মেঘনা আলমকে দরজা ভেঙে আটক করতে হলো কেন?
Published: 15th, April 2025 GMT
বৃহস্পতিবার গভীর রাতে একটি ‘ফেসবুক লাইভ’ এবং সেখানে একজন নারীর করুণ আর্তি, দেশবাসীর কাছে সাহায্যের আবেদন এতটাই শক্তিশালী হয় উঠেছিল যে, তা আমাদের গণঅভ্যুত্থানপূর্ব বাংলাদেশের তিক্ত অভিজ্ঞতা মনে করিয়ে দিয়েছিল।
নারীর নাম মেঘনা আলম, পেশায় মডেল এবং ২০২০ সালে ‘মিস আর্থ বাংলাদেশ’ নির্বাচিতও হয়েছিলেন। তিনি নিজ ঘরের ভেতর থেকে ফেসবুক লাইভে কাঁপা কণ্ঠে বলছিলেন– ‘দয়া করে দরজা ভাঙবেন না, আমি আইনজীবীর সঙ্গে থানায়, সকালে থানায় আসব।’ দরজার বাইরে যারা দাঁড়িয়ে ছিল, তাদের হুমকি-ধমকিও ভেসে আসছিল অস্পষ্টভাবে।
মেঘনা আলমের ভাষ্যমতে, তারা প্রথমে পুলিশ পরিচয়ে বলেছিল যে, জন্মসনদ যাচাই করতে এসেছে। অথচ এটা পুলিশের এখতিয়ারের মধ্যে পড়ে না। পরে নাকি বলেছিল, মাদকের সন্ধানে তল্লাশি করতে হবে। সেটাও গভীর রাতে একজন একাকী নারীর ঘরে জোর করে ঢুকে কেন করতে হবে– প্রশ্নসাপেক্ষ। একবার জন্মসনদ, আরেকবার মাদকের কথা বলাও কতটা পুলিশসুলভ? সাধারণত অপরাধীরাই এমন বিভ্রান্তিকর পরিচয় দিয়ে কারও ঘরে ঢোকে। যা হোক, ফেসবুক লাইভেই দেখা গেল শেষ পর্যন্ত কথিত পুলিশের দল দরজা ভেঙেই ঘরের ভেতরে ঢোকে; কম্পিউটার বন্ধ করে মেঘনাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়।
গত এক দশকে আমরা অসংখ্যবার এ ধরনের রাষ্ট্রীয় দমননীতি প্রত্যক্ষ করেছি। যদিও এভাবে ফেসবুক লাইভের মধ্যে পুরো বিষয়টি ঘটার ঘটনা বিরল। এর আগে ২০২১ সালের আগস্টে চিত্রনায়িকা পরীমণি গ্রেপ্তার হওয়ার আগে এভাবে ‘লাইভ’ করেছিলেন। যদিও মেঘনা আলমের গ্রেপ্তার হওয়ার ঘটনাটি সময় বিবেচনায় এবং ঘরে আর কেউ না থাকার কারণে আরও বেশি গুরুতর।
এবারের ঘটনা আরও বেশি ধাক্কা দিয়েছে এই কারণে, জুলাই-আগস্টের গণআন্দোলনের পর আমরা ভেবেছিলাম, একটি নতুন ব্যবস্থার জন্ম নিচ্ছে। মানবিক, জবাবদিহিমূলক, ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার দিকে আমরা এগোচ্ছি। তাহলে এই নির্মমতা কেন এবং কাদের স্বার্থে?
আদালত মেঘনাকে ৩০ দিনের জন্য ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের ২(এফ) ধারার অধীনে আটকাদেশ দেন। অভিযোগ– তিনি ‘জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি’! একজন মডেল, যাঁর পরিচিতি তাঁর পরিধির বাইরে সামান্যই, সেই মানুষটা কীভাবে হঠাৎ করে ‘জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি’ হয়ে উঠলেন?
অধিকারভিত্তিক বিভিন্ন সংগঠনের সমলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে রোববার পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের প্রধানকে সরিয়ে দেওয়া হয়। অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল সংবাদমাধ্যমের সামনে বলেন, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলেও এই গ্রেপ্তারে ‘প্রক্রিয়াগত ভুল’ হয়েছে।
কেবল এই স্বীকারোক্তিই কি যথেষ্ট? বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে তিনি অন্য যে কারও চেয়ে বেশি জানেন– গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে ফৌজদারি কার্যবিধির নির্ধারিত ধাপ অনুসরণ করা বাধ্যতামূলক। অভিযোগ থাকলে তা লিখিত হতে হবে; পুলিশকে সেই অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত করতে হবে। তদন্তে প্রাথমিক প্রমাণ পাওয়া গেলে তবেই গ্রেপ্তার করা হতে পারে।
শোনা যাচ্ছে, এক বিদেশি রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে মেঘনা আলমের ব্যক্তিগত হিসাব-নিকাশের জের ধরে এই গ্রেপ্তার। প্রশ্ন হচ্ছে, রাষ্ট্রদূত যদি অভিযোগ করে থাকেন, সেটি কি লিখিত সাধারণ ডায়েরি বা এফআইআর আকারে ছিল? পুলিশ কি সেটার তদন্ত করেছে? তদন্তের ভিত্তিতে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ইস্যু হয়েছে? এসব প্রক্রিয়া সম্পন্ন ছাড়াই পুলিশ কি একজন নাগরিককে গ্রেপ্তার করতে পারে? তাও আবার গভীর রাতে দরজা ভেঙে ঢুকে? ওয়ারেন্ট ছাড়া ফোন ও ল্যাপটপ জব্দ করতে পারে?
আমরা দেখেছি ক্ষমতাচ্যুত সরকারের সময় কীভাবে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট এবং স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্ট ব্যবহার করে মানুষকে চুপ করানো হয়েছে। বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মী, সাধারণ নাগরিক– কেউ রক্ষা পায়নি।
এখন তো কোনো রাজনৈতিক সরকার নেই। একটি নিরপেক্ষ, বিশেষজ্ঞনির্ভর সরকার রাষ্ট্র পরিচালনা করছে। তাহলে প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কার নির্দেশে এভাবে আইন ভঙ্গ করছে? নতুন বন্দোবস্তে কাকে রক্ষা করতে গিয়ে তারা পুরোনো রূপে ফিরে যাচ্ছে?
মেঘনা আলমের বিরুদ্ধে যদি প্রকৃতই কোনো অভিযোগ থেকে থাকে, সেটি পুলিশের সঠিক তদন্ত এবং আদালতের মাধ্যমেই প্রতিষ্ঠা করুন। সংবিধান ও আইন অনুযায়ী বিচার চলুক। কিন্তু রাতের আঁধারে বাসায় হামলা, ডিজিটাল ডিভাইস জব্দ এবং আদালতে ‘জাতীয় নিরাপত্তা’র ছুতোয় ৩০ দিন আটকে রাখা– এসব গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের চিত্র হতে পারে না।
রাষ্ট্রের অপরিহার্য দায়িত্ব হলো প্রত্যেক নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিত করা।
আমরা ভুলে যেতে পারি না– জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে হাজার তাজা প্রাণ ঝরে গেছে একটি বৈষম্যহীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। এই রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি হবে গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার ও মানবাধিকার। এটি চলবে সংবিধান ও আইন দ্বারা; ক্ষমতা ও অর্থের প্রভাব দ্বারা নয়।
মেঘনা আলম একজন মডেল হোন বা না হোন; তিনি একজন নাগরিক। তাঁর মৌলিক অধিকার, তাঁর মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, তাঁর ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রাষ্ট্রকে রক্ষা করতে হবে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং প্রশাসনে কর্মরত সবারই নাগরিকদের সঙ্গে মর্যাদা ও শ্রদ্ধার সঙ্গে আচরণ করা উচিত।
রাজনৈতিক দল বা মতাদর্শ নির্বিশেষে সব মানুষ অনেক আশা ও আকাঙ্ক্ষা নিয়ে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে বর্তমান সরকারকে সমর্থন করে আসছে। কিন্তু রাষ্ট্রযন্ত্রের অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি বা ব্যক্তিগত আক্রোশ থেকে এর ব্যবহার সেই আশাবাদকে ম্লান করে দেয়। বিদেশি কোনো নাগরিকের স্বার্থ রক্ষায় দেশীয় নাগরিকের অধিকারহানি কোনো সভ্য রাষ্ট্রে কল্পনা করাও কঠিন।
আরাফাত আশওয়াদ ইসলাম: গুলশান সোসাইটির নির্বাহী কমিটির সদস্য
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: সমক ল ন প রসঙ গ তদন ত সরক র আলম র
এছাড়াও পড়ুন:
রাতারাতি তারকা হলে দীর্ঘ সময় দর্শকের মনে থাকা কঠিন: রিচি
রিচি সোলায়মান। ছোটপর্দার জনপ্রিয় এই অভিনেত্রী এখন অনেকটাই আড়ালে। আজ বিশ্ব বাবা দিবস উপলক্ষে প্রকাশ হয়েছে বিশেষ গানচিত্র ‘বাবা শুনতে কী পাও’। এতে অভিনয় করেছেন রিচি সোলায়মান। এই গানচিত্র এবং সাম্প্রতিক নানা বিষয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন মীর সামী
আপনার অভিনীত গানচিত্র ‘বাবা শুনতে কী পাও’ নিয়ে কিছু বলুন?
‘বাবা শুনতে কি পাও’ শিরোনামের এই বিশেষ গানটি তৈরি করেছেন প্রান্তিক সুর। তাতে কণ্ঠ দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী গজল ঘরানার শিল্পী শিরিন চৌধুরী। গানটির কথাও লিখেছেন শিল্পী নিজে। গানচিত্রে একটি সুন্দর সামাজিক বার্তা পৌঁছে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিয়ের পর একটা মেয়ের স্বপ্ন যেন মরে না যায় এবং শুধু মানুষটাকে নয়, তার স্বপ্নকেও ভালোবাসার সংবেদনশীল এবং হৃদয়স্পর্শী বাবার অনুরোধের বার্তা থাকছে এতে। গানের কথার সূত্র ধরে গল্পনির্ভর ভিডিওটিতে বাবার ভূমিকায় অভিনয় করেছেন আবুল হায়াত আর মেয়ের ভূমিকায় আমি। অনেকদিন পর হায়াত চাচার সঙ্গে কাজ করলাম।
এই কাজটির সঙ্গে যুক্ত হলেন কীভাবে?
কিছুদিন আগে নির্মাতা চয়নিকা চৌধুরী আমায় গানচিত্রটিতে অভিনয়ের জন্য বললেন। যখন শুনলাম এই গানে বাবার ভূমিকায় অভিনয় কবেন আবুল হায়াত চাচা; ঠিক তখনই রাজি হয়েছি। কারণ, আমি হায়াত চাচার পরিচালনায় অনেক নাটকে তাঁর মেয়ের ভূমিকায় অভিনয় করেছি। তাই ভাবলাম বাবা দিবসের এই কাজটি আমাদের আরও একটি ডকুমেন্টেশন হয়ে থাক। আমাদের এই কাজে একজন মেয়ের দৃষ্টিভঙ্গিতে বাবাকে ঘিরে তার স্মৃতি, ভালোবাসা আর না বলা কথাগুলো উঠে এসেছে। কাজটি করার সময় আমার বাবার কথা খুব মনে পড়ছিল। একজন বাবার অবদান যে কত বিশাল, সেটি অনেক সময় আমরা বুঝতে পারি না–এই গানচিত্রে সেটিই তুলে ধরা হয়েছে।
আপনাকে এখন টিভি নাটকে খুব কম দেখা যায়। ইচ্ছা করেই দূরে সরে আছেন?
আমি এখন পরিবার আর নিজের সময়কে প্রাধান্য দিচ্ছি। পাশাপাশি কাজের মানের প্রতিও সবসময় সংবেদনশীল ছিলাম। নাটকের সংখ্যা বাড়ানোর বিষয়ে কখনও বিশ্বাসী ছিলাম না। এখন তো অনেক সময় দেখা যায় গল্প বা চরিত্রের গভীরতা কম, কাজগুলো অনেকটাই ‘কনটেন্ট ভিউ’ নির্ভর হয়ে যাচ্ছে। আমি চাই, যখন কাজ করি, সেটি যেন দর্শকের মনে থাকে। তাই শুরু থেকে এখনও বেছে বেছেই কাজ করছি।
এখন নাটকে ‘ভিউ’ ও ‘ট্রেন্ড’ অনুসারে শিল্পী নির্বাচন হয় বলে অভিযোগ আছে...
এটি ঠিক যে এখন ‘ভিউ’ একটি বড় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রশ্ন হলো– দীর্ঘ মেয়াদে এই দর্শক আসলে কাদের মনে রাখে? আমার মনে হয়, একটি শিল্পমাধ্যমে যখন কেবল সংখ্যা দিয়ে শিল্পী বা কাজের মান বিচার হয়, তখন সেখানে অন্তর্নিহিত শিল্পবোধ অনেকটা হারিয়ে যায়। আমি বিশ্বাস করি অভিনেতা বা অভিনেত্রী হিসেবে আমাদের প্রথম দায় নিজের চরিত্রের প্রতি। ‘ভিউ’ দিয়ে নয়, শিল্পের গভীরতা দিয়ে একজন শিল্পীকে বিচার করা উচিত।
বর্তমান সময়ে ওটিটি মাধ্যমের প্রসারে নাটকের গুণগত মানে কী প্রভাব পড়েছে বলে মনে করেন?
ওটিটি একটা বড় প্ল্যাটফর্ম। নতুন গল্প আর নতুন নির্মাতাদের সুযোগ এনে দিয়েছে। এখানেও একটি সিন্ডিকেট তৈরি হচ্ছে। যারা আগে টিভিতে প্রভাবশালী ছিলেন, এখন তারা ওটিটিতেও আধিপত্য রাখছেন। এটি শিল্পের জন্য মোটেই ভালো নয়। প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও অনেক শিল্পী সুযোগ পাচ্ছেন না। আমি বলব, ওটিটি হোক কিংবা টিভি–প্রতিভা ও গল্পকেই প্রাধান্য দেওয়া উচিত, ‘চেনা মুখ’ বা ‘সেলিব্রেটি প্যাকেজ’কে নয়।
যে সিন্ডিকেটের কথা বললেন, তা কী ভাঙা যায় না?
অবশ্যই যায়। যারা বিষয়টি নিয়ে কাজ করবেন, তারাই এখন সেই দলের হয়ে যাচ্ছে। ফলে বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে? আমি যখন নিয়মিত কাজ করেছি, সেই সময় কিন্তু সবাই যার যার যোগ্যতা দিয়ে কাজ করেছেন। এখন পরিচয়ের ভিত্তিতে হচ্ছে। ফলে ধীরে ধীরে আমাদের নাট্যাঙ্গনের শিল্পটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
ওটিটির কাজে আগ্রহ অনুভব করেন?
অবশ্যই। যদি ভালো গল্প আর শক্তিশালী চরিত্র পাই, আমি ওটিটিতেও কাজ করতে চাই। অশ্লীলতা বা অহেতুক সাহসী দৃশ্যের নামে যদি গল্পের গুরুত্ব হারিয়ে যায়, তাহলে সেটি আমাকে টানে না। শিল্পমান থাকলেই আমি আগ্রহী।
বর্তমান প্রজন্মের নতুন অভিনেত্রীদের সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?
নতুনদের মধ্যে অনেকেই খুব ভালো করছেন। আমি তাদের একটা কথাই বলি, নিজেকে সময় দিন, নিজেকে গড়ুন। রাতারাতি তারকা হওয়া যায়। দীর্ঘ সময় দর্শকের মনে থাকা কঠিন। টিকে থাকার জন্য শুধু সৌন্দর্য নয়, কাজের প্রতি নিষ্ঠা, অধ্যবসায় ও আত্মসমালোচনাও জরুরি।