Samakal:
2025-11-03@09:48:14 GMT

সন্ধ্যাতারা আবার শুকতারা

Published: 15th, May 2025 GMT

সন্ধ্যাতারা আবার শুকতারা

ঢাকার আলো-আঁধারি রাতে যখন সিনেমার পোস্টারগুলোর রঙ ম্লান হয়ে যায়, ব্যর্থ নায়িকাদের চোখে তখন সেইটুকু আশার আলোও জ্বলে না। তবে মধুমিতা মউ ব্যতিক্রম। সে বারবার হেরেছে, বারবার পুড়েছে; কিন্তু হাল ছাড়েনি। মফস্বলের ছোট শহরে বেড়ে ওঠা মউ সিনেমা বলতে জানতো শুধু হলের পর্দায় ঝাঁ চকচকে নায়ক-নায়িকাদের দেখা। কিন্তু সিনেমা নিয়ে তাঁর অনুভব ছিল তার চেয়েও বড় কিছু, একটা ঘোর, একটা তৃষ্ণা, একটা স্বপ্ন। ছোটবেলায় আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সংলাপ বলতে বলতে কখন যে বাস্তবকে আড়াল করে স্বপ্নে ঢুকে পড়ত! পরবর্তীকালে সেই স্বপ্নের পথ পুষ্প শোভিত ছিল না, ছিল কাঁটা, অবহেলা, সন্দেহ আর অপমান।
দুই 
শুরুটা ছিল একেবারেই একা। পরিবার মানতে পারেনি মেয়ের এই পাগলামো। মা চোখের পানি ফেলে বলতেন, ‘এই পথে গেলে মেয়েরা ফিরে আসতে পারে না।’ কোথা থেকে ফিরতে পারে না বুঝতে পারে না মউ। মায়ের স্বপ্ন মেয়ে হবে ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার। ‘তুই সিনেমায় যাবি?’ বাবার কণ্ঠে স্পষ্ট তাচ্ছিল্য। বাবার কণ্ঠ ছিল কড়া, ‘চলচ্চিত্র মানেই চরিত্রহীনতা।’ কিন্তু মউ নিজেকে জানত। সে জানত, তার মন অন্য কিছু চায় না। এরপর পড়াশোনার সুবাদে ঢাকায় চলে আসা। এক বান্ধবীর ফ্ল্যাটে কিছুদিন থাকে, তারপর মেসে উঠে। দিনের বেলায় অডিশনে দৌড়, রাতের বেলায় একমুঠো ডাল-ভাত আর অনিশ্চয়তার ঘুম। 
তিন 
শুরুতে অডিশনে গিয়ে দাঁড়াতো বিশাল লম্বা লাইনে। একবার এক প্রযোজক সরাসরি বলে দিয়েছিল, ‘তোমার ফিগারটা ঠিক করো, তারপর এসো।’ আরেকজন বলেছিল,‘তোমার চেহারায় হিরোইনসুলভ কিছু নেই।’ সেদিন রাতে ফিরে এসে একা বিছানায় বসে নিজেকে আয়নায় দেখেছিল। ধবধবে রঙ না হলে, কোমর চিকন না হলে, ঠোঁট ভরাট না হলে—অভিনয় কি হবে না? অভিনয় কি শুধু শরীরের ওপর নির্ভর করে? কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছিল। পরদিন আবার অডিশনে যায়। কারো কাছে নিজেকে প্রমাণ করার জন্য নয়, নিজের ইচ্ছাটাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য। তবে মউ জানতো, অভিনয় তার রক্তে। ক্লাস সেভেনে স্কুল নাটকে এক নারী চরিত্রে অভিনয় করার পর থেকেই সে জানে, বড় পর্দার মঞ্চের আলো তাকে ডাকছে। সেদিন উপস্থিত দর্শকদের অনেকেই তাই বলেছিলেন। একদিন হঠাৎ এক অডিশনে গিয়ে এক প্রখ্যাত নির্মাতার চোখে পড়লো সে। স্ক্রিপ্ট ধরিয়ে দিয়ে পরিচালক বললেন,‘তোমাকে দিয়েই এই চরিত্রটা হবে। তুমি তৈরি তো?’ যেন স্বাগত উক্তির বেড়াজালে জড়িয়ে মউ; এই হয়ে এলো, হয়ে যাচ্ছে, পালকের মতো হালকা হয়ে পাহাড় চূড়া থেকে স্বপ্নটা নিচে পড়ছে মুহুর্তেই। বাতাসের তোড়জোড় নেই সেখানে, বাধাহীন। কিন্তু পালক ভেসে বেড়ায় এদিকওদিক। ‘আমি চেষ্টা করব’—লাজুক গলায় বলেছিল সে। সেবার ছিল ‘আলো এসে গেল’ একটি আর্ট ফিল্ম। চরিত্র ছিল নির্যাতিত এক নারীর। মউ নিজের সর্বস্ব ঢেলে দিয়েছিল অভিনয়ে। কিন্তু রিলিজের আগে শেষ মুহূর্তে ঢুকে পড়ল একটি ‘আইটেম গান’। গানটি ফিল্মের চরিত্রের সাথে যাচ্ছিল না। মউ বুঝতে পারে। ‘তোমাকে করতে হবে মউ, প্রযোজক চাচ্ছেন।’ বলে পরিচালক। ‘কিন্তু গল্পে তো এটা ছিল না, স্যার।’ জানায় মউ। ‘এই ইন্ডাস্ট্রিতে আমাকে কেউ না বলে না, বুঝলে?’ তিরস্কার করে পরিচালক। ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে ড্রেসটা হাতে নিয়ে কেঁদে ফেলেছিল সে। কে কবে দেখেছে—নায়িকা শুটিং সেটে ড্রেস ধরে কাঁদে? তবু করেছিল, কারণ কাজ থামালে, ‘নাটক করলেও’ কেউ ডাকবে না—এই ভয় ছিল। যা ভেবেছিল তাই! গানটির জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক নিন্দিত হয়েছিল মউ। তারপর একে একে সিনেমা। কিন্তু যুত মতো হয় না। একবার নয়, বারবার ঠকেছে। এক সিনেমায় তাকে ‘হিরোইন’ বলা হয়েছিল। শুটিংয়ে গিয়ে দেখে গল্পে আরেক নায়িকাও আছে। আবার আরেকটি সিনেমায় গানটিই কেটে দেওয়া হয়েছে। এমনও হয়েছে, সিনেমা রিলিজ হয়নি; প্রযোজক পালিয়ে গেছে। ‘তুই এইসব করে কতদিন টিকবি মউ?’—এক সহ-অভিনেত্রী বলেছিল একবার। সে শুধু মুচকি হেসে বলেছিল, ‘সন্ধ্যাতারা আর শুকতারা একই, কিন্তু সেটা যারা জানে না তারা জানেই না ।’ এমন রহস্যময় উত্তরে কী বলবে বুঝতে পারে না সহ-অভিনেত্রী। কিন্তু ভেতরে একসময় ফাটল ধরতে শুরু করলো তার। ‘তোমার চরিত্রে এই গল্পটা নেই, কিন্তু শুটিংয়ে ঢুকেছে। দর্শক খাবে।’—এই লাইনটা মউ যতবার শুনেছে, ততবার তার আত্মবিশ্বাস একটু একটু করে মরেছে। একটি সিনেমার চুক্তিপত্রে গল্পের প্রসঙ্গ লেখা ছিল, একজন সংগ্রামী মেয়ের চরিত্র, যাকে মউ নিজের সঙ্গে মিলিয়ে নিতে পেরেছিল। 
কিন্তু শুটিংয়ে গিয়ে দেখে, দৃশ্য পাল্টে গেছে। তার ভূমিকা হয়ে গেছে নায়ককে প্রশ্নবিদ্ধ আবেদন এক্সপ্রেশনে পছন্দ করানো এক মোহময়ী নারী। স্ক্রিপ্টে ছিল না এমন কোনো দৃশ্য, যেগুলো হঠাৎ জুড়ে দেওয়া হয়েছে। পরিচালকের মুখে ছিল একটাই কথা,‘তুমি পারফর্ম করতে পারলেই দর্শক খাবে।’ সেই ‘পারফর্ম’ অভিনয়জনিত না, শরীরপরায়ণ! একটি দৃশ্যের কথা ছিল না, কিন্তু হুট করে তাকে বলা হয়, ‘এই গানে তোমাকে একটু সাহসী সাজতে হবে।’ সে অপারগতা জানালে বলা হয়, ‘ডিরেক্টরের চাওয়া। তুমি কি ছাড়তে চাও কাজটা?’ কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসে মউয়ের। ফ্লোরে তখন আলো জ্বলছে, ক্যামেরা ঘুরছে, আর সে পোশাক হাতে দাঁড়িয়ে। এইভাবে আরও একাধিক সিনেমার পেছনের গল্পটা প্রতারণার। তাকে প্রমিস করা হয়েছিল মুখ্য চরিত্র, কিন্তু পোস্টারে নামটাও থাকে না। কোনো সিনেমায় দেখা গেছে, তার গান সিনেমা থেকে বাদ পড়ে গেছে, কারণ নায়ক চাননি। প্রতিবার প্রতারণা, প্রতিবার অপমান। অথচ কেউ বুঝত না, প্রতিবার ঘরে ফিরে সে কাঁদত, ঘুম ভেঙে হতাশায় চিৎকার করে উঠত, ফোনের দিকে তাকিয়ে ভাবত—‘আর কী থাকবে এই হাতে?’ তবু অভিনয় ছাড়েনি। 
চার 
আসবার কথা তার সাফল্য, অথচ আসে করোনা মহামারি। যেন তার সমস্ত ক্লান্তি  ও মনোবেদনার ওপর মহামারির চাদর প্যাঁচিয়ে যায়। হঠাৎ করে সব থেমে যায়। মউ কিছুটা নিঃশ্বাস নিতে পারেন। কিছু যদি আর স্বাভাবিক না হয়, আর না হয় অভিনয়ই না করলেন, এই ভাবনাটা হঠাৎ বেশ ভালো লাগতে থাকে। লকডাউন, থেমে যাওয়া ক্যামেরা, বন্ধ স্টুডিও! মউ একা থাকত একটি ভাড়া বাসায়। চারদিকে নিস্তব্ধতা। ফোন বাজে না, প্রস্তাব আসে না। ‘আমি কি সত্যিই শেষ?’—রাতে আয়নায় তাকিয়ে নিজেকে প্রশ্ন করত। তবে মাঝেমধ্যে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ডায়লগ দিত : 
‘মা, আমি ভালো আছি। আমি এখন সিনেমার নায়িকা!’
বলেই হেসে ফেলত, আর পরক্ষণেই ভেঙে পড়ত কান্নায়।
টানা কয়েক মাস ঘরবন্দি। আয়-রোজগার থেমে যায়, ফোন বাজে না, মেসেঞ্জারে একটাও কাজের মেসেজ আসে না। এক রাতে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে বলে,‘তুই কি হেরে গেছিস? শঠতার কাছে, করোনার কাছে?’
পাঁচ 
করোনার পর এক নাট্যনির্মাতা তাকে ফোন দিলেন, ‘একটা চরিত্র আছে, একটু সাদামাটা, গৃহবধূ। করবা?’ ‘করব’— মউ বলল। এভাবেই শুরু হলো নাটকে মউয়ের যাত্রা। আপাতত নাটকে সে নিজেকে খুঁজে পেল, তবে মন পড়ে রইলো সিনেমায়। তবুও সে জানত, আর সিনেমায় ফিরে যাওয়া মানেই সেই নোংরামি, সেই ভয়াবহ অভিজ্ঞতা। একদিন  ফোন এলো নামকরা নির্মাতা খালেক আফসারের কাছ থেকে। ‘তোমার জন্য গান আছে—মধু কই কই বিষ খাওয়াইলা।’ মউ দ্বিধায় ছিল, তবু করল। সিনেমা রিলিজ হলো। গানটা হিট, কিন্তু বিতর্কও উঠল। পরিচালক যেভাবে সিনেমায় উপস্থাপন করেছিলেন মউকে, তা দেখে দর্শক কী বলবে সে নিজেই লজ্জায় ডুবে গিয়েছিল। ‘আমি শুধু নিজেকে পরিচিত করতে চেয়েছিলাম, অপমানিত নয়,’—এক সাক্ষাৎকারে বলেছিল মউ। এই সিনেমা তার আত্মবিশ্বাসে চূড়ান্ত আঘাত হানে। মউ সিদ্ধান্ত নেয়, সিনেমা থেকে নিজেকে সরিয়ে নেবে। কিন্তু পারে না। আহারে জীবন! এর দু’বছর পর আসে অফার—‘আহারে জীবন’। চরিত্র এক বিধবা নারীর, যে সমাজের চোখ রাঙানির মধ্যেও নিজের ইচ্ছাকে বাঁচিয়ে রাখে।‘এই চরিত্র আমি করব, কারণ এটা আমার অদম্য ইচ্ছার গল্প’—মউ বলেছিল। সেটে এক দৃশ্যে তার কাঁদার কথা ছিল। ক্যামেরা অফ হয়ে গেছে, তবুও মউ কাঁদছে। পরিচালক বললেন,‘কাট তো হয়ে গেছে! তুই এখনো কাঁদছিস কেন?’ ‘এই কান্না তো কাট বোঝে না, স্যার’—মউ ফিসফিস করে বলে। এই সিনেমায় অভিনয়ের পর অনেকেই বলেছিল, ‘মউ ফিরল।’ কিন্তু মউ বলেছিল,‘আমি ফিরিনি, আমি এই শহরেই ছিলাম, শুধু আমাকে কেউ ডাকেনি।’ এভাবে যখন মনে হচ্ছিল সব শেষ, তখন শুরু করালো ‘আহারে জীবন’। গল্প পড়েই স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল মউ। যেন নিজেরই জীবনী। রাইটার জানলো কেমন করে? সেই সিনেমায় মউ শুধু অভিনয় করেনি, নিজের ভেতরটা উজাড় করে দিয়েছিল। কিন্তু কোনো এক অজ্ঞাত কারণে এই সিনেমার শুটিং শেষ করেই মউ নিজেকে গুটিয়ে নেয়। সে আর কোথাও নেই। না নাটকে, না সিনেমায়। নিজেকে সময় দিতে চায়। ঘুমায়, পড়ে, গান শোনে। কারো সাথেই মেশে না। কোনো ব্যস্ততা নয়, কোনো মিডিয়া সাক্ষাৎকার নয়। একা থাকে। 
ছয় 
মউ যখন একা, তখন বদলাতে থাকে হাওয়া। ওয়েব সিরিজের ট্রেন্ড এবার! মানুষের হাতে হাতে সিনেমা হল। হঠাৎ আসে ওয়েব সিরিজের অফার তার। নাম ‘রিটার্ন’। চরিত্র ‘কবিতা’, এক গৃহবধূ যে কবিতার ভাষায় নিজের নিঃশব্দ প্রতিবাদ করে। কবিতা চরিত্রটা একেবারে ভেতরে ঢুকে যায়। গাজীপুরের রিসোর্টে শুটিংয়ের প্রথম দিন সবার আগে হাজির হয় মউ। রিসোর্টে শুটিং চলাকালীন এক সহ-অভিনেতা বলেছিল,‘এই চরিত্রটা তুই না করলেই হত, ওভার ম্যাচ করতেছিস।’ মউ হেসে বলেছিল, ‘এই চরিত্রটা শুধু কবিতা না, এটা মধুমিতা।’ ওয়েব সিরিজ রিলিজ হতেই আলোচনায় আসে ‘কবিতা’ চরিত্রটি। তার পারফরম্যান্স দর্শকের হৃদয় ছুঁয়ে যায়। ফেসবুকে, ইউটিউবে, ব্লগে বলা হতে থাকে—‘নতুন করে চেনা এক মধুমিতা।’ মউ ও মধুমিতা—নামের দুই অংশই পরিচিতি পায়। যেন শুধু মউ-এ হচ্ছিল না মিডিয়ার। এক সাংবাদিক তাকে  প্রশ্ন করলেন,‘তোমার এতো ব্যর্থতা, এত অপমান.

.. কীভাবে টিকে আছো?’ মউ একটু হেসে বলেছিল, ‘আমি না থাকলে কেউ জানত না বার বার হেরে যাওয়া দেখতে কেমন।’ মউ জানে, জয় সবসময় পোস্টারে হয় না, জয় হয় নিজেকে টিকিয়ে রাখার ক্ষমতায়। v
 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: বল ছ ল র জন য র স মন অপম ন

এছাড়াও পড়ুন:

দোষ বিয়ারিং প্যাডের নয়, যারা লাগিয়েছে কিংবা বুঝে নিয়েছে, তাদের: ডিএমটিসিএল এমডি

মেট্রোরেল চালুর আগে নিরাপত্তার পূর্ণাঙ্গ নিরীক্ষা (সেফটি অডিট) ছাড়াই যাত্রা শুরু হয়েছিল ঢাকার মেট্রোরেলের। এর মধ্যে বিয়ারিং প্যাড নিচে পড়ে একজন পথচারী মারা গেছেন। এবার নতুন করে নিরাপত্তার নিরীক্ষা করার উদ্যোগ নিয়েছে ঢাকা মাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল)।

বিয়ারিং প্যাড পড়ে পথচারীর মৃত্যুর এক সপ্তাহ পর আজ সোমবার সকালে উত্তরার দিয়াবাড়িতে মেট্রোরেলের প্রধান কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ফারুক আহমেদ। তিনি বলেন, ‘মেট্রোরেলের আগে সেফটি অডিট হয়নি। তাই সেফটি অডিট করতে চাইছি। যত দ্রুত করা যায়, সেটা আমরা করব। থার্ড পার্টিকে (তৃতীয় পক্ষ) দিয়ে এই অডিট করানো হবে। ইউরোপীয় কোনো প্রতিষ্ঠান দিয়েই করানো হবে। আমাদের কাছে ফ্রান্সের দুটি প্রতিষ্ঠান আবেদন করেছে। সেফটি অডিট করার জন্য আমরা খুব শিগগির টেন্ডারের প্রক্রিয়ায় যাব।’

এক বছর আগে ঢাকার মেট্রোরেলের স্তম্ভের একটি বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ার পর গত ২৬ অক্টোবর ফার্মগেটে আরেকটি বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ে এক পথচারীর মৃত্যু হয়। এরপর ২৪ ঘণ্টার বেশি সময় শাহবাগ থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত মেট্রোরেল চলাচল বন্ধ ছিল।

বিয়ারিং প্যাড পড়ে যাওয়ার পর এগুলোর নিরাপত্তা সম্পর্কে জানতে চাইলে ডিএমটিসিএলের এমডি বলেন, ‘বিয়ারিং প্যাড হঠাৎ করে পড়ে যায়নি। এটা হঠাৎ করে পড়ে যাওয়ার জিনিস নয়। যেহেতু এটা নিয়ে তদন্ত চলছে, ফলে এ বিষয়ে আমি জাজমেন্টাল হতে চাই না। তবে যেটা হতে পারে, সেটা বলতে পারি, ডিজাইন ফল্ট হতে পারে। যে জিনিসের ওপর বসানোর কথা বলা হয়েছিল, যা যা দেওয়ার কথা ছিল, সেটা বসানো হয়নি। যে ডিজাইনে হওয়ার কথা ছিল, সেটা হয়তো ঠিকাদার করেনি। যে পরামর্শককে বুঝে নেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, তারা হয়তো ঠিক করে জিনিসটা বুঝে নেয়নি। এই চারটা কারণে হতে পারে অথবা এর মধ্যে কোনো একটা কারণেও হতে পারে।’

ফারুক আহমেদ আরও বলেন, ‘দোষ কিন্তু বিয়ারিংয়ের নয়। বিয়ারিং যে লাগিয়েছে, সেটি বাজেভাবে লাগানো হয়েছে কি না? যার আসলে বুঝে নেওয়ার দায়িত্ব ছিল, সে বুঝে নিয়েছে কি না, সেগুলো এখন দেখতে হবে।’

আরও পড়ুনবৃষ্টির পানি ঢোকে, এসি বিকল হয়, মেট্রোরেল ব্যবস্থায় ৪৫ সমস্যা০২ নভেম্বর ২০২৫

এসব কাজ বুঝে নেওয়ার জন্য হাজার কোটি টাকায় বিদেশি পরামর্শক নিয়োগ করা আছে জানিয়ে ফারুক আহমেদ বলেন, ‘প্রথম ঠিকাদারের কাছ থেকে বুঝে নেবেন পরামর্শক। আমাদের বুঝিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব পরামর্শকদের। তখন এই কাজগুলো কিছুটা তাড়াহুড়া হয়েছে। কেন হয়েছে, সেটার উত্তর তো আমি দিতে পারব না। যেখানে দুর্ঘটনা ঘটেছিল, সেই অংশে অনেক ডিফেক্ট আছে। ফলে সেটা এখনো আমরা বুঝে নিইনি।’

ডিএমটিসিএলের এমডি বলেন, যেখানে বিয়ারিং প্যাড পড়ে গিয়েছিল, ওই অংশের ত্রুটি সারিয়ে দেওয়ার সময়সীমা (ডিফেক্ট লায়াবেলিটি) গত জুন পর্যন্ত ছিল। কিন্তু ডিএমটিসিএল তাদের এই সময়সীমা গ্রহণ করেনি। কারণ, এখনো অনেক বড় ত্রুটি রয়ে গেছে। যত সমস্যা আছে, এগুলো ঠিকাদারকে মেরামত করতে হবে। এ জন্য ‘ডিফেক্ট লায়াবেলিটি’ দুই বছর বাড়ানোর জন্য ঠিকাদারকে বলা হয়েছে।

দুর্ঘটনার পর মেট্রোরেলের সব কটি পিলার পরিদর্শন ও পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে জানিয়ে ফারুক আহমেদ বলেন, এর আগে পুরো পথের বিয়ারিং প্যাডের ছবি ড্রোন ক্যামেরা দিয়ে তোলা হয়েছে। এরপর কর্মকর্তারা সরেজমিনে নিরীক্ষা করেছেন। যেসব স্থানে ত্রুটি শনাক্ত করা হয়েছে, সেগুলোর বিষয়ে পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে জানানো হয়েছে। ডিএমটিসিএলের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হলো, যেখানে ত্রুটি বা সমস্যা পাওয়া যাবে, সেখানে বিয়ারিং প্যাড অবশ্যই পরিবর্তন করা হবে।

আরও পড়ুনমেট্রোরেলের বিয়ারিং প্যাড কী, খুলে পড়ার কারণ কী হতে পারে২৬ অক্টোবর ২০২৫

চার বছর আগে তাড়াহুড়া করে ঢাকার মেট্রোরেল চালু করা হয়েছিল দাবি করে ফারুক আহমেদ বলেন, প্রকল্পটি চালুর আগে ন্যূনতম ছয় থেকে নয় মাসের পরীক্ষামূলক চলাচল নিশ্চিত করার প্রয়োজন ছিল। তিন বছরে মেট্রোরেল চালু হবে বা পাঁচ বছরে মেট্রোরেল সম্পূর্ণ হবে—এ ধরনের ধারণা আসলে ভুল। কোনো মেট্রোরেল নির্মাণের জন্য সব ঠিকাদার নিয়োগ দেওয়ার পর ছয় থেকে সাত বছর লাগে। এর আগে প্রকল্প প্রণয়ন, সম্ভাব্যতা যাচাই ও অন্যান্য প্রস্তুতিতে চলে যায় তিন বছর।

২০৩০ সালের মধ্যে ঢাকায় ছয়টি মেট্রোরেল লাইন নির্মাণের যে লক্ষ্যমাত্রা আগে নেওয়া হয়েছিল, তা কিসের ভিত্তিতে হয়েছে, তা তার বোধগম্য নয় বলে মন্তব্য করেন ডিএমটিসিএলের এমডি।

নতুন মেট্রোরেল লাইন নির্মাণ প্রকল্প তাহলে মুখ থুবড়ে পড়ছে কি না, এমন প্রশ্ন করা হলে ফারুক আহমেদ বলেন, ‘মেট্রোরেল প্রকল্প মুখ থুবড়ে পড়েনি। মেট্রোরেল আমাদের লাগবে। আমাদের লক্ষ্য হলো, দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যেন এই প্রকল্পের ঋণ পরিশোধ করতে সক্ষম হয়। সরকারের উদ্দেশ্য হলো একটি প্রতিযোগিতামূলক বাজার তৈরি করা, যাতে একাধিক প্রতিষ্ঠান অংশ নিতে পারে এবং কম খরচে উন্নত মানের মেট্রোরেল নির্মাণ সম্ভব হয়। মেট্রোরেল আমাদের করতেই হবে; তবে তা হবে স্মার্ট ফাইন্যান্সিংয়ের মাধ্যমে।’

আরও পড়ুনবিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ে ফার্মগেটে একজন নিহত, মেট্রোরেল চলাচল বন্ধ ২৬ অক্টোবর ২০২৫

সম্পর্কিত নিবন্ধ