনে ছয়টার দিকে আর সূর্যাস্ত হয় সোয়া ছয়টার দিকে। সকালে প্রায় এক ঘণ্টা ও সূর্যাস্তের আগের ঘণ্টাখানেক সূর্যের তাপ তেমন থাকে না। কিছু সময় মেঘলা থাকে। এসব বাদ দিলে দিনে ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা সময় সূর্য কিরণ দেয় উলম্বভাবে। পরিষ্কার মেঘমুক্ত আকাশ আর এর সঙ্গে থাকা প্রখর তাপে দিনের তাপমাত্রা বেড়ে যায়, যেমন এখন যাচ্ছে। যদি কেউ কোনো খোলা মাঠে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকায় এবং যদি আটভাগে ভাগ করা হয়, তখন মেঘের পরিমাণ থাকে এক ‘অকটা’। মেঘ পরিমাপের একক অকটা। অর্থাৎ এ সময়টায় মেঘের পরিমাণ অনেকটাই কম থাকে।

কিন্তু দিনের এ তাপমাত্রা রাতে কোথায় চলে যায়, কেন রাতে দেশের কোথাও কোথাও রীতিমতো শীত পড়ে?

আবহাওয়া অধিদপ্তরের জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক প্রথম আলোকে বলেন, সন্ধ্যার পর সূর্যের তাপ কমে গেলে এবং আকাশ মেঘমুক্ত থাকলে সূর্যের বিকিরণজনিত শীতলতা তৈরি হয়। রাত যত বাড়ে, এই শীতলতা তত বাড়ে। দিনে সূর্যের তাপে ভূপৃষ্ঠ উত্তপ্ত হয়ে পড়ে। সেই গরম হাওয়া রাতে বিকিরণের কারণে কমতে থাকে। তাতেই তাপ কমে, শীতলতা কমে।

এই প্রাক্‌–মৌসুমি বায়ুর সময়টায় ধোঁয়াশার পরিধি বিস্তৃত থাকে। বৃষ্টি খুবই কম থাকায় ধুলার পর্দাও দীর্ঘ থাকে এ সময়টায়। আর এখন ভারতের দিল্লি, পাকিস্তানের লাহোর পেরিয়ে আন্তমহাদেশীয় দূষিত বায়ু বাংলাদেশে প্রবেশ করে।

এ সময়ে দিনের তাপের সঙ্গে দেখা যায় রাতের তাপমাত্রা অনেকটাই কমে গেছে। যেমন গত ২৮ মার্চ যশোরে দিনের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। রাতে তা ১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস কমে যায়। গতকাল শনিবার দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল রাজশাহীতে ৩৮ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর সর্বনিম্ন ছিল ২৩ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। উত্তরের আরেক জনপদ পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ১৭ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ওই এলাকায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল প্রায় দ্বিগুণ, ৩৪ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

উত্তরের কুড়িগ্রাম, ঠাকুরগাঁও, রংপুর থেকে ময়মনসিংহ, নেত্রকোনাসহ হাওরের সুনামগঞ্জ পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকায় রাতে তাপমাত্রা কমে যাওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। আবার এসব এলাকাতেই এ সময়ে, বিশেষ করে ভোরের দিকে কুয়াশার মতো ঘন পর্দা দেখা যায়।

রাত ও দিনের তাপমাত্রার এ পার্থক্য এবং রাতে এ ধরনের ঠান্ডা আবহাওয়া প্রকৃতিতে, বিশেষ করে এ সময়ে নতুন কিছু নয়, জানান আবহাওয়াবিদেরা। তবে যাকে ‘কুয়াশা’ বলা হচ্ছে, তা কিন্তু আসলে কুয়াশা নয়, একে বরং ‘ধোঁয়াশা’ বলেন তাঁরা। কেন এটা হয়?

মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক বলছিলেন, এ সময়ে বাতাসে যদি জলীয় বাষ্প বেশি থাকে, তবে এর সঙ্গে মিলে যায় বৃষ্টিহীন এ সময়ে বাতাসে থাকা ক্ষুদ্র বস্তুকণা। ঠান্ডার স্পর্শে এসব বস্তুকণা ঘন হয়ে যায়। একটা পর্দার মতো অবস্থা সৃষ্টি করে। তবে ধীরে ধীরে দিনের আলো ফুটে উঠলে এ পর্দাও অদৃশ্য হয়ে পড়ে।

উত্তরের এসব জনপদ ও হাওরের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে আছে জলাভূমি। সেখানে জলীয় বাষ্প স্থানীয় আবহাওয়ার কারণে শীতল হয়ে পড়ে। এসব অঞ্চলে রাতের শীতলতার এ–ও এক কারণ।

সন্ধ্যার পর সূর্যের তাপ কমে গেলে এবং আকাশ মেঘমুক্ত থাকলে সূর্যের বিকিরণজনিত শীতলতা তৈরি হয়। রাত যত বাড়ে, এই শীতলতা তত বাড়ে।মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক, জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ, আবহাওয়া অধিদপ্তর

এখন এই প্রাক্‌–মৌসুমি বায়ুর সময়টায় ধোঁয়াশার পরিধি বিস্তৃত থাকে। বৃষ্টি খুবই কম থাকায় ধুলার পর্দাও দীর্ঘ থাকে এ সময়টায়। আর এখন ভারতের দিল্লি ও পাকিস্তানের লাহোর পেরিয়ে আন্তমহাদেশীয় দূষিত বায়ু বাংলাদেশে প্রবেশ করে। এর প্রবেশদ্বার দেশের উত্তরের রংপুর ও দিনাজপুর অঞ্চল। এই দীর্ঘ প্রবাহ ময়মনসিংহ থেকে শুরু করে বিশাল এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে থাকে বলে জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক আব্দুস সালাম।

এসব অঞ্চলে এই বায়ুপ্রবাহের কারণে, বিশেষ করে ভোরের দিকে কুয়াশার মতো ধোঁয়াশার গভীর পর্দা থাকে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

এভাবে রাতে শীতল হাওয়া ও ভোরের ধোঁয়াশার কারণ হিসেবে সীমানা স্তরের উচ্চতাকে (বাউন্ডারি লেয়ার হাইট–বিএলএইচ) কারণ বলে মনে করেন অধ্যাপক আব্দুস সালাম। তিনি বলেন, এটি হলো বায়ুমণ্ডলের সর্বনিম্ন স্তরের এমন একটি উচ্চতা, যেখানে পৃথিবীর পৃষ্ঠের ঘর্ষণের প্রভাবে বাতাস প্রভাবিত হয়। এটি আবহাওয়া, জলবায়ু ও বায়ুদূষণের বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দিনে সূর্যের উত্তাপে বিএলএইচ গভীর হয় আর রাতে ঠান্ডায় এটি কমে যায়।

কেন উত্তর ও উত্তর–পূর্বের বাংলাদেশে দিন ও রাতের তাপমাত্রায় এত পার্থক্য বা ভোরের ধোঁয়াশা বেশি দেখা যায়? রাজধানীতে এর প্রভাব তেমন দেখা যায় না কেন?

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, যানবাহন, গাছপালা কম হওয়া, প্রচুর বাড়িঘর, উন্মুক্ত স্থান না থাকা ও বিপুল জনসংখ্যার বসতির কারণে রাজধানীতে রাতের তাপমাত্রায় পার্থক্য খুব বেশি হয় না।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ক য় শ র মত স লস য় স সময়ট য় প রব হ পর দ ও দশম ক এ সময়

এছাড়াও পড়ুন:

অমর একুশে বইমেলা ফেব্রুয়ারিকে স্পর্শ করুক

অমর একুশে বইমেলা বাংলাদেশের মানুষের প্রাণের মেলা। মূলত প্রকাশকদের উদ্যোগে মুক্তিযুদ্ধ উত্তর বাংলাদেশে এই বইমেলার সূত্রপাত। সম্প্রতি এই বইমেলা নানা কারণে-অকারণে ডিসেম্বরে করার কথা শোনা যাচ্ছে। এ প্রেক্ষিতে সুস্পষ্টভাবে বলতেই হচ্ছে -ডিসেম্বরে কিছুতেই মেলা করা যাবে না। কারণ সেসময় সারাদেশে শিক্ষার্থীদের বার্ষিক পরীক্ষা চলবে।

বইমেলার প্রধান পাঠক আমাদের শিক্ষার্থী। তারা ডিসেম্বরে কিছুতেই মেলায় আসতে পারবে না। প্রধান পাঠকই যদি মেলায় আসতে না পারে তাহলে মেলা প্রাণহীন হয়ে পড়বে। বইমেলায় অংশগ্রহণকারি প্রকাশকরাও ভয়াবহ ক্ষতির মুখে পড়বে। তাছাড়া একুশের চেতনাকে ধারণ করে যে অমর একুশে বইমেলা, সেটা ফেব্রুয়ারিকে স্পর্শ করুক। ভাষা শহীদদরর প্রতি বইমেলার মাধ্যমে আমাদের যে শ্রদ্ধাঞ্জলি, তা অক্ষুন্ন থাকুক। 

আরো পড়ুন:

রাজশাহীতে বইপড়ায় কৃতিত্বের পুরস্কার পেল ২৩০৩ শিক্ষার্থী

‘গল্পকারের পছন্দের ৫০ গল্প’ গ্রন্থ প্রকাশিত

সর্বোপরি ৫ জানুয়ারি থেকে ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, এই সময়ে বইমেলা হতে কোন সমস্যা হওয়ার কথা নয়। অথবা তারিখ দুই একদিন এদিক-সেদিক করে নেয়া যেতে পারে। এ সময়ে রোজা নেই, নির্বাচনও নেই। নির্বাচনী ক্যাম্পেইন চলবে। এই মাঠে বইমেলা চলাকালীন সর্বদলীয় সিদ্ধান্তে কেউ সভা-সমাবেশ না করার সিদ্ধান্ত নিলে অনায়াসে এই সময়টাতে বইমেলা করা যেতে পারে। আমার বিশ্বাস- সব দলই অমর একুশে বইমেলার জন্য এই ছাড়টুকু দেবেন।

প্রায় পঞ্চাশ বছরের অধিক সময়ের  প্রচেষ্টায় অমর একুশে বইমেলা মহিরুহ হয়ে আমাদের কাছে আবির্ভূত, হঠকারি কোন সিদ্ধান্তে তা যেনো ধ্বংস হওয়ার উপক্রম না হয়। জেনে শুনে বাঙালির এতো বড় একটি সাংস্কৃতিক উৎসবকে ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্থ না করে বরং তা যে কোন মূল্যে আমাদের রক্ষা করা উচিত।

জানুয়ারিতে বাণিজ্যমেলায়ও হয়ে থাকে। এতে অমর একুশে বইমেলার ওপর কোনো বিরূপ প্রভাব পড়বে বলে আমি তা মনে করি না। বইমেলার প্রধান পাঠক শিক্ষার্থী। তারা বইমেলায় আসার জন্য মুখিয়ে থাকে। বাণিজ্য মেলায় যাওয়ার লোকজন বেশির ভাগই আলাদা। তবে অনেকেই বইমেলা এবং বাণিজ্যমেলা দুটোতেই যান। এটা তারা ম্যানেজ করে নিতে পারবেন বলে আমার বিশ্বাস।

আমি বলেছি শুধুমাত্র মেলার মাঠ প্রাঙ্গনে সভা-সমাবেশ না করার মাধ্যমে যদি সর্বদলীয় একটা সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় তাহলে জানুয়ারি- ফেব্রুয়ারি মিলিয়ে  বইমেলা করা সম্ভব।আমার মনে হয়, বইমেলা চলাকালীন এই মাঠ কোন দলকে সভা-সমাবেশের জন্য সরকার বরাদ্দ না দিলে, অথবা বইমেলা চলাকালীন দলগুলো নিজের থেকেই এই মাঠের বরাদ্দ না চাইলে সমস্যা আর থাকে না।

লেখক: প্রকাশক পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লিমিটেড

ঢাকা/লিপি

সম্পর্কিত নিবন্ধ