প্রথম আলো এক্সপ্লেইনার: মুদ্রার বিনিময় হার কী, কেন তা এত গুরুত্বপূর্ণ
Published: 7th, June 2025 GMT
ডলারের বিনিময় হার কীভাবে নির্ধারণ করা হবে, তা নয়ে গত তিন বছরে অনেক আলাপ-আলোচনার পর অবশেষে বাংলাদেশ ব্যাংক জানাল, ডলারের বিনিময় হার নির্ধারণ করবে ‘বাজার’। বাস্তবে ডলারের বিনিময় হার যে শতভাগ বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে, তা নয়; এটাও একধরনের নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থা। কিন্তু মুদ্রার বিনিময় হার নিয়ে গত কয়েক বছরে এত হইচই কেন, কী এর কারণ।
কোভিডের আগে থেকেই দেশের রপ্তানিকারকেরা দাবি করে আসছিলেন, ডলারের বিনিময় হার বাড়ানো হোক। সেটা হলে রপ্তানিকারকদের আয় বাড়ে, কিন্তু আমদানিকারকদের ক্ষতি। কারণ, তাতে আমদানি ব্যয় বেড়ে যায়। অর্থনীতিবিদেরা বলেছেন, টাকার মান কৃত্রিমভাবে বাড়িয়ে রাখা হয়েছে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাবে, ২০১৮ ও ২০১৯ সালে টাকার প্রকৃত অতি মূল্যায়ন হয়েছে ৯ দশমিক ৫ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবেও দেখা গেছে, টাকার প্রকৃত মূল্য ২০১৫-১৬ ভিত্তি বছর অনুযায়ী রাখতে হলে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ডলারের মূল্য ৯৩ টাকা হওয়ার কথা ছিল, যদিও তখন আন্তব্যাংক বাজারে ডলারের মূল্য ছিল ৮৪ দশমিক ৯ টাকা। অর্থাৎ ২০১৫-১৬ ভিত্তি বছরের প্রকৃত মূল্যের তুলনায় প্রতি ডলার ছিল প্রায় ৮ টাকা অতিমূল্যায়িত।
এরপর ২০২২ সালে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে বিশ্বব্যাপী ডলার–সংকট শুরু হয়, বাংলাদেশেও সেই সংকট দেখা দেয়। পরিণামে ডলারের দাম একলাফে অনেকটা বেড়ে যায়; বর্তমানে যা ১২৩ টাকা। অর্থনীতিবিদেরা বলেন, ধারাবাহিকভাবে ডলারের বিনিময় হার বৃদ্ধি করলে ২০২২ সালে এক ধাক্কায় ডলারের দাম এতটা বাড়াতে হতো না।
তবে এটাও সত্য, যেসব দেশের অর্থনীতি রপ্তানিমুখী, সেসব দেশ মুদ্রার বিনিময় হার কমিয়ে লাভবান হয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০১৬ সালে প্রথম ক্ষমতায় আসার পর চীনের বিরুদ্ধে যে বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু করেন, তখন তাঁর অন্যতম অভিযোগ ছিল, চীন মুদ্রা কারসাজি করে রপ্তানি বাণিজ্যে লাভবান হচ্ছে।
বিনিময় হার কী
মুদ্রার বিনিময় হার একটি দেশের মুদ্রার তুলনামূলক মান, যার ভিত্তিতে অন্য দেশের মুদ্রার বিপরীতে বিনিময় হয়। মুদ্রার বিনিময় হার সব সময় অন্য একটি মুদ্রার তুলনায় পরিমাপ করা হয়। যেমন এখন ডলারের গড় বিনিময় হার ১২২ দশমিক ৫২; অর্থাৎ এক ডলারের বিপরীতে ১২২ দশমিক ৫২ টাকা পাওয়া যাচ্ছে।
বিনিময় হার নির্ধারণ প্রক্রিয়া
দুই দেশের মুদ্রার বিনিময় হার কেমন হবে, তা অনেকগুলো বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। এককথায় উত্তর দেওয়া না গেলেও শুধু এটুকু বলা যায়, মোটামুটি দুই মুদ্রার চাহিদা-জোগান ও পারস্পরিক ক্রয়ক্ষমতার ওপর বিনিময় হার নির্ভর করে। কোনো মুদ্রার বিনিময় হার অন্যান্য মুদ্রার তুলনায় কেমন হবে কিংবা কেমন হওয়া উচিত, সে বিষয়ক বেশ কিছু তত্ত্ব ও মতবাদ আছে। এর মধ্যে আছে (ক) মিন্ট প্যারিটি তত্ত্ব, (খ) আইএমএফ পার ভ্যালু তত্ত্ব, (গ) ক্রয়ক্ষমতা সমতা তত্ত্ব ও (ঘ) ব্যালান্স অব পেমেন্টস তত্ত্ব।
(ক) মিন্ট প্যারিটি তত্ত্ব
এ তত্ত্ব অনুযায়ী, কোনো দেশের মুদ্রার বিনিময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে কতটুকু স্বর্ণ পাওয়া যেত, সে অনুপাতে অন্যান্য স্বর্ণমানসম্পন্ন দেশগুলোর মুদ্রার বিনিময় হার নির্ধারণ হতো। ১৯ শতকে এ পদ্ধতি ব্যবহৃত হতো।
(খ) পার ভ্যালু তত্ত্ব
আইএমএফ প্রবর্তিত এ তত্ত্ব অনুযায়ী প্রতিটি দেশ তাদের মুদ্রার মান নির্দিষ্ট পরিমাণ স্বর্ণ অথবা মার্কিন ডলারের হিসাবে ঘোষণা দিত এবং বিনিময় হার সেই স্তরে স্থিতিশীল রাখতে মুদ্রানীতি ও বিনিময় নীতি অনুসরণ করার ব্যবস্থা করত। এই তত্ত্ব প্রথম কার্যকরভাবে প্রয়োগ হয় ব্রেটন উডস ব্যবস্থায়। তখন আইএমএফের সদস্যরাষ্ট্রগুলো নিজেদের মুদ্রার মান কমবেশি এক শতাংশের সীমার মধ্যে স্থির রাখার প্রতিশ্রুতি দেয়। ডলারকে স্বর্ণের সঙ্গে এবং অন্যান্য মুদ্রা ডলারের সঙ্গে সম্পর্কিত করা হয়। কিন্তু ১৯৭০–এর দশকের শুরুতে এ পদ্ধতি আর থাকে না।
(গ) ক্রয়ক্ষমতা সমতা তত্ত্ব
এ তত্ত্ব অনুযায়ী আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বিনিময়যোগ্য পণ্য ও সেবার ক্রয়ক্ষমতার ওপর নির্ভর করে পারস্পরিক বিনিময় হার। সহজ কথায় বললে, একটি পণ্যের জন্য সব দেশে একই ব্যয় হওয়া উচিত—এটা হচ্ছে এই তত্ত্বের মোদ্দাকথা। ল অব ওয়ান প্রাইস বা একক পণ্যমূল্য তত্ত্ব হচ্ছে এর মূল ভিত্তি। যদি কোনো পণ্যের পরিবহন ব্যয় ও শুল্ক না থাকে এবং বাজারে বাধা না থাকে, সেই পণ্যের দাম সব দেশে সমান হবে (একই মুদ্রায় প্রকাশ করলে)। পরিবহন ব্যয়, শুল্ক ও অশুল্ক বাধা বিবেচনা করা হয় না এই তত্ত্বে। তবে পরিষেবা খাতের জন্য এটি প্রয়োগযোগ্য নয়।
(ঘ) ব্যালান্স অব পেমেন্টস তত্ত্ব
এ তত্ত্ব অনুযায়ী মুদ্রার জোগান ও চাহিদার টানাপোড়েনের মাধ্যমে বিনিময় হার নির্ধারণ করা হয়। এই তত্ত্ব অনুসারে, একটি দেশের মুদ্রার চাহিদা ও জোগানের ওপর নির্ভর করে বিনিময় হার নির্ধারিত হয়। চাহিদা-জোগান নির্ধারিত হয় রপ্তানি, আমদানি, বিদেশি বিনিয়োগ ও প্রবাসী আয়ের ভিত্তিতে। কিন্তু এই তত্ত্ব স্বল্পমেয়াদি বাজার জটিলতার ব্যাখ্যা দিতে অক্ষম। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হস্তক্ষেপকে পুরোপুরি ব্যাখ্যা করতে পারে না এবং রাজনৈতিক বা ভূরাজনৈতিক অস্থিরতা বিবেচনায় আনে না এই তত্ত্ব।
বিদ্যমান বিনিময় হার পরিস্থিতি
গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড বা স্বর্ণমান ব্যবস্থা অনেক আগেই হারিয়ে গেছে। স্থির বিনিময় হারের অপর সংস্করণ আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের পার ভ্যালু প্রথা ১৯৭০–এর দশকের শুরুতেই দৃশ্যপট থেকে বিদায় নিয়েছে। আন্তর্জাতিক আর্থিক ব্যবস্থা এখন দাঁড়িয়ে আছে সঞ্চরণশীল বিনিময় হার ব্যবস্থার ওপর। এ ব্যবস্থায় বিশ্বের প্রধান প্রধান মুদ্রার বিনিময় হার তাদের তুলনামূলক অন্তর্নিহিত শক্তি এবং চাহিদা ও সরবরাহের আলোকে নির্ধারিত হয়।
সঞ্চরণশীল (ফ্লোটিং) বিনিময় হার ব্যবস্থা
চাহিদা ও সরবরাহের পরিবর্তনের ফলে মুদ্রার বিনিময় হারে যে পরিবর্তন আসে, তা সঞ্চরণশীল (ফ্লোটিং) বিনিময় হার ব্যবস্থা হিসেবে পরিচিত। অর্থাৎ চাহিদা ও সরবরাহ অর্থনীতির আর দশটা দ্রব্যের মূল্যে যে ধরনের প্রভাব ফেলে, তেমনি কোনো মুদ্রার চাহিদা ও জোগানের পরিবর্তন সেই মুদ্রার বিনিময় হারে একইভাবে পরিবর্তন নিয়ে আসে। সঞ্চরণশীল বিনিময় হার ব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক অথবা আর্থিক কর্তৃপক্ষ তাদের মুদ্রার বিনিময় হার নির্দিষ্ট পর্যায়ে রাখার বিষয়ে স্বতঃপ্রণোদিতভাবে পদক্ষেপ নেওয়া থেকে বিরত থাকে। প্রায় সব দেশ দীর্ঘ পরিসরে মুদ্রার বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখার চেষ্টা করে। সে অনুযায়ী তারা অভ্যন্তরীণ রাজস্ব ও মুদ্রানীতি প্রণয়ন করে।
সঞ্চরণশীল (ফ্লোটিং) বিনিময় হারের সুবিধা
ক.
খ. ব্যালান্স অব পেমেন্টস স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভারসাম্যে পৌঁছে।
গ. বিদেশ থেকে উদ্ভূত অর্থনৈতিক অস্থিরতার প্রভাব সহজে মোকাবিলা করা যায়।
ঘ. সামগ্রিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিনিময় হার নির্ধারিত হয়।
ঙ. বিনিময় হার কর্তৃপক্ষের ইচ্ছা-অনিচ্ছা বা ব্যক্তিগত ধ্যান-ধারণার প্রভাবমুক্ত থাকে।
চ. রাজনৈতিক মতভেদ বা সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি করে না।
সঞ্চরণশীল বিনিময় হারের অসুবিধা
ক. বিনিময় হার সম্পর্কিত অনিশ্চয়তায় বিশ্ব বাণিজ্য সংকুচিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
খ. শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীরা ব্যবসা সম্প্রসারণ সম্পর্কে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভোগেন।
গ. সাময়িক কারণে বিনিময় হার পরিবর্তিত হলে বিনিময় হার পরিবর্তিত স্তরে রয়ে যেতে পারে।
মুদ্রার বিনিময় হার কোনো দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও আন্তর্জাতিক লেনদেনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমদানি–রপ্তানির খরচ, মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ, বিনিয়োগ ও পর্যটন খাতে এর সরাসরি প্রভাব পড়ে। দুর্বল মুদ্রা রপ্তানিকে উৎসাহিত করলেও আমদানি ব্যয়বহুল হয়ে ওঠে। সেই সঙ্গে শক্তিশালী মুদ্রা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষ প্রবাসী আয়ের ওপর নির্ভরশীল, ফলে মুদ্রা দুর্বল হলে তাঁদের লাভ; কিন্তু আমরা নিট আমদানিকারক দেশ বলে বিনিময় হারের ওঠানামা জাতীয় অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলে। সে কারণে স্থিতিশীল ও নির্ভরযোগ্য বিনিময় হার অর্থনৈতিক পরিকল্পনার জন্য অপরিহার্য।
মুদ্রা কারসাজি
অভিযোগ আছে, অনেক দেশ মুদ্রার বিনিময় হারে হস্তক্ষেপ করে। রপ্তানি বাণিজ্যে সুবিধা পেতে তারা এ কাজ করে থাকে। অর্থাৎ সরকারি উদ্যোগে মুদ্রার মান প্রভাবিত করার প্রক্রিয়াকে মুদ্রা ব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ বা কারেন্সি ম্যানিপুলেশন বলা হয়। সাধারণত কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো বিপুল পরিমাণে নিজেদের মুদ্রা কেনাবেচার মাধ্যমে বিনিময় হার নিয়ন্ত্রণে রাখে। অনেক সময় মুদ্রার মূল্য ইচ্ছাকৃতভাবে কমিয়ে রপ্তানি পণ্য সস্তা এবং আমদানি পণ্য ব্যয়বহুল করে তোলা হয়, যাকে বলা হয় প্রতিযোগিতামূলক অবমূল্যায়ন। ফলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ভারস্যহীনতা তৈরি হয় এবং বিভিন্ন দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক টানাপোড়েন তৈরি হয়।
আধুনিক বৈশ্বিক অর্থনীতিতে এ বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সরাসরি আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, বিনিয়োগ প্রবাহ, কর্মসংস্থান ও ভোক্তা মূল্যে তার প্রভাব পড়ে। বিশেষ করে ভূরাজনৈতিক টানাপোড়েনের সময় এ ধরনের হস্তক্ষেপ আন্তর্জাতিক বৈষম্য আরও গভীর করে তোলে।
২০২৪ সালের জুন মাসে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ মন্ত্রণালয় জাপানকে মুদ্রা নজরদারির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে। এর পেছনে ছিল ইয়েনের বিপর্যয়—মার্কিন ডলারের বিপরীতে যা ৩৮ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন অবস্থানে পৌঁছায়। ফলে জাপানের বৈদেশিক মুদ্রানীতির স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।
১৯২৯ সালে মহামন্দার পর বিশ্বের বিভিন্ন দেশ স্বর্ণমান ছেড়ে দিয়ে মুদ্রার মান কমাতে শুরু করে। যুক্তরাজ্য ১৯৩১ সালে প্রথম স্বর্ণমান থেকে সরে যায়। এরপর যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য দেশ একই পথে হাঁটে। প্রতিটি দেশ নিজের রপ্তানি বাড়াতে মুদ্রার মান ইচ্ছাকৃতভাবে কমিয়ে দেয়। লক্ষ্য ছিল, রপ্তানিতে প্রতিযোগিতা তৈরি করে অর্থনীতি চাঙা করা। ফলে বিশ্ববাণিজ্যে অস্থিরতা শুরু হয়। আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় শুরু হয় আস্থার সংকট। শেষ পর্যন্ত ১৯৪৪ সালে ব্রেটন উডস ব্যবস্থার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মুদ্রাব্যবস্থা পুনর্গঠিত হয়।
এরপর সবচেয়ে বড় মুদ্রাযুদ্ধ হয় ২০০৮ সালের বৈশ্বিক মন্দার পর, তখন যুক্তরাষ্ট্র কোয়ান্টিটেভিজ ইজিং(কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্তৃক অর্থনীতিকে উদ্দীপিত করতে বিপুল পরিমাণ বন্ড ক্রয় করে বাজারে অর্থ সরবরাহ বাড়ানোর নীতি) চালু করে বাজারে বিপুল পরিমাণ ডলার সরবরাহ করে। ফলে ডলারের মান পড়ে যায়। যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ, চীন অনেক আগেই তাদের মুদ্রা কৃত্রিমভাবে দুর্বল করে রেখেছে। ব্রাজিলের অর্থমন্ত্রী গুইডো মান্তেগা ২০১০ সালে বলেন, ‘আমরা এক আন্তর্জাতিক মুদ্রাযুদ্ধের মধ্যে পড়েছি।’ চীন, যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল সবাই এই যুদ্ধে থেকে ঘরোয়া চাহিদা ও রপ্তানি বাড়ানোর চেষ্টা করে। একপর্যায়ে আন্তর্জাতিক পরিসরে অস্থিরতা শুরু হলে ডব্লিউটিও ও আইএমএফ হস্তক্ষেপ করে। মার্কিন কংগ্রেসে চীনের বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক শুল্কের আলোচনা হয়। এরপর ২০১৬ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্প যে চীনের বিরুদ্ধে প্রথম শুল্কযুদ্ধ শুরু করেন, তার পাটাতন ছিল কংগ্রেসের সেই আলোচনা।
২০১৫ সালে চীন নিজেদের মুদ্রা ইউয়ানের মান হঠাৎ কমিয়ে দেয়। যুক্তরাষ্ট্র অভিযোগ করে, এটি একধরনের মুদ্রা কারসাজি। ২০১৯ সালে ট্রাম্প প্রশাসন চীনকে মুদ্রা কারসাজিকারী হিসেবে আখ্যা দেয়। ফলে বাণিজ্যযুদ্ধের তীব্রতা বৃদ্ধি পায় এবং অস্থিরতা তৈরি হয় বাজারে। একপর্যায়ে আইএমএফ হস্তক্ষেপ করে। এরপর কোভিড-১৯ মহামারির সময় অর্থনৈতিক স্থবিরতা কাটাতে অনেক দেশ নীতি সুদহার শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনে। সেই সঙ্গে বাজারে বিপুল অর্থ সরবরাহ করে। ফলে স্থানীয় মুদ্রার মান পড়ে যায়; অনেক দেশ রপ্তানি বাড়াতে সচেতনভাবে মুদ্রা দুর্বল করে রাখে। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে মুদ্রাব্যবস্থার এমন কৌশল শুধু অর্থনৈতিক ভারসাম্যই নয়, কূটনৈতিক সম্পর্কেও নতুন মাত্রা যোগ করছে।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: য ক তর ষ ট র হ র ব যবস থ র জন ত ক অন য ন য সরবর হ হ র পর র জন য র ব পর দ র বল স বর ণ র অর থ র পর ব র প রক ক রস জ সব দ শ ন ক রক অর থ ৎ পর ম ণ আমদ ন প রথম দশম ক
এছাড়াও পড়ুন:
২০২৬ সালে বিশ্ববাজারে জিনিসপত্রের দাম আরও ৭% কমতে পারে, বাংলাদেশে কেন কমছে না
চলতি বছরের শুরু থেকেই বিশ্ববাজারে দাম কমার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুসারে, চলতি বছরে সামগ্রিকভাবে পণ্যমূল্য ৭ শতাংশ কমবে। আগামী বছর, অর্থাৎ ২০২৬ সালে পণ্যমূল্য আরও ৭ শতাংশ কমবে। এ দাম হবে ছয় বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম।
কিন্তু বাংলাদেশের বাজারে তার প্রভাব নেই। দেশে মূল্যস্ফীতির হার এখনো ৮ শতাংশের ঘরে। যদিও একসময় তা দুই অঙ্ক ছাড়িয়ে গিয়েছিল। গত সেপ্টেম্বর মাসে মূল্যস্ফীতি ৮ দশমিক ৩৬ শতাংশ হয়েছে। দেশের মানুষকে এখনো বাড়তি দামেই পণ্য ও সেবা কিনতে হচ্ছে। আগামী বছর নিত্যপণ্যের দাম কমবে কি না, সেই নিশ্চয়তাও নেই। বিশ্লেষকেরা বলছেন, ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম কমলেও দেশে এর প্রভাব কম।
বিশ্বব্যাংকের ‘কমোডিটি মার্কেটস আউটলুক অক্টোবর ২০২৫’ শীর্ষক প্রতিবেদনের তথ্যানুসারে, ২০২৫ সালের শুরু থেকেই বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম কমতে শুরু করেছে। যার মূল কারণ হিসেবে তারা চিহ্নিত করেছে জ্বালানির দাম কমে যাওয়া। সেই সঙ্গে আরও কিছু কারণ চিহ্নিত করেছে তারা। সেগুলো হলো চীনে তেলের চাহিদা বৃদ্ধির গতি কমে যাওয়া এবং বিশ্ববাজারে সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় তেলের দামে বড় ধরনের পতন ঘটা। খাদ্যপণ্যের দাম বছরের শুরু থেকে ধীরে ধীরে কমতে থাকে, কিন্তু বছরের প্রথমার্ধে প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে পানীয় পণ্যের দাম হঠাৎ অনেকটা বেড়ে যায়। এ ছাড়া বছরের দ্বিতীয়ার্ধে সোনার দাম রেকর্ড উচ্চতায় ওঠে। মূলত রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যে নিরাপদ বিনিয়োগ মাধ্যম হিসেবে মানুষ সোনার দিকে ছুটেছেন।
বিশ্ববাজারে পণ্যের মূল্য নির্ধারণে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখে জ্বালানি তেলের দাম। বিশ্বব্যাংক গ্রুপের পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০২৫ সালে জ্বালানির দাম আগের বছরের তুলনায় ১২ শতাংশ এবং ২০২৬ সালে আরও ১০ শতাংশ কমবে। ২০২৭ সালে তা আবার প্রায় ৬ শতাংশ বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস ২০২৬ সালে কৃষিপণ্য, খাদ্য ও কাঁচামালের দাম কমবে। চলতি বছরেও এসব পণ্যের দাম কমেছে।
জ্বালানি তেলবিশ্বব্যাংকের ২০২৬ সালের পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, প্রাকৃতিক গ্যাসের চাহিদা বাড়ায় গ্যাসের দাম কিছুটা বাড়লেও তেলের দাম কমে যাবে এবং সেই প্রভাবকে ছাপিয়ে যাবে। ২০২৫ সালে ব্রেন্ট ক্রুড তেলের দাম হতে পারে ব্যারেলপ্রতি গড়ে ৬৮ ডলার; ২০২৪ সালের ৮১ ডলারের তুলনায় যা বেশ কম। ২০২৬ সালে এই দাম আরও কমে ব্যারেলপ্রতি গড়ে ৬০ ডলারে নামতে পারে ধারণা করা হচ্ছে।
এই পূর্বাভাস অনুযায়ী, তেলের ব্যবহার বৃদ্ধির হার আরও কমবে—মূলত চীনের চাহিদা কমে যাওয়া, বৈদ্যুতিক ও হাইব্রিড গাড়ির দ্রুত প্রসার ও বৈশ্বিক তেল সরবরাহ বৃদ্ধির কারণে এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে।
২০২৫ সালে বৈশ্বিক তেলের বাজারে সরবরাহ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। ২০২৬ সালে তা আরও বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ২০২০ সালের সর্বোচ্চ মাত্রার তুলনায় প্রায় ৬৫ শতাংশ বেশি হবে এ সরবরাহ।
কৃষিপণ্যবিশ্বব্যাংক গ্রুপের পূর্বাভাস অনুযায়ী, কৃষিপণ্যের মূল্যসূচক ২০২৫ সালে স্থিতিশীল আছে। ২০২৬ সালে তা সামান্য ২ শতাংশ ও ২০২৭ সালে আরও ১ শতাংশ কমবে।
খাদ্যপণ্যের দাম, যেমন শস্য, তেল, প্রোটিনজাত খাবারসহ অন্যান্য খাদ্যের দাম সাম্প্রতিক সীমার কাছাকাছি থাকবে। তবে মাঝেমধ্যে সামান্য কিছুটা ওঠানামা থাকবে। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, প্রধান ফসলগুলোর উৎপাদন বৃদ্ধির হার আবার দীর্ঘমেয়াদি প্রবণতায় ফিরে আসছে।
২০২৫ সালের বাকি সময়ে সয়াবিনের দাম কমবে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের যে সয়াবিন সাধারণত চীনে রপ্তানি হয়, তা এবার কম দামে অন্য ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করতে হতে পারে। চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যযুদ্ধের অন্যতম প্রধান ক্ষেত্রে হচ্ছে এই সয়াবিন। চীন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে সয়াবিন কিনছে না। ফলে ২০২৬ ও ২০২৭ সালে এই পণ্যের দাম তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল থাকবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বিশ্ববাজারে দাম কমে গেলে যুক্তরাষ্ট্রে সয়াবিন চাষের পরিমাণ কিছুটা কমতে পারে, তবে ব্রাজিল তার সয়াবিন আবাদ আরও বাড়ানোর পথে রয়েছে। পানীয় পণ্যের দাম ২০২৬ সালে ৭ শতাংশ ও ২০২৭ সালে প্রায় ৫ শতাংশ কমবে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।
এদিকে চলতি বছর সারের দাম সামগ্রিকভাবে ২১ শতাংশ বাড়তি। চাহিদা বৃদ্ধি, বাণিজ্যিক প্রতিবন্ধকতা ও কিছু অঞ্চলে সরবরাহ–ঘাটতির কারণে এ দাম বেড়ে যাওয়া। ২০২৬ ও ২০২৭ সালে দাম প্রায় ৫ শতাংশ কমতে পারে। তবু ২০১৫-১৯ সালের গড় দামের তুলনায় তা অনেক বেশি থাকবে। এর কারণ হলো উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়া, রপ্তানি সীমাবদ্ধতা ও চলমান আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা।
চীন ইতিমধ্যে নাইট্রোজেন ও ফসফেট সার রপ্তানিতে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে। অন্যদিকে পটাশ সরবরাহকারী বড় দেশ বেলারুশ এখনো ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিষেধাজ্ঞার আওতায় আছে। রাশিয়া ও বেলারুশ—উভয় দেশই সারের ওপর ইউরোপীয় ইউনিয়নের আরোপিত নতুন শুল্কের সম্মুখীন।
দেশে কেন দাম বেশিবিশ্ববাজারে দাম কমলেও দেশের বাজার দাম না কমার অন্যতম প্রধান কারণ ডলারের দামের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন। গত তিন বছরে ডলার দাম অনেকটা বেড়েছে। সেই সঙ্গে দেশের অনেক আমদানি পণ্যে শুল্ক বেশি বলে মনে করেন গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান।
মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বাজার ব্যবস্থাপনার কারণে দাম কমছে না। বাজারে চাহিদা কত বা কখন কোন পণ্য আমদানি করতে হবে, সে বিষয়ে যথাযথ তথ্যের ঘাটতি আছে। ফলে সময়মতো পণ্য আমদানি হয় না।
আরেকটি বিষয় হলো দেশে যেসব পণ্য আমদানি করা হয়, তার অনেক কিছু উৎপাদিতও হয়। কিন্তু বিনিয়োগ কমে যাওয়ায় এসব পণ্যের সরবরাহে টান পড়েছে। বাজারের পণ্যমূল্যে তার প্রভাব পড়ছে বলে মনে করছেন মোস্তাফিজুর রহমান।
তিন বছর আগে দেশে ডলারের দাম ছিল ৮৬ টাকা। এখন তা বেড়ে ১২২ টাকা হয়েছে। এ ছাড়া কয়েক মাস ধরে আমদানির ঋণপত্র খোলাও কমেছে। এতে আমসদানিতে চাপ পড়ছে।
দেশের বাজার উচ্চ মূল্যের কারণ সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক সেলিম রায়হান বলেন, বিশ্ববাজারে জ্বালানি, কৃষি ও খাদ্যপণ্যের দাম কমলেও বাংলাদেশের বাজারে তার প্রভাব দেখা যাচ্ছে না। জ্বালানি ও পরিবহন ব্যয়, শুল্ক ও করের চাপ ও বাজার ব্যবস্থাপনায় অদক্ষতার কারণে দাম কমছে না। পাইকারি থেকে খুচরা পর্যন্ত অতি মুনাফা ও অস্বচ্ছ বাণিজ্যিক শৃঙ্খলের কারণেও বাজারে কৃত্রিমভাবে উচ্চমূল্য বিরাজ করছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে টাকার অবমূল্যায়ন। ফলে আমদানি ব্যয় বেড়ে গেছে এবং আন্তর্জাতিক মূল্যহ্রাসের সুফল ভোক্তাপর্যায়ে পড়ছে না।
সেলিম রায়হান আরও বলেন, এ ছাড়া রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তার কারণ ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা নেমে এসেছে। বিনিয়োগকারীরা নতুন ঝুঁকি নিতে চাচ্ছেন না। পণ্য পরিবহন ও আমদানি ব্যাহত হচ্ছে। ফলে সরবরাহ শৃঙ্খল দুর্বল হয়ে পড়ছে। এই পরিস্থিতিতে বাজারে পণ্যের ঘাটতি ও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়। এটি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
দেশে তিন বছর ধরেই উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে গড় মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১০ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ। সম্প্রতি তা কিছুটা কমলেও সেপ্টেম্বর মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৮ দশমিক ৩৬ শতাংশ। গত আগস্ট মাসে এই হার ছিল ৮ দশমিক ২৯ শতাংশ।