দিনে গরম, রাতে কোথাও ঠান্ডা ও কুয়াশার মতো, কেন এমন হচ্ছে
Published: 6th, April 2025 GMT
সদ্য শেষ হওয়া ঈদের ছুটিতে ঢাকা থেকে ঠাকুরগাঁওয়ে নিজ বাড়ি গিয়েছিলেন ইমন আহমেদ। রাজধানীতে বাসে উঠেছিলেন রাত ১২টার দিকে। পরদিন প্রায় সন্ধ্যায় গিয়ে পৌঁছান বাড়িতে। ঈদের আগে যেদিন রাজধানী ছেড়েছিলেন, সেদিনও ঢাকায় তাপপ্রবাহ ছিল। ঠাকুরগাঁওয়ে গিয়ে কিন্তু পেলেন ভিন্ন পরিস্থিতি। রাত যত বাড়ে, তাপমাত্রা কমতে থাকে ধীরে ধীরে।
ইমন আহমেদ বলছিলেন, ‘রাতে একপর্যায়ে গায়ে কাঁথা জড়াতে হলো। এ ছাড়া উপায় ছিল না।’
বেশ সকালেই ঘুম ভাঙে ইমনের। তখন জানালা খুলে দেখেন, চারদিকে যেন শীতকালের কুয়াশার মতো। রাজধানীর চৈত্রের খরতাপ ছেড়ে যাওয়া ইমনের ধন্দ লাগে। অবশ্য একটু পর রোদ উঠলে ‘কুয়াশা’র সেই পর্দাও উধাও হলো। যথারীতি তাপও বাড়তে লাগল।
দিনে গরম আর রাতে তাপের এ পরিস্থিতি নিয়ে অনেকেই সামাজিক যোগাযোগের নানা মাধ্যমে ছবি দিয়ে পোস্ট দিচ্ছেন। আবহাওয়া কিংবা জলবায়ুর পরিবর্তন ভেবে শঙ্কাও প্রকাশ করছেন কেউ কেউ। আবহাওয়াবিদদের কাছে অবশ্য প্রকৃতির এ অবস্থার ব্যাখ্যা আছে।
মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে বয়ে গেছে মৃদু থেকে মাঝারি তাপপ্রবাহ। তাপপ্রবাহ এখনো চলছে। এরই মধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে কালবৈশাখী হয়েছে। আবহাওয়ার পূর্বাভাস অনুযায়ী, এ মাসে স্বাভাবিকের চেয়ে তাপমাত্রা বেশি থাকতে পারে। দেশজুড়ে প্রচণ্ড তাপপ্রবাহেরও আশঙ্কা আছে।
কিন্তু এরই মধ্যে এখন দিনে তাপ আর রাতে ঠান্ডা, ভোরে কুয়াশার মতো। কেন?
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এখন সূর্যোদয় হয় মোটামুটি পৌনে ছয়টার দিকে আর সূর্যাস্ত হয় সোয়া ছয়টার দিকে। সকালে প্রায় এক ঘণ্টা ও সূর্যাস্তের আগের ঘণ্টাখানেক সূর্যের তাপ তেমন থাকে না। কিছু সময় মেঘলা থাকে। এসব বাদ দিলে দিনে ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা সময় সূর্য কিরণ দেয় উলম্বভাবে। পরিষ্কার মেঘমুক্ত আকাশ আর এর সঙ্গে থাকা প্রখর তাপে দিনের তাপমাত্রা বেড়ে যায়, যেমন এখন যাচ্ছে। যদি কেউ কোনো খোলা মাঠে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকায় এবং যদি আটভাগে ভাগ করা হয়, তখন মেঘের পরিমাণ থাকে এক ‘অকটা’। মেঘ পরিমাপের একক অকটা। অর্থাৎ এ সময়টায় মেঘের পরিমাণ অনেকটাই কম থাকে।
কিন্তু দিনের এ তাপমাত্রা রাতে কোথায় চলে যায়, কেন রাতে দেশের কোথাও কোথাও রীতিমতো শীত পড়ে?
আবহাওয়া অধিদপ্তরের জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক প্রথম আলোকে বলেন, সন্ধ্যার পর সূর্যের তাপ কমে গেলে এবং আকাশ মেঘমুক্ত থাকলে সূর্যের বিকিরণজনিত শীতলতা তৈরি হয়। রাত যত বাড়ে, এই শীতলতা তত বাড়ে। দিনে সূর্যের তাপে ভূপৃষ্ঠ উত্তপ্ত হয়ে পড়ে। সেই গরম হাওয়া রাতে বিকিরণের কারণে কমতে থাকে। তাতেই তাপ কমে, শীতলতা কমে।
এই প্রাক্–মৌসুমি বায়ুর সময়টায় ধোঁয়াশার পরিধি বিস্তৃত থাকে। বৃষ্টি খুবই কম থাকায় ধুলার পর্দাও দীর্ঘ থাকে এ সময়টায়। আর এখন ভারতের দিল্লি, পাকিস্তানের লাহোর পেরিয়ে আন্তমহাদেশীয় দূষিত বায়ু বাংলাদেশে প্রবেশ করে।এ সময়ে দিনের তাপের সঙ্গে দেখা যায় রাতের তাপমাত্রা অনেকটাই কমে গেছে। যেমন গত ২৮ মার্চ যশোরে দিনের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। রাতে তা ১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস কমে যায়। গতকাল শনিবার দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল রাজশাহীতে ৩৮ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর সর্বনিম্ন ছিল ২৩ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। উত্তরের আরেক জনপদ পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ১৭ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ওই এলাকায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল প্রায় দ্বিগুণ, ৩৪ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
উত্তরের কুড়িগ্রাম, ঠাকুরগাঁও, রংপুর থেকে ময়মনসিংহ, নেত্রকোনাসহ হাওরের সুনামগঞ্জ পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকায় রাতে তাপমাত্রা কমে যাওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। আবার এসব এলাকাতেই এ সময়ে, বিশেষ করে ভোরের দিকে কুয়াশার মতো ঘন পর্দা দেখা যায়।
রাত ও দিনের তাপমাত্রার এ পার্থক্য এবং রাতে এ ধরনের ঠান্ডা আবহাওয়া প্রকৃতিতে, বিশেষ করে এ সময়ে নতুন কিছু নয়, জানান আবহাওয়াবিদেরা। তবে যাকে ‘কুয়াশা’ বলা হচ্ছে, তা কিন্তু আসলে কুয়াশা নয়, একে বরং ‘ধোঁয়াশা’ বলেন তাঁরা। কেন এটা হয়?
মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক বলছিলেন, এ সময়ে বাতাসে যদি জলীয় বাষ্প বেশি থাকে, তবে এর সঙ্গে মিলে যায় বৃষ্টিহীন এ সময়ে বাতাসে থাকা ক্ষুদ্র বস্তুকণা। ঠান্ডার স্পর্শে এসব বস্তুকণা ঘন হয়ে যায়। একটা পর্দার মতো অবস্থা সৃষ্টি করে। তবে ধীরে ধীরে দিনের আলো ফুটে উঠলে এ পর্দাও অদৃশ্য হয়ে পড়ে।
উত্তরের এসব জনপদ ও হাওরের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে আছে জলাভূমি। সেখানে জলীয় বাষ্প স্থানীয় আবহাওয়ার কারণে শীতল হয়ে পড়ে। এসব অঞ্চলে রাতের শীতলতার এ–ও এক কারণ।
সন্ধ্যার পর সূর্যের তাপ কমে গেলে এবং আকাশ মেঘমুক্ত থাকলে সূর্যের বিকিরণজনিত শীতলতা তৈরি হয়। রাত যত বাড়ে, এই শীতলতা তত বাড়ে।মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক, জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ, আবহাওয়া অধিদপ্তরএখন এই প্রাক্–মৌসুমি বায়ুর সময়টায় ধোঁয়াশার পরিধি বিস্তৃত থাকে। বৃষ্টি খুবই কম থাকায় ধুলার পর্দাও দীর্ঘ থাকে এ সময়টায়। আর এখন ভারতের দিল্লি ও পাকিস্তানের লাহোর পেরিয়ে আন্তমহাদেশীয় দূষিত বায়ু বাংলাদেশে প্রবেশ করে। এর প্রবেশদ্বার দেশের উত্তরের রংপুর ও দিনাজপুর অঞ্চল। এই দীর্ঘ প্রবাহ ময়মনসিংহ থেকে শুরু করে বিশাল এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে থাকে বলে জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক আব্দুস সালাম।
এসব অঞ্চলে এই বায়ুপ্রবাহের কারণে, বিশেষ করে ভোরের দিকে কুয়াশার মতো ধোঁয়াশার গভীর পর্দা থাকে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
এভাবে রাতে শীতল হাওয়া ও ভোরের ধোঁয়াশার কারণ হিসেবে সীমানা স্তরের উচ্চতাকে (বাউন্ডারি লেয়ার হাইট–বিএলএইচ) কারণ বলে মনে করেন অধ্যাপক আব্দুস সালাম। তিনি বলেন, এটি হলো বায়ুমণ্ডলের সর্বনিম্ন স্তরের এমন একটি উচ্চতা, যেখানে পৃথিবীর পৃষ্ঠের ঘর্ষণের প্রভাবে বাতাস প্রভাবিত হয়। এটি আবহাওয়া, জলবায়ু ও বায়ুদূষণের বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দিনে সূর্যের উত্তাপে বিএলএইচ গভীর হয় আর রাতে ঠান্ডায় এটি কমে যায়।
কেন উত্তর ও উত্তর–পূর্বের বাংলাদেশে দিন ও রাতের তাপমাত্রায় এত পার্থক্য বা ভোরের ধোঁয়াশা বেশি দেখা যায়? রাজধানীতে এর প্রভাব তেমন দেখা যায় না কেন?
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, যানবাহন, গাছপালা কম হওয়া, প্রচুর বাড়িঘর, উন্মুক্ত স্থান না থাকা ও বিপুল জনসংখ্যার বসতির কারণে রাজধানীতে রাতের তাপমাত্রায় পার্থক্য খুব বেশি হয় না।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ক য় শ র মত স লস য় স সময়ট য় প রব হ পর দ ও দশম ক এ সময়
এছাড়াও পড়ুন:
রাখাইনে করিডোর কি রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে আশার আলো দেখাবে
রোহিঙ্গা সংকট ঘিরে নতুন আলোচনা ও বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। এর সূত্রপাত হয় সম্প্রতি মিয়ানমার সীমান্তে হিউম্যানিটারিয়ান বা মানবিক করিডর গড়ে তুলতে অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টার মন্তব্যের মাধ্যমে, যেখানে তিনি বলেন, বাংলাদেশ এ বিষয়ে একটি নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
গত দুই মাসে রোহিঙ্গা সংকটকে ঘিরে ক্রমাগত নানা আলোচনা ও সমালোচনা চলমান। রোহিঙ্গা সংকটকে ঘিরে সাম্প্রতিক সময়ে প্রথম ইতিবাচক আলোচনা শুরু হয় মার্চ মাসে, যখন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বাংলাদেশ ভ্রমণ করেন এবং বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গা শরণার্থীশিবিরে পবিত্র রোজার মাসে তাদের সঙ্গে ইফতার করেন।
এ সময় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস তাদের মেহমান উল্লেখ করে বলেন, তিনি প্রত্যাশা করেন আগামী রোজা রোহিঙ্গারা নিজ দেশে করতে পারবেন।
পরবর্তী সময়ে ষষ্ঠ বিমসটেক সম্মেলনে যোগ দিতে গিয়ে একটি পার্শ্ব আলোচনার পর মিয়ানমারের পক্ষ থেকে বলা হয়, তারা প্রাথমিকভাবে ১ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে মিয়ানমারে ফিরিয়ে নিতে নীতিগতভাবে সম্মত।
এ নিয়েও জনসাধারণের মধ্যে একধরনের ধোঁয়াশা কাজ করে। কেননা, আরাকান আর্মিকে উপেক্ষা করে এ ধরনের মন্তব্য রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে খুব বেশি আশার আলো দেখাবে না। এর বেশ কিছুদিন পরে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা উল্লেখ করেন, সাম্প্রতিক সময়ে আরাকান আর্মি ও মিয়ানমারের সঙ্গে যে সহিংস দ্বন্দ্ব চলমান, সে প্রেক্ষাপটে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন এখনই সম্ভব নয়।
এই চলমান আলোচনায় নতুন বিতর্ক তৈরি হয় রাখাইনে মানবিক করিডর গড়ে তোলার আলোচনার মাধ্যমে, যদিও এরপর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব বলেছেন, এ বিষয়ে জাতিসংঘ বা অন্য কারও সঙ্গে তাঁদের এখনো কোনো আলোচনা হয়নি। এমন নানামুখী আলোচনায় জনমনে বিভ্রান্তি আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। রাখাইনে মানবিক করিডর গড়ে তোলার প্রধান যুক্তি হলো, এতে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে মিয়ানমারে অবস্থানরত জনগোষ্ঠীর সাহায্যার্থে ত্রাণ এবং অন্যান্য প্রয়োজনের সামগ্রী পাঠানো সম্ভব হবে।
মানবিক করিডর ও রোহিঙ্গা সংকটের বিষয়ে আলোচনার আগে একটু দেখে নেওয়া যাক মানবিক করিডর বলতে আসলে কী বোঝায়।
জাতিসংঘের ব্যাখ্যা অনুযায়ী সশস্ত্র সংঘাতপূর্ণ এলাকায় সংঘাত বা যুদ্ধ পরিস্থিতির সাময়িক বিরতির জন্য অনেক ধরনের পন্থা অবলম্বন করা হয়, তার মধ্যে একটি হলো মানবিক করিডরের প্রস্তাব।
এই মানবিক করিডরের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য এমন একটি জায়গা নির্ধারণ করা হয়, যেখানে সশস্ত্র সংঘাত যেন না ঘটে। সে বিষয়ে দুই পক্ষ জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে একমত হয়। মানবিক করিডরের পরবর্তী ধাপে সেই ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলের অধিবাসীদের একটি নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয় অথবা সেখানে খাদ্য, ওষুধ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সেবার ব্যবস্থা হয়।
এ ধরনের মানবিক করিডরের উদাহরণ আমরা ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে সংঘাতপূর্ণ বিভিন্ন দেশের প্রেক্ষাপটে দেখতে পাই। এখানে সামগ্রিক কর্মকাণ্ড জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে হবে, সেটাই প্রত্যাশা করা হয়। বিভিন্ন দেশের প্রেক্ষাপট থেকে আমরা দেখতে পাই, জাতিসংঘের ত্রাণবিষয়ক প্রতিষ্ঠান রেডক্রস এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলির মধ্যে অন্যতম হলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ইহুদি শিশুদের যুক্তরাজ্যে স্থানান্তর, নব্বইয়ের দশকে সারায়েভো সংকট, ২০১৮ সালে সিরিয়ার জনগোষ্ঠীকে নিরাপদ স্থানে স্থানান্তর করা এবং সর্বশেষ দেখতে পাই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ক্ষেত্রে।
যদি আরও রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিতে হয়, তাহলে তাদের দায়দায়িত্ব নিতে বাংলাদেশ কতটা প্রস্তুত, সেটা ভেবে দেখা জরুরি। কেননা, এখনই এক মিলিয়নের ওপর রোহিঙ্গা বিভিন্ন শরণার্থীশিবিরে মানবেতর জীবন যাপন করছে। এর সঙ্গে রয়েছে তাদের সামগ্রিক ব্যবস্থাপনার জন্য আন্তর্জাতিক মহলের অর্থনৈতিক সাহায্য কমিয়ে দেওয়া, যা বাংলাদেশের জন্য এক বড় অর্থনৈতিক বোঝা।রাখাইনকে ঘিরে মানবিক করিডর গড়ে তোলার এই নীতিগত সিদ্ধান্তের প্রেক্ষাপটে গবেষক, রাজনীতিবিদ, নীতিনির্ধারক ও সাধারণ জনগণের মধ্যে বেশ কিছু প্রশ্ন, আশঙ্কা ও দ্বিধা তৈরি হয়েছে।
তবে শঙ্কার পাশাপাশি কোনো কোনো গবেষক মনে করছেন, মানবিক করিডরের প্রস্তাব মেনে নেওয়ার মাধ্যমে রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলার চলমান সংলাপ আরও জোরদার হবে, যা ভবিষ্যতে এই সংকট মোকাবিলায়, বিশেষ করে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
তবে এই ইতিবাচক প্রত্যাশা ছাপিয়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনকে কেন্দ্র করে যে দ্বিধা রয়েছে, সেটি হলো এই মানবিক করিডরের মাধ্যমে ভবিষ্যতে কি রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন ত্বরান্বিত হবে, নাকি আরও বিলম্বিত হবে, নাকি আরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করার সুযোগ পাবে।
ইতিমধ্যে আমরা দেখেছি, এক লাখের ওপরে রোহিঙ্গা শরণার্থী আবারও বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী জেলা কক্সবাজারে প্রবেশ করতে বাধ্য হয়েছে। মানবিক কারণে বাংলাদেশ এই দায় যেমন এড়িয়ে যেতে পারছে না, তেমনি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ব্যবস্থাপনার ভারও বহন করতেও হিমশিম খাচ্ছে। এ অবস্থায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনসহ তাদের অন্যান্য সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে মানবিক করিডর কতটা বাস্তবসম্মত হবে, সেটা একটা বড় প্রশ্ন। কেননা, কোনো বিস্তারিত দিকনির্দেশনা আমাদের সামনে নেই।
অতীতের বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষাপট থেকে আমরা দেখতে পাই, মানবিক করিডরের অন্যতম প্রধান ব্যবহার হচ্ছে ঝুঁকিপূর্ণ জাতিগোষ্ঠীকে সংঘাতপূর্ণ স্থান থেকে নিরাপদ স্থানে স্থানান্তর করা। যেখানে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বাংলাদেশে চলমান অনুপ্রবেশ কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না, সেখানে মানবিক করিডরের মাধ্যমে আরও বৃহৎ অংশের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায় নিরাপত্তার স্বার্থে স্থানান্তর করার প্রক্রিয়ায় শুরু অস্বাভাবিক নয়।
এ প্রেক্ষাপটে যদি আরও রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিতে হয়, তাহলে তাদের দায়দায়িত্ব নিতে বাংলাদেশ কতটা প্রস্তুত, সেটা ভেবে দেখা জরুরি। কেননা, এখনই এক মিলিয়নের ওপর রোহিঙ্গা বিভিন্ন শরণার্থীশিবিরে মানবেতর জীবন যাপন করছে। এর সঙ্গে রয়েছে তাদের সামগ্রিক ব্যবস্থাপনার জন্য আন্তর্জাতিক মহলের অর্থনৈতিক সাহায্য কমিয়ে দেওয়া, যা বাংলাদেশের জন্য এক বড় অর্থনৈতিক বোঝা।
এর বাইরে আরেকটি চিন্তার জায়গা হলো সীমান্ত এলাকা বাংলাদেশ কতটা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবে, সেটি। সাম্প্রতিক ঘটনাবলি দেখলে বোঝা যায়, সীমান্ত প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে আমাদের বর্তমান প্রচেষ্টা খুব যে সুখকর, সেটি বলা যাবে না।
এ ছাড়া এই অঞ্চল বিভিন্ন কারণে মাদক ব্যবসা, মানব পাচার, সহিংসতা ও অন্যান্য নিরাপত্তাঝুঁকির জন্য একটি অন্যতম হটস্পট, যা নিয়ন্ত্রণ করতে আমাদের নানাভাবে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
এমন পরিস্থিতিতে সীমান্ত এলাকার নিয়ন্ত্রণ আরও ঝুঁকিপূর্ণ হয় কি না, সেটা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। মানবিক করিডরের মাধ্যমে বাংলাদেশ কীভাবে লাভবান হতে পারে, সে বিষয়েও যথাযথ পরিষ্কার ধারণা থাকতে হবে এবং নিজেদের স্বার্থেই আমাদের স্বচ্ছ থাকতে হবে।
এর সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোসহ অন্য অংশীজনের সঙ্গে পরামর্শ করারও বিশেষ প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কেননা, এর পরবর্তী পরিণতি ও ব্যবস্থাপনার দায়দায়িত্ব ভবিষ্যতের নির্বাচিত সরকারকেই গ্রহণ ও বহন করতে হবে। যদিও জাতিসংঘের মানবিক করিডরের প্রস্তাব বেশ পুরোনো, কিন্তু তড়িঘড়ি করে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হিতে বিপরীত হতে পারে। শরণার্থী বিষয়ে একটি টেকসই রূপরেখা এবং পরিকল্পনানীতি না থাকার কারণে সরকারকে অ্যাডহক প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিতে হয়, যা অনেক ক্ষেত্রেই সমস্যাজনক হয়।
এসব বিবেচনায় নিয়ে একজন গবেষক হিসেবে আমি বিভিন্ন সময় রোহিঙ্গাবিষয়ক একটি জাতীয় রোডম্যাপ বা রূপরেখা এবং শরণার্থীবিষয়ক নীতি প্রণয়ন করার পক্ষে কথা বলে আসছি। আমাদের সে ধরনের কোনো দৃশ্যমান পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি বিগত সময়ে ছিল না। বিশেষ করে যদি প্রত্যাবাসন ব্যর্থ হয় এবং জাতিসংঘের প্রস্তাবিত মানবিক করিডর আমাদের প্রত্যাশামতো কাজ না করে, তাহলে বিকল্প কী হবে, সে বিষয়ে বিস্তারিত পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি আমাদের থাকা উচিত। সেটি না হলে রোহিঙ্গা সংকট আরও জটিল আকার ধারণ করবে এবং তাদের নিজ দেশে স্বেচ্ছায় ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসন একটি ‘মিথ’ হিসেবে থেকে যাবে, যা আমাদের ও রোহিঙ্গা উভয়ের জন্যই হতাশার একটি বিষয় হবে।
● বুলবুল সিদ্দিকী সহযোগী অধ্যাপক, রাজনীতি ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়