রংপুরে হাঁড়িভাঙা আমের আনুষ্ঠানিক বাজারজাত শুরু, চাষিদের নানা অভিযোগ
Published: 17th, June 2025 GMT
রংপুরে আনুষ্ঠানিকভাবে বিক্রি শুরু হয়েছে হাঁড়িভাঙা আমের। আজ মঙ্গলবার দুপুরে মিঠাপুকুর উপজেলার পদাগঞ্জ স্কুল অ্যান্ড কলেজে আমচাষি ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রবিউল ফয়সাল এই আম বাজারজাতকরণের ঘোষণা দেন।
মিঠাপুকুর উপজেলা প্রশাসন ও উপজেলা কৃষি বিভাগ যৌথভাবে এ মতবিনিময় সভার আয়োজন করে। অনুষ্ঠানে আমচাষি, ব্যবসায়ী ও স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা বক্তব্য দেন। এ সময় আমচাষিরা হাঁড়িভাঙা আমের উৎপাদন, বাজারজাতকরণ, সংরক্ষণ ও মান উন্নয়ন নিয়ে বিভিন্ন সমস্যার কথা তুলে ধরেন।
মতবিনিময় সভায় স্বাগত বক্তব্যে মিঠাপুকুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মুহাম্মদ সাইফুল আবেদীন জানান, এ বছর মিঠাপুকুরে ১ হাজার ৩০০ হেক্টর জমিতে ২৬ হাজার মেট্রিক টন হাঁড়িভাঙা আম উৎপাদন হবে। আমের বাজারমূল্য, কুরিয়ার সার্ভিস, পরিবহন—সবকিছু মিলে শুধু পদাগঞ্জ হাটে ১৫০ কোটি টাকার ব্যবসা হবে। হাঁড়িভাঙা আমের বাজারজাতকরণ সময়সীমা বাড়াতে তিন থেকে চার ইঞ্চি বোঁটাসহ আম সংগ্রহ, কুসুম গরম পানিতে ধৌতকরণ ও বরিক অ্যাসিড দিয়ে প্লে করতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে চাষিদের। এ ছাড়া হাঁড়িভাঙা আম রপ্তানির জন্য প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। উত্তম কৃষিচর্চা ও কৃষক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কৃষি বিভাগ হাঁড়িভাঙা আমের গুণগত মান ও বৈশিষ্ট্য ধরে রাখতে কাজ করে যাচ্ছে।
আমচাষি মেহেদী হাসান অভিযোগ করেন, প্রতিবছর হাঁড়িভাঙা আম বাজারে আসার আগে তারিখ ঘোষণা করে জেলা প্রশাসন। কিন্তু এ বছর জেলা প্রশাসন থেকে আগে কোনো তারিখ ঘোষণা করা হয়নি। কৃষি বিভাগ গত বছরের মতো এবারও ২০ জুন আম সংগ্রহের তারিখ ঘোষণা করে। তবে পরে পাঁচ দিন এগিয়ে আনে। এ ক্ষেত্রে সমন্বয়হীনতা দেখা গেছে। আগে থেকে তারিখ ঘোষণা না করায় দূরের আম ব্যবসায়ীরাও সময়মতো আসতে পারছেন না। এতে আমচাষিরা বিপাকে পড়েছেন।
আরেক চাষি জহিরুল ইসলাম বলেন, হাঁড়িভাঙা আম সুস্বাদু। এটি জিআই পণ্যের স্বীকৃতি পেয়েছে। কিন্তু এর বাজারজাতকরণের সময়সীমা (সেলস লাইফ) খুব কম। এ কারণে প্রতিবছর অনেক আম নষ্ট হয়। হাঁড়িভাঙা আম সংরক্ষণের জন্য একটি বিশেষায়িত হিমাগার নির্মাণের দাবি জানান তিনি।
আমচাষি আইয়ুব আলী বলেন, জেলা প্রশাসন আম সংগ্রহের তারিখ ঘোষণা না করায় ঈদের পর থেকে অনেকে অপরিপক্ব আম বাজারে বিক্রি করেছেন। এভাবে অপরিপক্ব আম বাজারজাত করা হলে হাঁড়িভাঙা জিআই পণ্য থেকে বঞ্চিত হবে। হাজারো আমচাষি পথে বসে যাবেন।
আমচাষিরা অভিযোগ করেন, হাঁড়িভাঙা আমের প্রধান বাণিজ্যিক কেন্দ্র পদাগঞ্জ বাজার। এটি মিঠাপুকুরের ঘোড়াগাছ ইউনিয়নে হলেও মিঠাপুকুর থেকে দূরত্ব ২৭ কিলোমিটার। রংপুর থেকে ২৪ কিলোমিটার। বদরগঞ্জ থেকে ১২ কিলোমিটার। অথচ এখানে বাণিজ্যিক ব্যাংকের শাখা নেই। রাস্তাঘাট খানাখন্দে ভরা। এসব কারণে ব্যবসায়ীরা আম পরিবহনে ভোগান্তিতে পড়ছেন।
মিঠাপুকুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) মুলতামিস বিল্লাহর সভাপতিত্বে মতবিনিময় সভায় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক হাবিবুর রহমান, জেলা জামায়াতের আমির গোলাম রব্বানী, সেক্রেটারি এনামুল হক, জেলা বিএনপির সদস্য সাজিদুর রহমান, মিঠাপুকুর উপজেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক নাজমুল হক প্রমুখ বক্তব্য দেন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক হাবিবুর রহমান বলেন, এবার প্রচণ্ড গরমের কারণে হাঁড়িভাঙা আম নির্ধারিত সময়ের আগে এসেছে। হাঁড়িভাঙা আমের একটি সমস্যা, পাকলে এটি নরম হয়ে যায়, ভেতরে গলে যায়। এ জন্য রংপুরে আমকেন্দ্রিক শিল্পকারখানা প্রয়োজন।
মিঠাপুকুর উপজেলার পদাগঞ্জ স্কুল অ্যান্ড কলেজে আমচাষি ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় বক্তব্য দেন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রবিউল ফয়সাল.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ম ঠ প ক র উপজ ল আম ব জ র ব যবস য় আমচ ষ
এছাড়াও পড়ুন:
বরফ গলে মেরু এলাকায় নতুন বাস্তুতন্ত্রের খোঁজ
তাপপ্রবাহ, ওজোন গ্যাসের উপস্থিতিসহ বিভিন্ন কারণে পৃথিবীর দুই মেরু এলাকার বরফ গলে যাচ্ছে। তবে উত্তর মেরুর আর্কটিক সাগরের গলিত বরফ ভিন্ন ধরনের লুকানো বাস্তুতন্ত্র প্রকাশ করছে। সেখানে ব্যাকটেরিয়া নাইট্রোজেন গ্যাসকে পুষ্টিতে রূপান্তরিত করে শৈবালের বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে বলে দেখা গেছে। পুরু বরফের নিচে এই প্রক্রিয়া অসম্ভব বলে মনে করা হলেও এখন আর্কটিকের খাদ্যশৃঙ্খল ও বায়ুমণ্ডলীয় কার্বন শোষণের জন্য এই প্রক্রিয়াকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে। বিজ্ঞানীরা এখন নতুন বাস্তুতন্ত্র জলবায়ুগত সুবিধা দেবে নাকি নতুন অনিশ্চয়তা নিয়ে আসবে, তা নিয়ে গবেষণা করছেন।
আর্কটিক মহাসাগরকে দীর্ঘকাল ধরে হিমায়িত ও প্রাণহীন একটি সীমান্ত হিসেবে দেখা হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যখন এই অঞ্চলের সমুদ্রের বরফ গলতে শুরু করেছে, তখন পানির নিচ থেকে আশ্চর্যজনক নতুন নতুন সব তথ্য জানা যাচ্ছে। বিজ্ঞানীরা দেখছেন, গলিত বরফ আসলে শৈবালের বৃদ্ধি বাড়িয়ে সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রকে উৎসাহিত করতে পারে। এই শৈবালই মহাসাগরের খাদ্যশৃঙ্খলের ভিত্তি তৈরি করে। সেখানকার নতুন পরিবেশ আমাদের গ্রহের সংবেদনশীল জলবায়ু ভারসাম্যের জন্য সহায়ক হবে নাকি ক্ষতিকারক হবে, তা নিয়েও নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে।
জার্মানির আলফ্রেড ওয়েগেনার ইনস্টিটিউট ও কোপেনহেগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীদের গবেষণার ফলাফল আর্কটিক মহাসাগর সম্পর্কে আমাদের পূর্বের ধারণাকে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করছে। কয়েক দশক ধরে বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করতেন নাইট্রোজেন বায়ুমণ্ডলে উন্মুক্তকরণ প্রক্রিয়া পুরু আর্কটিক বরফের নিচে ঘটতে পারে না। এই প্রক্রিয়ায় ব্যাকটেরিয়া নাইট্রোজেন গ্যাসকে জীবনের সহায়ক রূপে রূপান্তর করে। এই রূপান্তরের জন্য দায়ী ব্যাকটেরিয়ার জন্য সেখানকার পরিস্থিতিকে খুব চরম বলে মনে করা হতো। নতুন গবেষণা ভিন্ন তথ্য প্রকাশ করেছে। মধ্য আর্কটিক বরফের নিচে দেখা গেছে, নাইট্রোজেন ফিক্সেশন বা বায়ুমণ্ডলে উন্মুক্তকরণ প্রক্রিয়া কেবল ঘটছে তা নয়, বরং এটি প্রত্যাশার চেয়েও বেশি বিস্তৃত হতে পারে। অন্যান্য সব সমুদ্রে সাধারণত সায়ানোব্যাকটেরিয়া দেখা গেলেও, আর্কটিকে নন-সায়ানোব্যাকটেরিয়া নামে পরিচিত একটি ভিন্ন দলের উপস্থিতি দেখা যায়। ভিন্ন ধরনের ব্যাকটেরিয়া দ্রবীভূত জৈব পদার্থ খেয়ে বেঁচে থাকে ও নাইট্রোজেন যৌগ মুক্ত করে যা শৈবালকে পুষ্টি জোগায়।
আর্কটিক এলাকাকে একসময় প্রাকৃতিক কার্যকলাপের জন্য খুব অনুর্বর বলে মনে করা হতো। গবেষণায় দেখা গেছে, গলে যাওয়া সমুদ্রের বরফের কিনারা বরাবর নাইট্রোজেনের বায়ুমণ্ডলে উন্মুক্তকরণ প্রক্রিয়া সবচেয়ে শক্তিশালী। এটি এমন একটি জায়গা যেখানে সূর্যের আলো, পানি ও পুষ্টির উপাদান মিশে গেছে, যা ব্যাকটেরিয়া ও শৈবাল উভয়ের জন্যই আদর্শ পরিবেশ। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে সমুদ্রের বরফ কমতে থাকলে আর্কটিকের নাইট্রোজেনচক্র নাটকীয়ভাবে পরিবর্তিত হবে। এ বিষয়ে বিজ্ঞানী লিসা ডব্লিউ ভন ফ্রাইসেন বলেন, আর্কটিক মহাসাগরে সহজলভ্য নাইট্রোজেনের পরিমাণ অনুমান করা হয়নি এখনো। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রের বরফ কমতে থাকলে শৈবাল উৎপাদনের সম্ভাবনা কেমন হবে তা এখনো জানা যায়নি। শৈবাল আর্কটিক খাদ্যশৃঙ্খলের জন্য অপরিহার্য। তারা আণুবীক্ষণিক ক্রাস্টেসিয়ানদের খাবার হিসেবে কাজ করে, যা পরবর্তী সময়ে ছোট মাছ এবং সিল ও তিমির মতো বড় শিকারি প্রাণীরা খায়। আরও শৈবাল এই শৃঙ্খলকে শক্তিশালী করতে পারে, যা সম্ভাব্যভাবে আর্কটিক সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রের উৎপাদনশীলতা বাড়িয়ে তুলবে বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা।
সাধারণভাবে শৈবাল কেবল সামুদ্রিক প্রাণীদের খাদ্য জোগায় না। তারা সালোকসংশ্লেষণের সময় বায়ুমণ্ডল থেকে কার্বন ডাই–অক্সাইডও শোষণ করে। যখন শৈবাল মরে যায়, তখন এই কার্বনের কিছু অংশ সমুদ্রের তলদেশে ডুবে যায়। বিজ্ঞানীরা প্রায়শই শৈবালকে প্রাকৃতিক কার্বন সিংক বা মহাসাগরের নিজস্ব ভ্যাকুয়াম ক্লিনার হিসেবে বর্ণনা করেন। নতুন তথ্য থেকে বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, নাইট্রোজেন বায়ুমণ্ডলে উন্মুক্তকরণ প্রক্রিয়া যদি শৈবালের বৃদ্ধিকে বাড়িয়ে তোলে, তবে আর্কটিক মহাসাগর আরও বেশি কার্বন ডাই–অক্সাইড শোষণ করতে পারবে। বিষয়টি একদিক থেকে জলবায়ুর জন্য সুসংবাদ বলে মনে করা হচ্ছে। শৈবালের ক্রমবর্ধমান বৃদ্ধি বৈশ্বিক কার্বন মাত্রাকে সামান্য হলেও প্রশমিত করতে পারে। তবে অনেক বিশেষজ্ঞ সতর্ক করে জানিয়েছেন, বিষয়টি এত সরল নয়। সামুদ্রিক সিস্টেম অত্যন্ত সংবেদনশীল। অন্যান্য পরিবেশগত পরিবর্তন এই ইতিবাচক প্রভাবকে দুর্বল করে দিতে পারে।
বিজ্ঞানী ল্যাসে রিম্যান বলেন, ফলাফল জলবায়ুর জন্য উপকারী হবে কি না, তা আমরা এখনো জানি না। তবে এটি স্পষ্ট যে সমুদ্রের বরফ কমতে থাকলে আগামী কয়েক দশকে আর্কটিক মহাসাগরের কী হবে, তা অনুমান করার সময় আমাদের নাইট্রোজেন বায়ুমণ্ডলে উন্মুক্তকরণ প্রক্রিয়ার মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়াকে সমীকরণে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রা বাড়তে থাকায়, আর্কটিক পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় প্রায় চার গুণ দ্রুত উষ্ণ হচ্ছে। এই দ্রুত পরিবর্তন কেবল বরফের ওপর নির্ভরশীল প্রজাতিদেরই নয়, বরং মহাসাগর কীভাবে কার্বন সঞ্চয় ও নির্গত করে, তারও পরিবর্তন ঘটায়। নাইট্রোজেন বায়ুমণ্ডলে উন্মুক্তকরণ প্রক্রিয়ার ভূমিকা বোঝা গেলে বিজ্ঞানীরা ভবিষ্যতের জলবায়ু ধরন সম্পর্কে আরও নির্ভুল ভবিষ্যদ্বাণী করতে সক্ষম হবেন বলে আশা করছেন।
সূত্র: টাইমস অব ইন্ডিয়া