বাজেটে টাকা আসবে কোথা থেকে, যাবে কোথায়
Published: 2nd, June 2025 GMT
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম এবং দেশের ৫৪তম বাজেট উপস্থাপন করা হয়েছে। ২০২৫-২০২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের আকার দাঁড়িয়েছে ৭ লাখ ৮৯ হাজার ৯৯৯ কোটি টাকা। বাজেটে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা। এই অর্থের বড় অংশের জোগান দেবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। বাকিটা আসবে অন্যান্য খাত থেকে।
সোমবার (২ জুন) বিকেলে অর্থ উপদেষ্টা ড.
বাজেটে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রার ৮৮ দশমিক ৪৭ শতাংশ আসবে এনবিআর থেকে। টাকার অঙ্কে তা ৪ লাখ ৯৯ হাজার কোটি। অন্যান্য খাত থেকে আসবে ৬৫ হাজার কোটি টাকা, যা লক্ষ্যমাত্রার ১১ দশমিক ৫৩ শতাংশ।
আরো পড়ুন:
ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের রিটার্ন দাখিলের বাধ্যবাধকতা থাকল না
বাজেটে পুঁজিবাজারের জন্য ৩ প্রস্তাব, বিনিয়োগকারীরা উপেক্ষিত
নতুন অর্থবছরের বাজেট ঘাটতি ধরা হয়েছে জিডিপির ৩ দশমিক ৬২ ভাগ। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ ঋণ থেকে আসবে ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা বা মোট ঘাটতির ৫৫ দশমিক ৩ শতাংশ। বিদেশি ঋণ থেকে আসবে ১ লাখ ১ হাজার কোটি টাকা বা ৪৪ দশমিক ৭ শতাংশ। নতুন অর্থবছরে উন্নয়ন ব্যয় ধরা হয়েছে ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা।
২০২৪-২০২৫ অর্থবছরের বাজেটে পরিচালন ব্যয় ছিল ৫ লাখ ৬ হাজার ৯৭১ কোটি টাকা। এবার ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা। এর ৫৭ ভাগই যাবে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন, ভর্তুকি, প্রণোদনা ও ঋণ পরিশোধে। নতুন বাজেটে সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য ১০ থেকে ২০ ভাগ মহার্ঘ ভাতা ঘোষণা করা হয়েছে।
নতুন বাজেটে দেশি-বিদেশি সুদ পরিশোধ ও ভর্তুকিতেও বড় ব্যয় ধরা হচ্ছে। পরিচালন ব্যয়ের প্রায় ৪০ ভাগ অর্থ বরাদ্দ করতে হবে এই দুই খাতে। এর মধ্যে সুদ পরিশোধে সরকারের খরচ হবে ১ লাখ ২২ হাজার কোটি টাকা। এরপর ১৯ শতাংশ ব্যয় হবে ভর্তুকি ও প্রণোদনা দিতে, টাকার অঙ্কে যা ২ লাখ ৩৫ হাজার ১৮৬ কোটি টাকা।
শিক্ষা ও প্রযুক্তিতে বরাদ্দ প্রায় ১২ ভাগ। সরকারি কর্মচারীদের পেনশনে বরাদ্দ সাড়ে ৬ শতাংশ। সামাজিক নিরাপত্তা খাতে সাড়ে ৫ ও কৃষি খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ২ ভাগ।
২০২৫-২৬ অর্থবছরে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ১ লাখ ১৬ হাজার ৭৩১ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। পেনশন ছাড়া এ খাতে বরাদ্দ প্রায় ৯১ হাজার ২৯৭ কোটি টাকা।
সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে স্বচ্ছতা আনতে বাজেটে এই খাতকে নতুন করে সাজানো হয়েছে। এবার এ কর্মসূচির আওতায় সুবিধাভোগীর সংখ্যা ও মাথাপিছু বরাদ্দ উভয়ই বাড়ানোর প্রস্তাব রাখেছেন অর্থ উপদেষ্টা। বয়স্ক ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতাসহ বেশকিছু ভাতার হার বৃদ্ধিরও প্রস্তাব করা হয়েছে বাজেটে।
এছাড়া জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহীদ পরিবার এবং আহতদের জন্য ৪০৫ কোটি ২০ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে বাজেটে।
বয়স্ক ভাতা কর্মসূচিতে নতুন করে ১ লাখ উপকারভোগীকে যুক্ত করা হবে। মাসিক ভাতা ৫০ টাকা বাড়িয়ে করা হয়েছে ৬৫০ টাকা। বিধবা, স্বামী পরিত্যক্তা ও দুস্থ নারী ভাতা ১০০ টাকা বাড়িয়ে ৬৫০ টাকা করা হয়েছে। এছাড়া, প্রতিবন্ধীদের মাসিক ভাতা ৫০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৯০০ টাকা করা হয়েছে। মা ও শিশু সহায়তা কর্মসূচির আওতায় প্রদত্ত মাসিক ভাতা ৮০০ থেকে ৮৫০ টাকা করা হয়েছে।
বাজেট বক্তব্যে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, সুবিধাভোগীর সংখ্যা এবং মাথাপিছু বরাদ্দ উভয়ই বৃদ্ধির বিষয়ে জোর দিয়েছি। এ প্রেক্ষাপটে আগামী অর্থবছর থেকে বেশকিছু ভাতার হার বৃদ্ধি করার প্রস্তাব করছি। এর মধ্যে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য হলো বয়স্ক ভাতার হার মাসিক ৬০০ টাকা থেকে ৬৫০ টাকা করা হয়েছে।
এছাড়া, অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জন্য মাসিক ভাতার হার ৬৫০ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে বাজেটে। খাদ্যবান্ধব কর্মসূচিতে ৫৫ লাখ পরিবারকে স্বল্প মূল্যে ১০ লাখ টন চাল বিতরণ করবে সরকার।
সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির মেয়াদ আগামী অর্থবছরের ৬ মাসে উন্নীত করার প্রস্তাব করছি। একই সঙ্গে বর্তমানে সহায়তাপ্রাপ্ত ৫০ লাখ পরিবারের অতিরিক্ত আরো ৫ লাখ পরিবারকে এর আওতাভুক্ত করার প্রস্তাব করছি।
এবারের বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। ২০২৪-২০২৫ অর্থবছর জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ছিল ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ। সাময়িক হিসাবে অর্জিত হয়েছে ৩ দশমিক ৯৭ ভাগ।
এবারের বাজেটে মূল্যস্ফীতি কমানোর ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। এ অর্থবছরের জন্য মূল্যস্ফীতির লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ। ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরের বাজেটেও সার্বিক মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৬ দশমিক ৫ শতাংশ। গত এপ্রিলের হিসেবে দেশের বর্তমান সার্বিক মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ১৭ শতাংশ।
সংসদ না থাকায় এবারের বাজেট রাষ্ট্রীয় সম্প্রচার মাধ্যম বিটিভিসহ অন্যান্য বেসরকারি গণমাধ্যমে একযোগে প্রচার করা হয়েছে।
এর আগে সোমবার দুপুরে রাজধানীর তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে উপদেষ্টা পরিষদের বিশেষ বৈঠকে ২০২৫-২০২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট অনুমোদন দেওয়া হয়। বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
ঢাকা/হাসান/রফিক
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর র লক ষ য দশম ক ৫ উপদ ষ ট ৬৫০ ট ক পর ব র র জন য বর দ দ সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
সোনালী ও রূপালী মুনাফায়, অগ্রণী ও জনতা লোকসানে
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের মেয়াদে অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে গত বছরের শেষে রাষ্ট্রমালিকানাধীন চার ব্যাংকের মধ্যে দুটিই বড় ধরনের লোকসানে পড়েছে। বেক্সিমকো, এস আলম গ্রুপসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ঋণখেলাপি হয়ে যাওয়ায় দেশের শীর্ষ লোকসানি ব্যাংকে পরিণত হয়েছে জনতা ব্যাংক। ব্যাংকটি গত বছর শেষে একাই লোকসান করেছে ৩ হাজার ৬৬ কোটি টাকা। অন্যদিকে অগ্রণী ব্যাংক লোকসান করেছে ৯৮২ কোটি টাকা।
তবে হলমার্ক কেলেঙ্কারির পর ঘুরে দাঁড়িয়েছে সোনালী ব্যাংক, গত বছর শেষে ব্যাংকটি মুনাফা করেছে ৯৮৮ কোটি টাকা; আর রূপালী ব্যাংক মুনাফা করেছে ১১ কোটি টাকা।
রাষ্ট্রমালিকানাধীন চার ব্যাংকের মধ্যে অগ্রণী ও জনতা মিলে গত বছর শেষে লোকসান করেছে ৪ হাজার ৪৮ কোটি টাকা। আর সোনালী ও অগ্রণী ব্যাংক মিলে মুনাফা করেছে ৯৯৯ কোটি টাকা। তবে চার ব্যাংকই মন্দঋণের বিপরীতে নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণের ক্ষেত্রে নিজেদের চাহিদামতো ছাড় পেয়েছে। এ কারণে কাগজে–কলমে জনতা ও অগ্রণী লোকসান কিছুটা কম দেখাতে পেরেছে; আর সোনালী ও রূপালীর মুনাফা বেড়েছে। কারণ, নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখতে হয় মুনাফা থেকে। নিয়ম অনুযায়ী, মন্দঋণের বিপরীতে যথাযথ নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখলে ব্যাংকগুলোর আর্থিক চিত্র আরও খারাপ হতো। ব্যাংক চারটির নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। দেশে রাষ্ট্রমালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংক মোট ছয়টি। উল্লেখিত চারটির বাইরে বাকি দুটি হচ্ছে–বেসিক ব্যাংক ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড বা বিডিবিএল।
নানা অনিয়ম–দুর্নীতির কারণে রাষ্ট্রমালিকানাধীন এসব ব্যাংক আর্থিক সংকটে পড়লে বিভিন্ন সময় সরকার জনগণের করের টাকায় মূলধন জোগান দিয়েছে। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের মেয়াদকালে এসব ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে আওয়ামী লীগ নেতাদের পাশাপাশি সরকারঘনিষ্ঠ আমলাদের নিয়োগ দেওয়া হয় রাজনৈতিক বিবেচনায়। ফলে ব্যাংকগুলোতে বন্ধ হয়নি অনিয়ম–দুর্নীতি। এখন লোকসানে থাকা জনতা ও অগ্রণী ব্যাংক একীভূত করা নিয়ে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা চলছে।
মুনাফায় শীর্ষে সোনালী ব্যাংক
রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর মধ্যে সোনালী ব্যাংক কয়েক বছর ধরে তাদের মুনাফার ধারা অব্যাহত রেখেছে। ২০২২ সালে ব্যাংকটি ৩৭১ কোটি টাকা মুনাফা করেছিল, যা ২০২৩ সালে বেড়ে হয় ৬৫১ কোটি টাকা। সর্বশেষ ২০২৪ সালে সোনালী ব্যাংকের মুনাফা আরও বেড়ে দাঁড়ায় ৯৮৮ কোটি টাকায়। ২০১২ সালে হল-মার্ক গ্রুপের ঋণ কেলেঙ্কারিতে ব্যাংকটি বড় ধরনের সংকটে পড়েছিল। সেই ধাক্কা কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে সোনালী ব্যাংক।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রথম মেয়াদে ২০১০ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত সোনালী ব্যাংক থেকে নানা কৌশলে প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা বের করে নিয়েছিল হল–মার্ক গ্রুপ। এ ঘটনা ছিল সে সময় দেশের ব্যাংক খাতে ঋণ অনিয়মের সবচেয়ে বড় ঘটনা। তাই দেশজুড়ে ব্যাপক আলোড়ন তৈরি করেছিল হল–মার্ক কেলেঙ্কারি। শেষ পর্যন্ত ঋণগ্রহীতাকে জেলে যেতে হয়েছিল। এই ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনার পর ব্যাংকটি পুনর্গঠন শুরু হয়। তাতে ধীরে ধীরে দেশের সবচেয়ে বড় এই ব্যাংকের প্রতি আবারও আস্থা ফিরতে শুরু করে আমানতকারীদের।
বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১২ সালে ব্যাংকটির আমানত ছিল ৬০ হাজার কোটি টাকা। গত জুন শেষে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকায়। ২০১২ সালে ব্যাংকটির ঋণের পরিমাণ ছিল ৩৪ হাজার কোটি টাকা। গত জুন শেষে তা বেড়ে হয়েছে প্রায় এক লাখ কোটি টাকা। বর্তমানে সোনালী ব্যাংকের ঋণের ৩৩ শতাংশই সরকারি খাতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া।
হল-মার্কের ঘটনার পর সোনালী ব্যাংক তাদের ঋণের গতি কমিয়ে দেয়। কৌশলও পাল্টে ফেলে। আগ্রাসী ঋণ না দিয়ে ব্যাংকটি সরকারি বিভিন্ন পণ্যে বিনিয়োগ করতে থাকে। পাশাপাশি বেসরকারি খাতে বিভিন্ন শিল্প গ্রুপকে বড় অঙ্কের ঋণ দেওয়ার বদলে অন্য ব্যাংককে টাকা ধার দিয়ে সুদ আয়ের পথ বেছে নেয়। আর তাতে ব্যাংকটির আর্থিক ভিত্তি মজবুত হয়। বেড়েছে গ্রাহকও। এক যুগ আগে ব্যাংকটির গ্রাহক ছিল এক কোটির ঘরে। এখন সেই সংখ্যা দুই কোটি ছাড়িয়েছে।
জানতে চাইলে সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শওকত আলী খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঋণের সুদ ও ট্রেজারি খাত থেকে গত বছর আমাদের ভালো আয় হয়েছে। তবে আয়ের ক্ষেত্রে বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ট্রেজারি খাতে। আবার অবলোপন করা ঋণ থেকেও ভালো আদায় হয়েছে, যা মুনাফায় যুক্ত হয়েছে। বেসরকারি ঋণের পাশাপাশি সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণের বিপরীতে চাহিদামতো নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণ করতে হয়েছে। এরপর মুনাফা এক হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি পৌঁছেছে।’
রূপালী ব্যাংকের মুনাফা কমেছে
রূপালী ব্যাংক ২০২২ সালে ২৮ কোটি টাকা মুনাফা করেছিল। ২০২৩ সালে সেই মুনাফা বেড়ে দাঁড়ায় ৬২ কোটি টাকায়। তবে ২০২৪ সালে তাদের মুনাফা কমে ১১ কোটি টাকায় নেমে আসে। গত বছরের শেষে ব্যাংকটির আমানত বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৮ হাজার ৫৯৮ কোটি টাকায়, যা আগের বছর ছিল ৬৬ হাজার ৭৩১ কোটি টাকা। গত বছরের শেষে ব্যাংকটির ৪১ শতাংশের বেশি ঋণখেলাপি হয়ে পড়েছে। এর ফলে যে পরিমাণ নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখার কথা, তা সংরক্ষণ করতে হলে ব্যাংকটি লোকসানে পড়ত। তবে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ায় নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণে ব্যাংকটিকে ছাড় দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ কারণে গত বছরের শেষে ব্যাংকটি ১১ কোটি টাকা মুনাফা দেখানোর সুযোগ পায়।
এ নিয়ে রূপালী ব্যাংকের এমডি কাজী মো. ওয়াহিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় মুনাফা কমে গেছে। এসব ঋণ আদায়ে সর্বোচ্চ চেষ্টা চলছে। ব্যাংকটির আর্থিক স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য এখন কম সুদের আমানত এনে ভালো ঋণ দেওয়ার চেষ্টা করছি।
রেকর্ড লোকসানে জনতা ব্যাংক
রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা জনতা ব্যাংকের। ২০২২ সালে ১১৩ কোটি টাকা এবং ২০২৩ সালে ৬২ কোটি টাকা মুনাফা করেছিল ব্যাংকটি। আর ২০২৪ সাল শেষে ব্যাংকটি রেকর্ড ৩ হাজার ৬৬ কোটি টাকা লোকসান করেছে। এই লোকসান রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংক খাতের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় লোকসানের রেকর্ড হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। ব্যাংকটি প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণে ছাড় নিয়েছে। যদিও খেলাপিঋণের বিপরীতে ওই পরিমাণ নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণ করতে হতো, তাহলে লোকসানও কয়েক গুণ বেড়ে যেত। ব্যাংকটি এই চরম দুর্দশায় পড়েছে বিদায়ী সরকারের মেয়াদে লাগামহীন ঋণ দেওয়ার কারণে, যেসব ঋণ এখন খেলাপি হতে শুরু করেছে।
গত মেয়াদে ব্যবসায়ীদের কয়েকজন ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে ব্যাংকটি থেকে সবচেয়ে বেশি ঋণ পেয়েছেন। ফলে ১০টি শিল্প গ্রুপের কাছে ব্যাংকটির ৫৫ শতাংশ ঋণ আটকা পড়েছে। প্রভাবশালী এসব গ্রাহকের দেওয়া বেশির ভাগ ঋণ ফেরত আসছে না, এতে গত বছরের শেষে ব্যাংকটির ৬৬ দশমিক ৮ শতাংশ ঋণখেলাপি হয়ে গেছে। টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ ৬৭ হাজার ৩৩০ কোটি টাকা, যা ব্যাংকগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ। ব্যাংকটির পরিস্থিতি এমন নাজুক অবস্থায় পৌঁছেছে যে সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়ানো বেশ কঠিন। কারণ, এসব ঋণ স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় আদায় হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। আবার গ্রাহকদের অনেকেই লাপাত্তা, কেউ জেলে আবার কারও কারখানা বন্ধ।
জনতা ব্যাংক একসময় ছিল দেশের ভালো ব্যাংকগুলোর মধ্যে অন্যতম। ব্যাংকটির অর্থায়নে সফল উদ্যোক্তা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছেন দেশের অনেক শিল্পোদ্যোক্তা। রপ্তানি বাণিজ্যতেও শীর্ষ পর্যায়ে ছিল। সেই ব্যাংক এখন নাজুক পরিস্থিতিতে। কারণ, গত ১৫ বছরে বড় ধরনের ঋণ অনিয়ম ও জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে ব্যাংকটিতে। যার সঙ্গে জড়িত ছিলেন ব্যাংকটির কিছু কর্মকর্তা ও বিভিন্ন সময়ে পর্ষদে থাকা আওয়ামীপন্থী পরিচালকেরা। যদিও এসব অনিয়মে জড়িত ব্যক্তিদের কারও বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা এখন পর্যন্ত নেওয়া হয়নি।
২০২৪ সাল শেষে জনতা ব্যাংকের আমানত কমে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৯ হাজার ৮০৯ কোটি টাকা, ২০২৩ সালে যা ছিল ১ লাখ ১০ হাজার ৩২৬ কোটি টাকা। ২০২৩ সাল শেষে ঋণ ছিল ৯৮ হাজার ৩৮৮ কোটি টাকা, যা গত বছর শেষে বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ৮০০ কোটি টাকা। তবে চলতি বছর ব্যাংকটির আমানত বেড়েছে। তবে গত জুন শেষে ব্যাংকটির আমানত বেড়ে আবার ১ লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।
জনতা ব্যাংকের শীর্ষ পাঁচ খেলাপি গ্রাহকের কাছেই আটকে আছে খেলাপি ঋণের প্রায় ৭০ শতাংশ অর্থ। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় খেলাপি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের বেক্সিমকো গ্রুপ। জনতা ব্যাংকে বেক্সিমকো গ্রুপের মোট ঋণের পরিমাণ ২৩ হাজার কোটি টাকা। এরপর শেখ হাসিনা ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী এস আলম গ্রুপের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১০ হাজার ২০০ কোটি টাকা। শেখ হাসিনার ছোট বোন শেখ রেহানার ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচয় দেওয়া অ্যাননটেক্স গ্রুপের খেলাপি ঋণ ৭ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। ক্রিসেন্টের খেলাপি ৩ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। থার্মেক্স গ্রুপের খেলাপি ২ হাজার ২০০ কোটি টাকা। সিকদার গ্রুপের খেলাপির পরিমাণ ৮৫০ কোটি টাকা।
অগ্রণী ব্যাংকও লোকসানে
মুনাফার দিক থেকে অগ্রণী ব্যাংক একসময় ভালো অবস্থানে থাকলেও ২০২৪ সালে ব্যাংকটি বড় ধরনের লোকসান করেছে। ২০২২ সালে ১১০ কোটি টাকা, ২০২৩ সালে ৬৯ কোটি টাকা মুনাফা করা ব্যাংকটি ২০২৪ সালে ৯৮২ কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে। খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়া, নিরাপত্তা সঞ্চিতি বা প্রভিশনিং ঘাটতি এবং অদক্ষতাই এই লোকসানের অন্যতম কারণ। গত বছরের শেষে ব্যাংকটির আমানত ছিল ৯৯ হাজার ২৪৮ কোটি টাকা, ঋণ ছিল ৭৯ হাজার ১৩৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৪১ শতাংশ ঋণই খেলাপি হয়ে গেছে। গত জুন শেষে ব্যাংকটির আমানত বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা। আর এ সময়ে ঋণ বেড়ে হয়েছে প্রায় ৭৮ হাজার কোটি টাকা। জনতা ব্যাংকের মতো অগ্রণী ব্যাংকও আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ব্যবসায়ীদের ঋণ দিয়ে এখন সংকটে পড়েছে।
ব্যাংকটির সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে জানতে চাইলে ব্যাংকের চেয়ারম্যান আবু নাসের বখতিয়ার প্রথম আলোকে বলেন, গত ১৫ বছরে নিয়মের বাইরে যেভাবে ঋণ দেওয়া হয়েছে, এখন তা বেরিয়ে আসছে। নিরাপত্তা সঞ্চিত সংরক্ষণে ছাড় না নিলে ব্যাংকটির লোকসান আরও অনেক বেশি হতো। যদি প্রকৃত লোকসানের চিত্র সবাই জানত, তাহলেই ভালো হতো। এই ব্যাংকের ঋণের অনেক টাকা বাইরে চলে গেছে। এ জন্য ঘুরে দাঁড়াতে বেশ সময় লাগবে। ব্যাংকটির গ্রাহকদের মধ্যে যাঁরা এখন দেশে আছেন, ব্যবসা চালাচ্ছেন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি করছেন, তাঁদের আরও সহায়তা দিতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়কে বিষয়টি ইতিবাচকভাবে দেখতে হবে। তাহলে ব্যাংকটি ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াবে।