ট্রাম্প শুল্ক, বিশ্ববাণিজ্য ও বাংলাদেশ
Published: 6th, April 2025 GMT
‘মুক্তবাজার অর্থনীতি’ এমন ব্যবস্থা, যেখানে ন্যূনতম বিধিনিষেধসহ দেশগুলোর মধ্যে পণ্য, পরিষেবা, শ্রম ও মূলধন অবাধে প্রবাহিত হয়। এটি অবাধ বাণিজ্য ব্যবস্থা বাজার শক্তিকে (সরবরাহ ও চাহিদা) মূল্য এবং উৎপাদন নির্ধারণ করে দেয়। রোনাল্ড রিগ্যান এবং ব্রিটেনে মার্গারেট থ্যাচারের রাজত্বকালে, বিগত শতাব্দীর ’৮০-এর দশক থেকে এই মুক্তবাজার অর্থনীতির মূলনীতি বিশ্বজুড়ে বাস্তবায়ন হতে শুরু করে। উন্নয়নশীল দেশগুলোর ওপর পশ্চিমা বিশ্ব অত্যন্ত দ্রুততম সময়ের মধ্যে চাপিয়ে দেয় তথাকথিত মুক্তবাজার অর্থনীতি। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর এই চাপিয়ে দেওয়া অর্থনীতি বাধাহীন হয়ে যায়। কেউ পছন্দ করুক আর না করুক, গুটিকয় দেশ ছাড়া মুক্তবাজার অর্থনীতিই হয়ে ওঠে বিশ্ব অর্থনীতির একমাত্র পন্থা।
মুক্তবাজার অর্থনীতিকে তথাকথিত বলছি এই জন্য, আজ পর্যন্ত কোনো দেশে, কোনোকালে সত্যিকারের মুক্তবাজারের দেখা পাওয়া যায়নি। অর্থনীতিকে কেউ কখনও মুক্ত হতে দেয়নি। শুল্ক, কর, ট্যারিফ, কোটা, লাইসেন্স, ভর্তুকি, জিএসপি, এভরিথিং বাট আর্মস, অগ্রাধিকার চুক্তি, আঞ্চলিক চুক্তি, দ্বিপক্ষীয় চুক্তি ইত্যাদি প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ বিধিনিষেধের জালে সব দেশে, সব কালেই বাজার বা অর্থনীতিকে বন্দি করে রাখা হয়েছে। বিশ্ববাণিজ্যও এর ব্যতিক্রম ছিল না। এবার বড়-ছোট, ধনী-গরিব নির্বিশেষে পৃথিবীর সব দেশের ওপর অসম্ভব পরিমাণ ‘মুক্তি দিবস আমদানি শুল্ক’ আরোপ করে তথাকথিত মুক্ত বাণিজ্যের বিদায় ঘণ্টা বাজিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
২ এপ্রিল ২০২৫ তারিখে স্বাক্ষরিত নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে তিনি সর্বজনীন শুল্ক সব দেশ বা অঞ্চলের জন্য ১০ শতাংশ এবং এর ওপর ৫৮টি দেশের জন্য রয়েছে পাল্টাপাল্টি শুল্ক। দেশভেদে এ শুল্ক ১১ থেকে ৫০ শতাংশের মধ্যে রয়েছে।
২০২৪ সালে আমেরিকার বাণিজ্য ঘাটতি হয়েছে ১ দশমিক ২ ট্রিলিয়ন ডলার এবং বৈদেশিক ঋণ দাঁড়িয়েছে বার্ষিক অভ্যন্তরীণ জাতীয় আয়ের প্রায় সমান। এত বিপুল বাণিজ্য ঘাটতি এবং বৈদেশিক ঋণ নিয়ে একটি দেশ চলতে পারে না। যে কোনো সময়ে ধস নামতে পারে। তা ছাড়া দিন দিন সে দেশের শিল্প উৎপাদন কমেছে। কমেছে শিল্প খাতে কর্মসংস্থান। করোনা অতিমারি এবং বাণিজ্য জাহাজের ওপর হুতিদের আক্রমণের সময় আমেরিকার সরবরাহ শৃঙ্খলের ভঙ্গুরতা সবার চোখে পড়েছে। অন্যদিকে আমেরিকায় রপ্তানি বাড়াতে বিভিন্ন দেশ তাদের মুদ্রার মান কৃত্রিমভাবে কমিয়ে রেখেছে। ফলে ডলারের দাম কৃত্রিমভাবে বেশি হয়েছে; আমেরিকার রপ্তানি করার সুযোগ কমেছে।
ট্রাম্প শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মূলত এসব সমস্যার সমাধান করতে। নিও লিবারেল অর্থনীতিবিদদের মতে, এত ব্যাপক মাত্রার শুল্ক আরোপের ঝুঁকি হচ্ছে, সে দেশের বাজারে বিদেশি পণ্যের দাম বৃদ্ধি পেয়ে মুদ্রাস্ফীতির আশঙ্কা বেড়ে যাওয়া; বিশ্ববাণিজ্যে অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হওয়া; অর্থনৈতিক মন্দাও দেখা যেতে পারে এবং বহু দেশ দেউলিয়া হয়ে যেতে পারে। ট্রাম্প শুল্কের প্রতিক্রিয়ায় ইতোমধ্যে পূর্ব ও পশ্চিমের শেয়ার বাজারগুলোতে ব্যাপক ধস হয়েছে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা জানিয়েছে, ট্রাম্প শুল্কের ফলে বিশ্ববাণিজ্য ১ শতাংশ কমে যেতে পারে।
এসব জেনে-বুঝেই ট্রাম্প শুল্ক হার বাড়িয়েছেন এ আশায়, বিপুল পরিমাণ শুল্ক বৃদ্ধির ফলে বিভিন্ন দেশ পণ্যের দাম কমাবে; অনেকে আমেরিকায় গিয়ে কারখানা বানিয়ে পণ্য উৎপাদন করবে; উৎপাদন খরচ কমাতে নিজ নিজ দেশে ঋণের সুদ কমাবে। এসব হলে বিশ্ববাজারে ডলারের চাহিদা কমে দাম কমে যাবে; আমেরিকার রপ্তানি শক্তি বৃদ্ধি পাবে।
গ্রিক অর্থনীতিবিদ এবং সে দেশের সাবেক অর্থমন্ত্রী ইয়ানিস ভারৌফাকিস গত ফেব্রুয়ারি মাসে প্রকাশিত এক নিবন্ধে এমন ধারণা দিয়েছেন, একদিকে যেমন ট্রাম্পের প্রত্যাশাগুলো বাস্তবায়নের সম্ভাবনা রয়েছে, অন্যদিকে বিশ্ববাণিজ্য চীনের নেতৃত্বে ব্রিক্সকেন্দ্রিক হয়ে পড়তে পারে। আগামী দিনের বিশ্ব বাণিজ্য ব্যবস্থার কেন্দ্রে যদি চীন, রাশিয়া, ভারতকে দেখা যায়, তাতে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
এবার বাংলাদেশের ওপর ট্রাম্প শুল্কের প্রভাবের দিকে দৃষ্টি দেওয়া যাক। ২০২৪ সালে বাংলাদেশ ৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রপ্তানি করেছে, যার মধ্যে আমেরিকায় রপ্তানি হয়েছে ৮ দশমিক ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের ৮৫ শতাংশ আসে তৈরি পোশাক শিল্প থেকে, যার মধ্যে আমেরিকায় রপ্তানি হয়েছে ৭ দশমিক ৩৪ বিলিয়ন ডলার। সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত দেশের তালিকাভুক্ত বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের ওপর আমেরিকার বিদ্যমান গড় শুল্কহার রয়েছে ১৬ দশমিক ৫ শতাংশ। নতুন শুল্ক চালু হওয়ার পর এই ১৬ দশমিক ৫ শতাংশের সঙ্গে যোগ হবে অন্তত ৩৭ শতাংশ পাল্টাপাল্টি শুল্ক। একই দেশের ওপর একই সঙ্গে সর্বজনীন শুল্ক এবং পাল্টাপাল্টি শুল্ক প্রয়োগ হবে কিনা, তা ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশে স্পষ্ট নয়। তাই সর্বমোট শুল্ক হবে অন্তত ৫৩ দশমিক ৫ শতাংশ। পাল্টাপাল্টি শুল্ক প্রধান প্রতিযোগী ভারত (২৫ শতাংশ) এবং পাকিস্তানের (২৯ শতাংশ) তুলনায় বেশি হওয়ায় বাংলাদেশ বিপদে পড়তে পারে। তবে অন্য দুই প্রতিযোগী কম্বোডিয়া (৪৯ শতাংশ) এবং ভিয়েতনামের (৪৬ শতাংশ) তুলনায় বাংলাদেশ সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। বাংলাদেশের এখন কাজ হচ্ছে– ১) ব্যবস্থাপনা দক্ষতা বাড়িয়ে উৎপাদন খরচ কমিয়ে আনা; ২) কম্বোডিয়া এবং ভিয়েতনাম যেসব পণ্য আমেরিকায় পাঠায় তার উৎপাদন বাড়িয়ে রপ্তানি করা; ৩) মার্কিন যেসব পণ্য বাংলাদেশ আমদানি করে, সেসব পণ্যের শুল্ক যতদূর সম্ভব কমিয়ে আনা এবং ৪) আমেরিকার সঙ্গে পেশাদারিত্ব সহকারে খুঁটিনাটি বিষয়ে দেনদরবার করা। বর্তমান লেখক পেশাগত কারণে মূল্যায়ন করতে গিয়ে দেখেছেন, এমনকি দেশের মানে ভালো ব্যবস্থাপনার পোশাক শিল্পতেও ব্যবস্থাপনা উন্নত করে কমবেশি ২০ শতাংশ উৎপাদন খরচ কমানো যায়। সময় এসেছে পোশাক শিল্পের এদিকে মনোযোগী হওয়ার; অন্যথায় হারিয়ে যেতে হতে পারে বিশ্বদরবার থেকে।
সাব্বির আহমেদ: চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: আম র ক য় আম র ক র ব যবস থ র ওপর দশম ক
এছাড়াও পড়ুন:
২০২৬ সালে বিশ্ববাজারে জিনিসপত্রের দাম আরও ৭% কমতে পারে, বাংলাদেশে কেন কমছে না
চলতি বছরের শুরু থেকেই বিশ্ববাজারে দাম কমার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুসারে, চলতি বছরে সামগ্রিকভাবে পণ্যমূল্য ৭ শতাংশ কমবে। আগামী বছর, অর্থাৎ ২০২৬ সালে পণ্যমূল্য আরও ৭ শতাংশ কমবে। এ দাম হবে ছয় বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম।
কিন্তু বাংলাদেশের বাজারে তার প্রভাব নেই। দেশে মূল্যস্ফীতির হার এখনো ৮ শতাংশের ঘরে। যদিও একসময় তা দুই অঙ্ক ছাড়িয়ে গিয়েছিল। গত সেপ্টেম্বর মাসে মূল্যস্ফীতি ৮ দশমিক ৩৬ শতাংশ হয়েছে। দেশের মানুষকে এখনো বাড়তি দামেই পণ্য ও সেবা কিনতে হচ্ছে। আগামী বছর নিত্যপণ্যের দাম কমবে কি না, সেই নিশ্চয়তাও নেই। বিশ্লেষকেরা বলছেন, ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম কমলেও দেশে এর প্রভাব কম।
বিশ্বব্যাংকের ‘কমোডিটি মার্কেটস আউটলুক অক্টোবর ২০২৫’ শীর্ষক প্রতিবেদনের তথ্যানুসারে, ২০২৫ সালের শুরু থেকেই বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম কমতে শুরু করেছে। যার মূল কারণ হিসেবে তারা চিহ্নিত করেছে জ্বালানির দাম কমে যাওয়া। সেই সঙ্গে আরও কিছু কারণ চিহ্নিত করেছে তারা। সেগুলো হলো চীনে তেলের চাহিদা বৃদ্ধির গতি কমে যাওয়া এবং বিশ্ববাজারে সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় তেলের দামে বড় ধরনের পতন ঘটা। খাদ্যপণ্যের দাম বছরের শুরু থেকে ধীরে ধীরে কমতে থাকে, কিন্তু বছরের প্রথমার্ধে প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে পানীয় পণ্যের দাম হঠাৎ অনেকটা বেড়ে যায়। এ ছাড়া বছরের দ্বিতীয়ার্ধে সোনার দাম রেকর্ড উচ্চতায় ওঠে। মূলত রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যে নিরাপদ বিনিয়োগ মাধ্যম হিসেবে মানুষ সোনার দিকে ছুটেছেন।
বিশ্ববাজারে পণ্যের মূল্য নির্ধারণে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখে জ্বালানি তেলের দাম। বিশ্বব্যাংক গ্রুপের পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০২৫ সালে জ্বালানির দাম আগের বছরের তুলনায় ১২ শতাংশ এবং ২০২৬ সালে আরও ১০ শতাংশ কমবে। ২০২৭ সালে তা আবার প্রায় ৬ শতাংশ বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস ২০২৬ সালে কৃষিপণ্য, খাদ্য ও কাঁচামালের দাম কমবে। চলতি বছরেও এসব পণ্যের দাম কমেছে।
জ্বালানি তেলবিশ্বব্যাংকের ২০২৬ সালের পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, প্রাকৃতিক গ্যাসের চাহিদা বাড়ায় গ্যাসের দাম কিছুটা বাড়লেও তেলের দাম কমে যাবে এবং সেই প্রভাবকে ছাপিয়ে যাবে। ২০২৫ সালে ব্রেন্ট ক্রুড তেলের দাম হতে পারে ব্যারেলপ্রতি গড়ে ৬৮ ডলার; ২০২৪ সালের ৮১ ডলারের তুলনায় যা বেশ কম। ২০২৬ সালে এই দাম আরও কমে ব্যারেলপ্রতি গড়ে ৬০ ডলারে নামতে পারে ধারণা করা হচ্ছে।
এই পূর্বাভাস অনুযায়ী, তেলের ব্যবহার বৃদ্ধির হার আরও কমবে—মূলত চীনের চাহিদা কমে যাওয়া, বৈদ্যুতিক ও হাইব্রিড গাড়ির দ্রুত প্রসার ও বৈশ্বিক তেল সরবরাহ বৃদ্ধির কারণে এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে।
২০২৫ সালে বৈশ্বিক তেলের বাজারে সরবরাহ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। ২০২৬ সালে তা আরও বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ২০২০ সালের সর্বোচ্চ মাত্রার তুলনায় প্রায় ৬৫ শতাংশ বেশি হবে এ সরবরাহ।
কৃষিপণ্যবিশ্বব্যাংক গ্রুপের পূর্বাভাস অনুযায়ী, কৃষিপণ্যের মূল্যসূচক ২০২৫ সালে স্থিতিশীল আছে। ২০২৬ সালে তা সামান্য ২ শতাংশ ও ২০২৭ সালে আরও ১ শতাংশ কমবে।
খাদ্যপণ্যের দাম, যেমন শস্য, তেল, প্রোটিনজাত খাবারসহ অন্যান্য খাদ্যের দাম সাম্প্রতিক সীমার কাছাকাছি থাকবে। তবে মাঝেমধ্যে সামান্য কিছুটা ওঠানামা থাকবে। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, প্রধান ফসলগুলোর উৎপাদন বৃদ্ধির হার আবার দীর্ঘমেয়াদি প্রবণতায় ফিরে আসছে।
২০২৫ সালের বাকি সময়ে সয়াবিনের দাম কমবে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের যে সয়াবিন সাধারণত চীনে রপ্তানি হয়, তা এবার কম দামে অন্য ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করতে হতে পারে। চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যযুদ্ধের অন্যতম প্রধান ক্ষেত্রে হচ্ছে এই সয়াবিন। চীন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে সয়াবিন কিনছে না। ফলে ২০২৬ ও ২০২৭ সালে এই পণ্যের দাম তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল থাকবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বিশ্ববাজারে দাম কমে গেলে যুক্তরাষ্ট্রে সয়াবিন চাষের পরিমাণ কিছুটা কমতে পারে, তবে ব্রাজিল তার সয়াবিন আবাদ আরও বাড়ানোর পথে রয়েছে। পানীয় পণ্যের দাম ২০২৬ সালে ৭ শতাংশ ও ২০২৭ সালে প্রায় ৫ শতাংশ কমবে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।
এদিকে চলতি বছর সারের দাম সামগ্রিকভাবে ২১ শতাংশ বাড়তি। চাহিদা বৃদ্ধি, বাণিজ্যিক প্রতিবন্ধকতা ও কিছু অঞ্চলে সরবরাহ–ঘাটতির কারণে এ দাম বেড়ে যাওয়া। ২০২৬ ও ২০২৭ সালে দাম প্রায় ৫ শতাংশ কমতে পারে। তবু ২০১৫-১৯ সালের গড় দামের তুলনায় তা অনেক বেশি থাকবে। এর কারণ হলো উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়া, রপ্তানি সীমাবদ্ধতা ও চলমান আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা।
চীন ইতিমধ্যে নাইট্রোজেন ও ফসফেট সার রপ্তানিতে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে। অন্যদিকে পটাশ সরবরাহকারী বড় দেশ বেলারুশ এখনো ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিষেধাজ্ঞার আওতায় আছে। রাশিয়া ও বেলারুশ—উভয় দেশই সারের ওপর ইউরোপীয় ইউনিয়নের আরোপিত নতুন শুল্কের সম্মুখীন।
দেশে কেন দাম বেশিবিশ্ববাজারে দাম কমলেও দেশের বাজার দাম না কমার অন্যতম প্রধান কারণ ডলারের দামের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন। গত তিন বছরে ডলার দাম অনেকটা বেড়েছে। সেই সঙ্গে দেশের অনেক আমদানি পণ্যে শুল্ক বেশি বলে মনে করেন গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান।
মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বাজার ব্যবস্থাপনার কারণে দাম কমছে না। বাজারে চাহিদা কত বা কখন কোন পণ্য আমদানি করতে হবে, সে বিষয়ে যথাযথ তথ্যের ঘাটতি আছে। ফলে সময়মতো পণ্য আমদানি হয় না।
আরেকটি বিষয় হলো দেশে যেসব পণ্য আমদানি করা হয়, তার অনেক কিছু উৎপাদিতও হয়। কিন্তু বিনিয়োগ কমে যাওয়ায় এসব পণ্যের সরবরাহে টান পড়েছে। বাজারের পণ্যমূল্যে তার প্রভাব পড়ছে বলে মনে করছেন মোস্তাফিজুর রহমান।
তিন বছর আগে দেশে ডলারের দাম ছিল ৮৬ টাকা। এখন তা বেড়ে ১২২ টাকা হয়েছে। এ ছাড়া কয়েক মাস ধরে আমদানির ঋণপত্র খোলাও কমেছে। এতে আমসদানিতে চাপ পড়ছে।
দেশের বাজার উচ্চ মূল্যের কারণ সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক সেলিম রায়হান বলেন, বিশ্ববাজারে জ্বালানি, কৃষি ও খাদ্যপণ্যের দাম কমলেও বাংলাদেশের বাজারে তার প্রভাব দেখা যাচ্ছে না। জ্বালানি ও পরিবহন ব্যয়, শুল্ক ও করের চাপ ও বাজার ব্যবস্থাপনায় অদক্ষতার কারণে দাম কমছে না। পাইকারি থেকে খুচরা পর্যন্ত অতি মুনাফা ও অস্বচ্ছ বাণিজ্যিক শৃঙ্খলের কারণেও বাজারে কৃত্রিমভাবে উচ্চমূল্য বিরাজ করছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে টাকার অবমূল্যায়ন। ফলে আমদানি ব্যয় বেড়ে গেছে এবং আন্তর্জাতিক মূল্যহ্রাসের সুফল ভোক্তাপর্যায়ে পড়ছে না।
সেলিম রায়হান আরও বলেন, এ ছাড়া রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তার কারণ ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা নেমে এসেছে। বিনিয়োগকারীরা নতুন ঝুঁকি নিতে চাচ্ছেন না। পণ্য পরিবহন ও আমদানি ব্যাহত হচ্ছে। ফলে সরবরাহ শৃঙ্খল দুর্বল হয়ে পড়ছে। এই পরিস্থিতিতে বাজারে পণ্যের ঘাটতি ও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়। এটি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
দেশে তিন বছর ধরেই উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে গড় মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১০ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ। সম্প্রতি তা কিছুটা কমলেও সেপ্টেম্বর মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৮ দশমিক ৩৬ শতাংশ। গত আগস্ট মাসে এই হার ছিল ৮ দশমিক ২৯ শতাংশ।