খুনির শাস্তি চাই, শাস্তি চাই অগ্নিসংযোগকারী-লুটপাটকারীর
Published: 31st, May 2025 GMT
২৭ মে গিয়েছিলাম যশোর জেলার অভয়নগর উপজেলার ডহর মশিয়াহাটি গ্রামে। ২২ মে ২০২৫, ওই গ্রামে তরিকুল ইসলাম নামের বিএনপির নেতা সনাতন ধর্মাবলম্বী মতুয়া সম্প্রদায়ের এক ব্যক্তির বাড়িতে নির্মমভাবে খুন হন। তিনি অভয়নগর উপজেলার নওয়াপাড়া পৌর কৃষক দলের সভাপতি ছিলেন। তাঁর খুন হওয়ার খবর পেয়ে ওই এলাকায় শত শত মানুষ জমায়েত হন এবং মতুয়া সম্প্রদায়ের ১৮টি বাড়িতে লুটপাট করেন এবং অগ্নিসংযোগ করেন। এ ছাড়া পার্শ্ববর্তী বাজারে কয়েকটি দোকানে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেন।
ডহর মশিয়াহাটি গ্রামে পাকা সড়ক–সংলগ্ন পুড়ে যাওয়া বাড়িগুলোতে যখন প্রবেশ করি, তখন তীব্র পোড়া গন্ধ টের পাওয়া যাচ্ছিল। পোড়া বাড়িতে প্রবেশ করতেই দেখি, আধপোড়া কাপড়ের স্তূপ, পুড়ে যাওয়া আসবাব, মোটরসাইকেল, রান্নার ব্যবহার্য জিনিসপত্রসহ অনেক কিছু।
প্রথমে বাড়িতে প্রবেশ করে পেলাম উষা বিশ্বাস নামের সেই ঘরের বয়স্ক এক বাসিন্দাকে। ঘরের বারান্দায় বসে থাকা উষার চোখেমুখে গভীর দুশ্চিন্তার ছাপ। তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছিল সেদিন? তিনি ২২ মে হামলার ঘটনার বর্ণনা দিলেন। আগুন থেকে একটি ঘর রক্ষা পেলেও সেটিও লুটপাট হয়। হামলাকারীদের বাধা দিতে গেলে তারা তাঁকে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করে।
উষার ছেলের বউ রেখা বিশ্বাস আগুন দেওয়ার সময় বাড়ির পাশে ছিলেন। তিনি জানালেন, উত্তেজিত জনতাকে বলতে শুনেছেন, ‘মাইরে ফেলায় দেব, কাইটে ফেলায় দেব, আগুন লাগায় দেব।’ রেখার ছেলেরও বিয়ে হয়েছে, কয়েক মাস আগে। তিনি জানান, ছেলের বিয়ের সময় বানানো কয়েক ভরি গয়না ও বিয়েতে পাওয়া সেলাই মেশিন পাওয়া যায়নি। পানি সেচ দেওয়ার দুটি মোটর ছিল, সেগুলো পুড়ে গেছে।
পাশের বাড়ি পান্না বিশ্বাসের। কয়েকজন নারীসহ তিনি বসেছিলেন। তাঁদের সঙ্গে কথা হলো। পান্না বললেন, তাঁর কলেজপড়ুয়া মেয়ে এবং স্কুলপড়ুয়া ছেলে বাড়িতে ছিল। যখন একটি কক্ষে লুটপাট শুরু হয়, তখন তাঁরা পাশের কক্ষ ভেতর থেকে আটকে দিয়ে খাটের নিচে আত্মগোপন করে ছিলেন। বাড়িতে আগুন দিলে প্রাণ নিয়ে তাঁরা বেরিয়ে এসেছিলেন। বাচ্চা আগুনে পুড়ে যাচ্ছে কি না, এই ভয়ে তিনি চিৎকার করে কান্নাকাটি করেছেন। আগুন লাগার পর কোনোরকমে দরজা ঠেলে তাঁরা বের হতে পেরেছেন। সেদিনের পরিস্থিতির পর তাঁর ছেলে এখন কারও সঙ্গে কথা বলছেন না। কেউ ডাকলে কেবল তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকছেন। মেয়েটিকে তার বান্ধবীরা নিয়ে গেছে। তার মন ভালো করার চেষ্টা করছে।
হামলার দিন গ্রামের যে বাড়িতে তিন দিনব্যাপী যজ্ঞানুষ্ঠান হচ্ছিল, সেই বাড়িতে প্রবেশ করে দেখি, রান্নার সবজি, বড় বড় পাতিল পড়ে আছে। পাশেই অনেকগুলো ডঙ্কা (বাদ্যযন্ত্র), ডঙ্কার পাশে পড়ে আছে পোড়া মোটরসাইকেল, কয়েকটি বাইসাইকেল। সে বাড়ির এক নারী বললেন, ‘মারটা আমাকে মাইরেছে বেশি। চ্যাপ্টা খুন্তি দিয়ে মাইরেছে।’ অনুষ্ঠানে আসা কয়েকজন মার খেয়েছেন। সেখানে কয়েক শ মানুষের রান্না হয়েছিল। মারপিট-লুটপাট-অগ্নিসংযোগে যজ্ঞানুষ্ঠান পণ্ড হয়।
উপস্থিত একজন জানাচ্ছিলেন, ফায়ার সার্ভিসের লোকজন প্রস্তুতি নিয়ে এক পথে আসার চেষ্টা করেছিলেন, পারেননি। তাঁদের পথে আটকে দেওয়া হয়েছিল। পরে তাঁরা বিকল্প পথে অনেকখানি ঘুরে এসেছেন।
ক্ষতিগ্রস্ত প্রতি পরিবার সরকারি সহায়তা পেয়েছে ৩০ কেজি চাল, ২ বান্ডিল টিন, ৬ হাজার টাকা, ২ করে কম্বল। বেসরকারি কিছু সহায়তা মিলেছে। বাড়িতে অনেকে থাকতে পারছেন না। থাকার অবস্থা হয়নি। আবার তাঁদের ভয়ও করছে। অনেকের পরনের পোশাক ছাড়া আর কিছুই নেই। পান্না বিশ্বাস বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোট ও সপ্তসারথী ফাউন্ডেশন থেকে চাল-তেল-ডাল-সবজি দিয়ে গেছে। কিন্তু রাঁধব কোথায়, রান্নার পাত্র কোথায়?’
পান্না বিশ্বাসের বাড়ির পাশের বাড়িতে দেখলাম, একজন নারী বিষণ্ন মনে বসে আছেন। সবকিছু পুড়ে তাঁরা নিঃস্ব। তাঁদের ৪০ মণ ধান ছড়ানো অবস্থায় পড়ে আছে। করুণ দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে আছেন।
তরিকুল ইসলামকে খুন করা হয়েছে। যে খুন করেছে, তার সর্বোচ্চ শাস্তি হতে হবে। তরিকুল ইসলাম যেহেতু বিএনপির নেতা, সেহেতু বাংলাদেশের বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে বলতে পারি, এখন তাঁর খুনিদের খুঁজে বের করা সহজ হবে এবং শাস্তি দেওয়া হবে। এটা আমরা চাই। মতুয়া সম্প্রদায়ের যাঁদের সঙ্গে কথা হয়েছে, তাঁরাও খুনের বিচার চান। সম্প্রদায় বিবেচনায় নয়, মানুষ হিসেবে এ খুনের বিচার না চাওয়ার কোনো কারণ নেই। তরিকুল ইসলামের পরিবারের প্রতি সহানুভূতিশীল না হয়ে খুনের বিচার না চেয়ে মতুয়া সম্প্রদায়ের বাড়িতে যারা অগ্নিসংযোগ করেছে, লুটপাট করেছে, তারা আর প্রকাশ্যে বিচার চাইতে পারবে কি? কারণ, তারা খুনের প্রতিবাদ করতে গিয়ে আরেক অপরাধ করেছে।
প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে হামলা বা হানাহানি কোনোভাবেই কাম্য নয়। কিন্তু সম্প্রদায় বিবেচনা করে যদি সেই হামলা হয়, তা আরও বেশি মেনে নেওয়া যায় না। এটিও তখন হয়ে পড়ে আমাদের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ওপর আঘাত। সেই আঘাতের ক্ষত সহজে
সারে না। আমি রংপুরের তারাগঞ্জে ঠাকুরবাড়িতে, রংপুরের পীরগঞ্জে জেলেপাড়ায় এবং গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে সাঁওতালপল্লিতে আগুন দেওয়ার পরবর্তী ভুক্তভোগীদের কাছে থেকে দেখেছি। তাঁরা স্বাভাবিক হতে দীর্ঘদিন লেগেছে।
এসব পাল্টাপাল্টি হামলার ঘটনা থেকে বেরিয়ে আসতে মানুষের শুভবুদ্ধির উদয় হওয়া ছাড়া উপায় নেই। আর আইনের কঠোর প্রয়োগ তো হতেই হবে। তরিকুল ইসলামের খুনিদের দ্রুত গ্রেপ্তারপূর্বক শাস্তির আওতায় আনা হোক, যারা লুটপাট, অগ্নিসংযোগ করেছে, তাদেরও বিচার হোক।
● তুহিন ওয়াদুদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক
* মতামত লেখকের নিজস্ব
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ল টপ ট
এছাড়াও পড়ুন:
৫০ শয্যার থানচি হাসপাতাল চলছে একজন চিকিৎসকে
বান্দরবানের থানচি উপজেলার প্রায় ৩০ হাজার মানুষের একমাত্র ভরসার জায়গা ৫০ শয্যার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসক, নার্স ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির সংকটে এই হাসপাতাল কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। বর্তমানে পুরো হাসপাতাল চালাচ্ছেন মাত্র একজন চিকিৎসক। গত পাঁচবছরে চিকিৎসাধীন ও রেফার্ড করা ২৪ জন রোগী মারা গেছেন।
হাসপাতাল সূত্র জানায়, ১৯৯৫ সালে ৩১ শয্যার থানচি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স যাত্রা শুরু করে। পরে এটি ৫০ শয্যায় উন্নীত হয়। এই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১২ জন চিকিৎসক থাকার কথা থাকলেও কর্মরত আছেন মাত্র দুইজন। তাদের মধ্যে একজন ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন। এ কারণে রোগীদের সেবা দিতে পারছেন না। ১৮ জন নার্স পদে রয়েছেন মাত্র চারজন। চারজন মিডওয়াইফ থাকার কথা, নেই একজনও।
আরো পড়ুন:
ফরিদপুরে পাগলা ঘোড়ার কামড়ে আহত ২০
বক্তব্য দেওয়ার সময় অসুস্থ হয়ে পড়লেন কাদের সিদ্দিকী
প্রাথমিক থেকে শুরু করে জরুরি চিকিৎসার জন্য এই হাসপাতালে ছুটে যান পাহাড়ি ও বাঙালিরা। তাদের অভিযোগ, হাসপাতালটি ৫০ শয্যায় উন্নীত হলেও আধুনিক চিকিৎসা সুবিধা যোগ হয়নি। প্রয়োজনীয় সংখ্যক চিকিৎসক না থাকায় গর্ভবতী নারী, শিশু ও বৃদ্ধ রোগীরা সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়ছেন।
দুর্গম এলাকার রোগীরা অনেক সময় নদীপথ কিংবা পাহাড়ি রাস্তা পাড়ি দিয়ে হাসপাতালে এলেও কাঙ্ক্ষিত চিকিৎসা সেবা পান না। বরং তাদের বান্দরবান সদর হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। অনেক সময় বান্দরবানে যাওয়ার পথে রোগীরা মারা যান। এ কারণে জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসক, নার্স ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সরবরাহের দাবি জানিয়েছেন তারা।
হাসপাতালের পরিসংখ্যানবীদ পঙ্কজ বড়ুয়া জানান, ২০২০ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত এখানে ভর্তি হয়েছেন ৫ হাজার ১৯৮ জন রোগী। এর মধ্যে ৪৫৬ জনকে রেফার্ড করা হয় বান্দরবান সদর হাসপাতালে। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন ১৭ জন রোগী।
থানচি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অ্যাম্বুলেন্স চালক মংক্যসিং মারমা বলেন, “২০১৯ সালে চাকরিতে যোগদান করার পর থেকে অন্তত সাতজন রেফার্ড করা রোগী মাঝপথে আমার গাড়িতেই মারা গেছেন।”
শৈসাই মং মারমা তিন বছর আগে বিনা চিকিৎসায় তার মাকে মারা যেতে দেখেছেন। তিনি জানান, তার মা শৈমেপ্রু মারমা (৩৪) অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। ২০২২ সালের ১৪ নভেম্বর হঠাৎ তিনি অচেতন হয়ে পড়েন। রেমাক্রী বাজার থেকে নদীপথে থানচি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান মাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাকে জেলা সদর হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। ভাড়া গাড়িতে জেলা হাসপাতালে যাওয়ার সময় চিম্বুক বারো মাইল এলাকায় তার মা মারা যান।
লেংরু ম্রো নামে চার সন্তানের মা হারিয়েছেন স্বামীকে। তিনি জানান, তার স্বামী রেং য়ুং ম্রো (৪৫) কিডনি জটিলতা নিয়ে থানচি হাসপাতালে যান। সঙ্গে সঙ্গে সেখান থেকে তাকে বান্দরবান সদর হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। থানচি থেকে বান্দরবান যাওয়ার মাঝপথে মারা যান তার স্বামী।
স্থানীয় বাসিন্দা মংমে মারমা বলেন, “হাসপাতালে চিকিৎসক, ওষুধ ও যন্ত্রপাতির সংকট দীর্ঘদিন ধরেই চলছে। বিশেষজ্ঞ ডাক্তার বদলি হলেও অনেকেই থানচিতে যোগ দেন না, ডিপুটেশনে থেকে যান সদর হাসপাতালে। ফলে এ অঞ্চলের পাহাড়ি ও বাঙালি প্রায় ৩০ হাজার মানুষ স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।”
রিয়েং ম্রো নামে অপর বাসিন্দা বলেন, “পাহাড়ে বসবাসকারীদের অধিকাংশ গরিব। জেলা সদর হাসপাতালে রোগী নিয়ে যাওয়া ব্যয়বহুল ও কষ্টকর। রেমাক্রি, বড় মোদক, তিন্দু থেকে থানচি সদরে রোগী আনতেই অনেক টাকা খরচ হয়ে যায়। এরপর আবার বান্দরবান সদর হাসপাতালে রেফার্ড করলে সাধারণ মানুষ কীভাবে চিকিৎসা করাবে?”
থানচি উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা (ইউএইচএফপিও) ডা. মো. ওয়াহিদুজ্জামান মুরাদ বলেন, “বর্তমানে হাসপাতালে আমিসহ দুইজন চিকিৎসক রয়েছেন। একজন ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসাধীন। তিন রোগীদের সেবা দিতে পারছেন না। ফলে পুরো হাসপাতাল পরিচালনার দায়িত্ব আমাকে একাই সামলাতে হচ্ছে।”
তিনি আরো বলেন, “জনবল ও সরঞ্জাম সংকটের কারণে গুরুতর রোগীদের রেফার্ড করা ছাড়া উপায় থাকে না। দীর্ঘ পথের কারণে অনেকেই জীবিত অবস্থায় সদর হাসপাতালে পৌঁছাতে পারেন না।”
বান্দরবান জেলা সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ শাহীন হোসাইন চৌধুরী বলেন, “শুধু বান্দরবান নয়, পুরো তিন পার্বত্য জেলাতেই চিকিৎসক সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। নতুন করে ৪৮তম বিসিএসের ডাক্তার পদায়ন না হওয়া পর্যন্ত এই সংকট পুরোপুরি সমাধান করা সম্ভব হচ্ছে না। তারপরও বিভাগীয় প্রধানকে বিষয়টি চিঠির মাধ্যমে জানানো হয়েছে। ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের আট-দশজন চিকিৎসককে বান্দরবানে বদলি করার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।”
ঢাকা/মাসুদ