ঢাকার আলো-আঁধারি রাতে যখন সিনেমার পোস্টারগুলোর রঙ ম্লান হয়ে যায়, ব্যর্থ নায়িকাদের চোখে তখন সেইটুকু আশার আলোও জ্বলে না। তবে মধুমিতা মউ ব্যতিক্রম। সে বারবার হেরেছে, বারবার পুড়েছে; কিন্তু হাল ছাড়েনি। মফস্বলের ছোট শহরে বেড়ে ওঠা মউ সিনেমা বলতে জানতো শুধু হলের পর্দায় ঝাঁ চকচকে নায়ক-নায়িকাদের দেখা। কিন্তু সিনেমা নিয়ে তাঁর অনুভব ছিল তার চেয়েও বড় কিছু, একটা ঘোর, একটা তৃষ্ণা, একটা স্বপ্ন। ছোটবেলায় আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সংলাপ বলতে বলতে কখন যে বাস্তবকে আড়াল করে স্বপ্নে ঢুকে পড়ত! পরবর্তীকালে সেই স্বপ্নের পথ পুষ্প শোভিত ছিল না, ছিল কাঁটা, অবহেলা, সন্দেহ আর অপমান।
দুই
শুরুটা ছিল একেবারেই একা। পরিবার মানতে পারেনি মেয়ের এই পাগলামো। মা চোখের পানি ফেলে বলতেন, ‘এই পথে গেলে মেয়েরা ফিরে আসতে পারে না।’ কোথা থেকে ফিরতে পারে না বুঝতে পারে না মউ। মায়ের স্বপ্ন মেয়ে হবে ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার। ‘তুই সিনেমায় যাবি?’ বাবার কণ্ঠে স্পষ্ট তাচ্ছিল্য। বাবার কণ্ঠ ছিল কড়া, ‘চলচ্চিত্র মানেই চরিত্রহীনতা।’ কিন্তু মউ নিজেকে জানত। সে জানত, তার মন অন্য কিছু চায় না। এরপর পড়াশোনার সুবাদে ঢাকায় চলে আসা। এক বান্ধবীর ফ্ল্যাটে কিছুদিন থাকে, তারপর মেসে উঠে। দিনের বেলায় অডিশনে দৌড়, রাতের বেলায় একমুঠো ডাল-ভাত আর অনিশ্চয়তার ঘুম।
তিন
শুরুতে অডিশনে গিয়ে দাঁড়াতো বিশাল লম্বা লাইনে। একবার এক প্রযোজক সরাসরি বলে দিয়েছিল, ‘তোমার ফিগারটা ঠিক করো, তারপর এসো।’ আরেকজন বলেছিল,‘তোমার চেহারায় হিরোইনসুলভ কিছু নেই।’ সেদিন রাতে ফিরে এসে একা বিছানায় বসে নিজেকে আয়নায় দেখেছিল। ধবধবে রঙ না হলে, কোমর চিকন না হলে, ঠোঁট ভরাট না হলে—অভিনয় কি হবে না? অভিনয় কি শুধু শরীরের ওপর নির্ভর করে? কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছিল। পরদিন আবার অডিশনে যায়। কারো কাছে নিজেকে প্রমাণ করার জন্য নয়, নিজের ইচ্ছাটাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য। তবে মউ জানতো, অভিনয় তার রক্তে। ক্লাস সেভেনে স্কুল নাটকে এক নারী চরিত্রে অভিনয় করার পর থেকেই সে জানে, বড় পর্দার মঞ্চের আলো তাকে ডাকছে। সেদিন উপস্থিত দর্শকদের অনেকেই তাই বলেছিলেন। একদিন হঠাৎ এক অডিশনে গিয়ে এক প্রখ্যাত নির্মাতার চোখে পড়লো সে। স্ক্রিপ্ট ধরিয়ে দিয়ে পরিচালক বললেন,‘তোমাকে দিয়েই এই চরিত্রটা হবে। তুমি তৈরি তো?’ যেন স্বাগত উক্তির বেড়াজালে জড়িয়ে মউ; এই হয়ে এলো, হয়ে যাচ্ছে, পালকের মতো হালকা হয়ে পাহাড় চূড়া থেকে স্বপ্নটা নিচে পড়ছে মুহুর্তেই। বাতাসের তোড়জোড় নেই সেখানে, বাধাহীন। কিন্তু পালক ভেসে বেড়ায় এদিকওদিক। ‘আমি চেষ্টা করব’—লাজুক গলায় বলেছিল সে। সেবার ছিল ‘আলো এসে গেল’ একটি আর্ট ফিল্ম। চরিত্র ছিল নির্যাতিত এক নারীর। মউ নিজের সর্বস্ব ঢেলে দিয়েছিল অভিনয়ে। কিন্তু রিলিজের আগে শেষ মুহূর্তে ঢুকে পড়ল একটি ‘আইটেম গান’। গানটি ফিল্মের চরিত্রের সাথে যাচ্ছিল না। মউ বুঝতে পারে। ‘তোমাকে করতে হবে মউ, প্রযোজক চাচ্ছেন।’ বলে পরিচালক। ‘কিন্তু গল্পে তো এটা ছিল না, স্যার।’ জানায় মউ। ‘এই ইন্ডাস্ট্রিতে আমাকে কেউ না বলে না, বুঝলে?’ তিরস্কার করে পরিচালক। ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে ড্রেসটা হাতে নিয়ে কেঁদে ফেলেছিল সে। কে কবে দেখেছে—নায়িকা শুটিং সেটে ড্রেস ধরে কাঁদে? তবু করেছিল, কারণ কাজ থামালে, ‘নাটক করলেও’ কেউ ডাকবে না—এই ভয় ছিল। যা ভেবেছিল তাই! গানটির জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক নিন্দিত হয়েছিল মউ। তারপর একে একে সিনেমা। কিন্তু যুত মতো হয় না। একবার নয়, বারবার ঠকেছে। এক সিনেমায় তাকে ‘হিরোইন’ বলা হয়েছিল। শুটিংয়ে গিয়ে দেখে গল্পে আরেক নায়িকাও আছে। আবার আরেকটি সিনেমায় গানটিই কেটে দেওয়া হয়েছে। এমনও হয়েছে, সিনেমা রিলিজ হয়নি; প্রযোজক পালিয়ে গেছে। ‘তুই এইসব করে কতদিন টিকবি মউ?’—এক সহ-অভিনেত্রী বলেছিল একবার। সে শুধু মুচকি হেসে বলেছিল, ‘সন্ধ্যাতারা আর শুকতারা একই, কিন্তু সেটা যারা জানে না তারা জানেই না ।’ এমন রহস্যময় উত্তরে কী বলবে বুঝতে পারে না সহ-অভিনেত্রী। কিন্তু ভেতরে একসময় ফাটল ধরতে শুরু করলো তার। ‘তোমার চরিত্রে এই গল্পটা নেই, কিন্তু শুটিংয়ে ঢুকেছে। দর্শক খাবে।’—এই লাইনটা মউ যতবার শুনেছে, ততবার তার আত্মবিশ্বাস একটু একটু করে মরেছে। একটি সিনেমার চুক্তিপত্রে গল্পের প্রসঙ্গ লেখা ছিল, একজন সংগ্রামী মেয়ের চরিত্র, যাকে মউ নিজের সঙ্গে মিলিয়ে নিতে পেরেছিল।
কিন্তু শুটিংয়ে গিয়ে দেখে, দৃশ্য পাল্টে গেছে। তার ভূমিকা হয়ে গেছে নায়ককে প্রশ্নবিদ্ধ আবেদন এক্সপ্রেশনে পছন্দ করানো এক মোহময়ী নারী। স্ক্রিপ্টে ছিল না এমন কোনো দৃশ্য, যেগুলো হঠাৎ জুড়ে দেওয়া হয়েছে। পরিচালকের মুখে ছিল একটাই কথা,‘তুমি পারফর্ম করতে পারলেই দর্শক খাবে।’ সেই ‘পারফর্ম’ অভিনয়জনিত না, শরীরপরায়ণ! একটি দৃশ্যের কথা ছিল না, কিন্তু হুট করে তাকে বলা হয়, ‘এই গানে তোমাকে একটু সাহসী সাজতে হবে।’ সে অপারগতা জানালে বলা হয়, ‘ডিরেক্টরের চাওয়া। তুমি কি ছাড়তে চাও কাজটা?’ কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসে মউয়ের। ফ্লোরে তখন আলো জ্বলছে, ক্যামেরা ঘুরছে, আর সে পোশাক হাতে দাঁড়িয়ে। এইভাবে আরও একাধিক সিনেমার পেছনের গল্পটা প্রতারণার। তাকে প্রমিস করা হয়েছিল মুখ্য চরিত্র, কিন্তু পোস্টারে নামটাও থাকে না। কোনো সিনেমায় দেখা গেছে, তার গান সিনেমা থেকে বাদ পড়ে গেছে, কারণ নায়ক চাননি। প্রতিবার প্রতারণা, প্রতিবার অপমান। অথচ কেউ বুঝত না, প্রতিবার ঘরে ফিরে সে কাঁদত, ঘুম ভেঙে হতাশায় চিৎকার করে উঠত, ফোনের দিকে তাকিয়ে ভাবত—‘আর কী থাকবে এই হাতে?’ তবু অভিনয় ছাড়েনি।
চার
আসবার কথা তার সাফল্য, অথচ আসে করোনা মহামারি। যেন তার সমস্ত ক্লান্তি ও মনোবেদনার ওপর মহামারির চাদর প্যাঁচিয়ে যায়। হঠাৎ করে সব থেমে যায়। মউ কিছুটা নিঃশ্বাস নিতে পারেন। কিছু যদি আর স্বাভাবিক না হয়, আর না হয় অভিনয়ই না করলেন, এই ভাবনাটা হঠাৎ বেশ ভালো লাগতে থাকে। লকডাউন, থেমে যাওয়া ক্যামেরা, বন্ধ স্টুডিও! মউ একা থাকত একটি ভাড়া বাসায়। চারদিকে নিস্তব্ধতা। ফোন বাজে না, প্রস্তাব আসে না। ‘আমি কি সত্যিই শেষ?’—রাতে আয়নায় তাকিয়ে নিজেকে প্রশ্ন করত। তবে মাঝেমধ্যে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ডায়লগ দিত :
‘মা, আমি ভালো আছি। আমি এখন সিনেমার নায়িকা!’
বলেই হেসে ফেলত, আর পরক্ষণেই ভেঙে পড়ত কান্নায়।
টানা কয়েক মাস ঘরবন্দি। আয়-রোজগার থেমে যায়, ফোন বাজে না, মেসেঞ্জারে একটাও কাজের মেসেজ আসে না। এক রাতে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে বলে,‘তুই কি হেরে গেছিস? শঠতার কাছে, করোনার কাছে?’
পাঁচ
করোনার পর এক নাট্যনির্মাতা তাকে ফোন দিলেন, ‘একটা চরিত্র আছে, একটু সাদামাটা, গৃহবধূ। করবা?’ ‘করব’— মউ বলল। এভাবেই শুরু হলো নাটকে মউয়ের যাত্রা। আপাতত নাটকে সে নিজেকে খুঁজে পেল, তবে মন পড়ে রইলো সিনেমায়। তবুও সে জানত, আর সিনেমায় ফিরে যাওয়া মানেই সেই নোংরামি, সেই ভয়াবহ অভিজ্ঞতা। একদিন ফোন এলো নামকরা নির্মাতা খালেক আফসারের কাছ থেকে। ‘তোমার জন্য গান আছে—মধু কই কই বিষ খাওয়াইলা।’ মউ দ্বিধায় ছিল, তবু করল। সিনেমা রিলিজ হলো। গানটা হিট, কিন্তু বিতর্কও উঠল। পরিচালক যেভাবে সিনেমায় উপস্থাপন করেছিলেন মউকে, তা দেখে দর্শক কী বলবে সে নিজেই লজ্জায় ডুবে গিয়েছিল। ‘আমি শুধু নিজেকে পরিচিত করতে চেয়েছিলাম, অপমানিত নয়,’—এক সাক্ষাৎকারে বলেছিল মউ। এই সিনেমা তার আত্মবিশ্বাসে চূড়ান্ত আঘাত হানে। মউ সিদ্ধান্ত নেয়, সিনেমা থেকে নিজেকে সরিয়ে নেবে। কিন্তু পারে না। আহারে জীবন! এর দু’বছর পর আসে অফার—‘আহারে জীবন’। চরিত্র এক বিধবা নারীর, যে সমাজের চোখ রাঙানির মধ্যেও নিজের ইচ্ছাকে বাঁচিয়ে রাখে।‘এই চরিত্র আমি করব, কারণ এটা আমার অদম্য ইচ্ছার গল্প’—মউ বলেছিল। সেটে এক দৃশ্যে তার কাঁদার কথা ছিল। ক্যামেরা অফ হয়ে গেছে, তবুও মউ কাঁদছে। পরিচালক বললেন,‘কাট তো হয়ে গেছে! তুই এখনো কাঁদছিস কেন?’ ‘এই কান্না তো কাট বোঝে না, স্যার’—মউ ফিসফিস করে বলে। এই সিনেমায় অভিনয়ের পর অনেকেই বলেছিল, ‘মউ ফিরল।’ কিন্তু মউ বলেছিল,‘আমি ফিরিনি, আমি এই শহরেই ছিলাম, শুধু আমাকে কেউ ডাকেনি।’ এভাবে যখন মনে হচ্ছিল সব শেষ, তখন শুরু করালো ‘আহারে জীবন’। গল্প পড়েই স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল মউ। যেন নিজেরই জীবনী। রাইটার জানলো কেমন করে? সেই সিনেমায় মউ শুধু অভিনয় করেনি, নিজের ভেতরটা উজাড় করে দিয়েছিল। কিন্তু কোনো এক অজ্ঞাত কারণে এই সিনেমার শুটিং শেষ করেই মউ নিজেকে গুটিয়ে নেয়। সে আর কোথাও নেই। না নাটকে, না সিনেমায়। নিজেকে সময় দিতে চায়। ঘুমায়, পড়ে, গান শোনে। কারো সাথেই মেশে না। কোনো ব্যস্ততা নয়, কোনো মিডিয়া সাক্ষাৎকার নয়। একা থাকে।
ছয়
মউ যখন একা, তখন বদলাতে থাকে হাওয়া। ওয়েব সিরিজের ট্রেন্ড এবার! মানুষের হাতে হাতে সিনেমা হল। হঠাৎ আসে ওয়েব সিরিজের অফার তার। নাম ‘রিটার্ন’। চরিত্র ‘কবিতা’, এক গৃহবধূ যে কবিতার ভাষায় নিজের নিঃশব্দ প্রতিবাদ করে। কবিতা চরিত্রটা একেবারে ভেতরে ঢুকে যায়। গাজীপুরের রিসোর্টে শুটিংয়ের প্রথম দিন সবার আগে হাজির হয় মউ। রিসোর্টে শুটিং চলাকালীন এক সহ-অভিনেতা বলেছিল,‘এই চরিত্রটা তুই না করলেই হত, ওভার ম্যাচ করতেছিস।’ মউ হেসে বলেছিল, ‘এই চরিত্রটা শুধু কবিতা না, এটা মধুমিতা।’ ওয়েব সিরিজ রিলিজ হতেই আলোচনায় আসে ‘কবিতা’ চরিত্রটি। তার পারফরম্যান্স দর্শকের হৃদয় ছুঁয়ে যায়। ফেসবুকে, ইউটিউবে, ব্লগে বলা হতে থাকে—‘নতুন করে চেনা এক মধুমিতা।’ মউ ও মধুমিতা—নামের দুই অংশই পরিচিতি পায়। যেন শুধু মউ-এ হচ্ছিল না মিডিয়ার। এক সাংবাদিক তাকে প্রশ্ন করলেন,‘তোমার এতো ব্যর্থতা, এত অপমান.
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: বল ছ ল র জন য র স মন অপম ন
এছাড়াও পড়ুন:
অবশেষে স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা গরু ফেরত দিলেন, দল থেকেও বহিষ্কার
ঝালকাঠির রাজাপুরে নার্গিস বেগম (২৫) নামে সেই গৃহবধূর গরু ফিরিয়ে দিয়েছেন অভিযুক্ত স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা বেল্লাল হোসেন খান। তবে গরু ফিরিয়ে দেওয়ার আগে একটি কাগজে ২৬ হাজার ৬শত টাকা পাওনা আছে বলে ওই নারীর কাছ থেকে সই নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এছাড়াও গরু ফিরিয়ে দেওয়ার সময় ওই নারীকে চড় থাপ্পড়ও মারা হয়।
বৃহস্পতিবার (১৫ মে) বিকেলে রাজাপুর শুক্তাগড় ইউনিয়নের কেওতা ঘিগরা মাদরাসায় এক সালিসি বৈঠকে গরুটি ফেরৎ দেওয়া হয়।
এদিকে এ ঘটনায় রাজাপুর উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক দল দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগ স্থায়ীভাবে দলের পদ থেকে বেল্লাল খানকে বহিষ্কার করেছে।
অভিযুক্ত বেল্লাল খান (৫৮) উপজেলার শুক্তাগড় ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের স্বেচ্ছাসেবক দলের সাংগঠনিক সম্পাদক। তবে তিনি নিজেকে ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক পরিচয় দিতেন।
রাজাপুর উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের আহ্বায়ক রতন দেবনাথ ও সদস্য সচিব আমিরুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে জানানো হয়, আপনি মো. বেল্লাল হোসেন খান রাজাপুর উপজেলার শুক্তাগড় ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের স্বেচ্ছাসেবক দলের সাংগঠনিক সম্পাদক। বিভিন্ন জাতীয় গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমরা অবগত হই যে, পাওনা টাকা আদায় করতে গিয়ে জনৈক আবু বক্করের ( ভুক্তভোগী নারী নার্গিস বেগমের স্বামী) পোষা গাভী (গরু) তার গোয়াল থেকে নিয়ে এসেছেন। যাহা বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। আমরা অত্যন্ত ব্যথিত হই। আপনার এই কর্মকাণ্ড কোন সভ্যসমাজের আচরণ হতে পারে না। যেহেতু আপনি জেনে শুনে এ ধরনের কাজে লিপ্ত হয়েছেন তাই দল আপনার বিরুদ্ধে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে সমস্ত পদ ও পদবী এবং দল থেকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করেছে।
স্থানীয়রা জানান, বৃহস্পতিবার বিকেলে রাজাপুর শুক্তাগড় ইউনিয়নের কেওতা ঘিগরা মাদরাসায় সালিসি বৈঠকে ভুক্তভোগী নারী নার্গিস বেগমের কাছ থেকে একটি কাগজে ২৬ হাজার ৬ শত টাকা পাওনা আছে বলে ওই নারীর কাছ থেকে সই নেওয়া হয়। পরে তার গরুটি ফেরৎ দেওয়া হয়।
এ সময় অভিযুক্ত বেল্লাল হোসেন খান ও উপজেলা বিএনপির সভাপতি আবুল কালাম আজাদের ভাতিজা নাজমুল হুদা ওরফে চমনসহ স্থানীয় বিএনপি'র নেতাকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।
এ বিষয়ে ভুক্তভোগী নারী নার্গিস বেগম বলেন, “আমি সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করায় সালিসি বৈঠকে উপস্থিত উপজেলা বিএনপির সভাপতি আবুল কালাম আজাদের ভাতিজা নাজমুল হুদা ওরফে চমন আমাকে থাপ্পড় মারেন। পরে জোরপূর্বক একটি সাদা কাগজে ২৬ হাজার ৬ শত টাকা পাওনা আছে বলে আমার কাছ থেকে সই নেওয়া হয়। পরে আমার গরুটি ফেরৎ দেওয়া হয়।”
অভিযুক্ত বেল্লাল হোসেন খান বলেন, “একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প থেকে আমি গ্রান্টার হয়ে নার্গিস বেগমের স্বামী আবু বক্করের জন্য ২০ হাজার টাকা ঋণ উত্তোলন করে দেই। সেই টাকা সুদে আসলে ৩০ হাজার টাকা হয়। সেই ঋণের জন্য কর্তৃপক্ষ আমাকে চাপ সৃষ্টি করে। তাই বাধ্য হয়ে গরুটি নিয়েছি। আজ (বৃহস্পতিবার) বিকেলে মুরুব্বীদের উপস্থিতিতে একটি সাদা কাগজে ২৬ হাজার ৬ শত টাকা পাওনা আছে বলে স্বাক্ষর রেখে গরু ফেরৎ দিয়েছি।”
গত বুধবার (১৫ মে) সকালে উপজেলার শুক্তাগড় ইউনিয়নের ঘিগড়া গ্রামের একটি মাঠ থেকে গরুটি নিয়ে যান বেল্লাল।
তিনি শুক্তাগড় ইউনিয়নের বামন খান গ্রামের আজিজ খানের ছেলে এবং একই ইউনিয়নের বাসিন্দা ও রাজাপুর উপজেলা বিএনপির সভাপতি আবুল কালামের আজাদের অনুসারী হিসেবে পরিচিত।
ভুক্তভোগী নার্গিস বেগম শুক্তাগড় ইউনিয়নের ঘিগড়া গ্রামের আবু বক্করের স্ত্রী। আবু বক্কর আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকায় গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে আত্মগোপনে রয়েছেন। গরুটি ফেরত পেতে বৃহস্পতিবার সকালে গরুর বাছুর নিয়ে ঝালকাঠির আদালতপাড়ায় হাজির হন নার্গিস বেগম। সকালে ঝালকাঠির আদালতপাড়ায় অবস্থিত বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী স্কুলের দ্বিতীয় তলায় একজন আইনজীবীর চেম্বারের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন নার্গিস বেগম। এ সময় তার সঙ্গে শিশুসন্তানসহ গরুর বাছুরটি ছিল। নার্গিসের শিশুসন্তানটিকে বাছুরটি ধরে কান্না করতে দেখা যায়।
নার্গিস বেগমের অভিযোগ, “স্বামী আওয়ামী লীগের রাজনীতি করায় বেল্লাল ২০ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করে আসছে। চাঁদা না পেয়ে গরুটি নিয়ে গেছে। গরুর বাছুরটি মাকে হারিয়ে নিশ্চুপ হয়ে গেছে।”
রাজাপুর উপজেলা বিএনপির সভাপতি আবুল কালাম আজাদ বলেন, “বিষয়টি নিয়ে একটি সুষ্ঠু সমাধান হয়েছে এটাই সবচেয়ে বড় বিষয়।”
রাজাপুর উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের আহ্বায়ক রতন দেবনাথ বলেন, “দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে বেল্লাল হোসেন খানকে বহিষ্কার করা হয়েছে। তিনি যে ঘটনা ঘটিয়েছেন তা দলের জন্য লজ্জার।”
ঢাকা/অলোক/টিপু