ত্রুটি সারাতে ৫ মিনিট, কর্মীর পৌঁছাতে লাগল দেড় ঘণ্টা
Published: 26th, April 2025 GMT
ঢাকার মেট্রোরেল দৈনিক চার লাখের বেশি যাত্রী পরিবহন করে—এই তথ্য বড় করেই প্রচার করে কর্তৃপক্ষ। কিন্তু হুটহাট কারিগরি ত্রুটির কারণে চলাচল বন্ধ হয়ে গেলে যাত্রীদের সময়মতো তথ্য দেয় না মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ। এমনকি যে সমস্যা ১০ মিনিটে সমাধান করা সম্ভব, অব্যবস্থাপনার কারণে তা–ও দেড় ঘণ্টা বা তারও বেশি সময় লেগে যাচ্ছে।
আজ শনিবার এমনই এক ছোট ত্রুটির কারণে মেট্রোরেল চলাচল প্রায় দেড় ঘণ্টা বন্ধ থাকে। এই দেড় ঘণ্টা যাত্রীরা কোনো তথ্যই জানতে পারেননি। স্টেশনগুলোর মাইকে বন্ধ থাকার কথা বলা হলেও কখন চালু হতে পারে, সে বিষয়ে কোনো তথ্য দিতে পারে না। স্টেশনের বাইরে থাকা যাত্রীরা থাকছেন পুরো অন্ধকারে।
ঢাকায় মেট্রোরেল নির্মাণ ও পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল)। প্রতিষ্ঠানটির নিজস্ব ওয়েবসাইট আছে। রয়েছে ফেসবুক পেজ। ফেসবুক পেজে ফলোয়ার ১ লাখ ৬২ হাজার। আজ মেট্রোরেল বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং তা চালুর পর একটা ঘোষণা দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি কর্তৃপক্ষ। ডিএমটিসিএলের ফেসবুক পেজে সর্বশেষ পোস্ট ১৩ এপ্রিলের। তাতে বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে শাহবাগ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্টেশন দুটি বন্ধ থাকার ঘোষণা রয়েছে। ওয়েবসাইটে অস্বাভাবিকভাবে যাত্রীসেবা বিঘ্নিত হওয়ার কোনো তথ্য থাকে না।
ডিএমটিসিএল রাষ্ট্রায়ত্ত একটি কোম্পানি। এর প্রত্যেক কর্মকর্তা ও কর্মচারী জাতীয় বেতন স্কেলের তুলনায় ২ দশমিক ৩ গুণ বাড়তি বেতন পেয়ে থাকেন। ডিএমটিসিএলের নিচের দিকের কর্মীরা স্থায়ী নিয়োগ পাওয়া। গুরুত্বপূর্ণ ও উচ্চ পদে নিয়োগ পাওয়াদের একটা অংশ সরকারের প্রশাসন ও অন্যান্য ক্যাডারের কর্মকর্তা। আরও কিছু কর্মকর্তা রেল, সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তর থেকে অবসরে যাওয়া কর্মকর্তা। মেট্রোরেলের চলাচল বন্ধ কিংবা অন্য কোনো ত্রুটি দেখা দিলে প্রথমেই অপারেশন বা পরিচালন বিভাগ জানার কথা। কিন্তু এই বিভাগের পক্ষ থেকে গণমাধ্যম বা যাত্রীদের তথ্য সরবরাহ করা হয় না।
আজ মেট্রোরেল বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর অপারেশন বিভাগের পরিচালক ও রেলের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নাসির উদ্দিনকে বেশ কয়েকবার ফোন করেও পাওয়া যায়নি। একই বিভাগের মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ ইফতিখার হোসেনও সাড়া দেননি। ডিএমটিসিএলের স্থায়ী জনসংযোগ কর্মকর্তা নেই। সংস্থাটির উপব্যবস্থাপক (প্রশাসন) একাধারে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা এবং জনসংযোগের দায়িত্ব পালন করেন। তাঁকে ফোন করা হলে তিনি জানান, বৈদ্যুতিক গোলযোগের কারণে মেট্রোরেল চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
পরে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান প্রথম আলোকে বলেন, তিনিও মেট্রোরেল বন্ধ থাকার বিষয়টি অন্য মাধ্যমে জেনেছেন। এরপর বিদ্যুৎ বিভাগকে যুক্ত করেছেন। ডিএমটিসিএল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়েছেন।
ছোট সমস্যাতেও দীর্ঘ বিলম্বমেট্রোরেল কর্তৃপক্ষের সূত্র বলছে, বিজয় সরণি এলাকার সাবস্টেশন থেকে মেট্রোরেল লাইনে বিদ্যুৎ গ্রহণ বন্ধ হয়ে যায় বিকেল ৫টা ৬ মিনিটে। দু-এক মিনিটের মধ্যেই কেন্দ্রীয়ভাবে তা নিশ্চিত হওয়া যায় যে বিজয় সরণিতে লাইনে বিদ্যুৎ পাচ্ছে না। এর জেরে শাহবাগ ও শেওড়াপাড়া সাবস্টেশন থেকেও বিদ্যুৎ বন্ধ হয়ে যায় লাইনে। স্বয়ংক্রিয়ভাবে এভাবে বিদ্যুৎ বন্ধ হয়ে গেলে কারিগরি কাজে যুক্ত কর্মীদের সশরীর গিয়ে তা পুনরায় চালু করতে হয়। বড় কোনো সমস্যা হলে মেরামত করতে হয়। নতুবা পুনরায় সংযোগ চালু করলেই চলে। এর জন্য বড়জোর ১০ মিনিট ট্রেন চলাচল বিঘ্ন হতে পারে। কিন্তু এর জন্য মেট্রোরেল পুনরায় চালু করতে সময় লেগে যায় প্রায় ১ ঘণ্টা ৫০ মিনিট। এটাকে অস্বাভাবিক বলছেন মেট্রোরেল চলাচলে যুক্ত কর্মকর্তাদের কেউ কেউ।
এদিকে মেট্রোরেলের চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে বিভিন্ন স্টেশনে যাত্রীরা বিপাকে পড়েন। রাজধানীর শাহবাগসহ কয়েকটি স্টেশনে টিকিট ফেরত নেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়। স্টেশনগুলোতে টিকিট বিক্রি বন্ধ রাখা হয়। এরপর অনেক যাত্রী স্টেশন থেকে বেরিয়ে যান।
সন্ধ্যা ছয়টার দিকে মিরপুর যাওয়ার জন্য কারওয়ান বাজার স্টেশনে ছিলেন কামরুল হাসান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, কখন ট্রেন চালু হতে পারে, সেই বিষয়ে কোনো নিশ্চয়তা দিতে পারছেন না স্টেশনের দায়িত্বে থাকা কর্মীরা।
স্থায়ী কার্ডে যাতায়াত করা অনেকে ফোন দিয়ে জানান, তাঁরা একবার কার্ড পাঞ্চ করে প্ল্যাটফর্মে প্রবেশ করেছেন। বেরিয়ে গেলে টাকা ফেরত পাওয়া যাবে কি না, সেই বিষয়ে কোনো তথ্য পাচ্ছেন না।
সংশ্লিষ্ট কর্মীদের সশরীর এসে বিদ্যুৎ পুনরায় চালু করার জন্য দেড় ঘণ্টার বেশি সময় লাগার পেছনে কিছুটা অব্যবস্থাপনার তথ্য পাওয়া যায়। ডিএমটিসিএল সূত্র জানায়, স্টেশনের বাতি, শীতাতপনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাসহ অন্যান্য কাজ চালানো হয় অক্সিলারি বা সহযোগী বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থার মাধ্যমে। আর বিশেষ ব্যবস্থার মাধ্যমে মেট্রো ট্রেন চালানোর বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়। এর জন্য উত্তরা উত্তর, উত্তরা দক্ষিণ, মিরপুর ১১, শেওড়াপাড়া, বিজয় সরণি, শাহবাগ ও মতিঝিলে ছয়টি সাবস্টেশন রয়েছে।
কিন্তু ত্রুটি দেখা দিলে সশরীর ঘটনাস্থলে গিয়ে তা চালু করা কিংবা মেরামতের জন্য যেসব কর্মী রয়েছেন, তাঁরা বসেন উত্তরার দিয়াবাড়ীতে মেট্রোরেলের ডিপোতে। ফলে উত্তরা থেকে সড়কপথে যানজট ঠেলে কর্মী বিজয় সরণি এসে বিদ্যুৎ চালু করেন এবং এরপর ট্রেন চলাচল শুরু হয়। এতেই প্রায় দুই ঘণ্টার কাছাকাছি সময় লেগে যায়।
মেট্রোরেল পরিচালনায় যুক্ত দুজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, স্টেশনের বাতি কিংবা শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্রসহ অন্যান্য বিদ্যুতের সমস্যা হলে তা সমাধানের জন্য কয়েকটি স্টেশন পরপরই কর্মী রাখা হয়েছে। কিন্তু মেট্রোরেলের মূল লাইনের ত্রুটি সারানোর জন্য উত্তরা ছাড়া অন্য কোথাও কর্মী নেই। অথচ মাঝখানে আগারগাঁও ও শাহবাগসহ আরও কিছু স্থানে এ ধরনের কর্মী রাখা হলে দ্রুত ত্রুটি সারিয়ে ট্রেন চলাচল শুরু করা যায়।
ডিএমটিসিএল সূত্র বলছে, আজ ৫টা ৬ মিনিটে মেট্রোরেলের লাইনে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। ৬টা ২৮ মিনিটের দিকে কারিগরি কর্মী ঘটনাস্থলে পৌঁছান। অর্থাৎ ঘটনাস্থলে পৌঁছাতেই সময় লেগে যায় ১ ঘণ্টা ২২ মিনিট। ঘটনাস্থলে কর্মী পৌঁছানোর পাঁচ মিনিটের মধ্যে বিদ্যুৎ সঞ্চালন শুরু হয়। দীর্ঘ বিরতির সময় ট্রেনগুলো একেক স্থানে আটকা পড়ে। সেগুলো পুনরায় প্রস্তুত করে চালু করতে করতে সন্ধ্যা ৬টা ৫৫ মিনিট বেজে যায়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কারিগরি কর্মী ঘটনাস্থলে গিয়ে পুনরায় চালুর (রিস্টার্ট) পরই বিদ্যুৎ সঞ্চালন শুরু হয়ে যায়। আর যদি পুনরায় চালু করলে সঞ্চালন না হতো, তাহলে বড় ত্রুটি ধরা পড়ত এবং মেরামতের প্রয়োজন হতো।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, কোনো একটি সাবস্টেশন থেকে সাধারণ কারণে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেলে অন্য সাবস্টেশন থেকে তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে সরবরাহ করা হয়। এতে মেট্রোরেলের চলাচলে কোনো বিঘ্ন ঘটে না। কিন্তু কোনো অস্বাভাবিক কারণে, অর্থাৎ কারিগরি ত্রুটি কিংবা সার্কিট পুড়ে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটলে অন্য সাবস্টেশন থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা যায় না। কারণ, সতর্কতার অংশ হিসেবে ত্রুটিপূর্ণ স্টেশনের দুই পাশের আরও দুটি সাবস্টেশন স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। অর্থাৎ আজ শেওড়াপাড়া, বিজয় সরণি ও শাহবাগ সাবস্টেশন থেকে বিদ্যুৎ সঞ্চালন বন্ধ থাকে। কেন বিজয় সরণি সাবস্টেশনের বিদ্যুৎ মেট্রোরেল লাইন গ্রহণ করতে পারছিল না, সেটির কারণ তাৎক্ষণিকভাবে ধরতে পারেনি মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ। তবে এর কারণ পরে বের করা হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়।
আরও পড়ুনবৈদ্যুতিক গোলযোগে মেট্রোরেলের চলাচল বন্ধ, দুর্ভোগ৩ ঘণ্টা আগে.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ব দ য ৎ সরবর হ কর মকর ত বন ধ থ ক সময় ল গ শ হব গ ত কর ম র জন য প রথম সমস য
এছাড়াও পড়ুন:
২০২৬ সালে বিশ্ববাজারে জিনিসপত্রের দাম আরও ৭% কমতে পারে, বাংলাদেশে কেন কমছে না
চলতি বছরের শুরু থেকেই বিশ্ববাজারে দাম কমার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুসারে, চলতি বছরে সামগ্রিকভাবে পণ্যমূল্য ৭ শতাংশ কমবে। আগামী বছর, অর্থাৎ ২০২৬ সালে পণ্যমূল্য আরও ৭ শতাংশ কমবে। এ দাম হবে ছয় বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম।
কিন্তু বাংলাদেশের বাজারে তার প্রভাব নেই। দেশে মূল্যস্ফীতির হার এখনো ৮ শতাংশের ঘরে। যদিও একসময় তা দুই অঙ্ক ছাড়িয়ে গিয়েছিল। গত সেপ্টেম্বর মাসে মূল্যস্ফীতি ৮ দশমিক ৩৬ শতাংশ হয়েছে। দেশের মানুষকে এখনো বাড়তি দামেই পণ্য ও সেবা কিনতে হচ্ছে। আগামী বছর নিত্যপণ্যের দাম কমবে কি না, সেই নিশ্চয়তাও নেই। বিশ্লেষকেরা বলছেন, ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম কমলেও দেশে এর প্রভাব কম।
বিশ্বব্যাংকের ‘কমোডিটি মার্কেটস আউটলুক অক্টোবর ২০২৫’ শীর্ষক প্রতিবেদনের তথ্যানুসারে, ২০২৫ সালের শুরু থেকেই বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম কমতে শুরু করেছে। যার মূল কারণ হিসেবে তারা চিহ্নিত করেছে জ্বালানির দাম কমে যাওয়া। সেই সঙ্গে আরও কিছু কারণ চিহ্নিত করেছে তারা। সেগুলো হলো চীনে তেলের চাহিদা বৃদ্ধির গতি কমে যাওয়া এবং বিশ্ববাজারে সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় তেলের দামে বড় ধরনের পতন ঘটা। খাদ্যপণ্যের দাম বছরের শুরু থেকে ধীরে ধীরে কমতে থাকে, কিন্তু বছরের প্রথমার্ধে প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে পানীয় পণ্যের দাম হঠাৎ অনেকটা বেড়ে যায়। এ ছাড়া বছরের দ্বিতীয়ার্ধে সোনার দাম রেকর্ড উচ্চতায় ওঠে। মূলত রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যে নিরাপদ বিনিয়োগ মাধ্যম হিসেবে মানুষ সোনার দিকে ছুটেছেন।
বিশ্ববাজারে পণ্যের মূল্য নির্ধারণে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখে জ্বালানি তেলের দাম। বিশ্বব্যাংক গ্রুপের পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০২৫ সালে জ্বালানির দাম আগের বছরের তুলনায় ১২ শতাংশ এবং ২০২৬ সালে আরও ১০ শতাংশ কমবে। ২০২৭ সালে তা আবার প্রায় ৬ শতাংশ বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস ২০২৬ সালে কৃষিপণ্য, খাদ্য ও কাঁচামালের দাম কমবে। চলতি বছরেও এসব পণ্যের দাম কমেছে।
জ্বালানি তেলবিশ্বব্যাংকের ২০২৬ সালের পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, প্রাকৃতিক গ্যাসের চাহিদা বাড়ায় গ্যাসের দাম কিছুটা বাড়লেও তেলের দাম কমে যাবে এবং সেই প্রভাবকে ছাপিয়ে যাবে। ২০২৫ সালে ব্রেন্ট ক্রুড তেলের দাম হতে পারে ব্যারেলপ্রতি গড়ে ৬৮ ডলার; ২০২৪ সালের ৮১ ডলারের তুলনায় যা বেশ কম। ২০২৬ সালে এই দাম আরও কমে ব্যারেলপ্রতি গড়ে ৬০ ডলারে নামতে পারে ধারণা করা হচ্ছে।
এই পূর্বাভাস অনুযায়ী, তেলের ব্যবহার বৃদ্ধির হার আরও কমবে—মূলত চীনের চাহিদা কমে যাওয়া, বৈদ্যুতিক ও হাইব্রিড গাড়ির দ্রুত প্রসার ও বৈশ্বিক তেল সরবরাহ বৃদ্ধির কারণে এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে।
২০২৫ সালে বৈশ্বিক তেলের বাজারে সরবরাহ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। ২০২৬ সালে তা আরও বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ২০২০ সালের সর্বোচ্চ মাত্রার তুলনায় প্রায় ৬৫ শতাংশ বেশি হবে এ সরবরাহ।
কৃষিপণ্যবিশ্বব্যাংক গ্রুপের পূর্বাভাস অনুযায়ী, কৃষিপণ্যের মূল্যসূচক ২০২৫ সালে স্থিতিশীল আছে। ২০২৬ সালে তা সামান্য ২ শতাংশ ও ২০২৭ সালে আরও ১ শতাংশ কমবে।
খাদ্যপণ্যের দাম, যেমন শস্য, তেল, প্রোটিনজাত খাবারসহ অন্যান্য খাদ্যের দাম সাম্প্রতিক সীমার কাছাকাছি থাকবে। তবে মাঝেমধ্যে সামান্য কিছুটা ওঠানামা থাকবে। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, প্রধান ফসলগুলোর উৎপাদন বৃদ্ধির হার আবার দীর্ঘমেয়াদি প্রবণতায় ফিরে আসছে।
২০২৫ সালের বাকি সময়ে সয়াবিনের দাম কমবে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের যে সয়াবিন সাধারণত চীনে রপ্তানি হয়, তা এবার কম দামে অন্য ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করতে হতে পারে। চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যযুদ্ধের অন্যতম প্রধান ক্ষেত্রে হচ্ছে এই সয়াবিন। চীন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে সয়াবিন কিনছে না। ফলে ২০২৬ ও ২০২৭ সালে এই পণ্যের দাম তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল থাকবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বিশ্ববাজারে দাম কমে গেলে যুক্তরাষ্ট্রে সয়াবিন চাষের পরিমাণ কিছুটা কমতে পারে, তবে ব্রাজিল তার সয়াবিন আবাদ আরও বাড়ানোর পথে রয়েছে। পানীয় পণ্যের দাম ২০২৬ সালে ৭ শতাংশ ও ২০২৭ সালে প্রায় ৫ শতাংশ কমবে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।
এদিকে চলতি বছর সারের দাম সামগ্রিকভাবে ২১ শতাংশ বাড়তি। চাহিদা বৃদ্ধি, বাণিজ্যিক প্রতিবন্ধকতা ও কিছু অঞ্চলে সরবরাহ–ঘাটতির কারণে এ দাম বেড়ে যাওয়া। ২০২৬ ও ২০২৭ সালে দাম প্রায় ৫ শতাংশ কমতে পারে। তবু ২০১৫-১৯ সালের গড় দামের তুলনায় তা অনেক বেশি থাকবে। এর কারণ হলো উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়া, রপ্তানি সীমাবদ্ধতা ও চলমান আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা।
চীন ইতিমধ্যে নাইট্রোজেন ও ফসফেট সার রপ্তানিতে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে। অন্যদিকে পটাশ সরবরাহকারী বড় দেশ বেলারুশ এখনো ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিষেধাজ্ঞার আওতায় আছে। রাশিয়া ও বেলারুশ—উভয় দেশই সারের ওপর ইউরোপীয় ইউনিয়নের আরোপিত নতুন শুল্কের সম্মুখীন।
দেশে কেন দাম বেশিবিশ্ববাজারে দাম কমলেও দেশের বাজার দাম না কমার অন্যতম প্রধান কারণ ডলারের দামের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন। গত তিন বছরে ডলার দাম অনেকটা বেড়েছে। সেই সঙ্গে দেশের অনেক আমদানি পণ্যে শুল্ক বেশি বলে মনে করেন গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান।
মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বাজার ব্যবস্থাপনার কারণে দাম কমছে না। বাজারে চাহিদা কত বা কখন কোন পণ্য আমদানি করতে হবে, সে বিষয়ে যথাযথ তথ্যের ঘাটতি আছে। ফলে সময়মতো পণ্য আমদানি হয় না।
আরেকটি বিষয় হলো দেশে যেসব পণ্য আমদানি করা হয়, তার অনেক কিছু উৎপাদিতও হয়। কিন্তু বিনিয়োগ কমে যাওয়ায় এসব পণ্যের সরবরাহে টান পড়েছে। বাজারের পণ্যমূল্যে তার প্রভাব পড়ছে বলে মনে করছেন মোস্তাফিজুর রহমান।
তিন বছর আগে দেশে ডলারের দাম ছিল ৮৬ টাকা। এখন তা বেড়ে ১২২ টাকা হয়েছে। এ ছাড়া কয়েক মাস ধরে আমদানির ঋণপত্র খোলাও কমেছে। এতে আমসদানিতে চাপ পড়ছে।
দেশের বাজার উচ্চ মূল্যের কারণ সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক সেলিম রায়হান বলেন, বিশ্ববাজারে জ্বালানি, কৃষি ও খাদ্যপণ্যের দাম কমলেও বাংলাদেশের বাজারে তার প্রভাব দেখা যাচ্ছে না। জ্বালানি ও পরিবহন ব্যয়, শুল্ক ও করের চাপ ও বাজার ব্যবস্থাপনায় অদক্ষতার কারণে দাম কমছে না। পাইকারি থেকে খুচরা পর্যন্ত অতি মুনাফা ও অস্বচ্ছ বাণিজ্যিক শৃঙ্খলের কারণেও বাজারে কৃত্রিমভাবে উচ্চমূল্য বিরাজ করছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে টাকার অবমূল্যায়ন। ফলে আমদানি ব্যয় বেড়ে গেছে এবং আন্তর্জাতিক মূল্যহ্রাসের সুফল ভোক্তাপর্যায়ে পড়ছে না।
সেলিম রায়হান আরও বলেন, এ ছাড়া রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তার কারণ ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা নেমে এসেছে। বিনিয়োগকারীরা নতুন ঝুঁকি নিতে চাচ্ছেন না। পণ্য পরিবহন ও আমদানি ব্যাহত হচ্ছে। ফলে সরবরাহ শৃঙ্খল দুর্বল হয়ে পড়ছে। এই পরিস্থিতিতে বাজারে পণ্যের ঘাটতি ও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়। এটি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
দেশে তিন বছর ধরেই উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে গড় মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১০ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ। সম্প্রতি তা কিছুটা কমলেও সেপ্টেম্বর মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৮ দশমিক ৩৬ শতাংশ। গত আগস্ট মাসে এই হার ছিল ৮ দশমিক ২৯ শতাংশ।